সুখ নীড় পর্ব-২২

0
221

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২২

– ভালো করেই জানিস আমি কী করতে পারি। আমার ছেলেটাকে তুই আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস। কী ভেবেছিস, আমার ছেলেকে আমার থেকে আলাদা করে সুখ নীড় বাঁধবি! সেটা কোনোদিনই সম্ভব না। তোকে আমি আজ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারব। যন্ত্রণা কাকে বলে তখন টের পাবি। কবর দেবার জন্য কেউ তোর লাশও খোঁজে পাবে না, নষ্টা মেয়ে। তুই আমার ছেলের কানে এতটাই বিষ ঢেলেছিস যে সে আমার বিরুদ্ধে যেয়ে শাহীনের মতো একটা বেজন্মার সাপোর্ট দেয়। কী ভেবেছিস, একবার পালিয়েছিস, আবার পালাবি? এবার আর সেই সুযোগ তোকে দিব না। তোকে এখানেই মেরে ফেলে রেখে যাব। তোর এই সুখের নীড়েই তোর কবর রচনা হবে!

জয়ীতার চুলের গোছা শক্ত করে চেপে ধরে কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে বলছে জয়ীর শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরী।

জয়ীর চোখদু’টো ভয়ে টকটকে লাল হয়ে গেছে। এই মহিলাকে সে চিনে। ইনি যেটা বলে সেটা করতে মুহূর্তও ভাবে না। একবার তার হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে আবার হয়ত সম্ভব হবে না। সে বারবার সাবধান করেছিল পল্লবকে যাতে শাহীনের নির্বাচনী প্রচারণায় না যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পল্লবতো আসলে তার মায়েরই ছেলে। মা ছেলের কারো জিদ কারো থেকে কম নয়। জয়ী মনে মনে ধরেই নিয়েছে এবার আর তার নিস্তার নেই এই জল্লাদের হাত থেকে।
সাজেদা চৌধুরীর সাথে আরো দুইটা লোক আছে। দেখতে জল্লাদকেও হার মানাবে! এদেরকে জয়ী আগে কখনো দেখেনি তাদের বাড়িতে। হয়তো তার শাশুড়ির সব ধরণের কুকর্মের সাথী।

– আম্মি৷ বিশ্বাস করেন আমি পল্লবকে আপনার বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি। আমি ওকে অনেকবার নিষেধ করেছি। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বলল, জয়ী।

– আবারো মিথ্যে বলছিস! মরার ভয় নেই তোর! তুই না জানালে আমার ছেলে সেদিন আমার পাস্ট নিয়ে ওসব বলল কেনো? আমাকে বোকা ভেবেছিস? তোর কারণে আমার ছেলেটা আমাকে পর করে দিয়েছে। এই কষ্ট বুঝিস? সন্তান মায়ের থেকে দূরে গেলে কত কষ্ট হয় এটা তুই কী করে বুঝবি! তোর মতো একটা বাজারের মেয়ের কাছে এসবের মূল্য কী!

– জয়ী এত ব্যাথার মাঝেও একটা তিরস্কারের হাসি দিয়ে বলল, ওহ! তাহলে টের পাচ্ছেন তবে! আমার থেকে যখন আমার সন্তানদেরকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তখন কি একবারের জন্যও ভেবেছিলেন আমার কেমন লেগেছিল? সন্তান হারানোর সেই কষ্ট আমি আজও ভুলিনি। উপরওয়ালার আদালতে অভিযোগ করেছি। তিনি সবই দেখছেন। একটা কথা মনে রাখবেন, তিনি ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।

জয়ীর কথা শেষ হতে না হতেই সাজেদা চৌধুরী তার চুলের গোছা আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরে উপুর্যুপরি একটার পর একটা থাপ্পড় মারতে থাকে। জয়ীতার মনে হচ্ছিল মাথার খুলি থেকে তার চুলগুলি খুলে উনার হাতে খসে পড়বে। ব্যাথার তাড়নায় চোখমুখে অন্ধকার দেখছে সে। কিছুক্ষণের জন্য ধরেই নিয়েছে এই জল্লাদের হাতেই আজ তার মৃত্যু হবে।

পল্লব আজ ফেরার কথা। সকালে রওয়ানা দেবার আগে তাকে কল দিয়েছিল। জয়ী এখন শুধু আল্লাহর নাম জপছে মনে মনে। এছাড়া আর উপায়ই বা কী! এই বন্ধ ফ্লাটের দরজার এপাশে কী ঘটছে ওপাশের কেউ বা কী করে জানবে! তাকে সাহায্য করার জন্য কেউই আসবে না।

আজই তার জীবনের শেষ দিন এমনটা ভেবেই নিয়েছিল জয়ী। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। জয়ী যেন হালে পানি পায়। নিশ্চয়ই পল্লব চলে এসেছে। এ যাত্রায় তবে বেঁচে যাবে সে! মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায় সে।

কলিংবেলের শব্দ শুনেই সাজেদা চৌধুরী সতর্ক হলেন। পাশে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকদু’টিকে ইশারায় বললেন, কে এসেছে দেখতে! সে জয়ীর মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে ভিতরের রুমে চলে যায়।

দরজা খুলতেই পল্লব হতভম্ব । এই মানুষ দু’জন তার মায়ের সব ধরণের কুকর্মের সাথী। এরা এখানে কী করে এলো ভেবে সে দিশেহারা। মুহূর্তেই যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল। লোক দু’টি তাকে কিছু বলার আগেই সে তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জয়ীকে দেখতে না পেয়ে ভেতরের রুমে যায়। যেয়ে দেখে তার ভাবনা একচুলও অবান্তর নয়। তার আম্মি শক্ত করে চুলের মুঠি চেপে আছে জয়ীতার। আর জয়ীতা ব্যাথার তাড়নায় চোখমুখ কুচকে আছে। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

পল্লবের চোখ দুটি যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসবে তখনই। সে দিগ্বিদিক হারিয়ে চিৎকার করে উঠে।

– আম্মি? এখনই জয়ীকে ছেড়ে দাও। না হলে খুব ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে এখানে। তোমার শকুনের চোখ এখানেও পৌঁছে গেছে? এই মুহূর্তে তুমি জয়ীকে ছেড়ে এখান থেকে এক্ষুনি
বের হও। না হলে আমি বাধ্য হব খারাপ কিছু করতে! আমাকে বাধ্য করো না!

সাজেদা চৌধুরী পল্লবকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যান। সে জয়ীকে ছেড়ে দিয়ে রাগে গড়গড় করতে করতে পল্লবের দিকে এগিয়ে এসে পল্লব কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার গালে ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
জয়ীতার এটা দেখে হাত পা কাঁপা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। নিজের কষ্ট সে সহ্য করলেও পল্লবকে কষ্ট পেতে দেখে তার কষ্ট যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

– হারামির বাচ্চা! বউয়ের কেনা গোলাম হয়েছিস! আমি তোকে এইজন্য এত বড় করেছি? ভেবেছিস আমি তোদের খোঁজখবর কিছু জানিনা। যেখানেই যাবি ছায়ার মতো লেগে থাকব। তোর কলিজায় এত সাহস তুই আমার আজন্ম শত্রু শাহীনের সাথে হাত মিলিয়ে আমাকে বরবাদ করতে চাচ্ছিস!
তোর পিরিতের বউয়ের কষ্ট দেখে মায়া লাগছে খুব? তোর সামনে আজ তোর বউকে কেটে টুকরো টুকরো করব। দেখি কী করিস?

-পল্লব রাগে গজগজ করতে করতে ঘুরে দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, ভুলে যেও না আমি তোমার পেটেই জন্মেছি। বুকের পাটায় আমারও কম জোর নেই।
তোমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি চলে এসেছি। আমি যার সাথে খুশি তার সাথে মিশব! ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম? আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার তুমি কে? হু আর ইউ? হু? এখানে আমি তোমাকে আর এক মুহূর্ত দেখতে চাই না। জয়ীর গায়ে হাত দেয়া থাক দূরের কথা তুমি ওকে ছুঁয়েই দেখো আরেকবার! ভুলে যাব তুমি আমার মা।

পল্লবের এমন আগুন ঝরা রুপ জয়ী এর আগে কখনো দেখেনি। যেন আহত বাঘের মতো গর্জে উঠেছে পল্লব।

-ছেলের এমন আচরণে অপমানে নীল হয়ে সাজেদা চৌধুরী বললেন, তবে আমি আগে তোকেই খুন করব। তোর বউকে মেরে কোনো লাভ নাই। আমি তোর মতো কুলাঙ্গার আর বেজন্মাকে পেটে ধরে যে পাপ করেছি সেই পাপ আগে মোচন করে নেই। তোকে জন্মের সময়ই গলা চেপে মেরে ফেলা উচিৎ ছিল। বাঁচিয়ে জীবনে একটা চরম ভুল করে ফেলেছি যার খেসারত দিচ্ছি আমি পদে পদে। একটা ছোটলোকের বাচ্চাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে আমার ফ্যামিলিটাকে ধ্বংস করে ফেলেছিস। আমার লাইফটাকে নরকে পরিণত করেছিস।

– তখন মেরে ফেললেই ভালো করতে। এ জীবনের বোঝা কিছু কমত! আমার মত বেজন্মাকে জন্ম দিয়ে তুমি যে অন্যায় করেছ তার ক্ষমা তুমি আমার কাছে কোনোদিনই পাবে না।
আর কথায় কথায় অন্যকে দোষ দেবার আগে নিজের চেহারাটা আয়নায় একটু দেখো। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তুমি কে! তাহলে তোমার পরিচয় পেয়ে যাবে। এই এলিগ্যান্ট আর ক্লাসি লুকের মাঝে তোমার যে নোংরা ডাস্টবিনের মতো একটা কদর্য রূপ লুকিয়ে আছে সেটাকে ভালো করে দেখলেই খুঁজে পাবে। তোমার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি এই জীবন থেকে মুক্তি দাও আমাকে। আমার পেছনে ছায়ার মতো লেগে না থেকে নিজেকে শোধরাও। সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি। কথা দিলাম কোনোদিনই যাব না। না খেয়ে মরে গেলেও আমি বা আমার স্ত্রী তোমার দ্বারস্থ হব না। আমাকে মুক্তি দাও, প্লিইইজ। খুব ভদ্রভাবে বলছি। আশা করছি আমাকে আর অভদ্র হতে বাধ্য করবে না। না হলে আমিও কতটা অভদ্র হতে পারি সেটা এই মুহূর্তেই টের পাবে। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।

পল্লব তার মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মায়ের হাত ধরে টেনেহেচড়ে ঘর থেকে বের করে দিলো। সাজেদা চৌধুরী এমন অপমানে নিজেই নিজের চুল টেনে ছিড়েখুঁড়ে ফেলবেন এমন অবস্থা! পল্লব দরজা লাগাবার আগ মুহূর্তে সে বলল, আজকের প্রতিটি কথার জবাব তুমি পাবে, খুব শীঘ্রই পাবে।

জয়ীতা আর পল্লব দু’জনেই পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে বেশ সময় ধরে। কারো মুখে রা নেই। হঠাৎ এসব কী হয়ে গেল? পল্লব রাগে একটা কথাও বলছে না। জয়ীতা অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। কীভাবে তাদের জীবনটা স্বাভাবিক হবে সে বুঝতে পারছে না। পল্লবটাকেও যে একটু বোঝাবে সেই উপায় নেই। এত ঘাড়ত্যাড়া মানুষ সে জীবনে কমই দেখেছে। কতবার নিষেধ করেছে শাহীনের সাথে যেতে অথচ দোষ এখন সব ওর! খুব ভয় হচ্ছে পল্লবকে নিয়ে। পল্লবের সাথে সত্যিই যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে ওর মা? ওনাকে একবিন্দু বিশ্বাসও নেই জয়ীর। স্বার্থে আঘাত লাগলে এসব মানুষ নিজের রক্তের সম্পর্কও ভুলে যায়। এত এত যশ খ্যাতি, প্রতিপত্তির পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে কী হবে যদি মনেই শান্তি না থাকে! সব ভেবেচিন্তে শেষমেশ সবকিছুর জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে জয়ী।

বেশ সময় ধরে পল্লব ঝিম মেরে বসে থেকে উঠে বলল, আমি না আসা পর্যন্ত দরজায় বেল বাজাতে বাজাতে কেউ মরে গেলেও দরজা খুলবে না। আমি আসছি।

– জয়ীতা ভয় পেয়ে যেয়ে স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গিতে বলল, কই যাচ্ছ এখন আবার? মাথা ঠাণ্ডা করে বসো। আমি জুস নিয়ে আসি।

– জুস খাওয়ার সময় না এটা। যা বলেছি সেটা করো! ধমকের গলায় বলে পল্লব।

পল্লব মিনিট পেরুতেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

জয়ীতা ভেবে পাচ্ছে না এই মুহূর্তে সে আবার কই গেল? সে তার মায়ের সাথে কোনো ঝামেলা করতে যায়নি তো আবার? কী হচ্ছে এসব?

হাজার অশান্তির ভীড়ে আরেক নতুন চিন্তা যোগ হয়েছে জয়ীর মাথায়। হান্নান সাহেবকে পল্লব গতকাল সকালে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে ৪৮ ঘণ্টার। এই সময়ের মধ্যে তাকে জানাতে হবে পেট্রোলপাম্প পল্লব পাচ্ছে কি পাচ্ছে না। হান্নান সাহেব যে ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি মোটেও, সেটাও বুঝতে পেরেছে জয়ী.! চারদিকে এত শত্রু বাড়িয়ে পল্লব কী করে বাঁচবে এটা ভেবে মাথা ঘুরছে জয়ীতার। চারপাশে যেন সবকিছু ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। সম্পর্কের শুরু থেকেই পল্লবের এই একগুঁয়েমি তার একদমই পছন্দ ছিল না। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। এতটা নাছোরবান্দা গোছের মানুষ আগে দেখেনি সে। পল্লব যা চায় তা করে ছাড়ে। পল্লবের এই স্বভাবের কারণেই সে পল্লবকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল।

দিনগুলি চোখের সামনে যেন এখনও জ্বলজ্বল করছে৷ জয়ীতার। মনে পড়ছে এই স্বভাবের কারণেই কীভাবে পল্লব ধীরে ধীরে তার অফিসের বস থেকে প্রেমিকে পরিণত হয়। শত চেষ্টা করেও পল্লবকে পিছু ছাড়াতে পারেনি। জয়ী তখনই টের পেয়েছিল এই অসম ভালোবাসার পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না। ব্যাপারটা নিয়ে শুরুর দিকে যখন অফিসপাড়ার চারপাশে নানান ধরনের গুঞ্জন চাউর হতে থাকে তখন জয়ীতা নিজেকে সরাতে চেষ্টা করে । সে পল্লবকে কিছু না জানিয়েই এখান থেকে চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চাকরী খোঁজা শুরু করে । জয়ীতা তার এক বান্ধবীর সাহায্যে একটা চাকরি জোগাড়ও করে ফেলেছিল। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। পল্লব আরো উল্টো আঠার মত সারাক্ষণ তাকে অনুসরণ করতে লাগল । জয়ীতা পল্লবকে অ্যাভয়েড করছে এটা পল্লব কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। এক সময় সে জোর করে জয়ীতাকে তার বিছানায় যেতে বাধ্য করে।
সবকিছু হারিয়ে জয়ী তখন নিঃস্ব। সে ধরেই নিয়েছে পল্লব আর দশটা বড়লোকের ছেলের থেকে আলাদা নয়। সে তাকে ভোগ করতে চেয়েছে এবং সেটাই করেছে। এসব প্রেম ভালবাসা সব কিছুই মিথ্যে অভিনয় ছিল । তার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে ভালোবেসে পল্লব হয়তো নিজের স্ট্যাটাস নষ্ট করবে না।

জয়ীতা যখন সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল , এই পৃথিবী থেকে তিক্ত স্বাদ ছাড়া আর কোন কিছুই অনুভব করার সামর্থ্য সে হারিয়ে ফেলেছিল, পল্লবের দিক থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ঠিক তখনই সে সেই পল্লবকেই আশার আলোর মতো তার পাশে পায়। জয়ী বুঝতে পারে তার ভাবনার মধ্যে আসলেই ভুল ছিল পল্লব আর দশটা ছেলের মত নয়। পল্লব হাঁটু গেড়ে তার কাছে ক্ষমা চায়। আসলে জয়ীতা যাতে তাকে ছেড়ে যেতে না পারে এজন্যই পল্লব তাকে এভাবে বাধ্য করে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় এটুকু ভাবার মতো চেতনা তখন ছিল না পল্লবের। তাই সে জয়ীতাকে তার জীবনে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জয়ীতা তখনই আঁচ করতে পেরেছিল এই সম্পর্কের পরিণতি কখনোই ভালো হবে না। কী করবে কী না করবে ভেবে না পেয়ে রিক্তবক্ষে গ্রামে ফিরে যায়। সেখানে যেয়েও রক্ষে নেই। পল্লবও তার গ্রামে যায়। পল্লব জয়ীতাকে বিয়ে করার জন্য জয়ীর পরিবারকে রাজী করায় । একরকম জোরজবরদস্তি করে জয়ীকেও রাজি করায় সে। নিজের মা কোনোদিনই তাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না তাই তার বাবা খালেক সাহেবের সাহায্য নেয়। পল্লবের একগুয়েমি আর ভালোবাসার কাছে হেরে যায় জয়ীতা। বিয়ে করতে বাধ্য হয় তাকে।

এরপর শুরু হয় তাদের সংসার। জয়ীতা পল্লবের অফিসে চাকরি করত তখনও। পল্লবের খুব কাছের দু-একজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া তাদের বিয়ের খবর কেউ জানত না। বছরখানেক খুব ভালোভাবে কেটেছিল তাদের। পল্লব প্রায়ই নানান অজুহাতে বাসার বাইরে থাকার নাম করে জয়ীর কাছে থাকত। জয়ীতা বারবার পল্লবকে অনুরোধ করে তাদের সম্পর্কের কথা তার পরিবারকে জানাতে কিন্তু পল্লব সময়ের অপেক্ষায় ছিল। সেই মোক্ষম সময় আসার আগেই হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই পল্লব তার জীবন থেকে আবার দূরে সরে যেতে থাকে। বদলে যেতে থাকে।

ধীরেধীরে এমন অবস্থা হয় জয়ীর সাথে তেমন কথাবার্তাও বলত না। থ’ মেরে বসে থাকত। আসা যাওয়া কমিয়ে দেয় জয়ীর বাসাতে। জয়ীতাকে চাকরি থেকে রিজাইন দিতে বাধ্য করে। কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে যায়। অফিসে একদিন আসলে তিনদিন খবর থাকত না। কোথায় থাকত সেটা জয়ীতা জানতে চাইলেও বলত না। মাঝে মাঝে জয়ীতাকে চড় থাপ্পড় দিতেও কার্পন্য হতো না তার। মাঝেমধ্যে নেশাও করত। এ যেন পল্লবের এক অচেনা রূপ! জয়ীতা একদমই চেনে না এই পল্লবকে।

এরমাঝে তাদের বিয়ের কথা কানে যায় সাজেদা চৌধুরীর। সে নানান ভাবে থ্রেট করে জয়ীকে যাতে সে পল্লবের জীবন থেকে সরে যায়।

এই দোলাচলের মাঝেই হঠাৎ করে মাস দু’য়েক লাপাত্তা হয়ে যায় পল্লব। কোনো খবর ছিল না তার। হন্যে হয়ে পল্লবকে খুঁজেছে জয়ীতা কিন্তু না, কোথাও তার নাম নিশানা নেই।

আসলে হান্নান সাহেব নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য পল্লবকে সত্যটা জানিয়ে দিয়েছিল। পল্লব মানতেই পারছিল না যে সে আসলে একটা জারজ সন্তান। মানসিক অশান্তিতে পুড়ে পুড়ে নিজেকে কয়লায় পরিণত করে ফেলে। না পারত কাউকে কিছু বলতে, না পারত সইতে। মানসিক যন্ত্রণায় সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। পালিয়ে বাঁচার জন্য মালয়েশিয়া তার এক বন্ধুর কাছে চলে যায়। কিন্তু সেখানে যেয়েও এক ফোঁটা শান্তি মেলেনি। কোথায় যাবে সে ভেবে পায় না। এ যে তার আজন্ম কষ্টের এক উপাখ্যান।

নিজে থেকেই আবার জয়ীর কাছে ফিরে আসে। ভাবে শুধুশুধু এই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! তাকে মুক্তি দিয়ে নিজেই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায় সে। পল্লবকে ফিরে পেয়ে জয়ীর সব অভিযোগ গায়েব। সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। আবারও হাজারো রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে জয়ীতা কিন্তু মুহুর্তেই সেই স্বপ্ন খান খান হয়ে যায় যখন পল্লব তাকে জানায় সে তাকে ডিভোর্স দিতে চায়।

জয়ীতা নানানভাবে বোঝায় পল্লবকে। জানতে চায় কী তার অপরাধ! কিন্তু কোনো উত্তর নেই পল্লবের কাছে তার শুধু একটাই কথা সে মুক্ত হতে চায় সব সম্পর্কের বাঁধন থেকে।

যে মানুষটাকে জয়ী পাগলের মত ভালবাসে, যাকে খুঁজতে খুঁজতে সে নিজেকে একবিন্দু ক্লান্ত মনে করেনি এতদিনে সে হঠাৎ করে এসেই এখন বলছে সে তাকে চায় না। এটা কী করে সম্ভব? কিছুতেই মেনে নিতে পারে না জয়িতা। এর মাঝে সে টের পায় সে মা হতে যাচ্ছে। পল্লবকে এই খুশির খবর জানানোর মতো ধৈর্যটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে । যেখানে একফোঁটা ভালোবাসাই অবশিষ্ট নেই সেখানে এই সন্তানের কোনো মূল্যই আছে কিনা এই মানুষের কাছে সে সন্দিগ্ধ। পরে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পল্লবকে জানাতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোনো লাভ নেই। পল্লব বলে বাচ্চা নষ্ট করতে। জয়ী কিছুতেই রাজী হয় না।

সাজেদা চৌধুরীও জয়ীকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। পল্লব একদম গুটিয়ে ফেলে সবকিছু থেকে।

জয়ীতা বুঝতে পারে পল্লব বা তার আম্মি কখনোই তার অনুনয়, বিনয়, নম্রতাকে কোনো মূল্য দিবে না। সে নিজের এবং সন্তানের অধিকার আদায়ে নিজেই সোচ্চার হয়।

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই চোখদু’টি ঝাপসা হয়ে যায় তার। এত যুদ্ধ করে আজ এখানে পৌঁছাতে পেরেছে। এখান থেকে আবার কোনদিকে যেতে হবে কে জানে! একটা সুখের নীড় বুঝি আর বাঁধা হলো না।

একদিকে তার শাশুড়ি অন্যদিকে হান্নান সাহেব। তার উপর এখন শাহীন নামের এই আপদ!
ইনিও যে পল্লবের ভালো কিছু চায় না এটা সে ঠিকই টের পাচ্ছে। যার শুরুটা আজই হলো। এর শেষ কোথায় সে জানে না!

চলবে……

পর্ব- ২১

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/483925883390086/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here