#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৬১
#মিদহাদ_আহমদ
সপ্তাহ খানেকের ভেতর সবকিছু গোছগাছ হয়ে গেলো। সবকিছু যেনো এক ঝটকায় গুছিয়ে যেতে শুরু করলো। ননাস রাজি হয়ে গেলো ফারুক স্যারকে বিয়ে করার জন্য৷ সেদিন রাতে আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না! ননাস আমার কাছে জানতে চাইলো সে কী করবে এখন! একদিকে গল্প, অন্যদিকে তার মনের মধ্যে জাগ্রত হওয়া সুপ্ত বাসনা, কারো মা হওয়া, কারো স্ত্রী হওয়া, নিজের একটা সংসার হওয়া! সবকিছু যেনো এক ভয়ার্ত গোলকের মতো আটকে আছে তার জীবনে!
আমি ননাসকে সোজা বাক্যে বুঝিয়ে বললাম, তার উচিত নিজের জীবন নতুন করে শুরু করা। ননাস তারপর আবার বললো গল্পের কথা। আমি অনেক নির্ভরতা নিয়ে ননাসকে বললাম, গল্পের জন্য আমি আছি, মা আছেন, ওর বাবা আছে। ননাসের এখন মুন্নির প্রয়োজন। এক মা কীভাবে আরেক মা ছাড়া সন্তানকে এমন অসুখী দেখতে পারে? ননাস আর কোন কথা বলেনি সেদিন। আমি রুম থেকে চলে এলাম৷ বুঝতে পারলাম ননাসের সম্মতি আছে এই বিয়েতে। ঝটপট সবকিছুর আয়োজন হয়ে যেতে লাগলো মুহূর্তেই।
আজ বিকালে ফারুক স্যারের বড় বোন, দুলাভাই আর বড় ভাই আমাদের বাসায় আসবেন সব কথা পাকা করতে। কী কীভাবে হবে এসব। শাশুড়ি আসিফকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। আমিও গেলাম। আমাকে দেখে শাশুড়ির কিছু ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো এমন আমি বুঝতেই পারছিলাম। তবুও সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাশুড়ি আসিফকে বললেন,
‘বাবা সবকিছু তো ঠিকঠাক। আমি শুধু চাচ্ছিলাম যে কাবিনটা যেনো শক্ত করে ধরা হয়। আর এই কাবিনের বিনিময়ে আমি তোর বোনকে এই বাড়ির একটা অংশ লিখে দিতে চাচ্ছি।’
আসিফের মাথা গরম হয়ে উঠলো। সে বললো,
‘মানে কী বলতে চাইছো মা? এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও তুমি সেই আগের মতোই আগের চিন্তায় আছো? মানে চাচ্ছো টা কী তুমি?’
‘আমি চাচ্ছি আমার মেয়ের নিশ্চয়তা। আর কিছু না।’
‘টাকাপয়সা,বাড়ি গাড়ি সব দিয়েও কি মেয়ের নিশ্চয়তা তুমি পেয়েছিলে বলো? পেয়েছিলে?’
আমি আসিফকে সামলে নিলাম। তাকে রুমে আসতে বললাম। রুম থেকে আসিফ বের হতে হতে শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললো,
‘আমি দেখে নিবো এই বিয়েতে কেমন মনমানি তোমরা করো। আমিও দেখে নিবো।’
কাবিন নিয়ে আর কথা এগুলো না। বিকালে ফারুক স্যারের ভাই, ভাবি, বোন, বোনের জামাই, ফারুক স্যার নিজে আর তার সাথে করে মুন্নি আমাদের বাসায় এলেন৷ মুন্নি এসেই উপরের ঘরে চলে গেলো ননাসের কাছে। কিছুক্ষণ পর ননাস নিচে নেমে এলো ট্রেতে চা নিয়ে। সবাইকে চা দিলো৷ ফারুক স্যারের ভাবি ননাসকে দেখে বললেন,
‘সুন্দর। ডিভোর্স কয়বছর আগে হয়েছিলো জানি?’
এমন সরাসরি প্রশ্ন তিনি করে বসবেন এমনটা আমাদের ধারণায় ছিলো না। ফারুক স্যারের ভাই পাশ থেকে বললেন,
‘উফ রেশমি। কখন কী বলতে হয় কোন জ্ঞান দেখি নেই। চুপ করো। আচ্ছা আমরা কি কাবিনের বিষয়ে এখন কথা বাড়াতে পারি?’
বললেন ফারুক স্যারের ভাই। ফারুক স্যার পাশ কেটে বললেন,
‘আসলে কাবিনের বিষয়টা আমি ক্লিয়ার করতে চাই। শরিয়া বিধি মোতাবেক আমি বিয়ের আগেই কাবিনের টাকাটুকু পরিশোধ করতে চাচ্ছি। বিয়ের পরে না।’
ওনার মুখ থেকে এই কথা শোনার পর আমার খুব আনন্দ অনুভব হলো। একজন মানুষ তার স্ত্রীকে বিয়ের আগেই তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন যা কিনা ইসলাম সমর্থন করে, তার চেয়ে বড় আনন্দ আর কীসে হতে পারে?
শাশুড়ি ইশারায় আসিফকে ভেতরে আসতে বললেন। আসিফ উঠে গেলো। আমিও উঠে গেলাম। শ্বশুরও ভেতরে আসলেন। শাশুড়ি বললেন,
‘কাবিন আগে পরিশোধ করে দিবে এর মানে বুঝো? এর মানে কাবিন এক লাখ দেড় লাখ টাকা ধার্য করা হবে। এই কাবিনে কি তোর বোন তুই দিয়ে দিবি?’
শ্বশুর এবার সরাসরি শাশুড়ির বিরোধীতা করে বললেন,
‘আসিফের মা, তুমি সবসময় একটা স্বার্থ আর ভবিষ্যত নিয়ে ঘুরো। যদি এই বিয়েতে আল্লাহর হুকুম আর ইচ্ছা না থাকে তাহলে এই বিয়ে কোটি টাকার কাবিনেও টিকবে না। আর হুকুম হলে, এক টাকার কাবিনেও বিয়ে টিকে থাকবে৷ সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও এবার। আর ছেলে যেহেতু বিয়ের আগে কাবিন পরিশোধ করতে চাচ্ছে, এই সুযোগ তাকে দেয়া উচিত। এই সুযোগের দাবিদার সে। আর তা না হলে তুমি আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবা। আল্লাহর কাছে।’
‘তুমি বুঝাও মাকে। আমি আর এসব নিতে পারছি না বাবা।’
শ্বশুরকে এই কথাগুলো বলে আসিফ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আমিও তার সাথেসাথে বের হয়ে আসলাম। এসে সোফায় বসতেই ফারুক স্যার বললেন,
‘আমি আসলে কাবিনের বিষয়টা…’
আমি ভেবেছিলাম ফারুক স্যার হয়তো লাখ দেড়লাখের মধ্যে কাবিন দিবেন। কিন্তু আমাদের ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি বললেন,
‘আমি ওনাকে পাঁচ লক্ষ টাকা অগ্রীম পরিশোধ করতে চাচ্ছি কাবিনের জন্য। আর বাদবাকি আমার গ্রামে জমি আছে। খেতের জমি। সেই জমি থেকে এক কিয়ার জমি আমি ওনার নামে লিখে দিবো৷ আমার সামর্থ্য এটুকুই। আর আপনারা প্লিজ, যতো ছোট পরিসরে, যতো কম খরচে আমাদের হাতে আপনাদের বোন তুলে দিতে পারবেন, তাই করবেন। আমি শুধু এখান থেকে আমার বাচ্চার মা নিতে এসেছি। আর আমার বাচ্চার মায়ের জন্য আমি আর আমার বাচ্চা যা পছন্দ করবো, তাই হবে। এর বাইরে একটুকরা সুতোও যাবে না এখান থেকে।’
শ্বশুর বলে উঠলেন,
‘আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বাবা। আমার কোন দ্বিমত নেই। আমার মেয়ের বিয়ের জন্য আমার পূর্ণ সম্মতি আছে।’
ফারুক স্যারের দুলাভাই পাশ থেকে তাকে কিছু বলতে চাইছিলেন বুঝছিলাম। ফারুক স্যার তাকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলে। কিছুক্ষণের মাথায় টেবিলে সব নাস্তা সাজানো হয়ে যায়। সবাই নাস্তা করতে বসে। শ্বশুর অফার করলেন, আজ বুধবার। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মাঝ দিয়ে শুক্রবার যেনো বিয়ের তারিখ দিয়ে দেই। তিনি এও সম্মতি দিলেন যে বিয়ে একদম ঘরোয়া ভাবে শুধুমাত্র কয়েকজন আত্মীয়ের উপস্থিতিতেই হবে। তার কোন আপত্তি নেই।
শুক্রবার সকালেই ফারুক স্যার একটা গাড়ি করে বড় বোন আর ছোট মেয়েকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। ছোট্ট মুন্নি একটা লালা টুকটুকে বেনারসির ডালা নিয়ে বাসায় এসে ঢুকলো। ফারুক স্যারের বোন আমার শাশুড়িকে ডেকে তার হাতে একটা স্বর্ণের বক্স দিয়ে বললো,
‘এইটা খুলে দেখে নেন। এতে সোনার জিনিস আছে কিছু। একটা চেইন আর একজোড়া কানের দুল৷’
শাশুড়ি দেখলেন। ফারুক স্যারের বোন চলে গেলেন বের হয়ে। কিছু খেলেনও না। মুন্নি থেকে গেলো। সে তার মাকে সাজাবে। সোজা শাড়ির ডালা নিয়ে চলে গেলো উপরের দিকে। শাশুড়ি আমার দিকে তাকালেন। আমি শাশুড়িকে নিয়ে চললাম তার রুমে। বিছানায় বসিয়ে শাশুড়িকে বুঝাতে লাগলাম, এসব টাকা পয়সা, লাবন্য আর লোক দেখানোর মাঝে দুনিয়ার সুখ নেই। শাশুড়ি কান্না করতে করতে বললেন,
‘এসব লিকলিকে চেইন দেয়ার চেয়ে না দেয়াটাই ভালো ছিলো। আর কাবিনের টাকা দিবে আগে, কই দিলো? দিয়েছে? এসব চেইন এনে দিয়েছে এসব আমার মেয়ের গলায় চড়াবো? আমার এত এত গহনা থাকতে?’
আমি শাশুড়িকে বুঝালাম। শাশুড়ি আমার কথা শুনতে নারাজ। ফার্ণিচার সাফ আসিফ নিষেধ করে দিয়েছে মাকে। এজন্য ফার্ণিচার নিয়েও তিনি আর কোন কথা বলতে পারছিলেন না। আমি শাশুড়িকে বেশ কিছুক্ষণ বুঝিয়ে নিয়ে চললাম ননাসের রুমের দিকে। ননাসের রুমের দরজা ফাকা করা ছিলো৷ ননাস আয়নার সামনে বসা। ননাসের দুই পাশে মুন্নি আর গল্প। দুজন মিলে এইটা ধরছে, ওইটা ধরছে। সাধারণ লাল বেনারসি আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকে অপূর্ব লাগছে তাকে দেখতে। বাচ্চা দুইটা তাদের মাকে জড়িয়ে ধরছে দুইপাশ থেকে। ননাসও তাদের আদর করছে। আমি শাশুড়িকে বললাম
‘মা, এই ভালোবাসা আর আনন্দ টাকা দিয়ে কেনা যাবে বলেন? এরচেয়ে বড় কোন শান্তি আর আছে পৃথিবীতে?’
শাশুড়ির হাতে থাকা তার ভারি স্বর্ণের হার সমেত তিনি রুমে ঢুকলেন। ননাস পেছনে ফিরে তাকালো। শাশুড়ি ননাসের কাছে গিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়েকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।’
তারপর একপাশে শাশুড়ি তার ভারি স্বর্ণের গহনা রেখে, আমার হাত থেকে ফারুক স্যারের বাসা থেকে দেয়া সোনার চেইন আর কানের দুল নিয়ে ননাসের গলায় আর কানে পরিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন,
‘মারে, সুখ খুঁজে নিলে আর এতকিছুর প্রয়োজন হয় না। এই বিত্ত বৈভব ছেড়ে আমাদের সকলকেই তো চলে যেতে হবে একদিন। এই চলে যাওয়ার মাঝে আমরা ভুলে যাই আমাদের সুখের আসল ঠিকানা, মজে থাকি এই দুনিয়ার মায়ায়।’
দুপুরে ফারুক স্যার আসার সময় সাথে করেই কাবিনের টাকা পাঁচ লাখ আর জায়গার দলিল নিয়ে এলেন। বিয়ে হয়ে গেলো। খুব সামান্য আর সাধারণ আয়োজন করেই সম্পন্ন হলো আমার ননাসের বিয়ে। ননাসের বিদায়ের সময়ে গল্প বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো,
‘মামুণি কোথায় যাচ্ছে মা? সে এভাবে সেজেগুজে তো কখনো কোথাও যায়নি।’
মুন্নি গল্পকে বলছিলো,
‘তোমার মামুণিকে আমার মা করেছি। কী মজা কী মজা। আমার মা।’
গল্প তখন স্থির চোখে দেখছিলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমার ননাসকে। আমার ছোট্ট গল্পের ভেতর ভেতর কী অনুভব হচ্ছিলো আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম কিছুটা। ননাস গল্পকে জড়িয়ে সে কী কান্না শুরু করলো! গল্প তবুও ঠায়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কোন অনুভূতি তাকে নাড়া দিলো না যেনো। পেছনে এক বাচ্চাকে রেখে নতুন আরেক বাচ্চাকে ধরে নববিদায় হলো আমার ননাসের। একটা বাচ্চা আজ নতুন করে তার মা হারালো, আরেকটা বাচ্চা আজ নতুন করে তার মা খুঁজে পেলো। ভাঙ্গা গড়ার খেলায় এ যেনো এক জীবনের ছবি, জীবনের গল্প, গল্পের জীবন…
(চলবে)