সুখ নীড় পর্ব-১৩

0
229

#সুখ_নীড়
#পর্ব_১৩

আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জয়ীতা। বিচারক তার শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরী। জয়ীতার অপরাধের যেনো শেষ নেই। একের পর এক অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে তার নামে। অভিযোগের ভারে তার ঝুলি পরিপূর্ণ। তার অপরাধের মাঝে সবচেয়ে গুরুতর হলো পল্লবকে তার মায়াজালে জড়ানো, নাজায়েজ সন্তানের দায় পল্লবের ঘাড়ে চাপিয়ে মিডিয়া ডেকে এ বাড়িতে জোর করে বউ হয়ে আসা, পল্লবকে ছেড়ে চলে যাবার পরও আবার ফিরে আসা, ছলেবলে পল্লবকেও তার কাছে নিয়ে যাওয়া, আরো ছোটোখাটো অপরাধের লিস্টের যেনো শেষ নেই।

পল্লবের মা পল্লবকে সবার সামনে কিছুই বলল না। যা বলার জয়ীতাকেই বলছে। পল্লব প্রতিবাদ করতে পারে ভেবে কৌশলে বাসায় ঢুকেই তাকে একটা কাজে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছেন সাজেদা চৌধুরী। সে পল্লবের সাথে এমন আচরণ করেছে যেনো কিছুই হয়নি। পল্লবও মায়ের এমন আচরণ দেখে খানিকটা অবাক হয়েছে। তবুও সবকিছু শান্ত আছে দেখে দেখে সে মনে মনে খুশি হয়ে অফিসে চলে যায়।
জয়ীকে সে না আসা পর্যন্ত রুম থেকে বের হতে নিষেধ করলেও সাজেদা চৌধুরী পল্লব বেরিয়ে যাবার সাথেই জয়ীকে ডেকে পাঠায়।

জয়ীতা মাথা নিচু করে তার শাশুড়ির একের পর এক নোংরা কথার বাণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। অবলার মতো শুধু শুনেই যাচ্ছে সে। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেই সাহস হয় না। তাছাড়া পল্লবকে ভীষণ ভয় হয়৷ তার মাকে কিছু বললে সে যদি আবার আগের মতো বদলে যায়। যত যাই হোক পল্লবের মা তো সে! তাই মুখ বন্ধ করে শোনাটাকেই সে আপাতত শ্রেয় মনে করছে। চৈতীও শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আগুনে ঘি ঢালছে।

জয়ীতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না। সে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে সাজেদা চৌধুরীর চোখ রাঙানোকে সয়ে যাচ্ছে নীরবে।

সাজেদা চৌধুরী তাকে অপশন দিয়েছে কিন্তু অপশন সিলেক্ট করার স্বাধীনতা দেয়নি।

জয়ীতাকে হয় পল্লবের জীবন থেকে স্বেচ্ছায় সরে
যেতে হবে না হলে তাকে বাধ্য করা হবে। সে কি স্বেচ্ছায় চলে যাবে নাকি তাকে জোর করতে হবে এটা জিজ্ঞেস করল তার শাশুড়ি।

জয়ীতা তার ভেতরের ভয়টাকে গোপন রেখে বলল, আমি কি জানতে পারি পল্লবের স্ত্রী হিসেবে এ বাড়িতে আপনাদের সাথে এক ছাদের নিচে থাকলে কী অসুবিধা হবে আপনাদের?

সাজেদা চৌধুরীর রাঙা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আবার বলল, আমি আপনাদের স্টান্ডার্ডের না, আপনাদের মতো আমার বংশ মর্যাদা নেই। এটাই কি আমার অন্যায়?

সাজেদা চৌধুরী জয়ীতার এমন দুঃসাহস দেখে ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।

দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, সবই তো বুঝিস! তবে আর জিজ্ঞেস করছিস কেনো? তোর সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানিস! জানতেই যখন চাইলি তবে বলি, তোর বংশ মর্যাদা চুলাতে যাক। সে তো আর নাই বলি! তোর প্রধান সমস্যা হলো তোর কারণে আমার আদরের ছেলেটা আমার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। তোর কারণে সে আমার বাধ্য ছেলেটা অবাধ্য হচ্ছে দিনের পর দিন। তুই ওর জীবনে জবরদস্তি করে আসার পর থেকে আমার যোগ্য ছেলেটা সবচেয়ে বেশি অযোগ্য হয়েছে। জানিস, এই যে আমার ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়েছিল এ ক’দিন তাতে কোম্পানির কী কী ক্ষতি হয়েছে, কত টাকার ক্ষতি হয়েছে, কী কী ডিল ক্যান্সেল করতে হয়েছে? তোকে বলছি কেনো এসব? আমিও পাগল! তোর মতো একটা অফিস ক্লার্ক এসবের কী বুঝবি! তোর মতো একটা অযোগ্য আর অপয়া আমার ছেলেটার জীবনে যেদিন পা রেখেছে সেদিন থেকেই ও নিজের অমঙ্গল ডেকে এনেছে। আমার আফসোস আমি মা হয়েও কিছুই করতে পারছি না। তুই যদি সত্যিই ওকে ভালোবাসিস, ওর ভালো চাস তবে যা নেবার আমার থেকে নিয়ে ও ফেরার আগেই ওর লাইফ থেকে বিদেয় হ। আমাদেরকে মুক্তি দে। তোর মরা বাপের কসম লাগে। আমার ছেলের ঘাড় থেকে এবার নাম। ওর লাইফটাকে আর বিষ দিয়ে ভরাস না।

জয়ীতা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভেঙে পড়ে। বাবা তুলে কথা বলায় আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কষ্টটাকে লুকিয়ে সে এবার কঠোরতার সাথে বলে, সত্যি বলেছেন। আমি অযোগ্য, আমি অপয়া। কিন্তু একবারও কি আসল সত্যিটা জানতে চেষ্টা করেছেন, যে আপনার ছেলে আসলেই কী কারণে এভাবে বদলে গেল? আমিই কি সেই কারণ নাকি আর কিছু আছে? আগে ছেলের মন পড়তে শিখুন তারপর না হয় আমি দোষী না নির্দোষ সেটা বলবেন! আপনার ছেলের জীবনটাকে আমি বিষিয়ে তুলছি না কি আপনি বা আপনার কোনো অতীত! সেদিকেও একটু নজর দিয়েন। আসলেই কি নিজে সন্তানের কাছে মা হিসেবে সম্মান পাবার যোগ্যতা রাখেন আপনি?

সাজেদা চৌধুরী এবার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন। ঠাস ঠাস করে দুই থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন জয়ীতার দুই গালে। এত জোরে থাপ্পড় মেরেছে যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতী ভয়ে কেঁপে উঠল। সে শাশুড়ির এমন অগ্নিমূর্তি দেখে ভয়ে দ্রুত সেখান থেকে রুমে চলে গেল। আর সার্ভেন্টরা তো আগেই গায়েব। এ বাড়িতে কোনো মিটিং বসলে কোনো সার্ভেন্টদেরই আশেপাশে থাকার সাহস নেই। কোনো কথায় কান পাতলেই তার কঠোর শাস্তি। সেই ভয়ে সবাই নিয়মের মধ্যেই চলে।

জয়ীতা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই সাজেদা চৌধুরী প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, তোদের মতো পয়জন সমাজে আছে বলেই এই সমাজ এত কলুষিত। শরীরের চামড়া দেখিয়ে ছেলেগুলোর মাথা নষ্ট করিস। এরপর ভুলিয়ে ভালিয়ে বিছানা অব্ধি নিতে পারলেই বাকী কাজটুকু ব্যস হয়ে গেল। আর কী চাই! কিন্তু ভুলে যাস কেনো তোদের ঠাঁই হলো বেশ্যালয়ে , কারো ফুলদানিতে সাজবার জন্য নয়। নিত্য নতুন খদ্দেরের জন্য তোদের মতো থার্ডক্লাশ মেয়েদের জন্ম। তোর মা তোকে এ বিদ্যা দিয়ে এই শহরে পাঠায়নি কেনো আমার বুঝে আসে না। নিজের নাজায়েজ সন্তানের দোহাই দিয়ে আমার ছেলের ঘাড় মটাকানোর পায়তারা করছিস! আমি কী কিছুই বুঝি না। আমি সাজেদা চৌধুরী বেঁচে থাকতে তোর পাপের দায় আমার ছেলের ঘাড়ে কিছুতেই চাপাতে দিব না। নেভার!

আসল কথা হলো সাজেদা বেগম এর অতীত নিয়ে কথা তোলায় সে এবার নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেছে না। সে ভীষণ অবাক হয়। এই মেয়ে এসব কী বলছে? সে যতটুকু জানে খালেক সাহেবের সাথে জয়ীর বেশ ভাব। কিন্তু খালেক সাহেবকেও সে চিনে। সে প্রাণ বেরিয়ে গেলেও কারো কাছে পল্লবের জন্মের সত্য প্রকাশ করবে না। তাহলে কীভাবে? গোলকধাঁধায় পড়ে গেল মুহূর্তেই।

জয়ীতা আঘাত পেয়ে এবার আরো প্রতিবাদী হয়ে উঠে। সে সিংহিনীর মতো গর্জে উঠে বলে, এই সমাজটাকে পয়জন করছি আমাদের মতো মেয়েরা না, করছেন আপনারা। আপনাদের মতো হাই ক্লাস মেইনটেইন করা মানুষেরা। নিজের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন মিসেস চৌধুরী। আপনি এত ভালো মানুষ তবে আপনার সংসার হয়নি কেনো? কেনো খালেক সাহেবের মতো নিরীহ মানুষের জীবন আজ পয়জনে ভরপুর? কেনো আপনার স্বামী আপনাকে ফেলে গিয়েছিল? আরো কিছু কি শুনতে চান?

আর হ্যা, আমার মা বাবা কী শিক্ষা দিয়েছে সেটা না হয় নাই জানলেন। তারা তো মুর্খ চাষাভুষা। কিন্তু আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আপনারা তো হাই সোসাইটি মেইনটেইন করে চলে আসছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাহলে আপনার বাবা মা আপনাকে কি শিক্ষা দেয়নি যে চামড়ার বিজনেস শুধুমাত্র আমাদের মতো লো ক্লাস হাভাতে মেয়েদের জন্য, আপনাদের মতো হাই ক্লাসদের জন্য নয়? নিজের অতীত ভুলে যাবেন না মিসেস চৌধুরী! মানুষকে সম্মান দিতে শিখুন। মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখুন। দেখবেন পৃথিবী সুন্দর হয়ে যাবে, সব সম্পর্ক সহজ হয়ে যাবে। তাতে নিজের সম্মান বজায় রাখতে পারবেন। অঢেল সম্মান পাবেন। আমাকে আর মুখ খুলতে বাধ্য করবেন না। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। প্রতিদিন একটা মানুষকে নানান বাহানায় খুঁচিয়েই যাবেন আর আমি সেটা সহ্য করব সেটা আর হচ্ছে না। আপনার কারণে আমি দুই দুইটা সন্তানকে হারিয়েছি। সন্তান হারানোর কষ্ট সেদিন বুঝবেন যেদিন নিজে হারাবেন। আল্লাহ যেনো এমন দিন কোনোদিন আপনাকে না দেয় সেই দোয়া করি। কারণ এই কষ্ট আপনি সইতে পারবেন না। সন্তান আপনার থেকে দূরে সরে গিয়েছে সেটাই মানতে পারছে না আর বাকীটা আর নাই বলি। আমি কোনো জারজ সন্তান পেটে ধরেছিলাম না। আমার পেটে আপনার ছেলেরই অংশ ছিল। বারবার আমাকে চরিত্রহীনা বলে অপদস্ত করেছেন। যারা পৃথিবীর বুকে আসেওনি আমার সেই সন্তানদেরকে নাজায়েজ বলেছেন। ওদেরকে দুনিয়ায় আসার আগেই মেরে ফেলেছেন। আপনি খুনী।
চোখের পানি মুছে জয়ীতা বলল, আমি সব সহ্য করেছি , কিন্তু আর না। আপনার জারিজুরির দিন শেষ। আমি যদি এবার দুনিয়ার সামনে মুখ খুলি না তাহলে এই ভণ্ড মুখোশ উন্মোচন হতে এক মুহূর্তও লাগবে না। নিজের মতো করে সবাইকে ভাববেন না দয়া করে। আমাকে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিন। তাতে আমারও ভালো আর আপনারও।

সাজেদা চৌধুরীর চোখ দু’টি যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসবে। কী বলছে এসব এই দু’দিনের পুচকে মেয়ে। তার জীবনের সবচেয়ে ঘৃন্য অধ্যায়কে এ কোথা থেকে টেনে নিয়ে এসেছে এত বছর পর? এত সাহস এই মেয়ের? সাজেদা চৌধুরী আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেল তার মাথায়। এই মেয়েকে বাচিঁয়ে রাখা মানে তার অতীতের কলঙ্কিত অধ্যায় সামনে চলে আসা। এত বড় ভুল করার মতো মানুষ সে না। আগে তার জানতে হবে এই মেয়ে এসব কোত্থেকে জেনেছে? কে জানিয়েছে? আর কতোটাই বা কী জানে। শেকড়সহ উপড়ে ফেলতে হবে তার। তারপর এর ব্যবস্থা করা তার জন্য ওয়ান টুর ব্যাপার! নিজের আত্মমর্যাদার চেয়ে বড় তার কাছে আর কিছুই না এ মুহূর্তে।

চলবে…..

(নেট প্রবলেম এর কারণে একবার লেখার পরও সব মুছে গিয়েছে। লেখা পোস্ট করতে যেয়ে দেখি নেটওয়ার্ক নেই। সব লেখা মুছে গেল। পরে এতটুকুই আবার লিখলাম। ইন শা আল্লাহ, আগামীকাল আবার পাবেন। জয়ীর পাশে থাকবেন আশা করছি।)

পর্ব- ১২

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/466950611754280/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here