#সুখ_নীড়
#পর্ব_৭
ছোটোখাটো একটা জটলা দেখে মর্ণিং ওয়াক করতে আসা খালেক সাহেব আর রমিজ সাহেব এগিয়ে এলেন। সমবয়সী কয়েকজন মিলে প্রতিদিনই এক্সারসাইজ করতে বের হন তারা। আর প্রতিদিনই তারা নিয়ম করে বাস স্টপেজের এখানে বসেন টং দোকানে আদা চা খেতে। খেতে খেতে নানান গল্পের ফাঁকে নিউজপেপারেও চোখ বুলিয়ে নেন। খালেক সাহেবের বাসা এখান থেকে ভেতরের দিকে প্রায় এক দেড় কিলোমিটার দূরে হবে। আজ স্টপেজের চায়ের দোকানে বসতেই জটলা চোখে পড়ল। সে আর আরেক বন্ধু রমিজ সাহেব দু’জন কৌতূহলী হয়ে জটলার কাছে এসে দেখলেন একটা মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে হা হুতোশ করছে খালেক সাহেবেরই বাসায় কাজ করা জাফরের মা।
জাফরের মাকে চিনতে পেরে তিনি বললেন,
– আরে জাফরের মা! তুমি ঢাকা দিয়ে আসলে কখন?
– এইতো ভাইজান, মাত্র নামলাম। দেখেন না কী একখান বিপদে পড়ছি।
– তোমার সাথের এই মেয়েটি কে?
– মেয়েটা তো আমার সাথে ঢাকা থাইকাই গাড়িতে একসাথে উঠছে। পাশের সিটে বইসাই আসছি। ওঠার শুরুর থাইকাই দেখছি মেয়েটার খুব জ্বর। এহনো অনেক জ্বর। জ্বরের ঘোরে মনে হয় অজ্ঞান হইছে। আমিতো ঘুমাই ছিলাম। এ যে কখন অজ্ঞান হইছে না হইছে আমি কিছুই টের পাই নাই। আমার পাশে বসা ছিল এজন্য বাসের কনডাক্টর আমার উপর চাপাই দিয়া চইলা গেল। আমি এখন এই মেয়েরে লইয়া কই যাই কন দেখি।
– আহা, মেয়েটার এড্রেস কোথায় জানো না তুমি কিছু? বলেনি বাসে বসে?
– না, কইলো কোন বান্ধবীর না কার বাসায় যাবে। শিকদার বাড়ি না কোন বাড়ি। এখান থেকে নাকি ভিতরে।
– মেয়েটির সাথে ফোন আছে মনে হয়। দেখো ফোন বের করে কিছু পাওয়া যায় কিনা।
– সেইটা আগেই দেখছি। আমি আর বাসের হেলপার দুই জনে মিইলাই দেখছি। এনার ফোন বন্ধ। আর সাথে এমন কিছু নাই যা দিয়া এনার ঠিকানা খুঁইজা পাওয়া যাবে।
– পাশাপাশি যখন ছিলে তখন টের পাওনি কারো সাথে কথাবার্তা কিছু বলেছে কিনা ফোনে?
– সারা রাস্তা কারো সাথেই কথা বলে নাই। কেমন যেন বিভ্রান্তের মত ছিল। আমি বাস স্ট্যান্ডে বহু সময় বসা দেইখা নিজেই রুটি, কলা, ঔষধ খাওয়াইয়া নিয়া গাড়িতে উঠছি। আমারে কইল সেও নাকি বাগেরহাট আসব তাই আমি আমার গাড়িতে সাথে করে নিয়া আসছি। একলা মাইয়া বাসস্ট্যান্ডে বইয়া রইছে ফালতু পোলাপানে ভরা চাইরপাশ। তাই সাথে কইরা লইয়া আইছি। এমন ঝামেলায় পড়ব জানলে জীবনেও আনতাম না।
– আচ্ছা, আচ্ছা। যা হইছে হইছে। চলো হসপিটালে লইয়া যাই। কাছেই একটা ক্লিনিক আছে।
– আচ্ছা, লন কি আর করা। একটা রিকশা ডাকেন।
সবাই মিলে ধরাধরি করে জয়ীতাকে রিকশায় তুলে দিলো। খালেক সাহেব আর রমিজ সাহেব আসলেন।
ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো। ক্লিনিকের বেডে শোয়ানোর পরে জয়ীতার মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরে যেতেই খালেক সাহেব কেঁপে উঠলেন। আরে এ তো তার ছেলের বউ, জয়ীতা। গতকাল সকালেও সে তার সাথে কথা বলেছে। জয়ী তখন হসপিটালে ছিল। মেয়েটা এখানে কী করে এলো এই শরীরে। বেশ অবাক হলেন।
সাত পাঁচ নানান কিছু ভেবে ফোন বের করে পল্লবকে ফোন করতে যেয়ে আবার করলেন না। ওখানেও কাউকে আর কিছু বললেন না জয়ীতার পরিচয়ের ব্যাপারে। ডাক্তারকে বললেন ভালো করে চেকআপ করতে যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়।
ডাক্তার এস এস নার্ভ দেখে, বিপি চেক করে বলল, ভয়ের কিছু নেই। জ্বর এবং দুর্বলতার কারণে অজ্ঞান হয়েছে।
ঘন্টাখানেক পরেই জয়ীতার হুশ ফিরল।
জয়ীতা জ্ঞান ফিরে খালেক সাহেবকে দেখে তো একদম ভড়কে গেল। সে বুঝতেই পারছেনা সে এখানে কী করে এলো!
খালেক সাহেবকে কিছু বলতে যাবে তখনই তিনি ইশারায় তাকে চুপ করতে বললেন। কিছুটা সুস্থ হবার পরে জয়ীতাকে তিনি বাসায় নিয়ে এলেন।
জাফরের মাও সাথেই আছেন। খালেক সাহেব তাকে জয়ীতার জন্য একটা রুম রেডি করে দিতে বললেন। জাফরের মা এখনো বুঝতে পারছেন না খালেক সাহেব জয়ীতাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন। তার যখন জ্ঞান ফিরেছে তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিলেই হয়।
জয়ী এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে এটা খালেক সাহেবের বাড়ি এবং সে গত রাতে জ্বরের ঘোরে ভুলেই গিয়েছিল যে বাগেরহাট পল্লবের বাবা থাকেন। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো। ঘুরে ফিরে আবার সেই একই গোলকধাঁধায়। সে চায় সবার থেকে দূরে সরে যেতে। যেহেতু এখানে চলে এসেছে তাহলে পল্লবের কানে নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবরটা পৌঁছে গেছে।
অপরাধীর ভঙ্গিতে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে সে সময় খালেক সাহেব রুমে ঢুকলেন। তাকে দেখে মাথা তুলে তাকাল জয়ী।
জাফরের মাকে রুম থেকে চলে যেতে বলে খালেক সাহেব তার পাশে বসলেন। তিনি আগে থেকেই জানতেন যে পল্লবের সাথে জয়ীতার সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। সরাসরি তাকে কেউ কিছু না বললেও জয়ীতা আর পল্লবের সাথে কথাবার্তা বলে কিছুটা আঁচ করে নিয়েছেন।
জয়ীতাকে অভয় দিতে তার মাথায় হাত দিয়ে আস্তে করে বললেন, তোকে আমি চিনতে ঠিকই ভুল করিনি মা। বুড়ো হয়েছি তাতে কি হয়েছে? সেই যে মাত্র একবার দেখেছিলাম তোকে।
জয়ীতা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছে কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে মাথা নিচু করে কান্নার মত করে ফোঁপাচ্ছে।
– কী হয়েছে আমাকে বল। গতকাল সকালেও তো আমার সাথে কথা হলো। তবে গতকালই আমি টের পেয়েছিলাম তোর ভিতরে নিশ্চয়ই কিছু চলছে কেমন যেন কথা বলার সময় উদ্বিগ্ন ছিলি। কেমন যেন আনমনা লাগছিল তোকে। শাশুড়ির সাথে ঝগড়া হয়েছে? নাকি আমার পাগল ছেলের সাথে?
জয়ীতা কোনো কথা বলছে না দেখে তিনি আবার বললেন, ভয় নেই আমি কাউকে কিছু বলব না। পল্লবকে আমি কিছুই জানায়নি। আমার কাছে বল কী হইছে? আমি যেমন পল্লবের বাবা তেমনি তোরও বাবা। তোকে আমি মেয়ের মতই ভালবাসি। আমার কাছে মনের সব কথা খুলে বলতে পারিস মা। আমি চৈতীর থেকে তোকে বেশি ভালোবাসি এটা কিন্তু তুই নিজেও জানিস। কারণ চৈতী হয়েছে সম্পূর্ণ তোর শাশুড়ির মতো। আর কল্লোলও কেমন যেন হয়েছে। আমার সাথে কথা বলার সময় তার হয় না। অবশ্য পল্লবও ধীরে ধীরে তার ভাইয়ের মতোই হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক আফসোস নেই কিছুরই। ও বাড়িতে তুই একমাত্র মানুষ যে আমার খোঁজ খবর নিস। বল মা, চুপ করে থাকিস না।
ধীরে ধীরে জয়ীতার ভয় কাটতে শুরু করল। সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, সরি বাবা। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।
– আরে বোকা! কোথায় ভুল করেছিস? তুই তো তোর বাবার কাছে এসেছিস। এবার বল কী হয়েছে? পুরোটা খুলে বল। না হলে বুঝব কী করে? ভয় নেই। একটা কথাও কেউ জানবে না। এটা বাবা মেয়ের মধ্যেই থেকে যাবে। তুই যে এখানে এসেছিস পল্লব জানে,?
– না, কেউ জানে না। আমি আসলে এখানেও আসতে চাইনি। আমি কালকে জ্বরের ঘোরে ভুল করে ওই খালার সাথে এই বাসে উঠে গিয়েছিলাম। তখন আমার একবারও মনে আসে নি এখানে আপনি আছেন।
– দেখেছিস! এটা হচ্ছে উপরওয়ালার কারিশমা। এবার বল কোথায় যেতে চেয়েছিলি তাইলে?
– নিরুদ্দেশের পথে, যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না।
– পাগলি মেয়ে নিরুদ্দেশে যাবি কি করতে? আমি আছি না। তুই আসতে না চাইলেও দেখ আল্লাহ ঠিকই তোকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। মা কে জানিয়েছিস তুই কোথায় আছিস?
– না, কাউকে কিছু জানাইনি।
– এটা কি করেছিস? তোর মা তোকে নিয়ে চিন্তা করবে না? এখনি জানিয়ে দে।
– ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু চিন্তা করুক না। অভিমানের সাথে কথাগুলি বলল, জয়ীতা।
– বোকা মেয়ে পৃথিবীর সবার উপর রাগ করলেও মায়ের উপরে রাগ রাখতে নাই। কোথায় আছিস সেটা যদি বলতে না চাস না বল কিন্তু তাকে জানিয়ে দে তুই ভালো আছিস। আমি তোর ফোনটা চার্জে লাগিয়েছি। চার্জ হলে ফোন অন কোরে ফোন দে!
একটু ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আয় একসাথে খাব খেতে খেতে বাকী কথা হবে! কথাগুলি বলতে বলতে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন জয়ীতার মাথায়।
জয়ীতার দু’চোখ বেয়ে গলগল করে অশ্রু ঝরে পড়ছে। তার মনে হচ্ছে সে যেন তার বাবার কাছে এসেছে। তার বাবাও তাকে তুই তুই করে এভাবে পরম মমতায় কথা বলতেন। কত বছর বাবার পাশে বসা হয় না। আজ খালেক সাহেবকে দেখে শুধু তাকেই মনে পড়ছে। এত ভাল মানুষটা এভাবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। তার মতই কতটা যন্ত্রণা সে পাচ্ছে সে বুঝতে পারছে।
এদিকে দশটা বেজে গেছে তখনও পল্লব ঘুমাচ্ছে সাজেদা চৌধুরীর মেজাজ গরম হয়ে গেল। আসলে গত রাতে জয়ীর টেনশনে পল্লবের ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। ভোররাতের দিকে সে কখন ঘুমিয়েছে নিজেও টের পায়নি।
আজ এগারোটার দিকে বোর্ড মিটিং ডেকেছে সাজেদা চৌধুরী একথা পল্লব নিজেও জানে। কল্লোল এবং পল্লব দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে অফিসের জন্য বের হবে। যেতে যেতে রাস্তায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তাও সেরে নেবে। আরেকটা কোম্পানির সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিল সাইন করবে তারা।
পল্লবকে নাস্তার টেবিলেও না পেয়ে সে নিজেই পল্লবের দরজায় যেয়ে জোরে জোরে ধাক্কা মারতে শুরু করল। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা মারার পরে পল্লবের ঘুম ভাঙল। আড়ামোড়া দিয়ে জেগে খুব বিরক্তি সাথে দরজা খুলে বলল, বিরক্ত করছ কেন আম্মি? ঘুমোতে দেবে তো! সাত সকালে উঠে চিৎকার চেঁচামেচি করে একদম বাড়ি মাথায় তুলেছ।
বাড়ির ঝি চাকরের সামনে ছেলের কাছে এত বড় অপমান হয়ে সাজেদা চৌধুরীর মাথা হেট হয়ে গেল। কোনো রকমে নিজের রাগটা সামলে নিয়ে ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকাল কি নেশা করতেও শুরু করেছো নাকি? চোখ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে.!বেশ অধঃপতন হচ্ছে দিন দিন। কার সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটুকু ভুলে গিয়েছো? ভুলে যাচ্ছ কেন তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ?
– আম্মি, প্লিজ! সকাল-সকাল তুমি তোমার লেকচার শুরু করো না। আমাকে বলো তুমি আমাকে কেন ডেকেছ? প্রতিদিন তোমার একই ধরনের ভাষণ আর এই একই টাইপের কথাবার্তা শুনতে শুনতে বিরক্ত, প্লিজ।
ছেলের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে সাজেদা চৌধুরী সত্যিই খুব অবাক হলেন। দিন দিন পল্লব তার সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে যাচ্ছে। বাড়ির সবার সামনে নিজেকে আর অপমান করাতে চাইলেন না তিনি। নিজেকে কোনরকম নিয়ন্ত্রণ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আজকে যে বোর্ড মিটিং আছে সেটা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি। এগারোটায় বোর্ড মিটিং। এখন দশটা বেজে গেছে।
– ওহ, আমি সরি। আমি যেতে পারছি না। তোমরা যাও। বলেই ঠাস করে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো, পল্লব।
সাজেদা চৌধুরী রাগে অপমানের থর থর করে কাঁপছেন। আবারো পল্লবের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে চিৎকার করে তাকে ডাকতে থাকলেন।
– পল্লব তোমার সাথে আমার কথা শেষ হয়নি। তুমি দরজা দিয়েছ কেনো? নিজেকে কী ভাবছো তুমি? এখনই দরজা খোলো। না হলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
পল্লব দরজা খুলছে না দেখে এসে আরো চিৎকার করতে থাকল। পল্লব, এখনই দরজা খোলো। তুমি কী শুরু করেছ? দরজা খোলো বলছি। তোমার সাথে আমার কথা আছে।
মায়ের এই অবস্থা দেখে কল্লোল এসে পাশে দাঁড়াল। সে তার মাকে শান্ত করতে বলল, আম্মি, প্লিজ! তুমি শান্ত হও! তুমি গাড়িতে যেয়ে বসো। আমি ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসছি।
– না, কল্লোল, আমাকে কথা বলতে হবে ওর সাথে। তুমি ওর সাথে পারবে না। আর ও তোমার সাথেও মিস বিহেভ করবে। আমার সাথে কী করেছে তা তো দেখলে। তোমার কি মনে হয় ও তোমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করবে?
– জানিতো। এত ষ্টুপিড হয়েছে কী করে সেটাই মাথায় আসে না। কাউকে সম্মান করে না। এখন তোমার সাথেও! উহ!
– আমার এত ভালো ছেলেটা কী করে এমন হলো? বলতে বলতে সাজেদা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন। এই সবকিছুর জন্য, আমার বাধ্য ছেলেটাকে এমন অবাধ্য বানানোর জন্য ওই মেয়েটা দায়ী। আমি ওকে খুন করব। এবার বাসায় পা রাখুক ও। বাসায় পা রাখতেই ওকে আমি খুন করব। আমি আর কিছু ভাবব না। আমি আমার ঘরের শান্তি চাই যেকোনো মূল্যে।
সাজেদা চৌধুরীর কথা শেষ হতে না হতেই পল্লব দরজা খুলে বেরিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ! পারো তো শুধু ওই মেয়েটাকে খুন করতেই। আর কত কি করার বাকি আছে তোমার? আর বুঝি এই খুনটা করতেই শুধু বাকি রেখেছ, তাই না? তোমার মত একটা জঘন্য মহিলার কাছে এছাড়া আর আশাই বা করা যায় কী?
পল্লবের মুখে এ ধরনের কথা শুনে কল্লোল নিজেকে এবার ঠিক রাখতে পারল না। সে ঠাস করে পল্লবের দুই গালে দুই থাপ্পর বসিয়ে দিলো। আওয়াজে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠল।
পল্লব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। সেও কল্লোলকে মারার জন্য উদ্যত হলো। তাড়াতাড়ি সাজেদা চৌধুরী এই অবস্থা সামলাতে দ্রুত দুই ভাইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাতে তাদের বাঁধা দিলেন।
খাবার টেবিলে বসে ধীরে ধীরে সব কথাই শুনলেন খালেক সাহেব। জয়ীতার সব কথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে তারপরে বললেন,
পল্লব তোর সাথে এমন কেনো করছে আমি বুঝতে পারছি না। আমি যতদূর জানি ও তোকে ভীষণ ভালোবাসে। তোকে ঘরে তোলার জন্য ওর মায়ের সাথে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন হলো জানি না। ও তোকে কেনোই বা ডিভোর্স দিতে চাইল, ঘরে তুলতে অস্বীকার করল এগুলি আমার মাথায় আসে না। কিন্তু যতটুকু বুঝি এর পেছনে ওর মায়ের হাত আছে হয়ত বা। ও ওর মায়ের খুব ভক্ত। মাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। আর ওর মায়েরও জান পল্লব।
তবে তুই একটা বাঘের বাচ্চা। নিজের অধিকারের জন্য পল্লবের সাথে, ওর মায়ের সাথে ফাইট করেছিস। জিতেও গিয়েছিস। আর তুই পারবি। সেই তুই এভাবে সব ছেড়ে চলে আসলি? এত কষ্টে অর্জিত সংসার ছেড়ে আসা উচিত হয়নি।
– জয়ীতা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল ভুলটা তো আমি সেই শুরুতেই করেছিলাম। কিসের সংসার? এই এক বছর তাদের সাথে ঠিকই ছিলাম কিন্তু ওই সংসারের কেউ ছিলাম না। জোর করে সংসার হয়না এটা আমার বোঝা উচিত ছিল। থানা পুলিশ মিডিয়া ডেকে ঘরের দরজা তো পার করতে পেরেছিলাম কিন্তু কারো মনের দরজায় টোকা মারার সাহসও হয়নি আমার। সেই ভুল শোধরাতেই ঘর ছেড়েছি আমি।
– জোর করে যে ঘর সংসার হয় না এটা আমার থেকে ভালো আর কে বুঝবে? কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুই কোথাও ভুল করছিস। আমার মনে হয় পল্লবও তোকে ভালবাসে। কিছু একটা সমস্যা তো আছে। না হলে যে পল্লব একসময় তোর জন্য এত পাগল ছিল সে হঠাৎ করে রাতারাতি এমন বদলে যাবে কেন?
– রাতারাতি তো আপনাদের ভালোবাসাও বদলে গিয়েছিল তাই না, বাবা? সে তো ওই মায়েরই সন্তান! এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব।
– খালেক সাহেব জয়ীতার কথায় একটা ধাক্কা খেলেন যেনো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, রাতারাতি কিছুই বদলায়নি মা। আমাদের কথা না হয় থাক। অন্য কোনো একদিন বলব। আমার কাছে যখন এসেছিস এখানে থাক কিছুদিন। আমি পল্লব কে কিছুই বলব না। ওর সাথে কথাবার্তা বলে ওর ভিতরের অবস্থাটাকে বুঝি। এমনিতে তো আর আমার কাছে তোরা আসতি না। দেখ, উপরওয়ালার কী কেরামতি! ঠিকই আমার কাছে তোকে ঠেলে নিয়ে এসেছে। এই নিঃস্ব জীবনে কিছু দিন না হয় মা ছেলে একসাথে থাকি।
– জয়ীতা মাথা নাড়িয়ে মৌন সম্মতি দিলো।
– যা, এখন রুমে যেয়ে বিশ্রাম নে। আরেকটু পরে পারলে ছাদে যেয়ে ছাদে আমার বিশাল বাগান আছে দেখে আয়। দেখলে মন ভালো হয়ে যাবে। আর বিকেলবেলা আমি আমার একটা ঘের আছে তোকে সেখানে নিয়ে যাব। দেখবি সবুজের মাঝে গেলে তোর একদম কোনো কষ্টই মনে থাকবে না।
জয়ীতা আস্তে করে বলল, আচ্ছা।
গাড়িতে বসে নিঃশব্দে কেঁদেই যাচ্ছেন সাজেদা চৌধুরী। কল্লোল মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাতটা চেপে ধরে স্বান্তনা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
সাজেদা চৌধুরী একটা টিস্যু নিয়ে চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে বললেন, একটা কাজ করবে?
– বলো আম্মি।
– যে করে হোক ওই জয়ী মেয়েটাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দাও। তাতে যা করতে হয় তাই করবে। তবে সাবধানে করবে যেনো কোনো ভুলচুক না হয়।
– আম্মি , তোমার কি মনে হয় ওই জয়ীতার কারণেই পল্লব এতটা চেঞ্জ হয়েছে? আমার সেটা মনে হয় না। চৈতীর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি ওই মেয়ের সাথে পল্লবের সম্পর্ক খুব বেশি ভালো না। আর যদি ভাল হয়ও তাতে এতটা ওভার রিয়্যাক্ট করার কথা না। আমার মনে হয় আর কোনো ঘাপলা আছে।
– তাহলে কিছুদিন ওর গতিবিধির উপর খেয়াল রাখো। কী করে, কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, ওর সার্বক্ষণিক সব খবর আমি চাই।
– চিন্তা কোরো না। আমি শহিদের সাথে কথা বলছি। শহিদ তো তোমার খুব বিশ্বস্ত লোক। ওই পল্লবের সব খোঁজ-খবর আমাকে ঠিকঠাক দিবে নিশ্চিন্ত থাকো! আর তারপরেও যদি তোমার মনে হয় যে জয়ীতার কারণে এত সব কিছু ঘটছে তাহলে জয়ীকে কি করতে হয় সেটাও আমি বুঝব।
চলবে……
পর্ব- ৬
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/461142832335058/