#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫১
#মিদহাদ_আহমদ
সে যাত্রায় আমার পড়াশোনার ইতি ঘটলো। কিন্তু কথায় আছে না, বিধাতা যাকে দিতে চান তাকে কেউ বঞ্চিত করে রাখতে পারে না। হয়তো বিধাতার ইচ্ছাতে এমন কোনকিছু আমার কপালে লিখা ছিলো। তিনি হয়তো তার সেই ইচ্ছার জন্যই আমাকে আমার আরাধ্য আমার স্বপ্ন মেডিকেলে চান্স দেননি৷ হয়তো তার বিধানে ছিলো অন্যকিছু।
বছর ঘুরতেই আমার কোলে এসে জায়গা জুড়ে নেয় আমার অংশ, আমার নাড়িছেঁড়া ধন, আমার মেয়ে। আমার গল্প। যেদিন সে পৃথিবীতে আসলো, সেদিন আমি যেনো পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় খুশিটাই পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় আসিফ আমার সামনে বসে বসে প্রচ্ছদের সব কাজ করতো৷ আমি বসে বসে দেখতাম। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতাম এইটা ওইটা কীভাবে কীভাবে করলো সে। আসিফ আমাকে বুঝিয়ে দিতো৷ এই বুঝাতে বুঝাতে কখন যে আসিফের সাথে হাত মেলাতে গিয়ে আমিও অল্প বিস্তর আঁকিবুঁকি শিখে ফেললাম তা আর ভাবনায় ই রাখে না। গল্প তখন আমার পেটে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়া, ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা আর গুনগুন করে গান গাওয়া ছাড়া সকালে আর কোন কাজ ছিলো না আমার। সকাল এগারোটার দিকে আসিফের অফিসের সহকারী একজন একগাদা আর্ট আর সিম্পল এনে, কার্টিজ পেপারে পিন করে সিম্পল দিয়ে চলে যান। আসিফ ঘুম থেকে উঠে কাজে হাত লাগায়। আমি তাকে বারবার বলতাম, অফিসের কাজ বাসায় কেন করে? অফিসে যায় না কেন। আসিফ আমার কথা শুনতো না। আসিফ বলতো,
‘আমার অংশ পৃথিবীতে আসতে চলেছে তোমার মাধ্যমে। এখন তোমার যত্ন শুধু একার না, তোমার সাথেসাথে আমাদের অনাগত সন্তানেরও যত্ন আমাদের করতে হবে। সন্তান শুধু তোমার একার না, এর প্রতি দায়িত্ব তো আমারও। তাইনা নুপুর?’
আসিফের এমন কথার শেষে আমি আর কথা বলতে পারি না। বলবো কীভাবে? এমন সময়ে সব মেয়েদের হয়তো ইচ্ছা করে তার নিজের মানুষটা তার কাছে থাকুক৷ তাকে ভরসা দিক। আসিফ একটা মুহূর্তের জন্য আমাকে একা ফিল হতে দেয়নি। শ্বশুর রোজ বিকালে গল্পের বই এনে জোরে জোরে পড়তেন আমার সামনে। আমি গল্প শুনে হাসতাম। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতাম,
‘আমাকে গল্প শুনাচ্ছেন কেন বাবা?’
শ্বশুর হেসে হেসে জবাব দিতেন,
‘তোকে না, আমার ওই পুচকে দাদুভাইকে শুনাই৷ দাদুভাই দুনিয়ায় এলে তোর হাতের চা খাবো। চায়ের জন্য কতো উশখুশ করছে মন!’
আমি চা বানাতে যেতে চাইলে বাধা দেন এসে শাশুড়ি। তিনি না করে দিয়েছেন সরাসরি। এই নয়মাসে কোন ধরণের কাজ আমার করা যাবে না। এরই মাঝে একটা রেস্ট্রিকশন ও দিয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি। আমি বাপের বাড়ি যেতে পারবো না। মাঝখানে বার দুয়েক মা এসে দেখে গিয়েছিলেন আমাকে। শাশুড়ি আমার মেয়ে গল্প দুনিয়ায় আসার আগেই যেনো এক মহা উৎসব আয়োজন করতে লেগে গিয়েছেন। বাড়িতে মহিলা কয়েকজন এনে, পুরোনো সুতি কাপড় ধূয়ে, মাড় দিয়ে শক্ত করে মিহি সুতোর কাজ করাতে লাগলেন। কী আদর আর দরদ মাখা সেই কাজগুলো!
গল্পের পেটে থাকা অবস্থাতেই আমি ছবি আঁকা রপ্ত করে ফেললাম। এইটা ওইটা ধরাধরি করতে করতে আসিফ আমাকে শেষমেশ শিখিয়েই ছাড়লো তার ছবি আঁকা। আমিও যেনো এক পৃথিবীর আগ্রহ খুঁজে পেলাম ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। পুরোদমে সংসারী হয়ে যেতে শুরু করলাম। এরই মাঝে তিন তিনটা বছর কেটে গেলো। গল্পের তিন বছর হয়ে গেলো। আঁকিবুঁকি নিয়ে টুকটাক কাজ, প্রচ্ছদ ডিজাইন করা এসব আমার সহজেই রপ্ত হয়ে গেলো। তামান্না বছর দুয়েক আগেই মিশিগান চলে গেলো তার ছেলেকে নিয়ে। হুট করে একদিন তামান্না কল করে আমাকে আর তার ভাইকে জানালো, আমরা দুজনে কেন হায়ার স্টাডির জন্য আমেরিকা আসি না। এখানে আর্ট কালচার নিয়ে কাজ করার দারুণ স্কোপ আছে। আমি তামান্নাকে না করে দেই৷ বিয়ের পাঁচ বছর পর, এখন আর নতুন করে পড়াশোনার ভার নেয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি আমার নেই।
সেদিন রাতে আসিফ আমাকে বললো,
‘এখন আবার শুরু করা যায় না নুপুর? সবকিছু নতুন করে? আবার নতুন এক শুরু?’
‘না আসিফ। এখন আমাদের গল্প হয়েছে। তাকে নিয়েই আমাদের সবকিছু। দেখো আমাদের গল্প এখন হাঁটতে পারে৷ তার ছোট ছোট ঠোঁট দুইটা এক করে যখন মা মা করে ডাকে, তখন কী যে ভালো লাগে! আমি এই ডাক শুনেই জীবন পার করে দিতে চাই।’
‘কিন্তু পড়াশোনা?’
‘পড়াশোনা তো অনেক করলাম। এখন আমার ঘর সংসার করি আমি’
আসিফ না সূচক মাথা নাড়ালো। আমি বুঝতে পারলাম ভেতরে ভেতরে আমার এই সিদ্ধান্তে সে সম্মত নয়। সপ্তাহ খানেক পর আসিফ জানালো সেন্ট্রাল মিশিগান কলেজে আর্ট কালচারের উপর ডিপ্লোমার জন্য আমার আর তার নিজের জন্য মাস্টার্সে সে আবেদন করেছে। আমি হেসে হেসে উড়িয়ে দিলাম তার কথাগুলো৷ তাকে বললাম,
‘ডাক্তারির জন্য পড়াশোনা করে এখন আবার আর্ট কালচার? আমাকে দিয়ে এসব হবে নাকি?’
‘কেন হবে না নুপুর? অবশ্যই হবে। জীবন কখন আমাদের কোনদিকে নিয়ে যায় তা কি আর আমরা জানি? এরই নাম তো জীবন।’
সেদিনের মতো আর আমাদের কথা এগোয় না। দিন দুই পরে একদিন ননাস আমার কাছে এসে বসে আমাকে বলতে লাগলেন,
‘নুপুর তুমি আমার পুচকে গল্পের জন্য চিন্তা করো না। আমি আছি না? ফুপু থাকতে কী চিন্তা আমার মেয়ের? গল্পের ফুপু এখনও জোয়ান। শরীরে ভারী শক্তি আছে তার। সে সামলে নিতে পারবে তার ভাইজিকে।’
‘ননাসের মুখে এই সামলে নেয়ার না নেয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিছু বুঝিনি আপা।’
ননাস আমার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর এক শীতল চক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুই এই কয়েক বছরে শক্ত হাতেই আসিফের সাথে থেকে শিখে নিয়েছিস আর্টের কাজগুলো৷ দেখ, কতো মায়াভরা হাতে তুই এই কাজগুলো করিস। এখন তোর সময় এসেছে এগুলো নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে কিছু করার৷ একটা ডিগ্রি অর্জন করার। আর কথা যখন গল্পের, তখন গল্পকে দেখার জন্য আমি আছি৷ আমিও তো গল্পের মা হই। তাইনা নুপুর? নাকি আমি গল্পের মা নই?’
‘না না আপা। আমার থেকে গল্পের উপর আপনার অধিকার বেশি। গল্প আমার না, গল্প আপনার মেয়ে। ও আপনার সবকিছু।’
আমি কথাটা বলতেই ননাস আমার বিছানার উপর ঘুমিয়ে থাকা গল্পকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন৷ ননাস আজ বছর খানেক থেকেই কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। কেকের বিজনেস আর এগিয়ে নিতে পারেননি। ননাস সবচেয়ে বেশি ট্রমায় পড়েছিলেন, যেদিন বদরুল লন্ডনে কার এক্সিডেন্ট করে মারা যায়। খবরটা ননাস কোথা থেকে পেয়েছেন আমাদের কারোর জানা নেই। কিন্তু পেয়েছেন। ননাস তার নিজের ইচ্ছাতেই সেদিন তার রঙিন ভূষণ ছেড়ে সাদা কাপড় গায়ে তুলে নিয়েছিলেন। এরপর থেকে যাই পরেছেন ননাস, সব এমন সাদা রঙের। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, গায়ের আভূষণে রঙ নেই। কোনকিছু নেই। ভেতরে ভেতরে নিজেকে এক আজন্ম বিধবা হিসেবে মেনে নিয়েছেন যেন! একা একা নিজেকে সেটে দিয়েছেন গভীর একলা জীবনে৷
শাশুড়ি রান্নাঘরে আমাকে কথার ফাকে ঘোর আপত্তির সুরে না করে দিলেন৷ বললেন,
‘এখন আবার নতুন কী শুরু করেছে আসিফ? সে বললেই হলো? মেয়েকে রেখে আমেরিকা গিয়ে পড়াশোনা আবার কী? কোন কাজকাম পাচ্ছে না নাকি? তুমি নুপুর শুনে রাখো, সে যাই বলুক, যাই করুক তোমার যাওয়া হচ্ছে না’
মাস তিনেকের মাথায় আসিফের পাগলামি আরও বেড়ে গেলো। কিন্তু সবশেষে আমার হ্যাঁ সূচক সম্মতিই আমাকে নিয়ে গেলো আমেরিকায়। আমার পড়াশোনার কাছে৷ ভেতর থেকে হুট করে অনুভব করতে লাগলাম, আমাকে আমার নিজের জন্য কিছু করতে হবে৷ এখন যখন ঘর হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে, এবার নাহয় নিজের জন্য কিছু করি। শাশুড়ির আপত্তি চড়া হয়ে উঠলেও শেষমেশ ননাস এগিয়ে আসেন। দুই হাত উজাড় করে আগলে রাখেন আমার গল্পকে। ননাস শাশুড়িকে বুঝালেন। বললেন আমাকে আমার মতো করে পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ যেনো তিনি দেন। আসিফ আর্ট এন্ড কালচারের উপর মাস্টার্সের জন্য ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়ে গেলো। আমার ডিপ্লোমা কোর্সের জন্যও তারা ত্রিশ পার্সেন্ট স্কলারশিপ দিলো। ভূমি মাটি বাংলাদেশ আর আমার ননাসের হাতে আমার নাড়ি ছেড়া ধন আমার বাচ্চা গল্পকে দিয়ে আমি আর আসিফ পাড়ি জমালাম সুদূর আমেরিকায়। আসিফ আমাকে ভরসা দিতে দিতে বললো
‘গল্প এখানে তার আরেক মায়ের কাছে ভালোই থাকবে। আমরা আমাদের গন্তব্য পর্যন্ত যেতে চাই এখন। ড্রিম এমন এক জিনিস যা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।’
আমি আসিফের চোখেমুখে তার ড্রিম পূর্ণ হওয়ার উচ্ছ্বাস দেখছিলাম। আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম আসিফ তার এক সময়ের ড্রিম প্রজেক্ট, আর্ট কালচার নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। তার এই সুযোগ আর উচ্ছ্বাস আমাকে ভেতর থেকে মুগ্ধ করে তুললো। অন্যদিকে আমিও হাতছানি দিতে লাগলাম আমার পড়াশোনার স্বপ্নে। এ যেনো এক নতুন উদ্দেশ্যে যাত্রা…
(চলবে)