অদ্ভুত_প্রেমবিলাস পর্ব-৬

0
807

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-০৬|

নিত্যদিনের অভ্যাসের মত মিতা বেগম খবরের কাগজ টা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। আজকাল দেশের যে অবস্থা, খুন খারাবা তো লেগেই আছে। এর মাঝে সালমা এসে চায়ের কাপ রেখে গেছে টেবিলে। আজ সালমার বকবক করার সময় নেই। খুব ব্যস্ত মানুষ সে। মিতা বেগমের কোন ছেলে বাড়িতে এলে, মিতা বেগমের থেকে সালমা বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। কোনটা রেখে কোনটা আয়োজন করব বুঝে উঠতে পারেনা। মিতা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আজ দুপুরে কি কি রান্না করবি?’

সালমা একনজর মিতা বেগমের দিকে তাকায়। ব্যস্ততার মাঝে হাতের কাজ থামিয়ে বলল,

‘ এখনও কিছু ঠিক করিনি আপা, লাবিদ বাবা আর বৌমা আসলে ওদের থেকে জিজ্ঞেস করে নেব ওরা কি কি খেতে চায়। তারপরে সেই অনুযায়ী রান্না করবো।’

মিতা বেগম কিছু না বলে আবার খবরের কাগজ পড়ে মন দেয়। কিছু সময় পরে কলিংবেল বাজলে, সালমা হাতের কাছে রেখে তড়িঘড়ি গিয়ে দরজা খুলে। লাবিদ আর তার বউ এসেছে। দুজনেই সালমা বেগম কে দেখে মৃদু হাসে। রুমি সালমা কে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ কেমন আছো আন্টি?’

সালমা হাসি মুখে বলল,

‘ আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো? আর এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো আসো ভিতরে আসো।’

দুজনের ভিতরে ঢুকি। লাবিদ সোজা গিয়ে ওর আম্মুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল,

‘ কেমন আছো আম্মু তুমি? তোমাকে এত শুকনো শুকনো লাগছে কেন? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না তুমি?’

ছেলের এমন হাজারো অভিযোগ শুনে মিতা বেগম মৃদু হেসে ছেলের গালে হাত দিয়ে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ আমি একদম ভালো আছি বাবা। তুই আমাকে অনেকদিন পর দেখছিস তো তাই শুকনো শুকনো মনে হচ্ছে। কিন্তু তোর চেহারা এমন হাল করেছিস কেন?’

লাবিদ ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে ওর আম্মুর কোলে মাথা রেখে বলল,

‘ ও কিছু না আম্মু।’

লাবিদের পিছন থেকে রুমি একটু উচু গলায় বলল,

‘ আম্মু তুমি তোমার ছেলের কথা একদম বিশ্বাস করবে না। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। না নিজের যত্ন নিবে না আমাকে একটু সময় দিবে। এই দুই-তিন সপ্তাহ ধরে তার রুটিন ছিল কি জানো আম্মু? ভোর ছয়টা কিংবা সাড়ে ছয়টার মধ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে আর ফিরবে রাত করে। কোন কোন দিন তো রাত একটা দুটো বাজিয়েছে তোমার এই গুণধর ছেলে।’

মিতা বেগম তার ছেলের কান আলতভাবে ধরে বলল,

‘ এইসব আমি কি শুনছি তোর নামে? তুই জানিস তো আমি এসব পছন্দ করিনা? তাহলে?’

লাবিদ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘ আম্মু তুমি আমার কথাটা তো শুনবে। আমাদের কোম্পানির সাইড এর কাজের জন্য ভাইয়া আমাকে যেতে বলেছিল। এই জন্যই তো রুটিনের হেরফের হয়েছে।’

মিতা বেগম ছেলের কান ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘ আমি যেন আর কখনো শুনি না কাজের জন্য বৌমাকে সময় দিচ্ছিস না। তোর বাবার কাছে সবার আগে ছিল তার ফ্যামিলি তারপরে ছিল কাজ। কথাটা সব সময় মাথায় রাখবি বাবা, ফ্যামিলি তোর প্রথম দায়িত্ব, না হলে একসময় দেখবি তোর কাজ তোর আপন হয়ে আছে আর ফ্যামিলি তো পর হয়ে গেছে। সবার আগে ফ্যামিলিকে প্রায়োরিটি দিতে হবে।’

লাবিদ নিজের কান ধরে বলল,

‘ সরি আমি আর কখনো এমন করব না।’

মিতা বেগম লাবিদের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

‘ এইতো আমার ভালো ছেলে মত কথা।’

রুমি এসে মিতা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল,

‘ কেমন আছো আম্মু তুমি?’

মিতা বেগম রুমির দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। পরে কথা হবে আগে গিয়ে তোমরা দু’জন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’

মিতা বেগমের কথামতো লাবিদ আর রুমি চলে যায় ওদের রুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

রফিক দুলার অশান্ত মন নিয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। বিছানার এপাশ ওপাশ করে চোখের পাতা এক করতে পারছেন না তিনি। দুপুর বেলার পড়ে দোকানে কাজ না থাকায় বাড়ি ফিরেছেন তিনি। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে আবার উঠে বসেন তিনি। এইটুকু বয়সে তার ছোট্ট মেয়েটার জীবনে কতকিছু হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই চেষ্টা করছে ওকে হাসিখুশি রাখার। কিন্তু হয়ত ওর মনে সবসময়ের জন্য একটা চাপা কষ্ট থেকেই যাবে। হয়তো তার ছোট মনে দারুণভাবে দাগ কেটেছে ওই দিনের ঘটনা। বিয়ে নিয়ে তো সব মেয়েরই কত জল্পনা-কল্পনা থাকে। আর সেই বিয়েতে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটে তাকে কী সহজে মন থেকে মুছে ফেলা যায়? যায় না! কোনমতেই যায় না! সব সময় একটা দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়ায়! তার ওপরে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনদের কত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা শুনতে হবে ওকে। হয়তো কখনো প্রতিবাদ করতে পারবে। আবার হয়তো পারবে না। এক অদ্ভুত সমাজে বাস করি আমরা তাই না? নতুন বিয়ে করার পরে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে সে দোষ নতুন বউয়ের। নতুন বউ অপায়া অশুভ। তার অশুভ ছায়ার জন্য বিপদ নেমে এসেছে তাদের সংসারে। বিয়ে বাড়ি থেকে যদি যৌতুকের জন্য বরপক্ষ বর তুলে নিয়ে যায়। তাহলে সেখানেও দোষ মেয়েটার। বড়ই আজব সমাজ। এ সমাজে পান থেকে চুন খসলেই সব দোষ মেয়েদের। সেখানে তার ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে সামাল দেবে এতকিছু। এসব দেরি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। এরমধ্যে তার স্ত্রী শাপলা এসে ঘরে ঢুকলো। এক নজর তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত? অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি আপনি কিছু ভাবছেন?’

রফিক দুলাল ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ মেয়েটার কথা ভাবছি। কি থেকে কি হয়ে গেল মেয়েটার জীবনে।’

শাপলা এসে রফিক দুলালের পাশে বসে আহত গলায় বলল,

‘ তা আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি তো চিন্তায় রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কখনো কি বিয়ে দিতে পারব আমরা আমাদের মেয়েটাকে! যে একটা বাজে পরিস্থিতির শিকার হয়েছি আমরা।’

রফিক দুলাল আফসোস করে বলল,

‘ কেন যে আমি সেইদিন ঘটকের কথা শুনতে গেলাম। তাহলে আর আজ আমাদের এই দিনটা দেখতে হতো না। আর ঘটকের ই বা কি দোষ দেবো? ওই মতিনের চাচা এমন রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে সত্য বোঝা মুশকিল ওদের অন্তরে যে এত বিষ আছে। আমার হাত ধরে বলে কিনা ভাইজান একদম চিন্তা করবেন না। আপনার বাড়ির মেয়ে আমাদের বাড়িতে রাজ রানী হয়ে থাকবে‌। লোকসমাজে দাঁড়িয়ে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। অসভ্য লোক কোথাকার।’

শাপলা মৃদু স্বরে বলল,

‘ আপনি উত্তেজিত হবেন না। উত্তেজিত হলেই আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।’

রফিক দুলাল নিজেকে শান্ত করে বলল,

‘ উত্তেজিত হওয়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় আছে তুমি বলো!’

শাপলা এই প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বলল,

‘ জানেন আপনারা দুই ছেলে মিলে কি করেছে?’

রফিক দুলাল শাপলার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ কি করেছে ওরা?’

শাপলা মৃদু হেসে বলল,

‘ আপনার ছোট ছেলে শহর থেকে একটা তক্তার মতো মোবাইল ফোন কিনে আনছে। ঐ যে অভি একটা আছে না ঠিক তেমন‌। দুই ভাই টাকা দিয়ে ধারার জন্য সেটা কিনছে।’

শাপলার কথা শুনে রফিক দুলাল হেসে দিয়ে বলল,

‘ আরে ওটা তক্তার মতন না, ওটাকে নাকি স্মার্টফোন বলে। আমাদের দোকানের যে ছেলেটা থাকে না ওর কাছ থেকে শুনেছি।’

শাপলা মুখ গোমড়া করে বলল,

‘ আমি অত কিছু জানিনা কি!’

শাপলার কথা শুনে রফিক দুলাল আবারও হেসে দিয়ে বলল,

‘ থাক তোমাকে আর জানতে হবে না। তুমি তোমার তক্তা মোবাইল ফোন নিয়েই থাকো।’

শাপলা তার স্বামীর দিকে তাকায়। এতক্ষণের করা পরিকল্পনা তার সফল হয়েছে। হাসি ফোটাতে পেরেছেন তিনি তার স্বামীর মুখের। এই ভেবে মৃদু হাসে শাপলা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here