#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৯
#মিদহাদ_আহমদ
রাতে খাবার রেডি করতে করতে শাশুড়ি আমাকে বললেন,
‘মারে, কিছু কি ভাবা যায় না?’
শাশুড়ির কথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ইঙ্গিতও বুঝতে পারলাম। আমি শাশুড়িকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। জানালার থাইয়ের গ্লাসে দেখতে পেলাম ননাস রান্নাঘরের দিকে আসছে৷ ননাস রান্নাঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো, রান্নায় ঝাল কম আছে কিনা। শাশুড়ি মা জবাব দিলেন,
‘হ্যাঁ রে মা। রান্নায় ঝাল কম। আমি তো জানি যে গল্প ঝাল খেতে পারে না।’
‘না ঘরে নতুন নতুন মানুষজন এসেছে তো। তাই যদি কেউ ঝাল বেশি দিয়ে দেয় তাহলে আমার মেয়েটা খেতে পারবে না।’
ননাসের এমন কথায় আজ থেকে কয়েক বছর আগে হলে আমি রাগ করতাম। হয়তো কিছু বলেও দিতাম মুখের উপর। কিন্তু এখন আর বলি না। আমি ভেতর থেকে দেখি, একজন মানুষের ধ্যান, জ্ঞান সব আমার মেয়েকে ঘিরেই। তিনি আমার মেয়ের ভালোই চাচ্ছেন।
ননাস রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময়ে শাশুড়ি মাকে বলতে লাগলো,
‘মা দেখেছো মেয়েটা কত লক্ষ্মী! আল্লাহ মেয়েটার মাকে তার থেকে নিয়ে নিলেন। বাচ্চাটার জন্য বড্ড মায়া হয় আমার’
‘হ্যাঁ রে মা। আল্লাহর বিধান৷ এর বাইরে যাওয়ার হুকুম যে আমাদের নেই।’
ননাস গুনগুন করে গান ধরে চলে গেলো রান্নাঘর থেকে। শাশুড়ির চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। আমারও সেই একই উচ্ছ্বাস। শাশুড়ি বললেন,
‘বুঝতে পেরেছিস নুপুর? তানিয়া কিন্তু বাচ্চা মানেই আদর, যত্ন আর মমতায় জড়িয়ে নেয়ার এক আখ্যান। বুঝতে পারছিস কিছু?’
আমার চোখেমুখে আনন্দ খেলে গেলো৷ মাকে বললাম,
‘আমি যা চিন্তা করছি, আপনিও তাই চিন্তা করছেন না তো?’
‘হ্যাঁ রে মা। আল্লাহ যদি আবার চান, আমার মেয়েটাকে যদি আবারও…’
আমি আর শাশুড়িকে শেষ করতে দিলাম না৷ শাশুড়ির হাতে হাত রেখে, পাশের টুলে বসিয়ে বললাম,
‘আপনার পুত্রবধূ দেশে এসেছে না মা? দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ সবকিছু একেবারে আগের মতো হয়ে যাবে। কোন চিন্তার কারণ থাকবে না। আল্লাহ আমাদের সব কথা শুনবেন।’
রাতে খাওয়ার পর ননাস তার সাথে করে গল্পকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে অদ্ভুতরকম ভাবে গল্প এসে আমার আর তার বাবার গালে চুমু খেয়ে গেলো৷ আমাকে বললো,
‘আম্মু আম্মু, কাল সকালে কিন্ডারজয় আনবা তো আমার জন্য?’
মেয়েটা আমাকে নিজ থেকে আম্মু বলে ডাকছে, এরচেয়ে আনন্দের, এরচেয়ে ভালোলাগার আর কী হতে পারে আমার জন্য! আসিফও এই একই বিষয় খেয়াল করলো। আসিফ তার মেয়ের গালে হাত দিয়ে টান দিয়ে বললো,
‘তোমার আম্মুকে আমি টাকা না দিলে সে আনবে কীভাবে?’
‘টাকা কেন দিবা না? এত্ত এত্ত টাকা দিবা আর আম্মু আমার জন্য এই এতোটা করে কিন্ডারজয় এনে দিবে। আমি খাবো। একা খাবো না, আমার যে বন্ধু আছে না নুরি, ওই মেয়েটা যে ক্লাসে খুব দুষ্টুমি করে, তাকেও দিবো। রিতিকাকেও দিবো। সবাইকে দিবো।’
কথাগুলো বলেই মেয়ের মুখে সে কী হাসি!
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার দেরি হয়ে যায়। এর মাঝে গল্পকে নিয়ে ননাস স্কুলে চলে গিয়েছেন। আসিফও কিছুক্ষণ পর অফিসে চলে যায়৷ আসিফ অফিসে যাওয়ার আগে শাশুড়ি তাকে টেবিলে বসিয়ে খাবার দিতে দিতে বললেন, তানিয়ার সাথে ওই ফারুক স্যারের কিছু করা যায় কিনা। আসিফ প্রথমে এক বাক্যে না বলে দিলেও পরে যখন আমার আর শাশুড়ির সাথেসাথে শ্বশুরেরও সম্মতি সে পেলো, সে জানালো যে সে দেখবে।
স্কুল থেকে গল্পের আসতে আসতে দুপুর দুইটা বেজে গেলো। ননাস গল্পকে খাইয়ে দিতে দিতে শাশুড়িকে বললো,
‘আজ আর্ট ক্লাস আছে বিকালে। গল্পকে নিয়ে আমি বের হবো।’
‘ওইযে গতদিন যে স্যার এসেছিলো তার আর্ট ক্লাস?’
‘হ্যাঁ।’
ননাস বিকালে বের হয়ে চলে গেলো গল্পকে নিয়ে৷
এদিকে অসুস্থ মুন্নিকে নিয়ে মুন্নির বাবা ফারুক স্যার আজ এসেছেন আর্ট ক্লাসে। গল্পকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে তানিয়া বসে আছে চেয়ারে। মুন্নি দূর থেকে গল্পকে দেখেই ছুটে আসে। গল্পও হাত টেনে কোলে তুলে নেয় মুন্নিকে। তারপর তাদের দুজনের সে কী আলাপ! ফারুক স্যার ক্লাসের জানালা দিয়ে দেখতে পান যে ওনার মেয়ে তানিয়ার কোলে উঠে কত আনন্দ করছে! এই আনন্দ ফারুক স্যারকেও ভরিয়ে তুলে প্রশান্তির ছোঁয়ায়। ক্লাস শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ছয়টা হয়ে যায়৷ গল্প রুম থেকে বের হয়ে আসতেই তানিয়া জিজ্ঞেস করে,
‘আজকের ক্লাস কেমন হলো মামুণি?’
‘অনেক ভালো। আমি বাড়ি যাবো এখন ‘
‘আচ্ছা মা এসো। ‘
তানিয়া তারপর মুন্নিকে পাশে রেখে, গাল টেনে মুন্নির থেকে বিদায় নিতে নিতে বললো,
‘আন্টি আসি এবার? লক্ষ্মী মেয়েটা আমার।’
মুন্নি অনেকটা বিষন্ন হয়ে গেলো। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। তানিয়া গল্পকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
এরমাঝে ক্লাস শেষ হতে না হতেই আসিফ এসে আর্ট স্কুলে হাজির। আসিফকে দেখে আর্ট স্কুলের সবাই আসিফের সাথে কুশল বিনিময় করতে লাগলেন৷ নানাবিধ কৌশল, কীভাবে এসব করেন, এত ভালো ভালো প্রচ্ছদ কীভাবে করে এসব জানতে চাইলো সবাই। আসিফ সহাস্যে সবার জবাব দিলো। অপর্ণা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন সরাসরি,
‘আপনি কি কোন বিশেষ প্রয়োজনে…’
অপর্ণা ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই চলে এলেন ফারুক স্যার। ফারুক স্যার বললেন সবাইকে,
‘আপনারা হয়তো জানেন না, এই গুণী শিল্পী আমাদের স্টুডেন্টের বাবা।’
সবাই অনেকটা হতবাক হয়ে গেলো। ফারুক স্যার আর ভণিতা না করে বললেন,
‘আমাদের গল্পের বাবা তিনি।’
আসিফ সবার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে ফারুক স্যারকে বললো,
‘আপনার সাথে আমার আসলে একটা কথা ছিলো। যদি কিছু সময় দিতেন আপনি?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। আমার রুমে আসুন আপনি।’
ফারুক স্যারের সাথে আসিফ রুমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মুন্নি এসে আসিফের পথ আটকিয়ে বললো,
‘আমাকে কি ওই আন্টি এনে দিবা? সে চলে গিয়েছে আজও।’
আসিফ বুঝতে পারলো মুন্নি কার কথা বলছে। রুমে ঢুকে আসিফ সরাসরি ফারুক স্যারকে প্রপোজাল দিলো তানিয়ার বিষয়ে৷ সবকিছু খুলেও বললো। এও বললো, তানিয়া আর কখনো মা হতে পারবে না৷ আসিফের সব কথা নীরবে শুনলেন ফারুক স্যার। তারপর তিনি বললেন,
‘আপনি আসলে যা ভাবছেন তা ভুল। আপনার ভাবনার প্রতি আমি পূর্ণ সম্মান জানাচ্ছি তবে আমার পক্ষে তা পসিবল হবে না। আমি কখনোই আমার মুন্নিকে কষ্ট দিবো না। আজ চার চারটা বছর হলো আমার একার জীবন, আমার একার সংগ্রাম। আমার এই সংগ্রাম আমি চালিয়ে যেতে চাই এভাবেই।’
আসিফ আর কথা বাড়ালো না। ভালোমন্দ বলে শেষমেশ বিদায় নিয়ে চলে এলো।
রাতে বাড়ি আসতেই আসিফকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন আমার শাশুড়ি৷ আমিও আসিফের সাথেসাথে রুমে ঢুকলাম। আসিফ কল করে বলেছে যে সে সন্ধ্যায় যাবে দেখা করতে ফারুক স্যারের সাথে৷ শ্বশুর পত্রিকা থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী খবর? সে কিছু জানিয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী বলেছে? রাজি?’
‘না। ফারুক স্যার রাজি নন। তিনি বলেছেন যে তিনি বিয়ে করতে পারবেন না। তার মেয়েকে আজ চার বছর হতে চললো তিনি একা একাই মানুষ করছেন৷ এই একার জীবনে তিনি আর দ্বিতীয় কাওকে আনতে পারবেন না।’
শাশুড়ি কেমন যেনো এগ্রেসিভ হয়ে উঠলেন৷ বললেন,
‘বললেই কী হলো? আমি কথা বলবো তার সাথে। বাড়ি গাড়ি, টাকা ফার্ণিচার যা যা লাগে আমি দিবো৷ টাকা পয়সা সোনা দানা কোন অপূর্ণতা আমি রাখবো না। আমার সাথে কথা বলিয়ে দে ছেলেটার।’
আমার রাগ উঠে গেলো। শাশুড়িকে বললাম,
‘মা, সবকিছু কি টাকা দিয়ে হয়? আর এই যে বললেন সোনাদানা টাকা পয়সা ফার্ণিচার দিয়ে ভরিয়ে দিবেন, এতে করে কি সুখ দিতে পারবেন নিজের মেয়েকে? নাকি টেলে দিবেন আবার নতুন নরকের মাঝে? আপনারা আসলে চান টা কী? নিজের সন্তানের ভালো? নাকি টাকা দিয়ে কেনা মেকি ভালোবাসা? কোনটা? একচুয়ালি আপনারা চান টা কী?’
শ্বশুরও তেড়ে গেলেন শাশুড়ির দিকে। তারপর বললেন,
‘একজন রাজি না হলে তো কিছু করার নেই৷ টাকা দিয়ে আর যাই হোক, সম্পর্ক, প্রেম, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর শান্তি কেনা যায় না আসিফের মা। এই এক জীবনে আর কতবার এই একই লেসন তোমাকে আমার শেখাতে হবে?’
(চলবে)
প্রিয় পাঠক, বিন্নি ধানের খই একেবারে শেষ প্রান্তে!…