সুখ নীড় পর্ব-২৮

0
257

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২৮

তুহিন সব বিল পরিশোধ করে জয়ীতার বাচ্চাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করিয়ে সাথে করে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে এসেছে। সাথে জয়ীর মাও আছেন। জয়ীতা হাসপাতলে অসুস্থ একথা এখনো তুহিন তার মাকে জানায়নি। জয়ীতা কখন না কখন সুস্থ হয় সেই অপেক্ষা না করে তুহিন নিজে থেকেই বাচ্চাটাকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে এসেছে।

সে হাসপাতালে পৌঁছাতেই কর্তৃপক্ষ জানালো যে, জয়ীতার বাচ্চার অবস্থা এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো। ফুসফুসও ভালোই কাজ করছে। অনেকটাই স্বাভাবিক। বড় কোনো ঝুঁকি নেই আর। তাই তারা চাইলে এখনই বাচ্চাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া হাসপাতালে নবজাতকের জন্য বেডের বেশ স্বল্পতা। বাসায় নিয়ে যথাযথভাবে দেখভাল করলেই খুব তাড়াতাড়ি সে আরো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

দুই তিনদিন আগে জয়ীতা হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে অনুনয়-বিনয় করেছে যাতে তার বাচ্চা কিছুটা স্বাভাবিক হলে রিলিজ দেওয়া হয়। প্রতিদিনের এত এত খরচ জয়ীতার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। তাই সে তার বাচ্চাকে বাসায় নিয়ে যেতে চায়। এমনিতেই এ পর্যন্ত তুহিনের কাছ থেকে প্রচুর নেওয়া হয়েছে আর কত নেওয়া যায়। সে মুখ ফুটে কিছু না বললেও তুহিন নিজে থেকে সবকিছু করছে। জয়ীতার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। এভাবে আর কত ঋণী থাকা যায়!

পল্লবের নিখোঁজ হওয়ার রাতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা শুনে সাজেদা চৌধুরীর চোখ ছানাবড়া। ওই রহস্যময় মেয়েটা কে হতে পারে, কিভাবে তার কাছে পল্লবের ফোন গেল এটা কিছুতেই সে মেলাতে পারছে না। সাজেদা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন এবার সে প্রমাণ পেয়েছেন তাই এবার আর বসে থাকবেন না। জয়ীতাকে সাথে নিয়ে সোজা থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জয়ীতাকে বললেন, সেদিন রাতে যা কিছু ঘটেছিল সবকিছু নিখুঁতভাবে থানায় যেন সে বর্ণনা দেয়। কোনো একটা সূক্ষ্ম ঘটনাও যেন বাদ না পড়ে। যে কোনো মূল্যে সে তার ছেলেকে যে বা যারা খুন করেছে তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়।

এত সময় ছেলের খুনিকে খুঁজে বের করার উত্তেজনায় সাজেদা চৌধুরী ভুলেই গিয়েছিলেন যে জয়ীতার বাচ্চা হয়েছে । কিন্তু সেই বাচ্চা এখন কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করার কথা এতক্ষণ মনে আসেনি। গাড়িতে বসে জয়ীতাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজে কিছুটা শান্ত হতেই পল্লব এবং তার বাচ্চার কথা মাথায় আসল।

জয়ীতা গাড়িতেও ডুকরে কেঁদেই যাচ্ছে সাজেদা চৌধুরী তাকে সান্তনা দিতে দিতে বললেন, যে যাবার সে তো চলে গিয়েছে। তাকে তো আমরা আর ফিরে পাবো না। শুধু শুধু কান্না করে তুমি তোমার বাচ্চাটার ক্ষতি করছ। আমার কাছে সবকিছুর আগে এই মুহূর্তে পল্লবের বাচ্চা । আমার আদরের নাতীকে তুমি কোথায় রেখেছ, মা। ওকে একনজর আমাকে দেখতে দাও।।

জয়ীতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ সে সতর্ক হলো। এই মানুষটার আসলেই কি পরিবর্তন হয়েছে নাকি তার সাথে অভিনয় করছে সে বুঝতে পারছে না। এভাবে মা বলে ডাকছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে নাকি তার কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নেয়ার পায়তারা করছে জয়ীতার মাথায় আসছে না কোনোটাই । তার বাচ্চাকে নিয়ে সত্যি বলবে নাকি মিথ্যে বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু এই মুহুর্তে সাজেদা চৌধুরীর কাছে মিথ্যে বলাটাও যেন একটা বড় অন্যায় হয়ে যাবে তার নিজের সাথেই। একদিকে তার ছেলের আকাশসম বিল সামলাতে হিমসিম খেতে হবে তাকে অন্যদিকে পল্লবের খুনিকে খুঁজে বের করতে হলে এনার সাহায্য ছাড়া তার একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না।

কিন্তু তার ভয় হচ্ছে সত্যটা জানার পরে তার কাছ থেকে তার বাচ্চাকে কেড়ে নেওয়া হবে নাতো! কিন্তু যাবে তো যাবেই বা কোথায়? সাজেদা চৌধুরী যখন একবার জানতে পেরেছেন যে পল্লবের বাচ্চা আছে। সে তাকে কিছু না জানালেও এই পৃথিবীর বুকে তার বাচ্চা যেখানেই থাক সে কিছুতেই জয়িতাকে ছেড়ে কথা বলবে না! তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করবে!

সাজেদা চৌধুরী আবারো জয়ীতাকে তার বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করলে জয়ীতা এবার আমতা আমতা করে বলে তার বাচ্চা তার বাসাতেই আছে। তার বাচ্চাটা যে প্রি-ম্যাচিউর বেবি এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে এসব কথা আর বলতে গেল না কিছুই।

জয়ীতার কাছে সেদিন রাতের সব বর্ণনা শুনে পুলিশ অফিসার এবার কেইস নিতে বাধ্য হলেন। জয়ীতা এবং সাজেদা চৌধুরী দু’জনেই আশাবাদী।

সাজেদা চৌধুরী নিজেই জয়ীতাকে নিয়ে জয়ীতার বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হলেন। জয়ীতা কয়েকবার চেষ্টা করেছে কোনোভাবে ওনার পিছু ছাড়ানো যায় কিনা কিন্তু কোন লাভ হয়নি। পল্লবের কবর দেখতে চাইলে সাজেদা চৌধুরী বলেন, পরে দেখাবেন।

একবুক হাহাকার আর শূন্যতা নিয়ে একদিন পরে বাসায় ফিরেছে জয়ীতা। বাসাতে ফিরে অবাক। তুহিন তার সমস্ত চিন্তাকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। তার বাচ্চাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করিয়েছে। এতগুলো টাকা কী করে সে বিল দিবে এটা নিয়ে চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছিল অথচ সবকিছুর সমাধান তুহিনই করেছে, অথচ সে কিছুই টের পেল না।

জয়ীতা তার মায়ের কাছে এ ব্যাপারে সব কথা শুনল কীভাবে তুহিন তাদেরকে সাহায্য করেছে। তার মায়ের কাছে পল্লবের কথা বলতে যেয়ে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে । সাজেদা চৌধুরীও নাতীকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

সেদিন রাতের আসা মেয়েটার নাম বলেছিল মেঘনা। তবে জয়ীর সন্দেহ হচ্ছে ওটা ওর আসল নাম কিনা! সে একবার ম শব্দটা বলে পরে বলেছে মেঘনা। তার মানে এটা তার আসল নাম না। আসল নাম বলতে গিয়ে সে আবার থেমে যেয়ে অন্য একটা নাম বলেছে। মেয়েটার কাছে পল্লবের ফোন কী করে এলো এটাই মাথায় ঘোরাচ্ছে জয়ীতা। হঠাৎ তার আরেকটা কথা মনে আসায় সে দ্রুত তার শাশুড়িকে ফোন করল।

সাজেদা চৌধুরী ফোন ধরতেই জয়ীতা বলল,

– আমি একটা বিষয় তো ক্লিয়ার যে ওই মেয়েটার নাম মোটেই মেঘনা নয় তবে ম অক্ষর দিয়েই কোনো নাম হবে। আরেকটা বিষয় আমার কাছে খটকা লেগেছে সেটা হলো ও নিশ্চয়ই নিজে গাড়ি চালিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত আসেনি। ওর সাথে হয়ত ওর ড্রাইভার ছিল অথবা অন্য কেউ।

– সাজেদা একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, তোমার এটা কেন মনে হচ্ছে? তুমিতো থানায় স্টেটমেন্ট দিলে ও নিজে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছে। ওর সাথে আর কেউই ছিল না।

– মনে হচ্ছে কারণ ওকে বিদায় জানাতে যখন আমি রাস্তা পর্যন্ত গিয়েছিলাম তখন খেয়াল করেছি ও যখন ড্রাইভিং সিটে বসে তখন সিটটাকে ও একটু এডজাষ্ট করে নিয়েছিল ওর নিজের জন্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ও যদি ওই রাতে নিজেই ড্রাইভ করে আসত তাহলে সিটটা ওর আন্দাজেই এডজাস্ট করা থাকত। আমার মনে হচ্ছে এখান পর্যন্ত ও নিজে ড্রাইভ করে আসেনি ওর সাথে অন্য আরেকজন ড্রাইভার ছিল। হয়তো সেও ওর সহযোগী!

– হতে পারে। তোমার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু অতো রাতে তুমি বললে যে ঐদিন ঝড়-বাদল ছিল তাছাড়া সামনে গাছ উপড়ে পড়েছিল তাহলে ওই লোকটা গেল কোথায়? আর গেলই বা কী করে?

– আমার মনে হচ্ছে লোকটা হয়তো এখানকার আশেপাশের কেউ অথবা ওনাদের সাথে আরও একটা গাড়ি ছিল সেটাতে ওরা ব্যাক করেছে।

– তোমারে কথাটা কেমন যেন মিলছে না। ওদের সাথে যদি আরেকটা গাড়ি থাকত এবং ওরা যদি ব্যাক করত তাহলে এই মেয়েটাও নিশ্চয়ই ওদের পিছু পিছু চলে যেত। সে একা ছিল বিধায় ঝড়বাদলের রাতে যেতে সাহস পায়নি তোমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে এবং ও যদি জানত এটা পল্লবের বাসা তাহলে সে কখনোই আসত না। সে হয়তো ভুল করেই তোমার এখানে এসেছে।

– আমিও সেটা ভাবছি কারন ও যদি জানত এটা পল্লবের বাসা তাহলে নিশ্চয়ই পল্লবের ফোনটা ওভাবে সাথে করে নিয়ে আসত না। আমার কাছে আরেকটা ব্যাপার খটকা লাগছে। আমার মনে হচ্ছে ওরা হয়ত পল্লবের পিছু করছিল। পল্লব সেই সময় বাসাতে ফিরছিল। না হলে ওই ঝড় বাদলের রাতে এখানে কেন আসবে?
পল্লবকে ওরা…. আর কিছু বলতে পারে না জয়ীতা। কিছুতেই চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারে না সে। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছে সেদিনের ঘটনা।

যদিও নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছে সে পল্লবের জন্য কাঁদবে না। কান্না মানুষকে দুর্বল করে দেয় এই মুহূর্তে তাকে দুর্বল হওয়া চলবে না। যে করে হোক পল্লবের খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে।

জয়ীতার সাথে কথা শেষ করে সাজেদা চৌধুরী দ্রুত থানার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

থানায় পৌঁছাতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। পল্লবের নিখোঁজ হওয়ার পরে আরও তিন দিন ধরে তার ব্যাংক ট্রানজেকশন হয়েছে। সাজেদা চৌধুরীর তো মাথায় হাত এটা কি করে সম্ভব একজন মৃত ব্যক্তির একাউন্ট কী করে ট্রানজেকশন হয়?

এবার আবার সাজেদা চৌধুরীর সন্দেহের তীর জয়ীর দিকে। যেহেতু লেনদেনগুলো কার্ডে হয়েছে তার মানে জয়ীতা নিশ্চয়ই পল্লবের কার্ডের পাসওয়ার্ড জানে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। স্বামীর ব্যাংক পাসওয়ার্ড স্ত্রী জানতেই পারে। এ ছাড়া আর কে পল্লবের পাসওয়ার্ড জানবে বা ব্যাংক থেকে টাকা তুলবে। ব্যাংক স্টেটমেন্টটা হাতে নিয়ে সে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করছে। রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। এই জয়ীতাই তাহলে তার ছেলে পল্লবকে খুন করেছে আর এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য নাটকের পর নাটক করে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য সেদিন রাতের ওই সব মনগড়া কাহিনী সাজিয়ে তাকে বোকা বানাচ্ছে।

এমন মুহূর্তে হান্নান সাহেব এসে সাজেদা চৌধুরীর পাশে বসল।

হান্নান সাহেবকে দেখে সাজেদা চৌধুরীর মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।

– তুমি? তুমি এখানে কি করতে এসেছ? আর তুমি জানলেই বা কী করে যে আমি থানায় এসেছি?

– শান্ত হও সাজেদা! থানায় এসেছি আমি অন্য একটা কাজে। যাওয়ার পথে তোমাকে দেখে এখানে থামলাম ।

– তোমার তো এখানে থামার কথা না। তোমার কাজ শেষ তুমি চলে যাও, প্লিজ। তোমার কারণে আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি তুমি ভুলে যেও না।

– আমার কারণে মানে? কী বলতে চাচ্ছ তুমি? পল্লব কি আমার কেউ ছিল না? আমি কি তাকে ভালোবাসতাম না? আমি এই ক’টা দিন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না।।যেদিকে তাকাই শুধু পল্লবকে দেখি। আমার কষ্টটা না বুঝে উলটা ব্লেম করছ! এই স্বভাবটা আর গেল না তোমার!

– তুমি যদি আমার ছেলের কান না ভরতে তাহলে সে আমাকে ছেড়ে এই জঙ্গলে বাসাও নিত না আর এভাবে খুনও হতো না।

– বাহ, নিজের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ! পল্লবের স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করেছ তুমি আর তোমার অহংকার! তোমার থেকে পালিয়ে বেড়াতেই সে বিরুলিয়াতে বাসা নিয়েছে। কী করেছিলে ওর সাথে আর ওর বউয়ের সাথে সেটা কি মানুষ ভুলে গেছে ভেবেছ?

– আরো কিছু বলতে যাবে তখন সাজেদা চৌধুরী চোখ কটমট করে তাকালেন।

চলবে….

পর্ব- ২৭

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/522962739486400/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here