সুখ নীড় পর্ব-২

0
350

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২

জোর করে পল্লবকে বিয়ে করার পরিণাম জয়ীতা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতে তার সম্মানের স্থানটুকু একদম তলানিতে। বাড়ির অন্য সবার কথা না হয় বাদই দিলো সে কিন্তু যে পল্লবের জন্য সে এ বাড়িতে এসেছিল সেই পল্লবের দু’চোখেই আজ অবধি একটু স্থান করে নিতে পারেনি জয়ী। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে কবে নিজের প্রাপ্তিটুকু নিয়ে সবার সাথে গর্ব করবে সে! এখন তো মনে হচ্ছে পল্লবকে বিয়ে করা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সেদিন যদি সবকিছু মেনে নিয়ে পল্লবের থেকে দূরে সরে যেত সেটাই তার জন্য খুব সুখকর হতো হয়তো ৷

ছাদের এককোণে বসে সেই দিনগুলোর কথা আজও তার স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায়। সেই যে আলো ঝলমলে এক পার্টিতে পল্লবকে প্রথম দেখা, পল্লবের প্রেমে পড়া, পল্লবকে বিয়ে করা, জোর করে তার ঘরে আসা সবই যেনো আজ তার জীবনের দুঃস্বপ্ন। কেনো সেদিন অমির সাথে পল্লবের পার্টিতে গিয়েছিল।

পল্লবের সাথে তার প্রথম দেখা হয় ওয়াশরুমে । ভুল করে সেদিন জয়ীতা ছেলেদের ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছিল। একটু ফ্রেশ হয়ে পেছন ফিরতেই দেখে পল্লবকে। পল্লবকে দেখে তার হাত-পা বরফের মতো জমে যায়। সে নিজেই যে ভুল করেছে সেটা বুঝতে না পেরে হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে,

– কী আশ্চর্য! আপনি এখানে কেন?

– ইজন্ট ইট রিডিকিউলাস টু হিয়ার দিস কোয়েশ্চেন ফ্রম ইউ? আর ইউ ক্রেজি? এটা জেন্টস ওয়াশরুম। আপনি বলুন, আপনি এখানে কী করছেন?

ততক্ষণে যেন হুশ ফিরল জয়ীতার। এই বোকামিটা সে আগেও করেছে। হুটহাট করে না দেখেই সেখানে ঢুকে পড়েছিল।

সে ঘাবড়ে যেয়ে বলল, ওহ! তাই নাকি আ’ম ভেরি সরি ভেরি সরি। প্লীজ, ক্ষমা করবেন!

– ইটস ওকে! এরপরে দেখেশুনে ঢুকবেন কিছুটা রাগত স্বরে বলল, পল্লব।

এমনিতেই অমির আচরণে ভীষণ বিরক্ত জয়ী তার উপরে ওয়াশরুমে যে এমন একটা ভুল করার কারণে আরো বেশি রাগ হচ্ছে নিজের উপর। কেন যে অমির সাথে নাচতে নাচতে এখানে চলে এলো?

হঠাৎ খেয়াল হলো অমি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

– এতক্ষণে তোর আসার সময় হলো? আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস বলতো!

– এক্সট্রিমলি সরি দোস্ত। ওদের সাথে যেয়ে আমি একদমই তোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। চল, চল পার্টি প্রায় শেষের পথে। খাওয়া-দাওয়া করি। এরপরে তোর সাথে পল্লবের দেখা করিয়ে দিব।

– খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই, কারো সাথে দেখা করারও দরকার নেই। আমি ফিরতে চাই, প্লিজ।

– বোকা নাকি তুই? কত কষ্ট করে এখানে আমরা আজকে এসেছি। আর কিছু না খেয়ে চলে যাব? তাছাড়া পল্লবের সাথে তো তোর দেখাই হয়নি! আজকে পল্লবের মুড ভালো আছে। আমার মনে হয় কাজ হয়ে যাবে।

– আমি বলেছি তো, তোর কোনো পল্লব টল্লব এর কাছে আমি যাব না। দেখাও করব না। তুই আমাকে নিয়ে চল। তুই যদি না যাবি আমি নিজেই চলে যাব। জীবনেও তোর আক্কেল হবে না। ব্যাক্কল ব্যাক্কলই রয়ে যাবি।
একটা মানুষকে এই অপরিচিত পরিবেশে এনে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিচ্ছিস তোর পার্টিতে। তারপরও তোর হুশ হয় না।

জয়ীতা রাগ করে প্রায়ই রওনা দিচ্ছিল ঠিক তখন পল্লব এসে হাজির তাদের মাঝে।

– হে, অমি! সে তাহলে তোর সাথে এসেছে? ও আই সি! এজন্যই ওকে আমি চিনেছিলাম না। বাই দ্যা ওয়ে, নাইস চয়েস! তা কবে থেকে রে বন্ধু? কিছুই তো জানালি না। ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছিস?

– আরে না! ওসব কিছু না। ও হচ্ছে আমার খুব ছোটবেলার ফ্রেন্ড। আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একসাথে পড়েছি। আমাদের বাসাও পাশাপাশি ছিল। আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে জয়ীতা। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আমার মত হ-য-ব-র-ল না।

আর জয়ীতা! ও হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড, পল্লব। যার কথা তোকে আমি বলেছিলাম।

– উনার সাথে আগেই আমার পরিচয় হয়েছে। তাও আবার ওয়াশরুমে। হেসে বলল, পল্লব!

– হাউ ফানি! কখন?

– মাত্র কয়েক মিনিট আগে। আচ্ছা সেসব কাহিনী তোর না জানলেও চলবে। তো ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। এই সুযোগে ওনার সাথে পরিচিত হওয়া গেল। ডিনার সার্ভ করছে। প্লিজ, বসে যা উনাকে নিয়ে।

অমি কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছিল না। পল্লব আবার চলে যাচ্ছিল তখন অমি তাকে পিছু ডাকল।

– পল্লব! তোর সাথে কিছু কথা ছিল ।

– পল্লব এগিয়ে এসে বলল, হ্যা, বল!

– জয়ীতাকে আসলে তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই নিয়ে এসেছিলাম। তুই ব্যস্ত মানুষ। সহজে তো পাওয়া যায় না তাই এখানে আসা। ওর একটা জব ভীষণ প্রয়োজন। গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। খুব ভালো রেজাল্ট ওর। দেখ তো কোথাও একটু ব্যবস্থা করা যায় কিনা। খুব প্রবলেমে আছে বলেই নিয়ে আসা। অনেক আশা নিয়ে তোর কাছে নিয়ে এসেছিলাম।

পল্লব খানিকক্ষণ জয়ীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কর্পোরেট জগৎ সম্মন্ধে প্রাক্টিক্যাল আইডিয়া আছে কিছু আপনার?

– ইয়ে মানে… না। তবে চেষ্টা করলে পারব হয়তো।

– ওকে, অমি! সানডেতে ওনাকে সিভিসহ নিয়ে আসিস অফিসে। কথা হবে সেদিন ডিটেইলস।

পল্লবের সাথে অতটুকুনই কথা হয় সেদিন জয়ীর। এরপরে পল্লবের অফিসে চাকরি হওয়া, প্রেম হওয়া সবই এখন স্মৃতি। যে মানুষটাকে সে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল সেই মানুষটা আর এই মানুষটা এক নয়। এই মানুষটার সাথে সে মন খুলে গল্প করতে পারে না।
ক’দিন ধরেই পল্লবকে একটা কথা বলবে বলবে করেও সে সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। অথচ একসময় অকপটে কতো কিছুই না বলা যেতো! আসলে সে খুব বোকা বলেই হয়তো পল্লবের আসল চেহারা তখন বুঝতে পারেনি।

জয়ী রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে সেই দিনগুলোর কথা ভাবছিল তখন পেছন থেকে এসে রুনু ডাক দিলো। রুনু এ বাড়িতে কাজ করে বহুবছর ধরে। এই একমাত্র মানুষ এ বাড়িতে যার সাথে মন খুলে একটু কথা বলতে পারে জয়ী।

– আফা, আপনে এই হানে! ভাইয়া, আইসা খুঁজতাছে। তাড়াতাড়ি যান নাইলে কুরুক্ষেত্র শুরু হইয়া যাইব।

– পল্লব এসেছে? এইসময় তো আসে না কখনো।

– তাই তো! দ্যাহেন যাইয়া। আইছে হয়তো কোনো কাজে। তাত্তারি যান।

পল্লবের সামনে যেতেই ভয় হয় জয়ীতার। সারাক্ষণ কেমন একটা থমথমে ভাব থাকে চোখমুখে। এই একটা বছরে কোনোদিন একটু মিষ্টি করে তার সাথে কথা বলেছে কি না এটাই মনে করতে পারে না জয়ী।
জিদের বশে আর মান সম্মানের কথা ভেবে এত যুদ্ধ করে পল্লবকে বিয়ে করাটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এটা সে প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছে।

রুমে ঢুকতেই পল্লব হুংকার দিয়ে বলে উঠল,

– কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

– ভয়ে ভয়ে জয়ী উত্তর দিলো, ছাদে?

– এই ভর দুপুরে ছাদে কী করতে? নাগর খুঁজতে গিয়েছিলে নাকি?

– এসব কী বলছ, পল্লব? কেউ শুনলে কী বলবে?

– শুনুক! আজকাল রাফির সাথে এত পিরিত কিসের তোমার ? চিৎকার করে বলে উঠল, পল্লব!

– ছিঃ! তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। বাইরে আম্মি আছেন, ভাবী আছেন, মেইডরা আছে, প্লিইজ। একটু তো বুঝেশুনে কথা বলো। রাফি এ বাড়ির ড্রাইভার। কাকে নিয়ে কী বলছ তুমি? কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, জয়ীতা।

– আমার কানে সবই আসে বুঝেছ? আজ দু’দিন ধরে কারো অনুমতি ছাড়াই কী এমন দরকার পড়ল যে রাফিকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে থাকতে হলো? কোথায় গিয়েছিলে জানতে পারি কি? নাকি রাফিকেই ডেকে জিজ্ঞেস করব?

জয়ী আর কিছু বলতে পারল না। কিছু বলতে যাবে তার আগেই কোনোরকমে মুখটা দু’হাতে চেপে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো।

হড়হড় করে বমি করতে শুরু করল সে। দরজাটা লক করার সুযোগ হয়নি তার। খানিক সময় পরে কিছুটা বমির ধকল কমলে একটু ফ্রেশ হয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে পল্লব দাঁড়িয়ে। পল্লবের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল এতক্ষণে ।

পেছন ফিরতেই পল্লবের রক্তবর্ণ চোখজোড়া দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠল জয়ী।

– আমার সন্দেহই তাহলে সত্যি। ইউ রাবিশ! আবার বাঁধিয়েছ? কতবার বলেছি সাবধান হতে!

– জয়ী আস্তে করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল, আমার কী দোষ বলো! আমি কি ইচ্ছে করে… আল্লাহ দিলে আমি….

– চুপ… একদম চুপ! আজ সন্ধ্যায়ই হসপিটালে যাবে এটাকে খসাতে! আর একটা কথাও না।

জয়ী ডুকরে কেঁদে উঠে।

– একদম চুপ। ভাব দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না! পেটে পেটে শয়তানিতে ভরপুর। আমি কি আর এসব বুঝি না। মল্লিক বাড়িতে শেকড় গাড়ার ধান্ধা শুরু করেছ, নাহ! ইম্পসিবল!

– জয়ীতা দু’হাতে পেট চেপে ধরে করুণ স্বরে বলে উঠল, আবার সেই মৃত্য যন্ত্রণা ? প্লিইজ!

– একটা কথাও শুনতে চাই না। আমি সন্ধ্যা আন্টির সাথে কথা বলে রাখছি। উনি ক্লিনিকে থাকবেন আজ। আজকের মধ্যেই যেনো এই জঞ্জাল সাফ করে আসা হয়।

আর কোনো কথা বলার সুযোগ জয়ীতা পেলো না। হনহন করে বেরিয়ে গেল পল্লব।

পল্লব বের হতেই দেখল ড্রয়িংরুমে তার আম্মি সাজেদা বেগম আর পাশেই তার বড় ভাবী চৈতী বসা।

– কী সমস্যা আবার? বললেন, সাজেদা বেগম।

– চোর ধরা পড়ার মতো করে পল্লব বলল, কই কিছু নাতো!

পল্লবের কথা শুনে চৈতী মৃদু হেসে সামনে থাকা বাটি থেকে এক টুকরো আপেল মুখে দিতে দিতে বলল, বুঝলেন আম্মি, আমাদের পল্লবের কপাল ভালো। এমন উর্বর ভূমি কি সাধনায় মিলে? আমি যেখানে এই সাত বছরে একটা বাচ্চার মা হয়ে আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেও পারছি না আর সেখানে আমাদের ছোট বউ বছরে দু’বার? দু’বার বলছি কেনো? তিনবার হবার কথা তো! একটা তো পেটে করেই নিয়ে এসেছিল!

পল্লব বুঝতে পারল এ বাড়িতে কোনো কথাই মাটিতে পড়ার জো নেই। দেয়ালেরও কান আছে এ কথা এ বাড়িতে একদমই সত্যি।

– আমি কোনো ঝামেলা চাই না। যা করার তুমি নিজেই করবে। এবং দ্রুত করবে। আমাকে হাজার ঝামেলা পোহাতে হয় সারাক্ষণ। এসব ফালতু ঝামেলাও যেনো আমাকে ডিল করতে না হয়!

এরপর চৈতীকে উদ্দেশ্য করে বলল, বৌমা, কল্লোলকে বলবে রাতের মিটিংটা ওকেই ডিল করতে আমি আর যাচ্ছি না। আমার অন্য একটা কাজ আছে।

– ঠিক আছে, আম্মি। বাধ্য পুত্রবধূর মতো জবাব দিলো চৈতী।

সাজেদা বেগম উঠে যাবার পরেও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে পল্লব। চৈতী তার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, আচ্ছা, আমিও উঠি। তোমার ভাইয়াকে খবরটা বলে আসি। জানোই তো আজকের মিটিংটা কতো ইমপর্ট্যান্ট। আম্মি তো আবার এমন সব কাজে তোমার ভাইয়াকে ছাড়া আর কাউকে ভরসাই করতে পারে না।

একদিকে জয়ীতার উপরে জমা হওয়া প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা আরেকদিকে চৈতীর এমন খোঁচা মারা কথা হজম করতেই কষ্ট হচ্ছে পল্লবের।

চোখ মুছতে মুছতে এর মধ্যে নিচে নামল জয়ী। নেমে দেখে পল্লব তখনো যায়নি। সে অনেক আশা নিয়ে পল্লবের জন্য অপেক্ষা করছিল। অথচ কী হতে কী হয়ে গেল। জীবনের হিসেব মেলাতে পারছে না একদমই।

জয়ীতাকে দেখে রাগটা যেনো আরো টগবগিয়ে উঠল পল্লবের। জয়ীর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, সবখানে রাষ্ট্র করা সারা।!
ইডিয়ট!

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here