সুখ নীড় পর্ব-৩

0
320

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩

মায়ের অতীত কলঙ্কিত অধ্যায় সন্তানের সামনে চলে আসলে কোনো সন্তানের পক্ষেই মানসিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব না। তাও আবার যখন নিজের জন্ম পরিচয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে তখন পৃথিবীর কোনো ভালোকেই ভালো মনে হয় না। পল্লবের অবস্থা এখন এমনই। কোনোকিছুতেই এখন তার মন বসে না। মাঝেমধ্যে মন চায় দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যায়। এই একটা বছর ধরে কী পরিমাণ যে মানসিক অস্থিরতার মাঝে প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে এটা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। যতই চেষ্টা করে সবকিছুতে স্বাভাবিক রিয়্যাক্ট করবে ততই যেন অস্বাভাবিক হয়ে যায় সে। এই কষ্ট সে কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না। কার কাছে বলে নিজেকে আরো ছোটো করবে! নিজের মায়ের দিকে তাকাতেও তার ঘৃণা হয় কিন্তু কী করবে মা তো! মাকে ছাড়া তার পরিচয়ই বা কী? মন চায় মায়ের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিন্তু সাহসে কুলোয় না একদমই। এই এক বছরে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে তার মায়ের থেকে সে। একসময় সে তার মায়ের চোখে হারাত অথচ তার মায়ের কোনো কথাই আর শুনতে মন চায় না। তাও শুনতে হয়! জোর করেই শুনতে হয়!

এতবছর ধরে যে বাবাকে সে নিজের বাবা মনে করে এসেছে সেই বাবার সাথে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই এটা সে কী করে মেনে নিবে নিজেই বোঝে না। তার জন্মের ইতিহাসটাই সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় তার জীবনে। এর মাঝে নতুন করে প্যারা যোগ হয়েছে জয়ীতা।

পল্লব বুঝে জয়ীতার কোনো দোষ নেই। তবুও কেনো যেনো জয়ীতাকে আর আগের মতো ভালো লাগে না তার। মেয়েটাকে এতবার নিষেধ করল তার জীবনের সাথে না জড়াতে কিন্তু শুনলে তো! এখন ভোগো!
জেনে বুঝেই নিজের জীবনটাকে এই নরকের মাঝে টেনে নিয়ে এসেছে। এখন নিজের জীবন নিজেই সামলাও।

রাগে বিড়বিড় করতে করতে হসপিটালের বেডে শোয়া জয়ীতার পাশে এসে দাঁড়াল সে।

পল্লবের দিকে তাকাতে ঘৃণা হয় জয়ীর। ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। চোখের কোল ঘেষে পানি গড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। সে শুধু ভাবে, একটাবারের জন্যও কী মানুষটার মনে একফোঁটা মায়া হয় না?

ডাক্তার সন্ধ্যা রানী ভেতরে ঢুকলেন। নার্সকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন। পল্লবকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, কতবার বলেছি এই পাপ আমাকে দিয়ে আর করাস না। তোরা এ যুগের ছেলেমেয়ে। এত অসচেতন হলে কী করে হবে?

– আ’ম এক্সট্রিমলি সরি, আন্টি। কথা দিচ্ছি নেক্সট টাইম এমন ভুল আর হবে না।

– কিছুটা ধমকের সুরে ডাক্তার সন্ধ্যা বললেন, “নেক্সট টাইম এমন ভুল আর হবে না” এর মানে কী? নেক্সট টাইম আসলে আমি কেনো কেউই তোর জন্য কিছু করতে পারবে না। মার্ডার কেসের আসামি হব নাকি? এবার তো ওর এত খারাপ অবস্থা হয়েছিল, মেয়েটাকে বাঁচাতে যে পেরেছি এটাই ভাগ্য!
ওর অবস্থা দেখেছিস! পুরা চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। উপরওয়ালার কাছে থেকে অনেক হায়াত নিয়ে এসেছে, যে কারণে কিছু হয়নি। কৈ মাছের প্রাণ বলা যায় মেয়েটার। অতটুকুন জানের উপর আর কত সয়?তোর মা আমার বাল্যকালের বান্ধবী! তাই তাকে আমি না করতে পারিনি।
কিন্তু এরপরে আমার পক্ষে আর কিছুই সম্ভব না। আমি বুঝতে পারি না তোদের সমস্যা কোথায়? বড় বউ একটা বাচ্চার জন্য হাহাকার করছে আর ছোট বউ বাচ্চা কনসিভ করেছে আর সেই বাচ্চা তোরা নিচ্ছিস না। আমি বুঝি না লাইফ এনজয় করার কি আছে? বাচ্চা এসেছে তাকে পৃথিবীতে আসতে দে।

পল্লব মাথা নিচু করে চুপচাপ সবকিছু হজম করছে। তার সব রাগ এখন জয়ীতার উপর।

ওকে কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে। বেড রেস্ট মানে বেড রেস্ট! কমপ্লিটলি বেড রেস্ট। ওর দিকে খুব খেয়াল রাখবি আর আমি যেসব খাবার দাবার, মেডিসিন সাজেস্ট করছি সেভাবে ঠিকঠাক রুটিনমাফিক দিবি। কোনো ভুল ত্রুটি না হয় যেনো।

জয়ীতার বিপি চেক করে ডাক্তার রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ডাক্তার সন্ধ্যা বের হয়ে যাবার পরে পল্লব ধমকের সুরে জয়িতাকে বলল, সন্ধ্যা আন্টি কি বলল বুঝেছ নিশ্চয়ই? দু’দিন যদি বাঁচতে চাও তাহলে সাবধানে চলবে। মাসান্তে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য আমার সাথে তোমার সংসার করার প্রয়োজন নেই। যদি বুঝে শুনে চলতে পারো তাহলে আমার সাথে থাকো, নইলে না। এখনো সময় আছে যা লাগবে নিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় হতে পারো। আমি একবারের জন্যও তোমাকে প্রশ্ন করব না যে কেন যাচ্ছো কী নিয়ে যাচ্ছো! তোমার লাইফ যাতে ফুললি সিকিউরড থাকে আমি সেই ব্যবস্থা করে দেব। এই সমস্ত সস্তা সেন্টিমেন্ট, ভালোবাসা, সংসার, স্বামী, স্ত্রী ডায়লগ বাজি বাদ দিয়ে নিজের জীবনটাকে নিয়ে ভাবতে শেখো। আমার সাথে থাকলে এই এক বছরের যেভাবে থেকেছো এর থেকে বরং আরো খারাপ হবে ভালো কিছুই পাবে না।

পল্লবের কথাগুলি শুনে জয়ীতার বুকের ভেতর দুমড়ে-মুচড়ে যেন কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে যায়। মানুষ এত পরিবর্তিত কী করে হয়? এই মানুষকে তো সে ভালবাসেনি। মানুষ চিনতে তার এত ভুল হবে একথা সে যেন আজও বিশ্বাস করতে পারে না।

কি কথা বলছো না যে! তোমার মাকে আর ভাইকে খবর দাও তোমাকে এসে নিয়ে যাক। তোমার যখন যা প্রয়োজন হবে তাই পাবে। ওখানে থাকলে তুমি ভালো থাকবে। তুমি যেমন ভালো থাকবে আমিও ভালো থাকব!

শেষের কথাগুলো বলার সময় পল্লবের গলাটা যেন কেঁপে উঠল, ব্যাপারটা এড়াল না জয়ীতার কাছে।

– জয়িতা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ভালো থাকার জন্যই তোমার সাথী হয়েছিলাম। তোমাকে ছেড়ে যাবার জন্য তো এত যুদ্ধ করে তোমার হাতটা ধরিনি। তুমি তো আমাকে গোপনে বিয়ে করে গোপনেই ডিভোর্স দিয়ে দিতে চেয়েছিলে!
একটা সত্য কথা বলবে পল্লব!
হঠাৎ করে কী এমন হলো যে তুমি একদম বদলে গেলে? তোমার কাছে আমি কিছু চাই না। তুমি শুধু আমার সেই আগের পল্লব হয়ে যাও! তুমি একবার মিষ্টি করে ভালোবেসে বলো আমাকে তোমার জীবন থেকে চলে যেতে আমি সব অধিকার ছেড়ে তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাব। কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো জয়ীতার। আর কোনো কথা বলতে পারল না সে।

জয়ীতা অনেক কষ্ট করে পল্লবের দিকে পাশ ফিরল। ফিরে দেখে তার পেছনে কেউই নেই। পুরো কেবিনে সে একা।
কষ্টে বুকটা আরো ভারী হয়ে এলো। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু অবহেলায় গড়িয়ে পড়ে মাথার বালিশটাকে ভিজিয়ে ফেলল।

পরপর দুইবার ফোন বাজার পরে ফোনটা তুলল পল্লব। হসপিটালের করিডোরে এইসময় তেমন মানুষজন নেই। পল্লব ফোনটা রিসিভ করবে কিনা ভাবছে।

স্ক্রিনে ভাসছে….. খালেক মল্লিক ইজ কলিং……

কিছু সময় অনেককিছু ভেবে সে ফোনটা রিসিভ করল।

ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই মোটা ভরাট কণ্ঠ।

– কিরে বাপ! ফোন ধরছিস না কেনো? এত অচ্ছুৎ হয়ে গেলাম তোদের কাছে!

পল্লব কী বলবে বুঝতে পারছে না। কি বলে তাকে সম্বোধন করবে সেটাও তার মুখে আসছে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল, না, না, বাবা। এসব কি বলছ! একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই রিসিভ করতে দেরি হলো।

– তাই বলে মাসের-পর-মাস তুই ব্যাস্ত থাকিস? লাস্ট আমার সাথে কবে কথা বলেছিস তোর মনে আছে?

– না মানে….!

– বুঝেছি মায়ের দীক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছো তোমরা দু ভাই আজকাল। কল্লোল না হয় সারাজীবনে একটু স্বার্থপর টাইপের কিন্তু তুই তো এমন ছিলি না। আর কেউ আমাকে মনে না করলেও সপ্তাহান্তে তুই একবার আমাকে কল দিতি। বুড়ো বাপটা মরে গেছি না বেঁচে আছি এতোটুকু খবর তো নিতে পারিস। এই একটা বছর ধরে তুই যেন কেমন বদলে গেলি রে, বাবা।

– আমি বদলাইনি, বাবা! আমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকি। তুমি কি আমাকে জরুরী কিছু বলবে না হলে আমি ফোনটা রাখতে চাচ্ছি। পরে কথা বলব তোমার সাথে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পল্লবের বাবা বলল, নারে বাবা কি আর বলব! তোরা কেমন আছিস সবাই সেটা জানার জন্য ফোন দিয়েছিলাম, তা ছাড়া শুনলাম জয়ী মা নাকি খুব অসুস্থ! মেয়েটাকে সেই যে একবার দেখলাম আর জীবনে দেখা হলো না। মাঝে মাঝে কথা হয় ওর সাথে। কতবার বললাম আমার কাছে একটু নিয়ে আয়। তোরা আসলি না! বৌমার খেয়াল রাখিস, খুব লক্ষ্মী মেয়ে! তোরা আমার নিজের ছেলে হওয়ার পরেও আমার খোঁজ খবর নিস না। এই মেয়েটাই একমাত্র আমার খোঁজ খবর নেয়!
জয়ী মা সুস্থ হলে একবার আয় না ওকে নিয়ে আমার কাছে। তোর মায়ের মত বিশাল রাজত্বের মালিক না হলেও এই মফস্বল এলাকাতে তোর বাবারও কিন্তু কম নেই। কবে না কবে মরে যাই আয় সবকিছু একটু দেখে যা। আমার মরার পরে এগুলো তো তোরাই পাবি নাকি। বেঁচে থাকতে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে রেখে যাই। জয়ী মায়ের নাম্বারে কল দিয়ে বন্ধ পেলাম। একটু দিবি ওকে?

– বাবা, আমি এখন দূরে আছি। পরে কথা বলো।
আচ্ছা, বাবা। সময় পেলে আসব আমরা। রাখি তাইলে।

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো পল্লব।

ঝাপসা চোখে খালেক মল্লিক লেখা নামটাকে আবার এডিট করে টাইপ করল, বাবা!

কিছুদিন আগে ‘বাবা’ শব্দটাকে মুছে খালেক মল্লিক লিখেছিল।
সে চেয়েছিল বাবা নামটাকে তার জীবন থেকে মুছে দিতে। কিন্তু এই লোকটার সাথে কথা বলার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, পল্লব ।

এই মানুষটাই তার বাবা। এই মানুষটাকেই সে বাবা বলে জানে, বাবা বলে জানতে চায় সারাজীবন।

গলাটা বুজে আসে তার!

খালেক সাহেব সারাজীবন ব্যবসায় করেছেন ঢাকাতে। পল্লবের জন্মের কিছু আগে থেকেই সাজেদার সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। ভেবেছিল পল্লবের জন্মের পর সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ তো দূরের কথা আরো বিপর্যস্ত হয় তার সাংসারিক জীবন। শেষে বাধ্য হয়ে আলাদা থাকতে শুরু করে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে চলে আসেন বাপ দাদার ভিটেয়। বাগেরহাটের অদূরেই বিশাল বাড়ি তার। বেশ জমাজমি আর সহায় সম্পত্তি পৈত্রিক সূত্রেই পেয়েছে। আর নিজেও অনেক কিছু করেছে। এই বুড়ো বয়সটা একাকী পার করছে। এত এত সম্পত্তির মাঝেও কোথাও সুখ নেই তার। সব থাকতেও নিঃস্বের মতো দিনযাপন করে । বাড়িতে কয়েকজন চাকর বাকর আছে। এদের নিয়েই দিন কাটে তার।
ছেলেদের দেখতে মন চাইলেও কখনো যাওয়া হয় না ঢাকাতে। সাজেদা তার সাথে ছেলেদের দেখা হোক এটা পছন্দ করে না। সাজেদার সাথে তার ডিভোর্স না হলেও সম্পর্কটা তার থেকেও খারাপ পর্যায়ের।

তাছাড়া ছেলেরাও মায়ের ছায়াতেই থাকতে চায়। থাকাটাই স্বাভাবিক। মায়ের বিশাল বিত্ত, বৈভব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা। এসবের বলয় ছেড়ে তারাও হয়ত বেরুতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। একবুক দীর্ঘশ্বাসকে পুঁজি করেই মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রতি রাতে ঘুমাতে যায় খালেক মল্লিক।

চলবে……

(ইন শা আল্লাহ, আগামীকাল বড় পর্ব দেবার চেষ্টা থাকবে, প্রিয় পাঠক।)

পর্ব-২

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/446986847083990/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here