#সুখ_নীড়
#পর্ব_১
জয়ীতার সাথে পল্লবের পরিচয় পর্বটা কিছুটা নাটকীয় ভাবেই শুরু হয়। কিছুদিন ধরে জয়ীতা একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিল। সেই সূত্র ধরেই পল্লবের সাথে তার পরিচয়। জয়ীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু অমি নিয়ে এসেছে পল্লবের পার্টিতে। এমন চাকচিক্যময় আর জৌলুস ভরা পার্টিতে এর আগে কখনোই যাওয়া হয়নি জয়ীর৷ ছাপোষা ঘরের মেয়ে সে। এতবড় পার্টিতে তাকে ইনভাইটই বা করবে কে আর সে যাবেই বা কীভাবে? পল্লবকে প্রথম দেখে তার কাছে মনে হয় সিনেমার কোনো হিরো হবে হয়তোবা। চলনে বলনে হিরোদের থেকে কম তো কিছু নয়। তার দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারছিল না জয়ী। অমি বলেছে পার্টির শেষে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে পল্লবের। পল্লব অমির ফ্রেন্ড। এমন একজন মানুষের সাথে অমির বন্ধুত্ব থাকতে পারে ভেবেই জয়ীতা খানিকটা অবাক হয়। অমিও তার মতোই একটা সাদাসিধে পরিবারের ছেলে। তার যে এত বড় মাপের বন্ধু আছে একথা তার কাছে বিশ্বাস করতেও জন্য একটু কষ্ট হয়।
বছর খানেক আগে জয়ীতার বাবা মারা যাবার পরে ওর মা ছোট ভাইবোন দু’টিকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। জয়ীতাকে বাধ্য হয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থেকে যেতে হয়েছে । তার বাবার পেনশনের সামান্য ক’টা টাকায় ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া করে থাকা তাদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব না। জয়ীকে একা এই শহরে রেখে যেতে একদমই মন চায়নি জয়ীর মা সালমা খাতুনের। কিন্তু কী করবে সে? জীবন নিয়ে চলতে তো হবে? ঢাকায় থেকে প্রতিমাসে বাসা ভাড়া টানতে গেলে ছোট ছেলেমেয়ে দু’টিকে পড়াশোনাই বা করাবে কী দিয়ে আর মুখেই বা দিবে কী? অনেক ভেবেচিন্তেই গ্রামে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। জয়ী তখন থার্ড ইয়ারের ছাত্রী ছিল। এখান থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে গ্রামে নিয়ে যেতেও মন সায় দেয়নি তার আর জয়ীও যেতে চায়নি। তাদের আত্মীয় স্বজন অনেকে বুদ্ধি দিয়েছে ট্রান্সফার হয়ে তাদের এলাকার কোনো কলেজে চলে যেতে। কিন্তু জয়ী এত ভালো একটা কলেজে পড়ে তাই ট্রান্সফার হতেও ইচ্ছে হয়নি। সে তার মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করিয়ে ঢাকায় থেকে যায়। কলেজের হোস্টেলে সীট পেয়েছে বেশ ঝামেলার পর। নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাচ্ছে। আবার বাড়িতেও কিছু পাঠানোর চেষ্টা করে প্রতিমাসে। তার বাবার ওই ক’টা টাকায় তার মা কী করে সংসার চালাচ্ছে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পারে।
জয়ীতাকে অমি খুব পছন্দ করে এটা জয়ীতা বুঝেও সবসময় না বোঝার ভাণ করে। অমিকে তার প্রেমিক হিসেবে পছন্দ না হলেও বন্ধু হিসেবে ছেলেটা বেশ ভালোই। জয়ীতার এক ডাকেই তার যেকোনো সমস্যা নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়। জয়ীতাকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে তার। কতবার যে সে ছলেবলে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে জয়ীকে ভালোবাসে। এ কথা বলার কেন যেন সাহস হয়ে ওঠেনি। শুধু ভয় তার জয়ীতা যদি তাকে ভুল বোঝে। তাহলে এত দিনের বন্ধুত্বটা মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে।
প্রতিদিনের মতোই সেদিনও ভীষণ বিরক্ত জয়ী। এমন একটা দিন নেই যেদিন তাকে অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না নেহার। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নেহা। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হলেও চলন বলন দেখলে মনে হবে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এটুকু বয়সেই মানুষকে মাপে সে অর্থের মাপকাঠিতে। মাপাটাও অস্বাভাবিক নয়। বিত্তশালী বাবার মেয়ে। জয়ীতাকে প্রতিদিন এসে কমপক্ষে আধঘন্টা বসে থাকতে হয়।
এরপর সে পড়ার জন্য আসে। নিচতলার কর্ণারের একটা ঘর ঠিক করে দেয়া হয়েছে নেহাকে পড়ানোর জন্য। দেরী করে আসার পরেও সামান্য একটা স্যরি পর্যন্ত বলে না মেয়েটা। মেধা মোটামুটি থাকলেও শিষ্টাচারের ‘শ’ ও নেই। জয়ী কখনো নেহার এই দেরী হওয়া নিয়ে বা পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সাথে সাথে এতটুকুন মেয়ে তার কথাবার্তার স্টাইলে বুঝিয়ে দেয় সে এমনই। মন চাইলে তাকে পড়াবে নইলে নেই।
ওর মা বাবাকে বলবে সেই সাহস জয়ীতার নেই। আজ ক’মাসে ওর বাবাকে আজ অবধি দেখেনি সে। আর নেহার মাকে সেই শুরুর দিনই দেখেছিল। ইন্টারভিউ নেয়ার সময় যা কথা হয়েছে। তার সাথে কথা বলেও জয়ী বুঝেছে এনারা মা মেয়ে একই ধাঁচের। মাসের এক তারিখেই দশ হাজার টাকার একটা খাম হাতে দিয়ে যান একজন মহিলা।
রেহানা খালা নামে সবাই ডাকে মহিলাকে। খুব জাদরেল আর কড়া স্বভাবের। কখনো জিজ্ঞেস করার সাহস না হলেও জয়ী বুঝে গিয়েছে ইনি হয়তো এ বাড়ির কেয়ারটেকার গোছের কেউ। খুব বেশি কথাবার্তা বলেন না। জয়ী মাঝে মাঝে চেষ্টা করে একটু ভাব জমানোর কিন্তু উনার পক্ষ থেকে তেমন সাড়া না মেলায় জয়ীও এখন আর কথা বলতে আগ্রহ বোধ করে না।
জয়ীর একবিন্দুও ইচ্ছে হয় না নেহাকে পড়ানোর। কিন্তু মাস গেলে যে মোটা অংকের টাকাটা হাতে আসে সেটাকে সে কিভাবে হেলায় ফেলে যাবে। তিন চারটি স্টুডেন্ট পড়ালে যে টাকা পাবে সেটা এখানে এক স্টুডেন্ট পড়িয়েই পেয়ে যায় সে। অন্য স্টুডেন্টদের মায়ের কাছে বেতনের টাকার জন্য যেখানে অপেক্ষা করতে করতে অনেক সময় মাসের মাঝামাঝি হয়ে যায় সেখানে নেহাকে পড়ানো বাবদ মাসের শুরুতেই সে টাকাটা পেয়ে যায়।
একটা মিডিয়ার মাধ্যমে সে এই টিউশানিটা পেয়েছে। প্রথম তিনমাসের বেতনের অর্ধেক উনাদের দিয়ে দিতে হয়েছে। এরপর থেকে পুরো টাকাটাই তার। সে থাকে বাড্ডায়। আর পড়াতে আসে গুলশানে। আসা যাওয়া বাবদ কিছু টাকা বেরিয়ে গেলেও বেশকিছু টাকা থাকে তার।
অনার্স শেষ করে একটা চাকরির জন্য হণ্য হয়ে ঘুরছে। এত ভালো রেজাল্ট হবার পরেও কোনো চাকরিই পাচ্ছে না। আজকাল রেফারেন্স ছাড়া চাকরি বাকরি পাওয়াই মুশকিল। আর সরকারি চাকরিতে যে পরিমাণ লবিং তাত সরকারি চাকরির আশা তো সে করেই না। টিউশানি করেই এতদূর এসেছে । তার উপর বাড়িতেও কিছু টাকা পয়সা পাঠাতে হয়। এই দুর্মূল্যের বাজারে তার মায়ের পক্ষে ছোটো ভাইবোন দু’টির পড়াশোনা চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
জয়ীর বিয়ে দেওয়া নিয়েও তার মায়ের চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু মেয়ের জন্য যোগ্য ছেলেই পাচ্ছেন না। দেখতে শুনতে এত সুন্দর হবার পরেও যোগ্য ছেলে পেলেও যেখান থেকেই সম্মন্ধ আসছে বড়সড় রকমের ডিমান্ড তাদের। জয়ীর মায়ের সেই সামর্থ্য কোথায়? তাই এক দিন দু’দিন করতে করতে সময় পেরিয়েই যাচ্ছে। একেকটা দিন যাচ্ছে আর সাথে পাল্লা দিয়ে সালমা খাতুনের দুশ্চিন্তা বেড়েই যাচ্ছে। জয়ী এ নিয়ে তাকে চিন্তা করতে বারবার নিষেধ করে কিন্তু মায়ের মন কি সেটা শোনে! তাছাড়া এতবড় সেয়ানা মেয়ে একা একা শহরে থাকে। তাই জয়ীকে নিয়ে পাড়ার লোকজন কীসব আজেবাজে কথা কানাঘুষা করে। সবই টের পায় সে। কিন্তু অপারগ হয়ে শুধু শুনে আর হজম করে। এদিকে জুঁইও বড় হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের চিন্তায় সালমা বানু দুশ্চিন্তায় রাত পার করে। এখন একটু আশা মেয়েটার একটা ভালো চাকরি হলে হয়ত বিয়ে দিতে তেমন সমস্যা হবে না। মরার আগে মেয়ে দুইটাকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায় সে। ছেলেটা মাত্র সেভেনে পড়ে। কবে বড় হবে আর কবে সংসারের হাল ধরবে এ নিয়েও দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
অমি টুকটাক রাজনীতি করে একথা জয়ীতার জানা ছিল। ক’দিন ধরেই অমির কান খসাচ্ছিল একটা চাকরির জন্য। নেহাকে তার পড়াতে একদমই ইচ্ছে করে না। টাকাই কি সব, যেখানে ন্যূনতম সম্মানটুকু নেই সেখানে পড়ানোর কোনো অর্থই হয় না। সেদিন হোমওয়ার্ক না করার কারণে কিছুটা বকাঝকা করতেই নেহা ভীষণ দুর্ব্যবহার করে জয়ীতার সাথে। জয়ীর একবার তো মন চাইছিল কষে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় ওর গালে। সময় মত নেহার ছোট চাচা তুহিন এসে না পড়লে এমন কিছু ঘটতে খুব বেশি বিলম্ব হতো না। আর নেহার গালে থাপ্পর দিলে কী যে কুরুক্ষেত্র অবস্থা হতো সেটাও জয়ীতার অজানা নয়।
তুহিন বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। জয়িতার সাথে খুব বেশি পরিচয় না থাকলেও মাঝে মাঝে দেখা হলে হাই-হ্যালো টাইপের কথাবার্তা হয়। নেহা যে কেমন স্বভাবের সেটা তো তুহিনের অজানা নয়। কিছুটা উচ্চস্বরে কথাবার্তার টের পেয়েই সে ছুটে চলে আসে। জয়ীতার সামনেই সে নেহাকে ধমক দেয়। নেহাকে তার খারাপ আচরণের জন্য জয়ীতার কাছে বারবার স্যরি বলতে বললেও সে স্যরি বলল না। উলটা চাচার উপর রাগ দেখাচ্ছে। তুহিন নেহার সাথে না পেরে ভাতিজির পক্ষ থেকে সে নিজেই জয়ীতাকে স্যরি বলে। এতটুকুন বাচ্চার কাছে অপমানিত হয়ে তুহিনের সামনে ভীষণ লজ্জিত হয় জয়ীতা।
নেহাদের বাসা থেকে বের হয়ে জয়ী তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই মেয়েকে আর নয়। এমন বেয়াদব মেয়েকে পড়িয়ে পয়সা ইনকামের চেয়ে না খেয়ে মরাও ভালো।
রাগে গজগজ করতে করতে যখন ফুটপাত ধরে হাঁটছিল ঠিক তখনই অমির ফোন এলো।
– হ্যাঁ বল, কিছু বলবি?
জয়ীতার কথা বলার সুর শুনে অমি বুঝতে পারল জয়িতা ভীষণ রেগে আছে কোনো কারনে।
– ম্যাডাম দেখছি ভীষণ রেগে আছেন! কী হয়েছে এই অধমকে কি বলা যাবে?
– বলা যাবে না কেনো? বলাতো অবশ্যই যাবে। তোকে কতবার বললাম একটা চাকরি জোগাড় করে দে, ছোটখাটো যাই হোক কোন সমস্যা নেই। এই টিউশন করাতে আর ভালো লাগে না।
– বুঝতে পেরেছি নেহার সাথে তোর আবার ঝামেলা হয়েছে, না?
– বুঝতেই যখন পেরেছিস তাহলে কিছু একটা কর! আমি ওকে আর পড়াব না, ফাইনাল। আর ওকে না পড়ালে আমার কিভাবে চলবে সেটাও নিশ্চয়ই তুই বুঝেছিস।
– আমি কি করবো বল! আমি নিজেও তো একটা বেকার। চেষ্টা তো কত জায়গায় করছি।
– তোর না কত বড়লোক বড়লোক বন্ধু আছে নাকি শুধু শুধু গল্প করিস? তারপর তুই আবার রাজনীতিও করিস। দেখ না কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কিনা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে রে, ভাই! আর পারছি না। ওদিকে মায়ের ফোনের পর ফোন। সামনের মাসের জুঁইয়ের ফরম ফিল আপের টাকা দিতে হবে। কীভাবে কি করবো মাথায় আসছে না।
মাঝে মাঝে মন চায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরি। এত হিসাব করে কি জীবন চালানো যায়?
– নদী পাবিরে কোথায় তুই? ঢাকা শহরে তো আছে ওই এক পঁচা বুড়িগঙ্গা নদী। ঝাঁপ দেওয়ার জন্য কাছে যেয়ে যখন দাঁড়াবি, পঁচা গন্ধে তখন নাড়িভুঁড়ি এমনিতেই উল্টে বের হয়ে আসবে তখন আর মরার ইচ্ছা থাকবেনা! হা হা!
– সবকিছুতে তোরে খামখেয়ালিপনা আর ভালো লাগে না। ফোন রাখ। আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিবি না।
– স্যরি, স্যরি, স্যরি। আর একটা কথা বলি শোন। ফোন রাখিস না, প্লিজ।
– তোর সাথে ফালতু কথা বলার সময় নেই। আর কখনো ফোন দিবি না। তোর তো মাথার উপর তবু বড় বোন আছে। মাঝে মাঝে নির্লজ্জের মতো তার কাছে যেয়ে হাত পাততে পারিস আমার তো সেই জায়গাও নেই। তাই তুই আমার সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছিস না।
– একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমি বলল, ঠিকই বলেছিস যে যার জায়গায় বসে তার সিচুয়েশন বুঝতে পারে অন্যের জায়গায় যেয়ে সিচুয়েশন বোঝা যায় না। তাহলে এ কথা বলতে পারতিস না। আচ্ছা, এক কাজ কর আজকে আটটার দিকে তুই ফ্রী আছিস? তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।
জয়ীতা বুঝতে পারল তার কথায় অমি কষ্ট পেয়েছে।
– আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? ভীষণ দুঃখিত, দোস্ত। জানিসই তো মাথা গরম হলে কোনো কিছু ঠিক থাকে না আমার। আচ্ছা, এবার বল আটটার সময় কোথায় নিয়ে যাবি? আটটার সময় বেরুলে ফিরব কখন? হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে তো? কোথাও বিক্রি করে করে দিবি না তো আবার? পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য হেসে বলল, জয়ীতা।
– ভয় নেই তোকে বিক্রি করে দিব না। আর তোর মতো একটা মেয়েকে কিনবেই বা কে? খালাম্মা জন্মের সময় তোর মুখে এক ফোঁটা মধু দিয়েছিল কি না দেখা হলে জিজ্ঞেস করে নিবো! বেশি দেরি হলে আজ আর হোস্টেলে ফিরতে হবে না। আমার কাজিন মায়ার কাছে থাকিস ওকে আমি বলে রাখব।
– সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু যাবটা কোথায় সেটা তো বলবি আগে!
– চাকরি চাকরি করে তো মাথাটা খেয়ে ফেলছিস। চল, আজ তোকে আমার এক বন্ধুর পার্টিতে নিয়ে যাই। বিশাল বড় ব্যবসায়ী আর পলিটিশিয়ান মায়ের ছেলে। তোকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। দেখি তোর একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা! একটু ভালো করে ফিটফাট হয়ে আসিস। ভালো একটা ড্রেস পরিস। কারণ এমন বড়লোকদের পার্টিতে আমাদের মত হাভাতে ঘরের ছেলে মেয়ে দাওয়াত পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! আমি বাইক নিয়ে তোর হোস্টেল গেটে অপেক্ষা করব।
– সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এত বড়লোক বন্ধু আছে তাহলে তোর একটা চাকরির ব্যবস্থা হয় না কেনো? তোরই যেখানে কোনো চাকরি হয় না সেখানে আমাকে নিয়ে কী করবি?
– বন্ধুদের কাছে চাকরি চাইতে নেই তাহলে বন্ধুত্ব থাকে না ওদের গোলাম হয়ে থাকতে হয় । এত প্রেস্টিজলেস মানুষ আমি না, হাহাহা।
– পেটে ভাত নেই অথচ প্রেস্টিজ! আর তোর এই বাইক নিয়ে সারাদিন ফুটানি করা আর গেল না।
– এই যে শুরু হয়েছে বড় আপার মত লেকচার দেওয়া। আমি বাইক চালাই তাতে তোদের কী রে? আমি কি কারো কাছে বাইকের তেল কেনার টাকা চাই? সারাদিন এর পিছে ওর পিছে চামচামি করে যা দু’চার পয়সা কামাই তাতে আমার বাইকের তেলের পয়সা চলে যায়।
আচ্ছা, জ্ঞান দেয়া বাদ দে। বাদ দিয়ে হোস্টেলে ফিরে যেয়ে বেশ ভালো করে রেডি হবি। জানিসই তো ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা লাস্ট ইম্প্রেশন।
– কেনোরে, তোর বন্ধু কি সুন্দরী দেখে চাকরি দেয় নাকি?
– ব্যাপারটা সেরকম না। তবে এটা তো তুইও স্বীকার করিস যে আউটলুক যদি ভালো না হয় তাহলে সহজে কারো নজরে আসা যায় না। তাছাড়া পল্লব কিছুটা চুজি টাইপের। ওর কাছের বন্ধুবান্ধব সব ফিট এন্ড এলিগ্যান্ট৷ আমাকে দেখেও বুঝতে পারছিস না। হা হা হা।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। বুঝেছি, বুঝেছি। সুযোগ পেয়ে নিজের ঢোল বাজিয়ে যাচ্ছেন, ফিটবাবু। আমি রেডি থাকব আপনি ঠিক আটটার সময় চলে আসবেন। আপনার তো আবার সময়ের কান্ডজ্ঞান একটু কম।
– বুঝেছি। আজ পড়েছি মোঘলের হাতে খানা খেতে হবে তার সাথে। আমি ঠিক আটটায় তোর গেটের সামনে থাকব।
ঝামেলায় পড়ল জয়ীতা। তার কাছে যেসব ড্রেস আছে সেগুলোর বেশিরভাগই আটপৌরে। ওগুলো পরে কোনো পার্টিতে যাওয়ার মতো না। বড়লোকদের ওইসব পার্টিতে তো একেবারেই না। এ ধরনের পার্টিতে সে না গেলেও টিভিতে দেখে সে এটুকু বুঝতে পারে যে ওখানে কেমন ধরনের পোশাক-আশাক পরে মেয়েরা যায়। একবার মন চাচ্ছে সে যাবে না। এ ধরনের পার্টিতে অনেক সময় ছেলেমেয়েরা ড্রিঙ্ক করে থাকে। মাতাল অবস্থায় নানান ধরনের উল্টাপাল্টা কাজ করে। কিন্তু না যেয়ে উপায় নেই। তাছাড়া অমিকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। অমি যেহেতু তার সাথে আছে অতএব কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই তার। তার উপর অমিকে সে কথা দিয়েছে। এখন যদি না যাবার কথা বলে তাহলে ভীষণ রেগে যাবে।
জয়ীতার গোমরা মুখ দেখে ওর রুমমেট মারিয়া এগিয়ে এলো।
– কিরে, কি হয়েছে? সমস্যা কোনো?
– সমস্যা না, আবার সমস্যা। একটা পার্টিতে যাব কিন্তু কি পরে যাব বলতো! আমার তো সেরকম কোনো ভালো ড্রেস নেই। কয়েকটা সুতির ড্রেস আছে সেগুলো তো রেগুলার পরা হয়। আর সিল্কের একটা ড্রেস আছে ওটা তো খুব বেশি দামি ড্রেসও না। ওটা পরে ওদের ওখানে যাওয়াটা মনে হয় ভালো হবে না।
– আমার ড্রেস পরতে পারতি। কিন্তু ওগুলো তো তোর গায়ে ফিট হবে না। এক কাজ কর তোর কাছে না খালাম্মার একটা শাড়ি আছে।
– পার্টিতে শাড়ি পরে যাব?
– হুম, তাতে কি! এটাইতো বেস্ট। জিন্স, টপস, শার্ট বলিস আর যত দামি থ্রি পিসই বলিস সবকিছুর উপর হচ্ছে শাড়ি। একটা এলিগ্যান্ট লুক নিয়ে আসে। তাছাড়া খালাম্মার ওই শাড়িটা তো খুব ভালো। শাড়িটা পরলে তোকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে!
– ঠিক আছে, তাহলে বের করি।
বহুদিন পর আজ তার মায়ের আকাশী কালারের জামদানি শাড়িটা ভাঁজ খুলতেই যেন মনে হলো তার মায়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সেই ঘ্রাণ নিলো। এটা তার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় শাড়ি। কোনো এক বিবাহ বার্ষিকীতে তার বাবা উপহার হিসেবে কিনে দিয়েছিল। কলেজের ফাংশনে পরার জন্য এই শাড়িটা রেখেছিল।
– আয়, আমি পরিয়ে দেই।
শাড়িতে সব সময়ই যেকোনো মেয়েদেরই একটু বেশিই সুন্দর দেখায়। আকাশী জামদানীর সাথে ম্যাচিং করে হালকা গহনায় ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে জয়ীতাকে।
হোস্টেল গেটে পৌঁছাতেই জয়ীতাকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে অমি।
– কিরে, হা করে আছিস কেনো? চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে না, এবার?
– এত সুন্দর করে সেজেছিস কেনো?
– সাজলাম কোথায়? আর তুইই তো বললি পরিপাটি হয়ে আসতে।
– তাই বলে শাড়ি পরতে হবে অন্য কিছু পরতি!
– আমার যেটা মন চেয়েছে সেটা পরেছি। তুই এখন যাবি কি না বল। না গেলে বল আমি হোস্টেলে ফেরত যাই।
– না, না। ঠিক আছে। ওঠ, শক্ত করে ধরিস।
পার্টিতে পৌঁছে চারদিকে এত আলো ঝলমলানিতে নিজেকে খুব ফিকে লাগছে জয়ীতার। সবাই কত আনন্দ ফূর্তি করছে। নানান রঙের ছোঁয়ায় একেকজনকে একেকরকম সুন্দর লাগছে। আর তাকে বড্ড সেকেলে লাগছে সবার মাঝে। পুরো পার্টিতে চোখ
বুলিয়ে সে দেখতে পেল না কাউকে যে কেউ শাড়ি পরেছে। কোনরকম গুটিসুটি মেরে বসে আছে জয়িতা
অমির উপর ভীষণ বিরক্ত সে। এসেই তাকে এখানে বসিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে বলে গেল। এমন যাওয়া গেল আসার আর নাম নেই। বন্ধুবান্ধব পেলে আর কোনো হুশ থাকে না।
পল্লবের সাথে জয়ীকে কেউ পরিচয় করিয়ে না দিলেও বারবার তার চোখ পল্লবকে ঘিরেই ঘুরছে। সে মনে মনে আন্দাজ করেছে এই নিশ্চয়ই পল্লব। পার্টি’র একদম মধ্যমণি।
কয়েকটা মেয়ে জয়ীতার দিকে তাকিয়ে কানাঘুষো করছে আর কি যেনো বলছে। জয়ীতা এটা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে। করবেই না বা কেন সবাই যেখানে আনন্দ-ফুর্তিতে মশগুল সেখানে সেই একমাত্র মানুষ যে অপদার্থের মত পার্টির এক কোণে বসে আছে , তার উপর পরেছে শাড়ি ।
খেয়াল করল এসির মাঝেও দরদর করে ঘামছে সে। অমিকে কয়েকবার ফোন দিয়েও কোনো খবর নেই। এত শব্দের মধ্যে হয়তো ফোনের রিংটোনটা তার কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে জয়ীর। কোন আক্কেলে যে সে অমির মতো একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের কথায় নাচতে নাচতে এখানে চলে এসেছে এটা ভেবেই এখন খুব রাগ হচ্ছে। অমিকে ডাকতে যে সামনের দিকে যাবে সেই সাহসও তার নেই। সবার মাঝে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে তার। কে আবার কী বলে ফেলে এই ভয়ে আরো গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
চলবে……