#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৪১_৪২_৪৩

0
708

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৪১_৪২_৪৩

#মিদহাদ_আহমদ

*প্রিয় পাঠক, আপনাদের জন্য একসাথে তিন পর্ব দিলাম গল্পের।

শাশুড়ি আমাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, আমার পড়াশোনা আর হবে না৷ এসব তাঁর পছন্দ না। ননাস শাশুড়ির সাথে তাল মিলিয়ে কথা শুনালো আমাকে। এও বললো,

‘বাপু পড়াশোনা করে কি তুমি ডাক্তার হয়ে যাবা? ডাক্তার হওয়া কি এতো সোজা? এইটা কি মেয়ের হাতের মোয়া যে চাইলাম আর হয়ে গেলাম?’

ননাস, শাশুড়ি কারো কথার কোন জবাব আমার ছিলো না৷ রাতে ঘুমানোর সময়ে আসিফকে বললাম,

‘আমার আর পড়াশোনার ইচ্ছা নেই আসিফ৷ দেখো, আমি এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি৷ জানি না রেজাল্ট কী হবে৷ তবে দিয়েছি। যাই হয়েছে তোমার সাপোর্ট পেয়েই হয়েছে৷ এখন আর আমার পড়ার ইচ্ছা নাই৷ ঘর, সংসার সবকিছু শেষে আমি এই চাপ নিতে পারবো না ‘

আসিফের দিকে তাকাতেই দেখলাম তার মেজাজ কেমন জানি বিগড়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল

‘বাসায় না করেছে এজন্য?’

‘না। এজন্য হবে কেন?’

‘আজ আমি লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছি কি বাসার চাহিদামতো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে নাকি আমার ইন্টারেস্টের বিষয় থেকে?’

আমি চুপ করে থাকলাম৷ তারপর আবার আসিফ বললো,

‘এই লাইফটাই একটা স্ট্রাগলের। কেউ তোমার স্বপ্ন পর্যন্ত নিয়ে যাবে না। নিজের স্বপ্ন নিজেকেই পূর্ণ করতে হয়৷ স্বপ্ন দেখে তো তোমার মতো হাজারো মেয়েরা৷ কিন্তু পূর্ণ করে কয়জন?’

কোন জবাব দিলাম না আর। সেই রাতে ঘুমিয়ে গেলাম৷ এক ঘুমে রাত পার হয়ে গেলো৷ সকালে কাজে যাওয়ার আগে আসিফ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী সিদ্ধান্ত নিলে? সবার কথা শুনবে নাকি নিজের মনের কথা শুনবে?’

আমি সাফ জানিয়ে দিলাম,

‘আমি মেডিকেলে পড়তে চাই না আসিফ। আর মার এসব চাপ নেয়া পসিবল না। আমি ঘর সংসার করতে চাই।’

‘অহ আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে।’

আসিফ আর কোনকিছু না বলে চলে গেলো কাজে। রান্নাঘরে কাজ করার সময় শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,

‘মাথা থেকে পড়ার ভূত নেমেছে?’

আমি কোন জবাব মুখে না দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। শাশুড়ি আমার কপালে চুপু খেয়ে বললেন,

‘দেখো বউমা, এই ঘরে আমি বউ হয়ে এসেছিলাম আজ থেকে আড়াই যুগ আগে। আর আড়াই যুগ পরে তুমি এসেছো৷ সংসার, স্বামী আর তারপর বাচ্চাকাচ্চা এই নিয়েই তো জীবন। জীবনের মানে আর কী? আর মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছো৷ আর দশটা মেয়ের জীবন যেমন করে কাটছে, তেমন করেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে মঙ্গল। তাইনা?’

আমি আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। ননাস এসে আদেশের সুরে বললো,

‘ঘর কর্মে মন দাও। তোমার জামাই কাজ কর্মে মন দিয়েছে৷ এখন সংসারকর্ম তোমার করা উচিত।’

আমার মুখ শুধু আটকে রেখেছিলাম। বলিনি এই ভেবে যে ননাস মনে মনে কষ্ট পাবে। কিন্তু মনে মনে ঠিকই বলতে চাচ্ছিলাম, ‘তারও তো সংসার আছে। সে তো কোন সংসারধর্ম পালন করছে না৷ বাপের বাড়িতে থাকছে এসে’

দুপুরে খেয়দেয়ে বিছানায় এসে শুয়েছি মাত্র। মায়ের নাম্বার থেকে মিসকল এলো। মায়ের নাম্বার থেকে মিসকল এলে আমি বুঝতে পারি মায়ের মোবাইলে টাকা নাই। কল ব্যাক করলাম। মা কাশি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি৷ আমি বুঝতে পারলাম মা অসুস্থ। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘অসুস্থ তুমি?’

‘ না এতকিছু না। আজ কয়দিন ধরে কাশি, সর্দি এতকিছু ছাড়ছেও না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছিলা?’

‘ওই দেখিয়েছিলাম হসপিটালে। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে এক হাজার টাকার আর টেস্ট দিয়েছে কয়টা। তোর মিলানি কাকি বললো ওসব টেস্ট করানোর দরকার নাই। আর আমিও বলি, সামান্য জ্বর, সর্দির জন্য এত ওষুধ দেয়া লাগে নাকি বল?’

‘আর টেস্ট?’

‘ওসব করানোর কি আর টাকা আছে রে মা? তোর কী খবর? তোর ননদ রয়েছে না চলে গিয়েছে?’

মায়ের কথা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা আমি খুব সহজেই ধরতে পারি এখন। মা ওষুধও ঠিকমতো কিনেনাই আমি না দেখেও বলতে পারবো। তবুও জিজ্ঞেস করলাম মাকে

‘মা তুমি ওষুধ এনেছো তো?’

‘না। পাশের বাড়ির জমিরের বউয়ের দুইটা ড্রেস সেলাই করেছি। আগামীকাল নিয়ে যাবে হয়তো। টাকা দিলে এনে খাবো। আর গতকাল কিনিনাই। তোর ছোট ভাইয়ের জ্যামিতি বক্স কিনতে হয়েছে এজন্য।’

‘অহ আচ্ছা। তাহলে খেও ওষুধ কিনে কেমন?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোর শরীর ভালো তো?’

‘হ্যাঁ মা ভালো আছি আমি। আমার টেনশন করার দরকার নেই তোমার এখন।’

‘আর জামাই কেমন আছে রে মা?’

‘তোমার জামাই ভালোই আছে। কাজে আছে এখন’

‘আচ্ছা মা একটা কথা বলার ছিলো তোকে।’

‘হ্যাঁ মা বলো।’

‘আমারও অনেক দিনের ইচ্ছা, আর তোর শাশুড়িও আমাকে বলে দিয়েছেন, এবার একটা বাচ্চা নিয়ে নে। সংসার কর। দেখবি জামাইর ও মন বসবে ঘরে৷ সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে তোর।’

‘আচ্ছা মা ঠিক আছে৷ আর কিছু বলবা?’

মায়ের এমন অপ্রস্তুত কথায় আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলাম। মা বললেন আবার,

”যা বলছি তা যেনো মাথায় থাকে রে মা। কেমন? নিজেকে যতো দ্রুত গুছিয়ে নিতে পারবি ততো ভালো। আর শোন, তোর জন্য ডিম জমিয়ে রেখেছিলাম। হাসের ডিম। পাঁচ হালি হয়ে গিয়েছে। ওগুলা কীভাবে পাঠাই বল?’

আমার রাগ উঠে গেলো এবার। মাকে বললাম,

‘ডিম তোমরা খাওনাই? আমার ভাই দুইটা কি খায়নি?’

‘সে খাচ্ছে খাবে। আমরা তো গ্রামেই আছি৷ আচ্ছা রাখছি। পরে কথা হবে। সেলাই করে ফেলি।’

মা কল রেখে দিলো। আমার অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রু বের হলো। আসিফকে বললেই সে টাকা দিয়ে আসবে মায়ের ঠিকানায়৷ কিন্তু এইটা আমি কীভাবে বলবো! আমার যে আত্মভিমান আর আত্মসম্মান সেই সম্মান আমি বিসর্জন দিয়ে নিজের মায়ের জন্য কোনকিছু নিজের স্বামীর কাছে চাইতে পারবো না। বিকালে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম, যে করেই হোক আমাকে আমার মায়ের জন্য, পরিবারের জন্য কিছু করতে হবে। নিজে কিছু করতে পারলে তবেই নিজের মা ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে পারবো। অজান্তেই মনস্থির করলাম, আমি পড়বো৷ অন্তত ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত পড়বো৷ নিজে নিজে যতটুকু পারি পড়বো। আমার চেষ্টার কোন কমতি থাকবে না কিছু করার। আমাকে করতেই হবে, আমাকে আমার পরিবারের জন্য হলেও অন্তত পারতে হবে।

শাশুড়ি আমার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে একবার আমার রুমে ঢু মেরে বললেন,

‘তোমার মা কি কল দিয়েছিলেন নুপুর?’

‘হ্যাঁ মা।’

‘অহ আচ্ছা।’

শাশুড়ি আবার চলেও গেলেন। বুঝতে বাকি রইলো না মাকে দিয়ে শাশুড়িই এই কথা বলিয়ে নিয়েছেন।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪২
#মিদহাদ_আহমদ

দুইদিন আসিফ কিছুটা রেগে ছিলো আমার উপর। রাগ না, অভিমান বলা চলে। কথা বললেও বলতো না ভালোকরে। শুধু বলতো এই যে, তার চোখের সামনে একটা স্বপ্ন একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে আর সে কোনকিছু করতে পারছে না। এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা তার জন্য আর হতে পারে না। বিভিন্ন কথার ছলে সে বুঝাতেও চাইলে যে আমি যেনো হাল না ছাড়ি। আমি যেনো চেষ্টা করে যাই নিজের জন্য কিছু করার, নিজেকে প্রমাণ করার। শেষমেশ গতরাতে আসিফকে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাই। সবকিছু মিলিয়েই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷ একদিকে আমার স্বপ্ন, অন্যদিকে আমার মায়ের জন্য কিছু করার ইচ্ছা এই দুয়ে মিলেই আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলো। আসিফকে জানাই যে আমি একবার নিজেকে যাচাই করতে চাই৷ তবে এও বলি যে আমি নিজে নিজে যা পারি বাসায় পড়বো। বাসার বাইরে পড়তে যেতে পারবো না। ডাক্তার সানিউল আজিম সানি ভাই নামে একজন ভালো টিউটর আছেন সিলেটে। তিনি মেডিকেল ভর্তিচ্ছুদের কোচিং করান৷ অফলাইন এবং অনলাইন দুই জায়গায় ই পড়িয়ে থাকেন৷ আসিফকে জানালাম আমি ওনার কাছে অনলাইনে পড়বো৷ বাসায় কেউ জানতেও পারবে না। আসিফ তবুও আপত্তি করলো, এভাবে পড়া হয় নাকি৷ শেষমেশ আমার আপত্তি আর ইচ্ছা দুটোর কাছেই যেনো হার মানলো। বললো,

‘যা ইচ্ছা৷ তবে তুমি যে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা করতে চেয়েছো এটাই অনেক।’

পরেরদিন সকালে শাশুড়ির রুমে যাই৷ শাশুড়ির বিছানায় বসি। শাশুড়ি শুয়ে ছিলেন। উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন কিছু বলবো নাকি। আমি শাশুড়িকে বললাম,

‘মা, আমি একবার আমার স্বপ্নের পেছনে যেতে চাই৷ একটাবার আপনি আমাকে সুযোগ দিন। আর মেডিকেলে চান্স তো মুখের কথা না৷ আমি চেষ্টা করবো শুধু।’

শাশুড়ি মা বললেন,

‘তুমি আমার কাছে সোনা গয়না জহরত যা চাইবে আমি না করবো না। কিন্তু এইটায় আমি হ্যাঁ বলবো না।’

আমি বললাম,

‘মা আজ যদি তামান্না এসে আপনাকে বলতো এই কথা তাহলে কি আপনি না করে দিতেন? এভাবে ফিরিয়ে দিতেন?’

শাশুড়ি নিশ্চুপ থাকলেন কিছুক্ষণ। শ্বশুর ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। শ্বশুর বললেন,

‘আরে আসিফের মা, এতো কড়াকড়ি করে কী হবে বলো? বউমা পড়তে চাইছে, দাও সুযোগ৷ পড়ুক। ঘরের কাজের মেয়ের তো অভাব নাই আমাদের। কাজের জন্য যে তার পড়া হবে না এমন তো না।’

‘না আসিফের বাবা। তুমি বুঝতে পারছো না ‘

‘বুঝে কী হবে? বুঝার দরকার নেই৷ তাকে পড়তে দাও।’

শেষমেষ শাশুড়ি একটা লম্বা ফিরিস্তি দিলেন। ফিরিস্তি ছিলো এমন,

‘ঘরের কাজকর্ম পরে যদি সময় থাকে তখন পড়বা৷ এখন তামান্নার নতুন বিয়ে হয়েছে। তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আসবে যাবে দাওয়াত খাবে। বউ হিসাবে সবকিছুতে আমাকে থাকতে হবে সামনে। তখন পড়া চলবে না।’

আমি হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলাম মাথা নাড়িয়ে। মেনে নিলাম সবকিছু। শাশুড়িকে পা ধরে সালাম করে রুম থেকে বের হয়ে এলাম।

নুপুর রুম থেকে যেতে না যেতেই তানিয়া রুমে এসে মাকে বললো,

‘অহ তাহলে দিয়েই দিলা শেষমেশ অনুমতি?’

‘সব তোর বাবার জন্য৷ ওই মানুষটা এমনিভাবে সামনাসামনি বলছিলো যে আমিই একমাত্র দোষমন ওর।’

আসিফের বাবা হেসে হেসে আসিফের মা আর তানিয়াকে বললেন,

‘তোমাদেরও বলে বুঝাতে পারবো না আমি। মেডিকেল কি বাচ্চাদের খেলনা? যে পড়লো আর হয়ে গেলো? একবার ব্যর্থ হোক। তারপর সব স্বপ্ন উবে যাবে। ঘর সংসারে মন দিবে। আর আসিফকে তো চিনোই। একদিন, দুদিন কিছু বলছে না। যদি বলা শুরু করে তখন তো পড়িয়েই ছাড়বে। বলতে পারবে তার উপর? হীতে বিপরীত হবে। তারচেয়ে অনুমতি চাচ্ছে, অনুমতি দিয়ে পড়তে দাও। নিজের আয়ত্ত্বে রাখো সব।’

তানিয়া এবার বাবার সাথেসাথে সম্মতি দিয়ে বললো,

‘মা, বাবা কিন্তু ভুল বলেনি। এইভাবে ভেবে দেখিনি কোনদিন!’

‘হয়েছে হয়েছে। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তোমরা তাই করো৷ আমার কোন কথাই তো কোনদিন তোমাদের সঠিক মনে হয় না।’

বিকালে তামান্নার শাশুড়ি কল করে বললেন, আগামীকাল তামান্নাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে৷ শাশুড়ি জিজ্ঞেস করেছিলেন, এসেছিলো তো দশদিনের জন্য৷ তাহলে পাঁচ দিনের দিন কেন। তামান্নার শাশুড়ি বললেন, আগামীকাল নাকি তার ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসবে দাওয়াত খেতে। আর বাড়ির একমাত্র নতুন বউ, সে যদি না থাকে তাহলে কীভাবে হয়!

রাতে আসিফ বাসায় আসার আগে শাশুড়ি তাকে কল করে বাজারের ফিরিস্তি ধরিয়ে দিলেন। কল করে বললেন এই সেই নানাকিছু নিয়ে আসতে। আগামীকাল তামান্নার সাথে যাবে। এতকিছুর বাহার দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমার বাবা তো কোনদিন আমার সাথে ফিরতি যাত্রায় এসব দেননি। আসিফ বাসায় এসে খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘আগামীকাল কি কেউ দাওয়াত খেতে আসবে নাকি মা?’

‘কেন? না তো’

‘তাহলে স্পেশাল মিষ্টি দশ কেজি আর দই দশটার অর্ডার কেন দেওয়ালা আমাকে দিয়ে? বাসায় মেহমানও আসছে না’

‘কাল তামান্না চলে যাবে। তার সাথে দিবো। এতসব বুঝবি না তুই।’

শাশুড়ির কথা শুনে আসিফ আর কিছু বললো না৷

তামান্নাকে নিয়ে শ্বশুর সকাল এগারোটায় চলে গেলেন। আসিফও কাজে। বাসায় শুধু আমি, শাশুড়ি আর ননাস। কলিংবেল বেজে উঠলো এমন সময়৷ কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। আমি রুমে ছিলাম। কাজের মেয়ে রুমে এসে চুপিচুপি আমাকে বললো,

‘ভাবি দেইখন কালা কোর্ট ফিইন্দা বেডা লোক আসছে৷’

আমি পড়ছিলাম তখন৷ ওর কথা শুনে ফিরে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম,

‘কে এসেছে?’

‘খালাম্মা গেছুইন৷ আফনে দেখুন গিয়া’

আমি উঠে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে চেয়ে দেখলাম শাশুড়ি আর তানিয়া আপার সামনে একজন এডভোকেট বসা। আমি কিছু বুঝতে না পেরে নিচে গেলাম। গিয় দেখি ননাস শাশুড়িকে ধরে কান্না করছে আর বলছে,

‘এসব আমি বিশ্বাস করি না। এসব আমি বিশ্বাস করি না। মা তুমি কল দাও বদরুলের নাম্বারে। কল দাও ‘

আমি পরিস্থিতি বুঝতে পারছিলাম না। শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করবো করবো এর আগেই এডভোকেট একটা নোটিশ বের করে সামনে রেখে তানিয়া আপাকে বললেন,

‘দেখুন, আমাকে দিয়েই আপনার স্বামী উকিল নোটিশ দিয়েছেন৷ আপনাকে তিনি ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন৷ আর কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন যে তিনি আপনাকে নিয়ে সেটিসফাইড নন।’

আমি এডভোকেটের দিকে চেয়ে রইলাম অবাক দৃষ্টিতে৷ মোবাইল বের করে দুলাভাইর নাম্বারে কল দিলাম। কয়েকবার রিং হলো কিন্তু তিনি ধরলেন না৷ আবার দিলাম কল। এবার কল রিসিভ করে দুলাভাই বললেন,

‘উকিল গিয়েছে বাসায়। যা বলার উনি বলছেন। আমাকে আর ডিস্টার্ব করবা না।’

কল কেটে দিলেন তিনি। আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ননাস একদিকে কান্না করেই চলছে। এডভোকেট চলে গেলেন উঠে। শাশুড়ি না একেবারে জমে শক্ত হয়ে আছেন যেনো৷ আমি গিয়ে বসলাম কাছে। শাশুড়ি মাকে ইশারায় বুঝালাম যে আমার কথা হয়েছে। শাশুড়ি মা চোখ চেপে ধরলেন। একসাথে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমি ননাসের মাথায় হাত দিতেই ননাস তেড়ে এলো। ফিরে বললো

‘ডাইনি, অলক্ষ্মী জাদু করেছিস আমার স্বামীকে? আমার সুখ সহ্য হয় না তোর? সবকিছু তুই করেছিস। সব।’

তারপর শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললো,

‘মা বলো না সব মিথ্যা। এসব কী? এসব কাগজ পত্র হুদা হুদাই বলো না। আমার নামে না এসব।বলো। বদরুল কি এসব করতে পারে? তোমার বদরুল মা। তোমার ছেলের মতোন ছেলে সে। সে আমার সাথে এমন করবে বলো? বলো সবকিছু মিথ্যা।’

শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন তার মেয়েকে। কোন কথাই যেনো আর বলতে পারছেন না তিনি।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৩
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফকে কল করে জানালাম আমি সব। আসিফ একেবারে থ বনে গেলো। কোন কারণে এসব হচ্ছে এর কোনকিছু আমরা আন্দাজ করতে পারছিলাম না। রাতে শ্বশুর কল দিলেন তানিয়া আমার শাশুড়ির নাম্বারে। কল ধরতেই ওপাশ থেকে তানিয়ার শাশুড়ি বললেন,

‘কী দরকারে কল? কোন মতলব টতলব নাকি?’

‘বদরুল যে নোটিশ…’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তো কী করবে? বাজা মেয়েকে ঘরে পোষবে? ছেলে আমার এতোটাও বদবুদ্ধি ওয়ালা না যে আপনাদের কথায় আর ইশারায় নাচবে গাইবে উঠবে বসবে। সবকিছু একটা নিয়মবদ্ধ। সে একেবারে সন্তানহীন হয়ে জীবন কাটাবে? নিজের ঘরে তো ঠিকই নিজের মদখোর ছেলের জন্য বউ নিয়ে এসেছেন। নিজের বংশ রক্ষা করবেন আর আমার বেলায়? আমি ছেড়ে দিবো? এসব হবে না। যা দিয়েছে তাই ঠিক আছে। আপনার মেয়েকে বলিয়েন সবকিছু যেনো ভালোয় ভালোয় শেষ করে ফেলে। আর নাহলে হিতে বিপরীত হবে বলে রাখলাম।’

কথাটা বলেই খোদেজা বেগম শ্বশুরের কল কেটে দিলেন। শ্বশুর কল রেখে নীরবে বসে রইলেন। আসিফ সামনেই ছিলো। বোনের এমন কান্না জর্জরিত চেহারা দেখে সে আর সহ্য করতে পারলো না বুঝলাম। কল দিলো বদরুল দুলাভাইর নাম্বারে। কল দিয়ে তার সে কী রাগমাখা কথা! সে বদরুল দুলাভাইকে বললো,

‘আমার বোনকে আপনি ডিভোর্স না, আমার বোন আপনাকে ডিভোর্স দিবে। আপনাকে এর কারণ দর্শাতে হবে। আর নাহলে আমি আদালতে মামলা করবো আপনার নাম৷ বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি?’

ফোন স্পিকারে ছিলো। আসিফের কথা শুনে বদরুল দুলাভাই বললেন

‘কারণ জানতে চাও শালাবাবু? না না উফ! আমিও ভুল করি। আসিফ কারণ জানতে চাও? সব তো উকিল মারফত জানিতে দিলাম। তার পরও যখন জানতে চাও তখন জানাবো। ঠিক আছে? আমি কাল সকালেই আসছি। এসে জানাচ্ছি কারণ।’

আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কারো মুখ দিয়েই যেনো কোন কথা বের হচ্ছে না৷ ননাস চুপ করে বসে রইলো। আমি ননাসের কাছে গেলাম। তাকে নিয়ে উপরে রুমে গেলাম। ননাস বিছানায় বসতে গিয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করে উঠলো। আর বলতে লাগলো,

‘আমি আল্লাহর কাছে কি অন্যায় করেছিলাম নুপুর? আমি তো কারো কোন ক্ষতি করিনাই। আমি কারো কোনকিছু নষ্ট করিনাই। তাহলে আল্লাহ কেন আমাকে এমন শাস্তি দিচ্ছেন? আমাকে আল্লাহ মা হতে দিবেন না। এখন আল্লাহ আমাকে বাঁচাতে বাঁচাতে মেরে ফেলে দিলেন! আমি কার সাহায্যে বাঁচবো এখন!’

আমি কাছে বসতেই আমাকে ননাস জড়িয়ে ধরলেন। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। শুধু বারবার চোখে ভাসছে সেইদিনের দৃশ্য, যখন দেখেছিলাম বদরুল দুলাভাইকে আরেকটা মেয়ের সাথে গাড়িতে উঠতে। আর বারবার ভেসে আসছে, সেদিন আমিও তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম। নীরবে নিজের ভুল মেনে নিয়েছিলাম সবার সামনে। কোন প্রতিবাদ করিনি। যদি সেদিন আমি শক্ত হাতে ধরতাম, যদি আমি মেনে না নিতাম তাহলে হয়তো আজ এদিন দেখতে হতো না। হয়ত সবকিছু আমার জন্যই হয়েছে। নিজের ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট আমি কাওকে বলে বুঝাতে পারলাম না। নিজেও কেমন জানি চুপসে গেলাম। কোন বোধশক্তি কাজ করছিলো না নিজের মধ্যে। ননাসকে রেখে শাশুড়ির রুমে যেতেই দেখি শাশুড়ি জায়নামাজ বসিয়ে নামাজে আছেন। শাশুড়ি লম্বা সিজদা দিচ্ছেন আর উঠছেন ই না যেনো! আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, যেদিন আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এই বড় ঘরে, এই বড়লোকের অন্দরে, ঠিক সেদিন আমার মা এমন শোকরিয়া আদায় করে লম্বা সিজদায় আল্লাহর কাছে লুটিয়ে পড়েছিলেন৷ হায়রে জীবন! সন্তানের জন্য নিজের প্রভুর কাছে চাইতে চাইতে আমাদের বাবা মায়েদের জীবন যেনো একেবারে শেষ হয়ে যায়। তারা যেনো এই একটা জীবনের সুখেই নিজের সবকিছু বিলীন করে দেন। চারপাশ থেকে কাটিয়ে নিয়ে যান সব দুঃখ কষ্ট হেলা।

পরেরদিন বদরুল দুলাভাই বাসায় এসে নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে ডাকলেন৷ ননাস এক কোণে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। দুলাভাই ননাসের কাছে এসে বললেন,

‘তোর মতো মেয়ে যে তার ভাইয়ের সাথে এমন করতে পারে, সে আমার সাথে কেমন করবে তা কি আমি আন্দাজ করতে পারি না?’

আমরা সবাই চমকে উঠলাম। কী বলছেন উনি! ননাস তার ভাইয়ের সাথে কী করলেন? আমরা কোন হিসাব মিলাতে পারছিলাম না ওনার কথার। কেমন জানি একটা ভ্রম জুড়ে বসলো আমাদের মাঝে৷ ননাস একদম চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ননাসের জামাই বললো হেসে হেসে,

‘কী? এখন কোন কথা বের হচ্ছে না কেন?’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here