সুখ নীড় পর্ব-৩৪ শেষ পর্ব

0
462

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩৪

জয়ীতা এই দু’দিন ধরে শুধু ভাবছে সত্যিই কি তার পক্ষে পল্লবকে ভুলে নতুন করে তুহিনের সাথে সংসার করা সম্ভব! তুহিনের বলা কথাগুলি একটার পর একটা কানে বাজছে। এদিকে আদালতের সময় ঘনিয়ে এসেছে। যদিও আদালতের রায় কী হবে সেটা সে আন্দাজ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
একজন মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করার ক্ষমতা
এই পৃথিবীতে কারোরই নেই। কিন্তু যে মায়ের সন্তানকে লালন পালনের সামর্থ্য নেই সেই মায়ের হাতে কী করে একটা বাচ্চার ভবিষ্যৎ এর দায়িত্ব ছেড়ে দিবে বিজ্ঞজনেরা। আজকাল সবকিছু টাকায় মাপা যায়। মায়ের ভালোবাসাও ফিকে হয়ে যায় টাকার কাছে। হয়ত তার উপর দয়া করে সর্বোচ্চ এতটুকু রহম করা হবে যে তারও সন্তানের সাথে ও বাড়িতে থাকবার অনুমতিটুকু মিলবে!

কিন্তু ও বাড়িতে যাবার কোনো ইচ্ছেই নেই তার। ওখানে থাকলেও তাকে তার সন্তানের থেকে তাকে দূরে রাখা হবে। তাই যে কোনো মূল্যে আযানকে ও বাড়ি থেকে বের করতে চায় জয়ী।

অনেক অনেক ভাবনার জালে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যখন খুব ক্লান্ত ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই দেখল তার শাশুড়ির বাসার দারোয়ান আবুল চাচা। এই মানুষটা জয়ীতাকে খুব স্নেহ করে। আবুল চাচাকে জয়ীতা খুব শ্রদ্ধা করে। আবুল চাচার কোলে পিঠে চড়েই মানুষ হয়েছে পল্লব। পল্লবের সাথেও তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আবুল চাচা সেই যে ছোটোবেলা এ বাড়িতে এসেছেন আর এখন বয়স ষাট পেরিয়েছে। এখানেই জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন। খুবই সৎ একজন মানুষ।

জয়ীতাকে যেদিন বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল সেদিন সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেছিল, ‘ আমি তো আছি মা। আপনে ভাববেন না। পল্লব বাবাজিরে যেমনে কোলেপিঠে কইরা মানুষ করছি, বাবাজির ছেলেরেও আমি দেইখা রাখব!”
আপনে আমার নাম্বার লইয়া যান। যহন খুশি কল দিয়া বাবুর খোঁজখবর লইবেন। কেউ কিচ্ছু টের পাইব না। ‘

আবুল চাচার নাম্বারটা স্ক্রিনে ভাসতে দেখে জয়ীর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। ভয় পেল তার বাবুর কিছু হয়নি তো? নিশ্চয়ই আযান ভালো নেই। আবুল চাচ নইলে তাকে ফোন দিতে যাবে কেন?

ভয়ে ভয়ে ফোনটা রিসিভ করে জয়ী।

– হ্যা….হ্যালো চাচা, আসসালামু আলাইকুম।

– ওয়ালাইকুম আসসালাম, মা! কেমন আছেন আপনে?

– যেমন আল্লাহ রাখে বোঝেনই তো। কী খবর চাচা? আমার বাবু ভালো আছে তো?

–হ্যা, মা। বাবু ভালো আছে।
আপনি এখন কই আছেন? ঢাকায় আছেন নাকি ঢাকার বাইরে?

আবুল চাচার গলার স্বরে কেমন যেন একটা পরিবর্তন মনে হলো জয়ীর কাছে। কিন্তু ব্যাপারটা কী এটা সে বুঝতে পারছে না। কেমন যেন একটা উচ্ছ্বাস ভাব।

– না, না চাচা। ঢাকাতেই আছি। কী খবর বলেন তো?

– একটু বাসায় আসতে পারবেন?

– বাসায় মানে আপনাদের ওখানে?

– হ্যা মা। আপনি একটু দ্রুতই চইলা আসেন।

– কী হয়েছে চাচা? সত্যি বলেন তো। আযান ভালো আছে তো?

– আমি কি আপনার সাথে মিথ্যা বলতেছি? আযান বাবু ভালো আছে। আপনি আগে আসেন। আসলেই দেখতে পারবেন। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

– সারপ্রাইজ? আমার জন্য আবার কীসের সারপ্রাইজ চাচা? জীবন তো আমাকে একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়েই যাচ্ছে। আবার নতুন করে কীসের সারপ্রাইজ?

– আগে আসেনই না। ওইখানে বইসাই সব শুনবেন?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, চইলা আসেন।

– ওখানে আসব কিন্তু আমার শাশুড়ি?

– আরে না কিছু হবে না। আপনি আসেন তো আগে।

– আচ্ছা চাচা, আমি আসছি তাহলে।

আবুল চাচার এমন জরুরী তলবের কিছুই বুঝতে পারছে না জয়ীতা। ভালো কিছু নাকি মন্দ এটা সে জানে না। তবে ভালো কিছু যে তার জন্য অপেক্ষা করার দিন আর নেই এটা সে জানে। কিন্তু আবুল চাচার কণ্ঠস্বরে আবার সেটা মনে হয়নি। জয়ীতা কিছুই বুঝতে পারছে না। খুব ভয় হচ্ছে। আবুল চাচা তাকে এভাবে সাসপেনশনে কেন রাখল এটাই সে বুঝতে পারছে না। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সে পৌঁছে গেল। বাড়ির দরজার দিকে যতই এগুচ্ছে ততই তার বুকের মধ্যে ধুকপুক বেড়েই চলছে। গেটের কাছাকাছি এসে তার মনে হলো ভেতর থেকে কেমন একটা শোরগোলের আওয়াজ আসছে। কী হতে পারে? বাড়িতে কোনো বিপদ হয়নি তো? সবকিছু ঠিক আছে তো? যা ঘটে ঘটুক! এবাড়িতে কোন অঘটন ঘটলে তার কিছু এসে যায় না সে শুধু তার সন্তানকে নিয়ে ভাবছে। তার আযান ভালো আছে তো?

গেটে আবুল চাচার দেখাও মিলল না। সরাসরি বাসায় ঢোকার সাহস হলো না তাই উনাকে ফোন দিলো। কিন্তু আবুল চাচার ফোন ধরার নাম নেই। সে ভাবল, আচ্ছা লোক তো! তাকে আসতে বলে নিজেই গায়েব। কতবার ফোন দিচ্ছে ফোন পর্যন্ত ধরছে না কেটেও দিচ্ছে না।
লোকটা গেল কোথায়?

যতই সামনে এগুচ্ছে আর ভাবছে কী হয়েছে বাসার ভিতর? একবার ভাবে সামনের দিকে যাবে আবার ভাবে এখান থেকে পিছু ফিরে যাবে। কিন্তু তার আযান ভালো আছে তো? চাচাতো বলল আযানের কিছু হয়নি। এতদুর পর্যন্ত যখন এসেছে গুটিগুটি পায়ে সামনে এগুতে লাগল। যা হওয়ার হবে। তার শাশুড়ি তাকে দেখে দেখুক। অন্ততপক্ষে একবার আযানকে চোখের দেখা তো করা হবে। হয়ত তার জন্য এটা সহজ হবে না কিন্তু আযানকে না দেখে যাবে না।

বাড়ির যত ভেতরের দিকে যাচ্ছে ততই গুনগুন আওয়াজটা বাড়ছে। বাড়ির ভিতরে দেখল পরিচিত-অপরিচিত বেশকিছু মানুষ। সবাই এক জায়গায় জমায়েত করে আছে। তাকে দেখে গুনগুন শব্দ হঠাৎ করে কমে গেল। সবাই শুধু তার দিকে তাকাচ্ছে যেন এই প্রথম তাকে সবাই দেখছে। জয়ীতা কিছুই বুঝতে পারছে না, কী হচ্ছে এসব?

তার পায়ের গতি ধীর হয়ে এল। সবাই তার দিকে এভাবে হা হয়ে তাকিয়ে আছে কেন? তার আযান ভালো আছে তো? বুকের মাঝের স্পন্দন দ্রুত বেড়ে চলছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি সে হার্টফেইল করবে।

হঠাৎ করে মনোবল শক্ত করে জয়ীতা কিছুকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুতপদে বাড়ির মূল দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ড্রইং রুমে বেশ বড় একটা জটলা। চারপাশে কয়েকজন পুলিশও আছে। জয়ীর চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। খুব দ্রুত এগিয়ে যেয়ে ভিড় ঠেলে মাঝখানে প্রবেশ করল।

ভিড়ের মাঝে প্রথমেই চোখ পড়ল তার শ্বশুর খালেক সাহেবের দিকে। রক্তবর্ণ একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে সাজেদা চৌধুরীর দিকে। খালেক সাহেবকে দেখে জয়ীতা খুশি হবে নাকি খুশিতে চিৎকার দিবে কিছুই বুঝতে পারছে না। পাথরের মূর্তির মতো হা হয়ে তাকিয়ে আছে আশেপাশে কোনো দিকে আর চোখ নেই।

এত শোরগোলের মাঝে হঠাৎ জয়ীতার কানে এল একটা খুব পরিচিত সেই স্বর….. জয়ী….!!

শব্দটা এতটাই তীক্ষ্ণ যে এত এত শোরগোলের মাঝেও তার কানের পর্দা ভেদ করে সজোরে ভেতরে প্রবেশ করে। এতক্ষণের জয়ীতার হুশ ফিরে। শব্দকে লক্ষ্য করে তাকিয়ে যা দেখল তাতে সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।

এ সে কাকে দেখছে? সে স্বপ্ন দেখছে না তো? সেকি সত্যিই জেগে আছে নাকি ঘুমের ঘোরে এসব দেখছে?
হৃদপিণ্ডের ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ আওয়াজে তার নিজের কানই এখন বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এসব কী হচ্ছে তার সাথে?

আবারো সেই স্বর তাকে ডেকে উঠে, জয়ী…. এসেছ?

উপস্থিত সবার চোখ জয়ীতার দিকে। জয়ীতা নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

সে শব্দকে লক্ষ্য করে সামনে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। ছলছল চোখজোড়া দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, প……..ল্……..ল……ব?

হুইলচেয়ারে বসা পল্লব এবার নিজেকে সামলাতে পারল না আর। দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে যেয়ে চেয়ার থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। জয়ীতা খপ করে ধরে ফেলল পল্লবের হাত।

কয়েক মিনিট চারপাশে একদম নিরব। মুহূর্তেই দু’জোড়া চোখের নোনাজল সংক্রামিত হতে থাকে চারপাশে সবার মাঝে।

জয়ীতা পল্লবকে শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে, তুমি বেঁচে আছ, পল্লব? সবাই যে বলল তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছ? সবাই তাহলে আমাকে আবারো ধোকা দিয়েছে? এতবড়ো ধোকা?

পল্লব জয়ীতার মাথাটা টেনে তুলে তার চোখের সামনে।
জয়ীতার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, আমাকে চিনতে পেরেছ তুমি? আমি তো ভেবেছি আমাকে চিনবেই না। যে বিভৎস রকমের হয়েছে আমার চেহারা! আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই তো চিনি না।

সত্যিই পল্লবের মুখায়ব দেখে বোঝাই কষ্টকর। পুরো মুখে কয়েকটা সেলাইয়ের দাগ একদম দগদগে হয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে কাঠ। কঙ্কালসার একটা দেহ। একটা হাত নাড়াতে পারলেও আরেকটা হাত কিছুটা বাঁকামতো হয়ে আছে। তবে দুই হাতই সে নাড়াতে পারে।

খালেক সাহেব এগিয়ে এসে পাশে বসল জয়ীতা আর পল্লবের।

জয়ীতার মুখখানা তুলে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্না করে সে বলে ওঠে, ” আমাকে মাফ করে দাও মা। তোমার এই দুঃসময়ে এই হতভাগ্য বাবা কিছুই করতে পারেনি। তোমার উপর দিয়ে এত এত ঝড় বয়ে গেছে আর আমি কিনা… ছিঃ… ছিঃ…ছিঃ! আমি তো মরেও গেলেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। ছিঃ! নিজের সুখের জন্য দূরদেশে গিয়ে পড়ে ছিলাম। আর আমার সন্তানেরা এদিকে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ‘

জয়ীতা খালেক সাহেবের কান্না দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না আর। সে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল, কাঁদবেন না, বাবা। আপনার কোন দোষ নেই। যা হয়েছে সবই আমাদের ভাগ্য। কিন্তু বাবা হঠাৎ করে আপনি কোথা থেকে খবর পেলেন আর প….ল্ল…ব কী করে?

– সবই বলছি, মা। তুমি একটু শান্ত হও।

আসলে আমি তোমার মেসেজ পেয়েছি ক’দিন আগে। মেসেজ পেয়ে তোমার ফোনে কল দিয়েও পাইনি। পাগলের মতো দেশে ফেরার জন্য উদভ্রান্ত হয়ে পড়ি। ভাগ্নে ভাগ্নী আসতে দিতে চাচ্ছিল না। ওখানকার ওয়েদার ভালো না থাকায় ফ্লাইটও পাচ্ছিলাম না। সব ঘৃণাকে একপাশে ঠেলে রেখে তোমার পাষাণ শাশুড়ি আর আমার কুলাঙ্গার ছেলে কল্লোলের সাথে কথা বলি। কথা বলে নিশ্চিত হই আসলেই পল্লব নেই। খুব অসুস্থ হয়ে যাই। ভেবেছিলাম আমি বোধহয় আর দেশে আসতে পারব না। শরীরটা আসলেই প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। মন আর শরীর সব মিলিয়ে এক বিধ্বস্ত বাবা আমি। আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে আর আমি সেই খবর পাওয়ারও উপযুক্ত নই এদের কাছে। অভিমান করে একবার ভেবেছি দেশে ফিরব না আর কোনোদিন। এর ক’দিন বাদেই আমার ফোনে একটা কল আসে। আমি তখন বিছানায় শয্যাশায়ী প্রায়। শুয়ে শুয়ে আল্লাহর কাছে শুধু ফরিয়াদ করতাম, ‘ হে আল্লাহ, এমন হতো সকাল হলেই জানতে পারতাম আমার ছেলেটা বেঁচে আছে।’ জানতাম এটা আমার পাগলামি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পল্লবের কষ্টে তোমার মেসেজের কথা ভুলেই বসেছিলাম।

ফোন হাতে নিতেই দেখি বাংলাদেশের কল। তোমার ফোন মনে করে তড়িঘড়ি কল রিসিভ করি। পরে দেখি তুমি না। ‘ওই ভাইয়ের কল ছিল’ বলে সে অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা কালো করে মুরুব্বি একজন লোকের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে। জয়ীতা তাকাল তার দিকে।

লোকটাকে সে চেনে না। পল্লব তাকে তখনো জড়িয়ে আছে। জয়ীতা এতক্ষণে খেয়াল করল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে তার শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরী। তারও দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা বয়েই চলছে।

এই ভাই ই সেদিন কল দিয়ে জানাল পল্লবের কথা। উনি জানাল পল্লব নামের একটা ছেলে তার কাছে আছে। আমি তো অবাক। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি। পরে ওনার কাছে সবকিছু শুনে আমি আর নিজেকে আটকাতে পারিনি। সেই অসুস্থ শরীরেই দেশে চলে আসি। এসেই প্রথমে ওনার বাড়িতে যাই। সেখানে যেয়ই আমি ফিরে পাই আমার হারানো মানিককে। আল্লাহর দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা, তিনি আমার দোয়া কবুল করেছেন। এই জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার মা। বলতে বলতে চোখ মুছলেন।

জয়ীতার কাছে এখনো সবকিছু অস্পষ্ট।

পল্লব এতক্ষণে মুখ খুলল। চোখের পানি মুছে সে বলল, সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে তোমার সাথে কথা শেষ করে আমি বাসায় ফেরার জন্য গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে বের হই। রাস্তায় কোনো মানুষজন বা গাড়ি নজরে পড়ল না। ইপিজেড থেকে মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করে বাইরে বেরুতেই দেখি দুইজন লোক ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির আশায়। উনাদের দেখে কিছুটা খটকা লাগল। ভাবলাম খারাপ মানুষ কিনা! কাছাকাছি গেলে দেখলাম ওরা আমার কাছে লিফট চাইছে। আমি গাড়ির স্পিড কমালাম। ওনাদের দেখতে বেশ ভদ্রলোক মনে হলো। কথাবার্তা, পোশাক আশাকেও মনে হলো খুব ভদ্র গোছের। ভাবলাম বিপদে পড়েছে। তাই আগপাছ কিছু না ভেবে গাড়িতে তুললাম।

সেখান থেকে মাত্র কয়েকমিনিট সামনে এগুতেই পেছনে বসা লোকটা আমার গলায় ছুড়ি ধরল। আমি ব্রেক কষলাম। বুঝতে পারলাম এরা ছিনতাইকারী। প্রথমে কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা করলেও পরে আমার সবকিছু ওদের হাতে দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু এর পরেই বুঝতে পারলাম ওরা আসলে শুধুমাত্র পকেটমারই না , গাড়ি ছিনতাইকারী চক্রের লোক। গাড়িটা যেহেতু আমার না তাই আমি গাড়িটা হাতছাড়া করতে কোনোভাবেই রাজী হলাম না। গাড়িতে বসেই বেশ কিছুক্ষণ ওদের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি হলো। আমি প্রচণ্ডভাবে আহত হলাম। যখন বুঝতে পারলাম ওদের সাথে আমার পক্ষে পারা সম্ভব না তখন রাজি হলাম গাড়িটা দিয়ে দিতে। লোকগুলোকে যেহেতু আমি ভালো করে দেখে ফেলেছি তাই ওরা চেয়েছিল আমাকে মেরে রাস্তার পাশে ফেলে যেতে। তখন আমি ওদের খুব হাতজোড় করি। তোমার কথা বলি, আমাদের অনাগত সন্তানের কথা বলি । আমি ছাড়া যে তোমরা পৃথিবীতে কতটা অসহায় সেটা শুনে আমার পাশে বসা লোকটার কিছুটা দয়া হলো। পেছনের লোকটাকে বলে আমাকে ছেড়ে দিতে।
ওখানেই রাস্তার পাশে আমাকে রেখে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু বাইরে যে পরিমাণ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল ওখানে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে এলে আমি কোথায় যেতাম? আশেপাশে বাড়িঘর কিছুই নেই। অন্ধকার রাত। চারপাশে ফাঁকা। আর সাথে এত ঝড় বৃষ্টি। তাছাড়া মারধোর করার কারণে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম আমি। ওদেরকে রিকোয়েস্ট করলাম আবার বাসার কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দিতে। সামনে বসা লোকটার দয়া হলো। তবে আমাকে গাড়ির ভেতর না রেখে হাত পা বেঁধে পেছনে ডিকিতে রাখা হলো। পেছনে বসে বুঝতে পারলাম ওদের মধ্যে একজন হয়ত ওদের নেক্সট শিকার ধরার জন্য সেখান থেকে নেমে গেছে। আর বাকী লোকটা আমাকে নিয়ে নিয়ে রওয়ানা হলো। আমি নিয়তির হাতে সব ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নাম মনে করছিলাম আর চোখের সামনে ভাসছিল তোমার মুখখানা। বুঝতে পারছিলাম না আমি কি ভুল করলাম কিনা। ওরা ওদের সেইফটির কথা ভেবেই কি আমাকে এভাবে রেখেছিল নাকি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। নিজের বোকামির জন্য খুব আফসোস হচ্ছিল। ওইখানে নেমে গেলেই পারতাম। ঝড় বৃষ্টি ছিল তাতে কী? জানে তো বাঁচতাম।ওরা আমার সাথে কী করতে পারে ভাবতে ভাবতে গলা শুকিয়ে আসছিল।
হঠাৎ মনে হলো গাড়িটা থেমেছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আধমরা হয়ে পড়েছিলাম। পরে মনে হলো গাড়িতে তেল ছিল খুব কম। আমরা কোনো পাম্পে আছি বুঝতে পারলাম। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে বেশ সময় চলার পরে হঠাৎ গাড়ির পেছন সাইডে প্রচণ্ড ধাক্কায় আমি কেঁপে উঠি। ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ভূমিকম্পের মতো মনে হলো। বার কয়েক একইভাবে আঘাতের পর আঘাত খেয়ে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! ভেতরে বসে ধস্তাধস্তি করতে করতে হাতের বাঁধন খুলে ফেলি। কিন্তু ডিকিতো লক করা। আমার শরীরের কয়েক জায়গায় কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। আমি হাত দিয়ে অনুভব করি আমার ক্ষত। মাথাটাকে সেভ রাখার জন্য নানা কৌশল এপ্লাই করি।
এরপর কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ। পরে হঠাৎ খেয়াল করি গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারি আঘাতের কারণে ডিকির লক খুলে গেছে। পুরানা আমলের গাড়ি তো তাই খুব একটা মজবুত ছিল না সিকিউরিটি সিস্টেম। মনে মনে বাঁচার আশা খুঁজতে থাকি। এর কিচ্ছুক্ষণ পরেই একটা শব্দ হয়। বুঝতে পারি গাড়িসহ আমি উপর থেকে নিচের দিকে পড়ছি। বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম তখন। তোমার আর আমাদের সন্তানের কথা ভেবে বেশি খারাপ লাগছিল। এরপর কী হয়েছিল সবকিছু মনে না থাকলেও আমার মনে আছে আমি পানিতে পড়েছিলাম। কোনোভাবে নিজেকে ডিকি থেকে বের তো করলাম। তাছাড়া চলছিল প্রচুর ঝড় বাতাস ! চারদিকে থই থই পানি আর তীব্র স্রোত। কোনো রকম সাঁতরে কুলের দিকে যেতে চাই। কিন্তু আমার শরীর সাপোর্ট দিচ্ছিল না। তীব্র যন্ত্রণায় মনে হচ্ছিল ডুবে মরে যাচ্ছি। হাত পা এগুতে গেলেই পারছি না।। বুঝলাম শরীর থেকে হাত পা যেন আলাদা হয়ে গিয়েছে এমন । এক টুকরো ভাসমান গাছের মতো পেলাম। কোনোমতে ওটাকে জড়িয়ে বাঁচার চেষ্টা চালাতে চালাতে কখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি নিজেই টের পেলাম না। ভাসতে ভাসতে আমিনবাজার ব্রীজের নিচে পৌঁছাই। সেখান থেকে এই চাচা উদ্ধার করেন । না হলে হয়ত ওইদিনই মরে যেতাম।

উনি একজন সবজি ব্যবসায়ী। ভোরের দিকে সবজি নিয়ে মিরপুর এক নাম্বারে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে এনারাই টেনে তুলে। আমার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়। পরে অজ্ঞান অবস্থাতেই পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। পুলিশ এসে ইনভেস্টিগেশন করে যায় দু’তিনদিন বাদে। আমার সাথে মানিব্যাগ, ফোন বা আইডেন্টিটি পাবার মতো কিছুই ছিল না।

কোনোরকম নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা চলছিল। হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকি সপ্তাহ দুয়েক। এর মাঝে আমার জ্ঞান ফিরে আসলেও মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাবার কারণে কথা বলতে পারছিলাম না। কোনোকিছুর হুঁশও ছিল না। কই আছি, কেন আছি, আমি কে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হাত পা নাড়ানোর ক্ষমতা ছিল না। এটুকু বুঝতাম আমার হাত পা হয়ত আমার শরীরের থেকেআলাদা হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বেওয়ারিশ পেশেন্ট হয়ে কোনোমতে দিন যাচ্ছিল। ওই হাসপাতেলের এক আয়া আমাকে মন চাইলে দিনে একবার কিছু খাইয়ে দিয়ে যেত! না হলে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হতো। এভাবেই ছিলাম কিছুদিন। হাসপাতালের বাইরে যে একটা জগৎ আছে তখন সেটা আমার জানা ছিল না। ভাবতাম এটাই জীবন।

একদিন এই চাচা মানবিকতার খাতিরে আমার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য হাসপাতালে আসেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে যখন আমাকে পান আমার দুরবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট পান। দ্রুত নিজ দায়িত্বে আমার ভালো চিকিৎসার জন্য যা যা করা প্রয়োজন উনার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন। এরপরে আরো পনেরো দিন কেটে যায়। হাত পা ঠিক না হলেও ধীরে ধীরে আমি মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে শুরু করি। কথাবার্তা বলতে পারি। তোমার কথা মনে পড়তেই উনাকে তোমার সাথে যোগাযোগের জন্য ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দেই। কিন্তু উনি ফোনেও তোমাকে পায়নি আর ওই ঠিকানাতেও না। আমার ব্যাপারে কারো কাছে কিছু বলতে নিষেধ করি। কারণ আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম।
আম্মির ঠিকানা দিতে যেয়েও দেইনি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল আম্মিই আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী। আবার ভাবলাম শাহীন ভাইও করতে পারে। কিছুদিন ধরে ওনার সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। আবার ভাবলাম হান্নান সাহেবও করতে পারেন। সবমিলিয়ে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজে নড়তে চড়তে পারছি না অথচ মাথা থেকে তোমার আর আমাদের সন্তানের চিন্তায় পাগল হবার যোগাড়। কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারছিলাম না। পরে মনে হলো বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। বাবা অষ্ট্রেলিয়াতে এটা জানা স্বত্তেও তাকে মনে পড়ল। কারণ সেই আমার একমাত্র ভরসা ছিল। আমি বাবার নাম্বারে ট্রাই করি।

আমাকে কিছুটা সুস্থ হলে এই চাচার বাসা ধামরাইতে নিয়ে আসা হলো। কাটা জায়গাগুলিতে সেলাই দিয়ে কোনোরকম কিছু ঔষধপত্র নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছিলাম। অত উপর থেকে পড়ার কারণে আমার মেরুদণ্ড খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না, একটা হাত অকেজো ছিল একদম। চাচার পরিবারের মানুষগুলি খুব ভালো। আমার মতো একজন পঙ্গুকে দিনের পর দিন তাদের ঘরে রেখেছে। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সারাক্ষণ শুধু ভাবতাম তোমাকে আর আমাদের সন্তানকে হয়ত এরা মেরে ফেলেছে।

প্রতিতিদিনই চেষ্টা করতাম বাবার সাথে যোগাযোগের। হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম। আসলে বাবা নিজেও অসুস্থ ছিলেন। হসপিটাল আর বাসা করেই দিন যেত। তাই ফোন রিসিভ করত না কারো। ফোন পড়ে থাকত উনার রুমে ড্রয়ারে। বাবা সব জানতে পেরে ছুটে আসেন।

এরপর এই পনেরো দিন ধরে নানা চেষ্টার পরে এতটুকু ইম্প্রুভমেন্ট হয়েছে। হাতটা বাঁকা হয়ে গেলেও নাড়াতে চাড়াতে এখন আর খুব সমস্যা হয় না। আমাকে নিয়ে বাবা এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আর কোনোদিক খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ হয়নি।

জয়ীতার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে চোয়াল ভিজে যাচ্ছে। কত কষ্টই না করেছে মানুষটা। আর তারা কিনা ওই গাড়ি চোরকে পল্লব মনে করে কত কান্নাকাটি করেছে। পল্লবের শোকে সে এতটাই পাথর ছিল যে কে কবে ফোন দিচ্ছে না দিচ্ছে সেদিকে খেয়াল ছিল না। আর অপরিচিত নাম্বার হলে তো কথাই বলত না। অথচ পল্লব তাকে কত খুঁজেছে। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার।

পল্লব আবার কিছু বলতে যাবে তাকে থামিয়ে দেয় খালেক সাহেব।
তিনি বলেন, দু’দিন আগে যখন এ বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তুমি বেঁচে আছ। সত্যিই সেই খুশি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার জানতে পারি তোমার বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে কীভাবে এরা তোমাকে বাড়িছাড়া করেছে। সেটা জেনে আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। নিজে পুরোপুরি শিওর না হয়ে পল্লবকে প্রথমে কিছু জানাতে চাইনি। কিন্তু আমার অস্থিরতা দেখে ও বুঝতে পারে কিছু তো হয়েছে। এমনিতেই তোমাদের জন্য সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত। মাঝেমাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করত। দেশে ফিরেই আমি তোমাদের খোঁজ নিয়েছিলাম কিন্তু তখন কোনো সন্ধান পাইনি। পরে অনেক সোর্স ব্যবহার করে জানতে পারি তোমার ছেলে আর তুমি বেঁচে আছ। তাছাড়া তোমার মেসেজেঅ তুমি কিছু ক্লিয়ার করে জানাওনি তোমাদের অবস্থান। শুধু পল্লবের মৃত্যু সংবাদটাই দিয়েছিলে। আমি আর পল্লব তো ধরেই নিয়েছিলাম যে তোমাদের মেরে ফেলা হয়েছে। ওই ডাইনিটা যে তোমাদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে এটা ভাবিনি। ভেবেছিলাম পল্লব কিছুটা সুস্থ হলেই ওর বিরুদ্ধে একশানে যাব।

তবে তোমার আর আমার নাতীর সম্পর্কে যে নিউজ শুনেছি সেটাই বা মেরে ফেলার চেয়ে কম কীসে!
ওই বদমায়েশ মহিলার শাস্তি কতটা ভয়ানক হওয়া উচিত সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

আমি যেটা এখনো করিনি সেটাই করব আজ। অনেক দিন আগেই এটা করা উচিত ছিল। তাহলে হয়ত আজ সবকিছু অন্যরকম হতো।

খালেক সাহেব এগিয়ে যেয়ে সাজেদা চৌধুরীর গালে ঠাস ঠাস করে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় মারল। সাজেদা চৌধুরী এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ছেলেকে ফিরে পেয়ে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলেন বুকে জড়িয়ে নিতে কিন্তু পল্লব তাকে ধাক্কা দিয়ে দুর দূর করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার জীবনে সাজেদা চৌধুরীর মতো অমানুষের কোনো স্থান নেই। বহু আগেই সে সেই সম্মানের জায়গা হারিয়েছে। যতটুকু যাও ছিল সেটুকুও শেষ করে ফেলেছে তার স্ত্রী সন্তানের সাথে অন্যায় অবিচার করে। সে এবাড়িতে এসেছে শুধুমাত্র তার সন্তানকে নিয়ে যেতে। এবাড়ির সাথেও তার কোনো সম্পর্ক নেই।

সাজেদা চৌধুরী, কল্লোল দু’জনে মিলে নিজেদের মতো করে অনেক চেষ্টা করেও তাকে বোঝাতে পারেনি। আর খালেক সাহেবও চান না পল্লবের জীবনে ওই ডাইনির কোনো ছায়া পড়ুক। ছেলে, ছেলেবউ আর নাতীকে নিয়ে বাকী জীবন বাগেরহাটে নিজের বসত ভিটাতে কাটিয়ে দিবেন। তার যা আছে তা আরো তিনপুরুষ বসে খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। তাতে কারো কাছে হাত পাততে হবে না।

ছেলের কাছে চরমভাবে অপমানিত হয়ে আবার স্বামীর হাতে এত মানুষের সামনে লাঞ্চিত হয়েও আজ কেন যেন তার মোটেও খারাপ লাগছে না সাজেদা চৌধুরীর। পল্লব বেঁচে আছে এটা দেখার পর থেকে আজ খুশিতে দিশেহারা । যে ছেলেকে নিজের চোখের সামনে কবর দিতে দেখেছে সেই ছেলে তার চোখের সামনে কিন্তু সে তাকে ছুঁয়ে দেখবার অধিকার হারিয়েছে। তার ছেলে এত এত কষ্ট সহ্য করেছে অথচ সে কিছুই টের পায়নি। তার আদরের ছেলেটা বেওয়ারিশ হয়ে হাসপাতালের বারান্দায় পড়েছিল তাও তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। কতটা অবহেলা আর ঘৃণার পাত্রী ছেলের চোখে সে! নিজেকে আজ সত্যিই নর্দমার কীট মনে হচ্ছে। মিথ্যে অহংকার, আভিজাত্য আর স্টাটাস বজায় রাখতে যেয়ে সারাটা জীবন পার করেছে। এই জীবনের অর্থ কী যেখানে তার সন্তানের কাছে তার কোনো মূল্যই নেই। মনে মনে আল্লাহকে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছে তার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। পল্লবের শারীরিক অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েছে। একদমই চেনা যাচ্ছে না তার ছেলেটাকে। বাকীজীবনেও যে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে কিনা সে জানে না। পল্লবের মৃত্যুতে যতটা না ভেঙ্গে পড়েছিল তার থেকে বেশি ভেঙ্গে পড়েছে এখন পল্লবের অবস্থা দেখে।

একজন উকিল এসে সাজেদা চৌধুরীর হাতে একটা খাম দিলেন। বিদ্ধস্ত সাজেদা চৌধুরী কাগজটা খুলে দেখলেন একটা ডিভোর্স নোটিশ।

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন পেপারের দিকে। ভালো করে বোঝার জন্য চশমাটা চোখে পড়েই দেখতে পান খালেক সাহেব তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। নিজে থেকে কতবার ডিভোর্স দিতে চেয়েও বাবার মৃত্য শয্যায় করা অঙ্গিকারের জন্য পারেনি। যে ডিভোর্সের জন্য সারাজীবন মনে মনে অপেক্ষা করেছে আজ সেই অতি প্রত্যাশিত নোটিশটা পেয়ে বুঝতে পারে সে কী হারাচ্ছে! বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হলো। যে মানুষটাকে কোনোদিন মানুষ বলেই ভাবেনি সেই মানুষটা কতটা মহৎ হলে অন্যের বাচ্চা জেনেও পল্লবকে নিজের পরিচয় দিতে কখনো পিছপা হয়নি, তাকে আর পল্লবকে সমাজের চোখে ছোট করেনি। বাচ্চাদেরকে সমাজের কাছে ছোটো করতে তাদের মাকে ডিভোর্স দিতে কোনোদিনই রাজী হয়নি। নিঃস্বের মতো একটা জীবন পার করেছে সারাজীবন। আজ আবার তার সন্তান না হওয়া স্বত্তেও সেই সন্তানকে বুকে টেনে নিয়েছে পরম মমতায়। সাজেদা চৌধুরী সিক্ত চোখে তাকাল খালেক সাহেবের দিকে। পল্লব তাকে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে খালেক সাহেবকে। খালেক সাহেবকে সারাজীবন একজন পরাজিত মানুষ মনে হলেও আজ বুঝতে পারে আসলে সেই জয়ী হয়েছে জীবনের এই প্রান্তে এসে।

ডিভোর্স পেপারে সই করতে যেয়ে একবার অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল তার দিকে কিন্তু খালেক সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।

পল্লব তার ভাই কল্লোলের দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় নেই কোনদিনই তোমাদের সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে আসব না। আমার সন্তানও আসবে না। তোমাদের কাছে আমি মৃত ছিলাম মৃতই থাকব। আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দাও। আমি এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছি, দম আটকে আসছে আমার। কল্লোলও আজ ভাষাহীন। যে ভাইকে সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে ভেবে এতদিন কষ্ট পেত, তাকে চোখের সামনে ফিরে পেয়েও বুকে জড়িয়ে নিতে পারছে না।

সে আদ্র চোখে বলল, তোর সন্তান অবশ্যই তুই ফিরে পাবি কিন্তু এ বাড়ি থেকে কোথাও যেতে পারবি না।

পল্লব তার কোনো কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললো আমি আমার বাচ্চাকে চাই । জয়ীতা, উপরে যাও। আযান উপরেই আছে, ওকে নিয়ে এসো।

এতক্ষণে সেখানে উপস্থিত হয়েছে শাহীন আর তুহিন। আসলে এই ঘটনা এতক্ষণে মিডিয়ার বদৌলতে মোটামুটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সবকিছু শুনে তারা তো যেন আকাশ থেকে পড়ল। তবে পল্লবকে জীবিত দেখে দুজনেই ভীষণ খুশি হয়। জয়ীতাকে হারিয়ে ফেলবে এই ভয় তুহিনের মাঝে কাজ করলেও সে জয়ীতার মনের অবস্থা অনুভব করে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।

এদিকে চৈতী সবকিছু টের পেয়ে আযান-কে হারাবার ভয়ে তাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। সে কিছুতেই দরজা খুলবে না। জয়ীতা পল্লবের হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে ছুটে চলে যায় চৈতীর রুমে। কিন্তু কিছুতেই দরজা খুলতে পারছে না। চৈতীর মেয়ে, কল্লোল সবাই মিলে দরজা ধাক্কাতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। চৈতীর একটাই কথা, সে জীবন চলে গেলেও আযান-কে দিতে পারবে না। আযান তার সন্তান, এখানে কারো অধিকার নেই।

পুলিশ এসে যখন দরজা ভাঙ্গার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ধীরপায়ে এগিয়ে আসে সাজেদা চৌধুরী। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সে দরজায় যায়। চৈতীকে ডাক দেয়।

খুব বেশি চেষ্টা করতে হয়নি। দুই তিন ডাক দিতেই চৈতী দরজা খুলে দেয়। কারণ সে জানে তার শাশুড়ি যেহেতু আযান-কে দিয়ে দিতে বলেছে তার মানে পৃথিবী উল্টে গেলেও তার পক্ষে আযান-কে রাখা সম্ভব না। শাশুড়ির সামনেও আযানকে রাখবার জন্য কাকুতি মিনতি করলেও সে জানে তার পক্ষে আযানকে আটকানোর কোনো ক্ষমতাই নেই আর। আসলে এই ক’মাসের মধ্যে সে নিজেকে আযানের মা ভাবতে শুরু করেছে। কষ্টে বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে চৈতীর। আযানকে জয়ীতার কোলে দেয়। জয়ীতা আযানকে বুকের সাথে চেপে ধরে যেন তার হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে। সারামুখ চুমায় ভিজিয়ে দেয়। সাজেদা চৌধুরীর খুব হিংসে হলো এ দৃশ্য দেখে। জয়ীতা তার সন্তানকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে আদর করতে পারছে অথচ এই অধিকারটুকু তার নেই। সে তার সন্তানকে ছুঁয়ে দেখা থাক দূরের কথা তার মুখে মা ডাক শোনার অধিকারটুকুও হারিয়েছে আজীবনের জন্য।

চৈতী ফোঁপাতে ফোঁপাতে জয়ীতাকে বলে, আমি আজ বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট। আযানকে তোমার বুক থেকে যখন আমরা কেড়ে নিয়েছিলাম তখন তোমার কেমন লেগেছিল আজ টের পাচ্ছি । আমিতো আযান-কে জন্ম দেইনি তাতেই কষ্টে কাতর হয়ে পড়েছি আর তুমি পেটে ধরে জন্ম দিয়েছ, সেই ছেলেকে আমরা তোমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছি। অনেক বেশি অন্যায় করেছি আমরা। তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার সাহস নেই। শুধু এতটুকু অনুরোধ করব আমাদের ছেড়ে যেও না। কথা দিলাম আযানকে কখনও স্পর্শ করব না। শুধু দূর থেকে দেখতে তো পাব।

জয়ীতা কোনো কথার উত্তর না দিয়ে পল্লবের পাশে এসে দাঁড়াল। জয়ীতার কোলে আযানকে দেখে তার এতদিনের সব কষ্ট যেন নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। জয়ীতা আযানকে পল্লবের কোলের উপর শুইয়ে দিলো। পল্লব দু’চোখ ভরে আযানকে দেখে! টপটপ করে পড়া চোখের পানিতে ভিজে যায় আযানের চোয়াল। সেও ড্যাবড্যাব করে অবুঝ চোখে দেখছে তার তার বাবাকে।

খালেক সাহেবও খুব খুশি এই দৃশ্য দেখে। সে জয়ীতা আর পল্লবকে নিয়ে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে চৈতী আর কল্লোল এসে বাধা দেয়।

চোখের পানি মুছতে মুছতে সাজেদা চৌধুরী তাদেরকে বলে, ওদের পথ ছেড়ে দাও, ওদেরকে যেতে দাও। ওদেরকে মুক্ত করে দিলাম আজ থেকে।
কথাগুলি বলে আর সেখানে দাঁড়ালেন না। নিজের রুমে যেয়ে ঠাস করে দরজা লাগাল । পল্লব একবার সেদিকে তাকাল।

পল্লবকে ঠেলে নিয়ে চলছে জয়ীতা আর পিছুপিছু খালেক সাহেব।

তুহিন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। একবার চোখাচোখি হলো জয়ীতার সাথে। কোনো কথা হলো না। শুধু মৃদু হাসিতে বিদায় জানাল জয়ীতাকে।
আর জয়ীতার চোখেও কৃতজ্ঞতার হাসি।

বাড়ির মেইন দরজা থেকে বেরুবার সময় পল্লব বলল, একটু থামো। হালকা করে ঘাড় ঘুরিয়ে দোতলায় মায়ের রুমের বন্ধ দরজার দিকে আবারো খানিকক্ষণ তাকাল।
জয়ীতা বুঝতে পারল তার ভেতরে কী চলছে! যত খারাপই হোক উনি তো তার মা ! তাছাড়া কল্লোলের থেকে পল্লবকেই বেশি আদর করত সাজেদা চৌধুরী!

কিছু সময় বাদে জয়ীতা বলল, আমরা কি যাব?

অস্ফুটস্বরে পল্লব তার কোলের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বলল, হুম।

ধীরপায়ে সব সম্পর্ককে চিরদিনের জন্য শেষ করে নতুন করে একটা সূখ নীড়ের আশায় সামনে এগুতে থাকে পল্লব আর জয়ীতা।

(সমাপ্ত)

( প্রিয় পাঠক, জীবনও একটা গল্প ক্ষেত্র। এখানে প্রতিদিন কত কত কাহিনী ঘটে যায়। কোনোটা গোচরে, কোনোটা অগোচরে। তাও জীবন চলছে। লেখকের লেখায় লেখক তার কল্পনার আশ্রয়ে সামনে এগুতে থাকে। মনের মাধুরি মিশিয়ে সামনে নিয়ে যায় কাহিনী । কিন্তু বাস্তবতা হয়ত কখনো কাহিনীকেও হার মানায় বা আরো অবাস্তব কিছু ঘটে বা পাওয়া না পাওয়ার দোলাচালে দুলতে দুলতে এক জীবন পার হয়ে যায়। তবুও আমরা চলছি। কারণ নদীর স্রোতের মতোই জীবনের নিয়মেই জীবনকে চলতে হয়। চলতে চলতেই হঠাৎ করে একদিন থেমে যায়। এই তো জীবন। খুউব ভালো থাকবেন সবাই। অজস্র ভালোবাসা সবার জন্য।

এমন নতুন কোনো কাহিনী নিয়ে আবার আসব। ও হ্যা, আরেকটা খবর বলতে তো ভুলেই গেলাম।

ছাপার অক্ষরে বই আকারে আসছে আমার প্রথম উপন্যাস “নিয়তি নিরন্তর”। আপনারা আয়েশা আর অনন্যাকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত তো? আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি আপনাদের দিল ছুঁয়ে যাবার মতো করে আয়েশা আর অনন্যাকে উপস্থাপন করতে। আশা করছি আয়েশা, অনন্যা আর আরিয়ানের নিরন্তর নিয়তির সাথেও আপনাদের পাব।

বইয়ের প্রি অর্ডার আসার আগে আপনাদের আপডেট জানানো হবে। আপনাদের দোয়া প্রত্যাশায় রইলাম।

আপনাদের প্রচণ্ড বিরক্ত করেছি, পেইন দিয়েছি এই লেখাটা পোস্ট করার পর থেকেই। আজ খুব রিলিফ ফিল হচ্ছে। অপরাধী মনে হতো নিজেকে। খুব ভয় হতো প্রতিটা পর্ব পোস্ট করার সময়। আপনারা সত্যিই আমার খুউব প্রিয় মানুষ। না হলে এতটা অপেক্ষায় রাখার পরেও আপনারা কখনো আমাকে কটুকথা বলেন নি। আমার সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করেছেন।সত্যিই খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে নিজেকে।
খুউব ভালো থাকবেন সবাই। অজস্র কৃতজ্ঞতার সাথে আজ বিদায় নিচ্ছি। গল্প কেমন লাগল জানাবেন। খুব দ্রুত আবার দেখা হবে, ইন শা আল্লাহ।
আল্লাহ হাফেজ।)

পর্ব- ৩৩

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/548452916937382/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here