#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_২৭
#মিদহাদ_আহমদ
আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো আসিফ। আমি ঘুমচোখে তার দিকে চেয়ে বললাম,
‘কী হলো? এত সকাল?’
‘নজরুল কী বলেছেন?
“তোমার ছেলে উঠলে মা গো রাত পোহাবে তবে”
এহেম! তুমি আমার ছেলে নও যদিও, তার পরও সেই দায়িত্ব নিয়ে তোমার ঘুম ভাঙ্গাতে এলাম। উঠো তাড়াতাড়ি।’
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম সকাল ছয়টা বেজে এগারো মিনিট। আসিফ বললো,
‘ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও নাস্তা সেরে। সাতটায় সিএনজি চলে আসবে। যেতে হবে তো।’
আমার মনে পড়লো আসলেই তো! আজ আমাদের কলেজে যাওয়ার কথা। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে! কিন্তু আসিফের ঠিকই মনে আছে৷ বিছানা ছেড়ে উঠতেই দেখি মা খাবার রেডি করে ডাইনিং রুমের মেঝেতে কাগজ পেতে বসে আছেন। সকাল সকাল চোখের সামনে ধোয়া উড়ানো ভূণা খিচুড়ি দেখেই আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো৷ কতদিন হলো মায়ের হাতের ভূণা খিচুড়ি খাইনি আমি!
সাতটায় বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। বাড়িতে যেতে যেতে নয়টা। আসিফ আমাদের কলেজে যাওয়ার আগে গোরস্তানে গাড়ি থামালো। সে নেমে আমার বাবার কবর জিয়ারত করে এলো। আমাকে হাতের ইশারায় বাঁশঝাড়ের দিকে দেখিয়ে বললো,
‘ওইখানে তোমার বাবার কবর নুপুর।’
আমার চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো। আমার বাবা৷ যে বাবার কোলে পিঠে চড়ে আজ আমি এই নুপুর হয়েছি, সেই বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো! এভাবে একা করেই? আমার জীবন যেনো এক নিমিশে উবে যাওয়া কর্পুরের মতো হয়ে উঠলো!
আসিফ আমাকে স্বান্তনার বানী শুনিয়ে বললো,
‘এমন করলে হবে বলো? তোমাকে তোমার বাবার কবর দেখিয়েছি কেন জানো? আমি চাই তুমি তোমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করো। আমি চাই তোমার বাবা তোমার ভেতরে যে স্পৃহা জাগিয়ে দিয়েছেন, সেই স্পৃহার জোরেই তুমি একদিন তোমার স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে চলে যাও। তাইনা?’
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। কিছুক্ষণের মাথায় কলেজের হেড টিচারের রুমে আমাকে নিয়ে ঢুকলো আসিফ। স্যার শুরুতেই আসিফের কথা শুনে যারপরনাই প্রশংসা করলেন। বললেন,
‘এভাবে যদি আমাদের সমাজের সব পুরুষেরা উঠে আসে, নিজ হাতে তুলে নেয় নারী শিক্ষার দায়িত্ব, তাহলে দেখবে বাবা, একদিন এই বাংলাদেশ আমাদের নিজেদের স্বপ্নের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে। আমাদের দেশটা হয়ে উঠবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু আসলে বাধা কোথায় জানো? নারীদের পায়ে শিকল পড়িয়ে রাখা হয়৷ তাদের স্বপ্নদের আর আকাশের ঘুড়ি করা হয় না। তাদের সব পুষে রাখা স্বপ্নকে চাপা দিতে দিতে তারা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞান হারিয়ে ফেলে! নুপুরের কন্ডাক্ট আর রেজাল্ট দুটোই ভালো। প্রথম বর্ষের রেজিস্ট্রেশন শেষ কিন্তু এই ফাইনাল রেজিস্ট্রেসন না করলে সে পরীক্ষা দিতে পারতো না৷ সে কি এখন ক্লাস করতে পারবে কিছুদিন? না মানে আমি চাপ দিচ্ছি না। তুমি যে তাকে কলেজে এনে এক্সাম দেয়ার জন্য নিয়ে এসেছো সেটাই অনেক বড় বিষয়ে। তার পরও আমি বলছিলাম যে…
আসিফ বলে বসলো,
‘হ্যাঁ স্যার অবশ্যই। কেন নয়? অবশ্যই ক্লাস করতে পারবে সে।’
আমি বললাম,
‘কিন্তু এতদূর… ‘
‘কোন সমস্যা নেই। পড়ালেখার পেছনে সময় না দিলে স্বপ্ন পূরণ হবে কীভাবে?’
আমি চুপ করে গেলাম। ফর্ম ফিলাপের সব কার্যক্রম শেষ করলাম৷ কার্যক্রম বলতে শুধু আমার সিগনেচার আর ফর্ম ফিলাপের টাকাটা দিলাম৷ যখন আমার নামের জায়গায় বাবার নাম, নিজের নামের স্পেলিং ঠিক আছে কিনা মিলিয়ে দেখছিলাম, তখন যেনো একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠছিলো আমার বাবার মুখখানা। এ যেনো এক ভাস্কর হয়ে জলে উঠা প্রোজ্জ্বল দ্বীপ।
এদিকে আসিফের মা কল করলেন নুপুরের মায়ের নাম্বারে। কল করে শুরুতেই বলে বসলেন,
‘ভালো আছেন তো আমার ছেলে- ছেলে বউদের নিয়ে?’
নুপুরের মায়ের আর বুঝতে বাকি রইলো না বেয়াইনের অভিমানের সুর। তিনি বললেন,
‘আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন আপনি?’
‘আসিফ কোথায় এখন?’
আসিফের মা সালামের জবাবও দিলেন না। নুপুরের মা বললেন,
‘তারা দুজন কলেজে গিয়েছে। আসিফ বলেছে নুপুরকে নাকি আবার পড়ালেখা শুরু করাবে। আমি অবশ্য তাদের না…. ‘
নুপুরের মায়ের কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই কল কেটে দিলেন আসিফের মা।
কলেজ থেকে বের হতে হতে এগারোটা বেজে গেলো। সিএনজি সাথে ছিলো। আমরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
দুপুরে খাবারদাবার সব মা রেডি করে রেখেছেন৷ আমরা ভাত খাচ্ছিলাম এমন সময় মা বললেন,
‘আমাদের কি বাড়িতে রেখে দেওয়া যায় না? আমরা থাকতে পারবো তো একা একা।’
আসিফ বললো,
‘আপনাদের কি এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে মা?’
‘না না বাবা। সমস্যা হবে কেন। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু বাবা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এভাবে থাকি কীভাবে বলো? যতোই হোক আমার ছেলে দুইটার জন্মমাটি। তাদের বাবার ভিটে। এইটা কি ছেড়ে থাকা যায়? আর তোমরা দুজন তো আছোই৷ আমার যেকোন আপদে বিপদে তোমাদের আমি পাবোই৷ আর এমন না যে দুজন দুই ভিন্ন দেশে বাস করছি। তাইনা বাবা?’
আসিফ কোন কথা বললো না। আমিও নিশ্চুপে ভাত খেয়ে নিলাম।
বিকালে অফিস থেকে এসে বদরুল তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ওদিকের কি কোন খবর পেলে? আসিফ তো শুনলাম হোটেলে জয়েন করেছে।’
এই কথা শুনে তানিয়া যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বললো,
‘হোটেলে? কীসের হোটেলে?’
‘আরে বাবা আমি খবর নিয়েছি। সে এখন খুব ভালোভাবে ঘর সংসারে মন দিয়েছে জানলাম। বউকে কলেজে ফর্ম ফিলাপ করিয়েও এনেছে৷ শুনলাম পরীক্ষা দেওয়াবে। তুমি বেশি দেরি করো না আবার। মায়ের সাথে কথা বলো। দেখো সবকিছু আমাদের নামে করে ফেলতে পারো কিনা না।’
‘আচ্ছা আমি দেখছি।’
বদরুলকে পাশে রেখেই তানিয়া তার মাকে কল দিলো। কল দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝালো যে ছেলে এখন তার শাশুড়ি আর শাশুড়ির সন্তান পালতে ব্যস্ত। তারপর এও বললো তানিয়া কলেজে গিয়েছে ফর্ম ফিলাপ করতে। সে পরীক্ষাও দিবে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো মেয়ের কথাগুলো গিয়ে বিধলো আসিফের মায়ের মনে। তবুও মেয়েকে কোনকিছু বুঝতে দিলেন না। এক পর্যায়ে তানিয়া বললো,
‘তোমার এতকিছু এখন কী করার পরিকল্পনা করছো?’
‘এতকিছু মানে?’
‘মানে এই বিশাল সম্পত্তি যা যা আছে তার আরকি!’
‘কেন? আমি এখনও বেঁচে আছি নাকি? না মরে গেছি?’
‘না তা বলছি না মা।’
তানিয়া বুঝতে পারলো মায়ের সাথে এখন আর এই বিষয়ে কথা আগানো যাবে না। সে কল রেখে দিলো।
এদিকে তামান্না মায়ের কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করতে পারলো বড় বোন কোন বিষয়ে কথা বলছিলো মায়ের সাথে। তামান্না এসে মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলো,
‘আপু কী বলেছে? সে সম্পত্তি চায় নিশ্চয়ই? এজন্য ই তো কল করেছিলো তাইনা?’
মা আর মেয়ের কথায় সায় দেন না। চলে যান নিজের রুমে। কাজের মেয়েকে ডেকে দুপুরের রান্না করে ফেলতে বলেন।
কেটে যায় মাস চারেক। এপ্রিল মাস। সামনের সপ্তাহ থেকে আমার পরীক্ষা। এই চার মাসে বেশকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে আমার জীবনে৷ মাকে অনেকবার বুঝানোর পরও মা আমাদের সাথে আর থাকেননি। বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন৷ আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম মা কোন এক চাপানো কষ্ট আমাদের থেকে আড়াল করে বাড়িতে চলে গিয়েছেন। মা সেলাইয়ের কাজ জানতেন। মেশিন আগ থেকেই ছিলো। এই মাস চারেকের প্রতি মাসেই আসিফ তার বেতনের টাকা থেকে চার হাজার টাকা করে মাকে দিতো। মা সেলাই মেশিন চালিয়ে এ বাড়ি ওবাড়ির বউ ঝিয়েদের ড্রেস সেলাই করে দিয়ে যা উপার্জন করতেন, তা দিয়েই আমার ছোট ছোট দুই ভাই আর মায়ের দিন চলে যেতে লাগলো। এদিকে বাসা ভাড়া ছয় হাজার টাকা আর আমার মাকে চার হাজার টাকা দিয়ে আসিফের যে যৎসামান্য টাকা বাঁচতো সেই টাকা দিয়ে আমাদের চলতে হিমশিম লেগে যেতো। ফিজিক্সের বেশকিছু প্রবলেম সলভের জন্য আমি নোট কিনতে পারিনাই। পারিনাই বললে ভুল হবে, আমিই আসিফকে বলিনাই। নিচের তলার আপর সাথে আমার ভালো খাতির হয়ে যাওয়ায় তাদের ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড আমাকে দিয়ে দেন তিনি৷ সেই থেকে ইউটিউব দেখে দেখেই নিজের প্রবলেম সলভ করছি। খুব ভালো করেই আমাদের দিন কাটছিলো যেনো। কিছুটা অভাব, কিছুটা মেনে নেয়া, কিছুটা মানিয়ে নেয়া। ননাসের নাম্বার থেকে কল এলো আসিফের মোবাইলে। আসিফ কল রিসিভ করলো। ননাস আসিফকে বললেন,
‘তামান্নার বিয়ের আলাপ এসেছে। জামাই আমেরিকা থাকে। বয়স একটু বেশি। এর আগেও জামাইর একটা বিয়ে হয়েছিলো শুনেছি। বিয়ে টিকে নাই। একটা বাচ্চা আছে। বয়স দুই বছর। এদিকে সবাই তো জানেই যে তামান্নার আগের বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে। এখন মা এখানে কথা বলতে চাচ্ছিলেন।’
আসিফ বললো,
‘বলতে চাইলে বলো। আমি কী করতে পারি এখন?’
‘মা আমাকে বলেছেন যেনো তোকে কল করে জানিয়ে দেই সবকিছু। পর্শুদিন জামাইর বাড়ির লোকজন তামান্নাকে ফাইনাল দেখতে আসবে। সবকিছু মোটামুটি ফিক্সড বলা যায়৷ তারা তো আর জানে না যে ঘরের ছেলে আর ছেলের বউ ঘরছাড়া। এখন মা বলেছেন, তোদের দুজনকে লোক দেখানোর জন্য হলেও বাড়িতে আসতে হবে।’
আসিফ সরাসরি না বলে কল কেটে দিলো।
এদিকে তানিয়া মাকে কল করে আগ বাড়িয়ে বললো,
‘বলেছি তোমার ছেলেকে। তোমার ছেলে বলেছে, তার এসবে কোন মতলব নেই। কোন যোগসাজশ নেই। সে আসতে পারবে না। তার বউয়ের নাকি সামনে পরীক্ষা। তোমাকেও বলি মা, এত করে বুঝালাম, এত করে বললাম যে ছেলে আর তোমার ছেলে থাকেনি, তার পরও এসব কেন করছো? ভুলে যাও যে তোমার একটা ছেলে ছিলো। আমিই তোমার সব। এখন তোমার ছোট মেয়েকে যেখানে বিয়ে দিচ্ছো, আজ বাদে কাল সে আমেরিকা যদি চলে যায় তাহলে কী হবে বলো? এই আমাকে আর আমার জামাইকেই তো তোমায় দেখে রাখতে হবে তাইনা? আর কতো বুঝাবো তোমাকে? বাবারও তো বয়স হয়েছে নাকি? ‘
এক ঝাড়ির মতো কথাগুলো বলে তানিয়া কল কেটে দিলো।
[বিকাল থেকে কাশি আরও বেড়েছে। দোয়া করিয়েন আমার জন্য😴]
(চলবে)