সুখ নীড় পর্ব-১৮

0
229

#সুখ_নীড়
#পর্ব_১৮

প্রায় বিশ দিন হয়ে গেল এখন পর্যন্ত জয়ীতার কোনো খোঁজ মেলেনি। জয়ীতাকে হারিয়ে পল্লবের পাগলপ্রায় অবস্থা। চতুর্দিকে খোঁজ লাগিয়েও জয়ীতার সন্ধান করতে পারলেন না সাজেদা চৌধুরী। সম্ভাব্য প্রতিটি জায়গাতেই তিনি লোক লাগিয়েছেন জয়িতার খোঁজে কিন্তু রেজাল্ট সেই একই। দিন দশেক পল্লবকে হসপিটালে চিকিৎসার নামে বন্দি করে রাখা গেলেও ক’দিনই বা আর রাখা যায়! পল্লবের চিৎকার-চেঁচামেচিতে বাধ্য হয়ে তার মা তাকে বাসাতে নিয়ে এসেছে। বাসায় ফিরেও সেই একই অবস্থা। পল্লব কিছুতেই জয়ীতার হঠাৎ এভাবে গুম হয়ে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারছে না।
তার অভিযোগের তীর এখনো পর্যন্ত তার মায়ের দিকেই।

যদিও গত রাতে সাজেদা চৌধুরী কেঁদেকেটে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে কসম কেটেছে যে সে জয়ীর কোন খবর জানে না। যদি জানত তাহলে সে নিজেই জয়ীকে পল্লবের হাতে তুলে দিত। সে এমনভাবে অভিনয় করেছে যে পল্লবের বিশ্বাস না করেও কোনো উপায় ছিল না তখন। তাছাড়া এটা তো এখন সত্যি যে সে নিজেই এখন জয়ীর কোন খোঁজ জানেনা তাই পল্লবকেই বা কী করে খোঁজ দিবে?

পল্লব প্রতিদিন থানায় যাচ্ছে জয়ীতাকে খোঁজার জন্য, নানাভাবে তদবির করছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়ছে সে। এখন তো সে এই ভয়ে আছে জয়ীতা আদৌ কি বেঁচে আছে তো? তার বাবা খালেক সাহেব ফোন দিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছে। যেকোনো মূল্যে জয়ীতাকে খুঁজে বের করতে অনুরোধ করেছে। তাকে মিথ্যে আশ্বাস তো দিয়েছে কিন্তু কী করবে পল্লব নিজেও জানে না। এদিকে প্রতিদিনই জয়ীর মা ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে। তাকে কী করে সান্ত্বনা দেবে সেই ভাষাও পল্লবের জানা নেই।

তুহিন সপ্তাহে একবার মুন্সীগঞ্জে যায় জয়ীর সাথে দেখা করতে। সে জয়ীর ব্যাপারে কারো কাছেই মুখ খোলেনি। আসলেই তুহিন চায় না জয়ীকে নিয়ে তার ভাই কোনো ধরনের নোংরা পলিটিক্স করুক। তুহিনের সাথে জয়ীর সম্পর্ক এখন বন্ধুসুল। জয়ী এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। ঢাকার সব খোঁজ-খবর সে তুহিনের কাছ থেকে পায়। পল্লব বাসায় ফিরেছে একথা সে জানে এবং তাকে যে পাগলের মত খুঁজছে এটাও জানে।
তুহিন তার যে বন্ধুর পরিবারে তাকে রেখে গিয়েছিল এরা খুব ভালো মানুষ। তুহিনের বন্ধু মিতা তাকে বোনের মতোই ভালোবাসে। মিতার শাশুড়ি তাকে মেয়ের মত জানে। তবুও জয়ীতার এখানে মন টিকতে চায় না। তার মন ছটফট করছে শুধু পল্লবের কাছে ফেরার জন্য। তুহিন কিছুতেই তাকে এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হতে দিতে চাচ্ছে না। সে চাচ্ছে নির্বাচন শেষ হবার পরেই তাকে এখান থেকে বের কর‍তে। কারণ তার ভাইজান আর খালামণি কেউ যাতে আবার কোনো নতুন গেম খেলতে না পারে তাকে নিয়ে।

জয়ীতা আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল তখনই মিতার বাচ্চাটা ছুটে এসে তাকে বলল, তুহিন আংকেল এসেছে। জয়ীতা দ্রুত তুহিনের সাথে দেখা করতে ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়াল।

তুহিন জয়ীতার সাথে কথাবার্তা শেষ করে যখন চলে যাবে তখন জয়ীতা বলল, আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন আপনার কাছে আমি যতই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব ঠিক ততটাই কম হবে! নিঃস্বার্থ এমন বন্ধু পৃথিবীতে এখন আর কোথায় মিলে বলুন! আমার জন্য আপনি যা করেছেন তা আপন কোনো মানুষও আজকাল করে কিনা আমার সন্দেহ!
আপনার কাছে আমি ছোট একটা আবদার করতে চাই।

– এসব বলে লজ্জা দিবেন না, প্লিজ। আমি একজন মানবিক মানুষের দায়িত্ব পালন করেছি। প্লিজ, আপনার জন্য কী করতে হবে বলুন।

– আমাকে শুধু একবারের জন্য পল্লবের সাথে দেখা করিয়ে দিন, প্লিজ।

তুহিন খানিকক্ষণ মৌন থেকে বলল, দেখুন! আমি আপনার ভালোর জন্যই বলেছিলাম। পল্লব ভাইয়ের সাথে এই মুহূর্তে দেখা করা মানেই পল্লব ভাই আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইবে। আর সব সত্য জানলে আপনার শাশুড়ির সাথে তুমুল ঝামেলা বাধাবে। আপনার কি মনে হয় না এটা আমাদের করা মনে হয় ঠিক হবে না?

জয়ীতা তুহিনের কোনো কথাই বুঝতে চাইছে না। তার কাছে এই মুহূর্তে পল্লবের সাথে দেখা করাটাই বেশি জরুরি। তার মনে হচ্ছে পল্লব তাকে না পেয়ে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে। তাই পল্লবকে জানানো প্রয়োজন সে ভালো আছে।

জয়ীতার জিদের কাছে তুহিন হেরে গেল। সে তাকে কথা দিলো দু’একদিনের মাঝেই সে ব্যবস্থা করবে।
তুহিনের কথা শুনে জয়ীর বুকের উপর থেকে যেনো পাহাড় নেমে গেল।

হান্নান সাহেবের সাথে একটা কফিশপে বসে আছে পল্লব। পল্লবের মুড ঠিক করার জন্য তার বাবা হান্নান সাহেব তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। পল্লব প্রথমে আসতে চায়নি। কিন্তু পরে ফোনে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখা করাতে রাজী করাতে পেরেছে। এমনিতেই হান্নান সাহেবের মানসিক অবস্থাও ভালো না। সেদিন তার একসময় এর প্রেমিকা পল্লবের মা সাজেদা চৌধুরী হুমকি দিয়ে গেছে। সাজেদা চৌধুরী মনে করছেন, জয়ীর কাছে তাদের পুরানো প্রেমের গল্প সেই জানিয়েছে। নয়ত সেদিনের পুচকে মেয়ে এসব জানল কী করে? পল্লবের জন্মের ইতিহাস একমাত্র সে আর হান্নানই জানে! আর জানে তার স্বামী খালেক সাহেব। তবে সাজেদা চৌধুরীর দৃঢ় বিশ্বাস এ কথা খালেক সাহেব কোনোদিনই কাউকে জানাবে না। পল্লবকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। তাই পল্লবকে হারানোর ভয়ে কখনোই কারো কাছে সে জানাবে না যে পল্লব তার ছেলে নয়। তাহলে বাকী থাকে একজনই, হান্নান সাহেব।
আর হান্নান সাহেবকে অবিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি আছে তার। সে জানে হান্নানের মতো একটা হারামীর পক্ষে সবই সম্ভব।

হান্নান সাহেব ছিল তার বাবার পিএস। চলনে বলনে দেখতে সবদিক থেকে স্মার্ট আর সুদর্শন। তার স্বামী খালেক সাহেব যার কাছে কিছুই না। সাজেদার বাবার পিএস হবার সুবাদে প্রায়ই আসা যাওয়া লেগে থাকত তাদের বাড়িতে। কল্লোলের জন্মের আগে থেকেই পরিচয় থাকলেও সখ্যতা বাড়ে আরো পরে। চেনা জানা থেকে একসময় তাদের সম্পর্ক বিছানায় গড়ায়। এভাবে চলছিল তার বাবা মারা যাবার পরেও। কিন্তু ধীরেধীরে নানা কারণে আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয় দু’জনের মাঝে। সাজেদা চৌধুরীর ভালো লাগা ফুরাতে থাকে। তখন নিজেই তার জীবন থেকে বের করে দেন হান্নান সাহেবকে। হান্নান সাহেব আগে থেকেই বিবাহিত ছিল, বাচ্চাকাচ্চাও ছিল। সাজেদা চৌধুরী হান্নান সাহেবের থেকে দূরে সরে গেলেও পল্লবের কারণে চাইলেও দূরে সরতে পারলেন না। হান্নান সাহেব যখন বুঝলেন যে সাজেদা চৌধুরীর কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তখন সে শুরু করল ব্লাকমেইলিং। পল্লবের সাথে তার বায়োলজিকাল রিলেশন সবার কাছে ফাঁস করে দিবে এমন হুমকি দিতে থাকে। তখন বাধ্য হয়ে তার ডিমান্ড পূরণ করতে তার বাবার একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তার নামে লিখে দেন। তবে তাদের চুক্তির শর্তনামায় সাজেদা চৌধুরী স্পষ্ট এটা উল্লেখ করেন, যদি কোনোভাবে তার মাধ্যমে পল্লবের সাথে তার সম্পর্কের কথা কারো কাছে ফাঁস হয় তবে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা তার সমপরিমাণ মূল্য ফেরত দিতে হান্নান সাহেব আইনত বাধ্য।
হান্নান সাহেব কখনো কারো কাছে কিছু ফাঁস না করলেও অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেন এই একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কী হবে যদি সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটাকেই সে নিজের করে নিতে পারে! সেই মতোই সে সুযোগ বুঝে পল্লবকে নিজের পরিচয় দেয়। সেটাও কী কম কঠিন ছিল! কত কাঠখড় পুড়িয়ে পল্লবকে বিশ্বাস করিয়েছে। এখন পল্লবই তার একমাত্র ভরসা। অথচ সেই ছেলে তার সব বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বেড়াচ্ছে। ও নিশ্চয়ই ওর বউয়ের কাছে সব বলেছে নইলে এই মেয়ে কী করে জেনেছে? ছেলেটার মাথাটা খেয়ে ফেলল ওই মেয়েটা। মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত সে পল্লবের উপর। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছে না
করবেই বা কী করে? মায়ের মতো তুমুল ঘাড়ত্যাড়া হয়েছে। আবার না কী করে বসে! তার চেয়ে বরং যা গেছে তো গেছে এখন মায়ের বিজনেসের হাল ধরাতে পারলেই তার জন্য ভীষণ রকমের লাভজনক।

পল্লব থমথমে মুখ করে বসে আছে। তার মুখে কোনো কথা নেই। হান্নান সাহেব তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

– জয়ীতার জন্য আর কত এভাবে নিজেকে সবকিছু থেকে ডিচাচড রাখবে? বিজনেসের হাল ধরো। তুমি তো অফিসে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছ একদম। যে স্বেচ্ছায় লুকিয়েছে তাকে কী আর খোঁজে পাওয়া যায়?
নিজেকে শান্ত করো। তোমার জন্য যার একফোঁটা মায়া নেই তার জন্য আর কত কষ্ট পাবে?

– পল্লব মাথা তুলে বলল, এসব বলতে আমাকে ডেকেছেন? আপনাকে কতবার বলব, জয়ী বিপদে আছে! সে আমাকে ছেড়ে যায়নি।

– কেনো বিশ্বাস করতে চাইছ না? সে তো আগেও তোমাকে ছেড়ে গিয়েছে! এবারও তাই করেছে। এসব মেয়েরা এমনই। সুযোগ বুঝে চিলে গিয়েছে। আগেরবার ভাগ্যচক্রে খালেক সাহেবের হাতে পড়েছে। এবার হয়ত প্লান করেই এগিয়েছে। ওকে আসলে তোমার আনাই উচিত হয়নি।

– আগেরবার সে স্বেচ্ছায় গিয়েছিল এটা ঠিক কিন্তু এবার সে যায়নি। এবার তার সাথে জোর করা হয়েছে। জানিনা কোথায় আছে? উফ!

– আচ্ছা, মেনে নিলাম তোমার কথা! এতদিন হয়ে গেল। কোনো খোঁজখবর তো মিলল না। আমার মনে হয় তোমার এবার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাক করা উচিত। তোমার এভাবে সবকিছু থেকে একদম গুটিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।

– আমি নিজেকে যখন বিজনেসের জন্য ফিট মিনে করব তখনই ব্যাক করব। তার আগে নয়। আপনি পারলে জয়ীকে কী করে খুঁজে পাওয়া যায় সেই উপায় বলুন। ক্ষেপে যেয়ে বলল, পল্লব।

– জয়ী, জয়ী! এই মেয়ের কারণেই তোমার লাইফটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। কবে ব্যাক করবে? সব হাতছাড়া হবার পরে? টেবিল চাপড়ে বললেন, হান্নান সাহেব।

– হা হা! আমার লাইফ? আমার লাইফটাকে তো একটা কমেডি করে রেখেছেন আপনি আর আমার আম্মি। জয়ীকে মিথ্যে ব্লেম করছেন কেনো? ওই বরং আমাকে একটা গণ্ডির মাঝে গুছিয়ে এনেছিল।
আর প্লিজ, আপনি এসব বিজনেস ফিজনেস নিয়ে কথা বলবেন না তো! এসব আর ভালো লাগে না। আমি উঠব। আমার সাথে একদমই কন্টাক্ট করবেন না আর। আমি একটু এসব থেকে দূরে থাকতে চাই।

– আমার কথা তো ভালো লাগবেই না। এটা কেনো বোঝো না আমি যা বলি তোমার ভালোর জন্য বলি। এভাবে মায়ের অবাধ্য হয়ে সব হারিও না। একসময় চোখে সরষের তেল দিয়ে কাঁদতে হবে নইলে।

– সেটা আমি বুঝব! ভয় নেই আপনার দুয়ারে যেয়ে হাত পাতব না। আপনার ছেলেমেয়েদের ভাগে কম পড়বে না। এমন দুর্দিন আসার আগে যেনো উপরওয়ালা তুলে নেন।

আর কোনো কথা না বলেই রাগে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল পল্লব।

ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গজগজ করছেন হান্নান সাহেব। এই গর্দভ ছেলে তার ঔড়সের কি করে হয় এটা ভাবতেই এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। বিশাল সাজানো গোছানো প্লান তার। পল্লবকে কথা শোনাতে পারলেই সাজেদা চৌধুরীর রাজত্ব তার আর তার ছেলে পল্লবের হাতে। অথচ গাধার বাচ্চা গাধার কারণে সব শেষ হয়ে যাবে এটা সে কী করে সহ্য করবে! এসব কিছুর জন্য দায়ী ওই জয়ীতা। মেয়েটাকে যেই কিডন্যাপ করুক না মেরে ফেলুক একফম পার্ফেক্ট হয়েছে। এটাই ওর প্রাপ্য ছিল। রাগে অর্ডার করা কফি না খেয়েই বিল পরিশোধ করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল হান্নান সাহেব।

চলবে…..

পর্ব- ১৭

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/476302830819058/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here