সুখ নীড় পর্ব-৩৩

0
237

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩৩

একবার আদালতে, আরেককবার পাষাণ শাশুড়ির মন ভাঙ্গাতে তার দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে এখন ক্লান্ত জয়ীতা! আকাশের দিকে তাকিয়ে সে শুধু ভাবছে মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হলে সদ্য বিধবা এক মায়ের বুক থেকে তার তিন মাস বয়সী দুধের বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে পারে!

স্নেহ, ভালোবাসার নাম করে আযানকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বুঝতে পেরে সে যখন সন্তানকে কাছে পেতে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে তখন তাকেই বাড়িছাড়া করা হলো। হয়ত দু’বেলা দুমুঠো ভাতের জন্য সবকিছু মেনে নিয়ে সে ওখানে আশ্রয় পেতে পারত কিন্তু একই ছাদের নিচে থেকে সন্তানের কাছ থেকে দূরে থাকাটা একজন মা হয়ে কী করে সহ্য করবে?

মাঝেমাঝে মনে হয় সে হয়ত ভুলই করেছে ওদের সাথে যুদ্ধে যেয়ে। ওখানে থাকলে অনন্ত পক্ষে বাচ্চাটার মুখখানা তো দেখতে পেত! এখনতো সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। আদালত যে রায়ই দিক তার পক্ষে কখোনোই কি আদৌ সম্ভব ওই জেলখানা থেকে তার সন্তানকে উদ্ধার করা! মাথার উপরে কোন ঠাঁই নেই, হাতে পয়সা কড়ি নেই। ভবঘুরের মতো সে ঘুরছে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। পরিচিত অপরিচিত কার কাছে না গিয়েছে তার বাচ্চাকে ফেরত পাবার জন্য একটু সাহায্যের আশায়।

আজকে উকিলের কাছে কথা শুনে যতটুকু আশা ছিলো তাও ফুরোবার পথে। জয়ীতার কাছে কিছুই নেই। অর্থ-সম্পদ থাক দূরের কথা এমনকি তার সন্তানকে নিয়ে কোথাও মাথা গুজবে আপাতত সেই ঠাঁইটুকুও নেই । আদালতের কাছে সে কী বলবে? তার ছেলের নিরাপদ ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবেই একজন মা হিসেবে তাঁর অগ্রাধিকার থাকা স্বত্তেও সে হেরে যাবে। আসলেই আজ সে অনুভব করছে যার টাকা নেই এই পৃথিবীতে তার কিছুই নেই।

সুনিপুণ অভিনেত্রী সাজেদা চৌধুরী এসেছিলেন আজ আদালতে। বিচারকের সামনে সেকি ইনোসেন্ট ভাবটাই না দেখাল! সবার কাছে জয়ীতাকেই বরং অপরাধী করে রেখে গেল। আযান শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল বাচ্চা। তাকে প্রতিনিয়ত ডাক্তারের ফলোআপে রাখতে হচ্ছে। তার উপর বাচ্চাটাকে তার বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে সেই উপায়ও নেই। আজানকে বাঁচাতে হলে বাইরে থেকে দুধ কিনে খাওয়াতে হবে। সেটা কেনার পয়সাও জয়ীতার কাছে নেই। আদালত নিশ্চয়ই এতটা মূর্খ না যে একজন নিঃস্ব মায়ের কাছে তার সন্তানকে মরবার জন্য তুলে দেবে। তাছাড়া আদালতে জয়ীতাকে একজন মানসিক রোগী হিসেবে সাব্যস্ত করে ছেড়েছে তার শাশুড়ি।

আদালতে সে বুঝিয়ে দিয়েছে পল্লব কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি রেখে যায়নি যা আঁকড়ে ধরে জয়ীতা তার সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকবে। সে তার বংশের একমাত্র প্রদীপকে এভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে ঠেলে দিতে পারে না। তার নাতীকে সে যে কোনো মূল্যে তার কাছে রাখবেই।

বিচারকের সামনে সাজেদা চৌধুরী এমন ভান করেছেন যেন জয়ীতাকে সে বের করেই দেয়নি। জয়ী তার বাড়িতে থাকলে কোনো অসুবিধাই নেই বরং নিজেও চায় জয়ীতা তার বাড়িতেই থাকুক।
জয়ীতাই নাকি চায় না ও বাড়িতে থাকতে। কারণ জয়িতার মানসিক অবস্থা ভালো না। জয়ীতা যখন তখন বাইরে যায়, রাত-বিরাতে বাড়ি ফিরে, বাচ্চার দিকে কোনো খেয়াল না করে সারাদিনের সাথে ওর সাথে ফোনে গল্প করে আরো কত কি! এ নিয়ে তার শাশুড়ি বোঝাতে গেলে উলটো তাকে যাচ্ছেতাই বলে। সবকিছুই সে সহ্য করে যাচ্ছে তার মৃত ছেলে পল্লব আর তার নাতী আযানের কথা ভেবে। তারপরও এখনো যদি জয়ীতা এতকিছুর পরেও ও বাড়িতে ফিরতে চায় তার কোনো আপত্তি নেই কারণ সেও চায় না আযানকে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখতে। তবে হ্যাঁ, যেহেতু জয়ীতা একজন মানসিক রোগী তাই তার মানসিক অবস্থা পরিপূর্ণভাবে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আযান-কে তার কাছে দিতে চায় না । আদালত যদি চায়ও আর এতে যদি তার নাতীর কিছু হয় তবে আদালতকেই সে দায়ী করবে।

জয়ীতা আযানের পরিচয় পরিবর্তনের ব্যাপারে অভিযোগ তুললে এমনকি আযানের টিকা কার্ড আদালতে দেখিয়েও পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি। আদালতের সাফ সাফ জবাব জয়ীতা তার সন্তানকে নিতে হলে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে মানসিকভাবে সুস্থ এবং সে যথেষ্ঠ স্বচ্ছল তার সন্তানকে দেখভালের জন্য। তাহলেই ছেলেকে পাবে নয়ত আদালতকে আবেগ নয় বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জয়ীতা সত্যিই এবার অপারগ! কোথায় ভেবছিল স্বামী সন্তানকে নিয়ে একটুকরো সুখের নীড় রচনা করবে সেখানে সে তাদেরকে হারিয়ে পথে পথে ঘুরছে।

পার্কের বেঞ্চে বসে সে ভাবছে এই পৃথিবীতে তার মতো হতভাগী মনে হয় দ্বিতীয়টি আর নেই । ভাগ্যের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে আসা মেয়েটি আজ নিজের কাছেই যেন নিজে হেরে যাচ্ছে। মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে জয়ীতা।

তার শ্বশুর খালেক সাহেবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু উনি অস্ট্রেলিয়া থাকাতে সেটাও সম্ভব হয়নি। তার কাছে উনার যে নাম্বারটা ছিলো সেটাতে বারকয়েক কল করেও বন্ধ পেয়েছে। জয়ীতা তার শ্বশুরকে পল্লবের মৃত্যু সংবাদসহ তার সব দুরাবস্থার কথা জানিয়ে একটা মেসেজ করে রেখেছিল। যদি ভাগ্য সহায় হয় উনি যদি দেখে থাকেন, যদি কিছু হয় সেই আশায়। সপ্তাহদুই পেরিয়ে যাবার পরেও যখন তার কোন ফিরতি ম্যাসেজ পেল না তখন সে ছুটে গিয়েছিল বাগেরহাটে তার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখল খালেক সাহেবের বাড়িঘর তার দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। তার কাছে জানতে পেরেছে খালেক সাহেব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তাই হয়ত নাম্বার বন্ধ। তার সাথে যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যম জানতে চাইলে উনারা সেটা দিলেন না। আসলে জয়ীতার কাছে সবকিছু শুনে ওনারাও চান না খালেক সাহেব কোনোভাবে এগুলো জানতে পারুক বা সে দেশে আসুক। খালেক সাহেবের বড়ো বোনের সাথে জয়ীতার মাঝে মাঝে কথা হলেও তার সাথে যোগাযোগের রাস্তাও এখন নেই। পল্লবের সেই ফুফু মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। মারা যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত উনি ছেলেমেয়েদের অনুরোধ করে গিয়েছে যেন তার ভাইকে তারা কোনো অযত্ন না করে। মামাকে তাদের পরিবারে তাদের কাছেই রাখে। খালেক সাহেবের সব থেকেও নেই। দেশে একা একা থাকার চাইতে ভাগ্নে ভাগ্নীর কাছে থাকাটাকেই উনি ভালো মনে করেছেন।

খালেক সাহেবও বোনের কথা মেনে নিয়েছেন। তাছাড়া তার ভাগ্নে ভাগ্নীও তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। বোন মারা যাবার পর একবার দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলেও পরক্ষণেই আবার ভাগ্নে ভাগ্নীর অনুরোধে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তাছাড়া তার বয়সও হয়েছে। এই বয়সে একা একা থাকার চাইতে এদের কাছে থাকাটাকেই সে নিরাপদ মনে করছে। অষ্ট্রেলিয়া আসার পরেও বেশ কিছুদিন নিয়ম করে কথা হতো পল্লব আর জয়ীতার সাথে। কিন্তু ধীরেধীরে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। আসলে জয়ীতা আর পল্লবের নিজেদের নানান ঝামেলার কারণে ওনার সাথে যোগাযোগ কম হতো। খালেক সাহেবও অভিমান করে নিজে থেকে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। ধীরেধীরে একসময় যোগাযোগ একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়। বাগেরহাটের সব সম্পত্তি তার এক ফুফাতো ভাইকে দেখভালের দায়িত্বে দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত! অনেক তো সবার জন্য ভেবেছে এবার বাকী জীবনটা একটু নিজেকে নিয়ে ভাবতে চায় সে। তাছাড়া এই ভাগ্নে ভাগ্নী ছাড়া আপনজন তার আর আছেই বা কে?

জয়ীতার মা মেয়ের ভাগ্য মেনে নিয়ে তাকে গ্রামে ফিরিয়ে নিতে অনেক চেষ্টা করেও পারেন নি।
জয়ীতা কিছুতেই এসব মেনে নিতে পারছে না। পল্লবকে হারিয়ে এমনিতেই পাগলপ্রায় অবস্থা তার উপর এখন আবার ছেলেও তার থেকে দূরে চলে গেলে সে কীভাবে বাঁচবে? সিদ্ধান্ত নিলো সুইসাইড করবে। চারদিকে যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই অন্ধকার। আবার ভাবল এমন মহাপাপী হয়ে মরার চাইতে তার শাশুড়ির হাত পা ধরে ওই বাড়িতে যদি ঝি চাকরানী হয়েও থাকা যেত তাও তো ছেলেটাকে দেখতে পেত। কিন্তু মনে হয় না হাত পা ধরেও ঐবাড়িতে ঢোকা যাবে। আর ঢুকতে পারলেও তাকে পাগল বলে রুমবন্দী হয়ে কাটাতে হবে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল সেদিকে হুঁশ নেই জয়ীতার। হঠাৎ মনে হলো তার এখন ওঠা দরকার। চারপাশে আজেবাজে মানুষের ভিড় বেড়ে গেছে। তাছাড়া আকাশটা প্রচণ্ড মেঘলা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ব্যাগে একটা একশ টাকার নোট ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যেখানেই যাক গন্তব্যে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। ক’দিন ধরে এক বান্ধবীর বাসায় আছে। তুহিন বেশ কয়েকবার তাকে সাহায্য করতে চাইলেও সে তুহিনের সাহায্য ফিরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া তুহিনের বড়ো ভাই শাহিন চায় না সে তাদের কাছে কোনো সাহায্যের জন্য যাক। উনি স্পষ্ট করে জয়ীতাকে নিষেধ করেছে তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখতে। তারা অযথা আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না সাজেদা চৌধুরীর সাথে।
জয়ীতারও ভীষণ লজ্জা লাগছে। আর কত নেওয়া যায় একজন মানুষের কাছ থেকে? নিঃস্বার্থভাবে তার জন্য অনেক তো করেছে তুহিন। সেই মানুষটাকে অযথা ঝামেলা ফেলার কোনো মানে হয় না। তাই সে তুহিনকে এভয়েড করে চলছে আজকাল। ফোনে কথা বলতে হবে ভেবে ফোন নাম্বারটাও ব্লক করে রেখেছে।

রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাত থেকে মাত্র রাস্তায় নেমেছে অমনি ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। এই মুহূর্তে কাকভেজা দেওয়া ছাড়া যাওয়ার কোন জায়গাও সে দেখতে পেল না। অগত্যা বাধ্য হয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক সে সময় একটা গাড়ী এসে তার পাশে সজোরে ব্রেক কষল। জয়ীতা কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখলো দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং তুহিন।

তুহিনকে দেখে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তুহিনের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল দিন বিশেক আগে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই তুহিন বলল, ‘ দ্রুত গাড়িতে ওঠো। তুমি ভিজে যাচ্ছ। ‘

জয়ীতা প্রথমে একটু গাঁইগুই করলেও তুহিনের জোরাজুরিতে আর না করতে পারল না। তাছাড়া এই মুহুর্তে তার খুব কোনো আপনজনের প্রয়োজন ছিল। বুক চিরে কান্না বেরিয়ে আসছিল। নিজের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এটা তার হাঁটাচলার গতিবিধি দেখে নিজেই টের পেয়েছে।

তুহিন টিস্যু বক্সটা এগিয়ে দিলো। নিঃশব্দে বক্স থেকে দু’টো টিস্যু নিলো জয়ীতা।
মিনিট দু’য়েক গাড়ির ভেতর একেবারেই নীরবতা।
এরপর তুহিনই শুরু করল৷

– কোথায় থাকো তুমি? কোথায় না খুঁজেছি তোমাকে। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছ। আমি সবকিছু শুনেছি তোমার উকিলের কাছে। কী করতে চাচ্ছ এখন?

জয়ীতার দিক থেকে কোন উত্তর না আসায় সে আবার বলল, তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছ না? মানছি আমি অন্যায় করেছি। তোমার বিপদের সময় তোমার পাশে থাকতে পারিনি। ভাইয়া তোমাকে বেশি বেশি বলেছে। কিন্তু তুমি একবার ভেবে দেখো আমাদের কাছে ঠিক মনে না হলেও ভাইয়া তার জায়গায় ঠিক। খালামণির সাথে তো আমরা পারব না। তাছাড়া ওনার এখানে রাইট বেশি। আমাদের করারই বা কী আছে?

– ঠিক বলেছ। তোমার ভাইয়াও ঠিক এটা আমি অস্বীকার তো করছি না। আসলে যার টাকা নেই তার কিছু নেই। আজ যদি আমার টাকা থাকত তাহলে আমার শাশুড়ির ক্ষমতা একজন মায়ের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হতো৷ অথচ আজ আমি নিঃস্ব বলে মা হয়েও আমার কোনো অধিকার নেই। এটাকেই বলে জীবনের রঙ্গমঞ্চ। জীবন আমাকে অনেককিছুই দেখাল। বলে মৃদু হেসে ফেলল জয়ীতা।

এই হাসির অর্থ কতটা নিগুঢ়, কতটা বেদনার সেটা বুঝতে বাকী রইল না তুহিনের।

– এরপর আরো কয়েক মিনিট নিরবতার পরে তুহিন বলে উঠল, একটা কাজই এখন করা যেতে পারে, জয়ীতা। তোমার ছেলেকে তোমার বুকে ফিরিয়ে দিতে আমি আমার সাধ্যের সবটুকু করতে চাই।

– জয়ীতা আবারো একই ভঙ্গিতে হেসে বলল, কী করবে তুমি? তোমার খালার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করবে?

– নাহ, তোমাকে বিয়ে করব।

– হোয়াট? বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, জয়ী।

– অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এভাবে তাকিও না। আমি তোমার উকিলের সাথেও কথা বলে এসেছি। এটাই এখন একমাত্র সমাধান। উকিল বলেছে তুমি যদি আযানের বেড়ে ওঠার জন্য একটা ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারো তাহলে আদালত তোমার পক্ষে যাবে। তাছাড়া তুমি যে মেন্টাল পেশেন্ট না তার পক্ষেও একটা ভালো সাপোর্ট পাবে।

-আমি মেন্টাল পেশেন্ট হই বা না হই সেটা পরের ব্যাপার। তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি? মাথা ঠিক আছে?

– একদম।

– তুমি ভাবলে কী করে আমি বিয়েতে রাজী হবো।

– ভেবেছি এজন্য যে তুমি তোমার সন্তানকে কাছে পেতে সব করতে পারবে।

– হ্যা, সব করতে পারব। আমাকে মরতে বললে সেটাও আমি পারব।

– তাহলে বিয়েতে আপত্তি কোথায়?

– কারণ আমি অন্য আরেকজনের বউ।

– সে তো বেঁচে নেই। তাছাড়া শরীয়তেও কোনো বাধা নেই।

– তাতে কী হলো। আমি তো তাকে এখনো ভালোবাসি। স্বামী বলেই মানি।

– বাসো। আমি তো নিষেধ করছি না ভালোবাসতে। এটা কোনো যুক্তি হলো না।

– তুমি আমার থেকে বয়সে চার বছরের ছোটো। এমনটা ভাবলে কী করে?

– এটাও কোনো যুক্তি হলো না। এসব বয়সে বড়ো ছোটো কোনো ফ্যাক্ট না।

– তোমার পরিবারের কথা ভেবেছ? তারা কখনো মানবে?

– সেটা তাদের ব্যাপার! আমি স্বাধীন মানুষ। আমার ব্যাক্তিগত চাওয়া পাওয়া থাকতেই পারে। এটাও তোমার কোনো স্ট্রং লজিক না।

– তুহিনের কণ্ঠের দৃঢ়তা শুনে জয়ীতা বলল, তুমি কি আমাকে সত্যিই বিয়ে করতে চাও?

– তাই তো বললাম। শুনতে পাওনি?

– আমাকে ভালোবাসো?

তুহিন এবার একটু হোঁচট খেলো যেন। কথার খেই হারাতে যাবে যাবে তখনই মনে হলো সত্যিটা বলা উচিত। আর সুযোগ নাও আসতে পারে।

– হুম বাসি।

– জয়ীতা অবাক হলো না। সে বলল, কতটা?

– যতটা বাসলে একজন মানুষ আরেকজনের সাথে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিতে পারে।

– জয়িতা এবার অবাক হয়ে তুহিনের চোখের দিকে চোখ রেখে বলল, কবে থেকে ভালোবাসো আমাকে?

– প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন থেকেই

– জয়ী এবার ভীষণ অবাক হয়ে বলল, মানে?

– বললামই তো!

– মানে তোমার ভাস্তি নেহাকে পড়াতাম যখন তখন থেকে?

– হুম।

– তখন তো…

– তখন বলিনি কেন তাই ভাবছ? বলিনি কারণ তোমাকে যে ভালোবাসি সেটা বোঝার আগেই হুট করে তুমি নেহাকে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছিলে।

– তবে যে বললে তখন থেকেই ভালোবাসো?

– তোমাকে প্রথম দিন দেখেই খুব ভালো লেগেছিল। সেই ভালো লাগা যে ভালোবাসা ছিল সেটা বোঝার আগেই তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। এরপর অনেক খুঁজেছি তোমাকে কিন্তু যতদিনে তোমার দেখা পেয়েছিলাম ততদিনে তুমি পল্লব ভাইয়ের বউ। পল্লব ভাইয়ের কাছে অধিকার পাওয়ার জন্য যখন তুমি মিডিয়া ডেকেছিলে সেদিনই তোমাকে খুঁজে পাই। কষ্টটা ভুলতে বেশ সময় লেগেছিল। পরে আমি সম্পর্কে জড়িয়ে পরি মোহনার সাথে। বাকীটা তো জানোই।

– তবে যে বললে ভালোবাসি?

– ভুলে গেলেও সেই থেকেই তোমার জন্য মনের কোনো একটা কোণে এক টুকরো সফট পাওয়ার কাজ করত।

– তাহলে আমার জন্য এতদিন যা কিছু করেছ সেগুলি সব ছিল তোমার সেই সফট পাওয়ারের কারিশমা?

তুহিন নিশ্চুপ!

– তাহলে কি বলব পল্লবের এভাবে চলে যাওয়াতে তোমার খুব লাভ হয়েছে? নাকি বলব এই চলে যাওয়ার পেছনে তোমারও হাত আছে!

– ছিঃ! এতটা নীচ ভাবতে পারলে আমাকে? তোমাকে আমি ভালোবাসি তাই বলে অসম্মান করিনি কোনোদিন। পল্লব ভাইকেও আমি সম্মান করতাম। তোমাকে পল্লব ভাইয়ের পাশে সুখী দেখে আমি কখনোই হীনমন্যতায় ভুগিনি বরং খুশি হয়েছি। তোমাকে সুখী দেখতে আমি নিজে পল্লব ভাইয়ের জন্য ভাইয়ার কাছে রিকোয়েস্ট করেছি তার একটা ভালো জবের জন্য৷ এমন চিন্তা কখনো মাথায়ও আনিনি। তোমাকে পছন্দ করতাম তার মানে এই না যে তোমাকে পেতে চাইতাম। এতটুকু চিনলে এতদিনে আমাকে? আমি এখনো তোমাকে পেতে চাই না। আমি চাই না তুমি পল্লব ভাইকে ভুলে আমাকে নিয়ে ভাবো। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই। তোমার আযানকে তোমার বুকে ফিরিয়ে দিতে চাই। আমার চাওয়ার মাঝে কোনো অন্যায় থাকলে আমাকে ক্ষমা করো। আর এতদিনে আমার আচরণের কোনোকিছুতেও যদি তোমার মনে হয় যে আমি ভুল ছিলাম, আমি অসংযত ছিলাম তাহলেও ক্ষমা করো তাও এমন অপবাদ দিও না, প্লিজ। আমি তোমাকে একজন বন্ধু ভেবে পাশে থেকেছি, পাশে থাকতে চাই এর বেশি কিছুই না।

জয়ীতা তুহিনের কথা শুনে কিছুটা লজ্জিত হলো এই ভেবে যে মানুষটা তাকে এতদিন এতভাবে সাপোর্ট দিলো তাকেই কিনা সে সন্দেহ করে বসল। তুহিন না থাকলে সে এতটা পথ কীভাবে আসত সেটাই তো সে জানে না। ওই বিপদসংকুল দিনগুলিতে যে মানুষটা তাকে সবসময় সাহস যুগিয়েছে সবভাবে সাহায্য করেছে তাকেই কিনা! যে আযানের জন্য তার শাশুড়ির সাথে এত যুদ্ধ তুহিন না থাকলে সেই আযানকে বাঁচানো যেত না। তুহিন তো খারাপ কিছু চাচ্ছে না।

– জয়ীতা আস্তে করে তুহিনকে বলল, আমি নামব। সাইড করে নামিয়ে দিও।

তুহিন ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে মনে মনে। জয়ীতার ভেতরে কী চলছে সে জানে না। জয়ীতাকে এভাবে কষ্ট করতে সে দেখতে পারছে না।

তুহিন বলল, কোথায় যাবে বলো নামিয়ে দিয়ে আসি। রাত্তির বেলা বৃষ্টির মধ্যে কোথায় নামবে! গাড়ি পাবে না। পরে ঝামেলায় পড়বে।

জয়ীতা বুঝতে পারল এই নাছোড়বান্দা তাকে গন্তব্যে না ছেড়ে ক্ষান্ত দিবে না।

সে বলল, মিরপুর দশে যাব।

আচ্ছা। তুহিন আর জিজ্ঞেস করল না ওখানে কার কাছে যাবে জয়ী।

বেশ কিছু সময় নিরবতার পর তুহিন বলল, ফাইনাল হিয়ারিং তো নেক্সট উইকে, তাই না?

– হুম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হিয়ারিং দিয়ে আর কী হবে? যা হবার বোঝাই তো যাচ্ছে। সন্তান জন্ম দিলেই অধিকার খাটানো যায় না। এই পৃথিবীতে যার টাকা নেই তার মাতৃত্বের কোনো দাম নেই।

– তুহিন হাল না ছেড়ে বলল, এখনো বেশ সময় আছে। এক সপ্তাহ মানে সাত দিন। প্রতিটি দিন ছিয়াশি হাজার চারশত সেকেন্ড পাবে ভাববার জন্য। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে আশা করছি। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের চাইতে বড়ো মনে হয় না এই পৃথিবীতে আর কিছু আছে। যা করবে আযানের ভালোর জন্যই করবে। শুধু এইটুকু মনে রেখো আমি এই নশ্বর জীবনে যতক্ষণ পর্যন্ত আছি তোমার পাশে আছি। তবে তোমার উত্তর হ্যা হোক সেই প্রত্যাশা রইল।

– যদি না হয়?

– তখনো পাশে পাবে। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে তোমার পাশে থাকব কথা দিলাম।

জয়ীতা তুহিনের দিকে তাকিয়ে দ্রুতই চোখ নামিয়ে নিলো।

চলবে…..

(বাচ্চাদের এক্সাম শেষ হলো গতকাল। তাই আশা করছি আগামীকাল গল্পের শেষ পর্ব পাবেন, ইনশাআল্লাহ। খানিকটা লিখেছি ইতিমধ্যে।
আমার গল্পজীবনের সবচেয়ে দেরী করে করে পোস্ট করা গল্প এটা। কয়েকমাস লাগিয়ে দিয়েছি এই ক’টা পর্ব পোস্ট করতে। নিজেই খুউব লজ্জিত। আপনারা খুব বিনয়ী বলেই হয়ত এখনো পাশে আছেন। আশা করছি শেষ পর্বেও পাব আপনাদের৷)

পর্ব- ৩২

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/539837707798903/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here