#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩০
তুহিন আজকাল প্রায়ই অফিসের কাজকর্মে অনিয়মিত থাকছে। এটা নিয়ে তার বড়ো ভাই শাহীন তালুকদার ভীষণ ক্ষেপে আছে। সকালে বাসা থেকে বের হবার আগে এসব নিয়ে একদফা বকাঝকা করেছে।
আসলে তুহিন এখন ভীষণ ব্যস্ত মোহনাকে কী করে ট্রেস করা যায় সেটা নিয়ে। এই মেয়েটাকে ধরতে পারলে অনেক কিছুই সলভ হয়ে যেত! তার সম্ভাব্য সবখানে খুঁজেছে কিন্তু তেমন ইতিবাচক কোনো ফলাফল পায়নি। জয়ীতাকে সে কথা দিয়েছে পল্লবের খুনী পর্যন্ত পৌঁছাতে সে সব ধরণের সাহায্য করবে। এদিকে তার ভাইয়ের কাছে এ ব্যাপারে সত্যিটাও বলতে পারছে না। শাহীনের কড়া নিষেধ এসব নিয়ে কোনো ঘাটাঘাটি না করতে। পুলিশ তাদের ডিউটি করছে। এমনিতেই তারা এই মামলার সাথে সন্দেহভাজনের তালিকায় জড়িয়ে আছে। তার উপর তুহিন যদি আবার এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে থাকে তাহলে কীভাবে না কীভাবে ফেঁসে যায় তার খবর আছে!
কিন্তু নাছোড়বান্দা তুহিন কি আর কথা শোনার পাত্র! যাই হোক, সে আজ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ সারাদিন অফিসেই থাকবে। বেশ কিছু কাজ পেন্ডিং আছে সেগুলি দেখা দরকার। গতমাস জুড়ে বেশ কিছু মিটিং আর পার্টিতে সে অনুপস্থিত ছিল এটা নিয়েও কড়া ধমক খেয়েছে ভাইয়ের কাছে। সেগুলি থেকে নানান ডাটা কালেকশান করে কয়েকটা ডকুমেন্টস রেডি করতে হবে।
জয়ীতা দূর হতে তাকিয়ে সাজেদা চৌধুরীকে দেখছে।
সাজেদা চৌধুরী তার নাতীকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। জয়ীতার সাথে ব্যবহার খুব একটা ভালো না হলেও আগের থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক। সে নিজেও ওই ভিডিও ফুটেজ দেখার পরে জয়ীতার উপর অযথা দোষ দেবার কারণে মনে মনে লজ্জিত হলেও জয়ীতার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করেনি। জয়ীতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। আর ওনার মতো মানুষ জয়ীতার কাছে ভুল স্বীকারও করবে না, সরিও বলবে না। এটাও জয়িতা ভালো করে জানে। উনার মত মানুষের কাছ থেকে এটা আশা করা নিতান্তই অমূলক।
তিন চারদিন ধরে ঘনঘন জয়ীতার বাসাতে আসছে। উদ্দেশ্য একটাই নাতীকে আদর করা। আজ এসেই জয়ীতাকে বলেছে আগামী সপ্তাহে ঢাকায় ওনার বাসাতে নিয়ে যাবে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে রাখতে। জয়ীতা যেতে রাজি কিনা সেটা একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। সরাসরি অর্ডার ব্যাগপত্র গুছিয়ে ওনার বাসাতে যেতে হবে! যে বাসাতে থাকার জন্য কত যুদ্ধ করেছে হঠাৎ সেখানে জয়ীতার এত কদরের কারণ যে তার ছেলে। এটা জয়ীতা জানে। এজন্যই খুব ভয় হচ্ছে। এই মানুষটা স্বার্থ ছাড়া এক পাও চলার কথা না। তার ভয় হচ্ছে তার ছেলেকে না তার বুক থেকে কেড়ে নেয়। জয়ীতাকে যে সে কিছুতেই ও বাড়িতে খুব বেশি সময় টিকতে দিবে না এটা নিশ্চিত। খুব ভয় হচ্ছে ছেলেটাকে নিয়ে।
এত এত দুশ্চিন্তার মাঝে এখন পর্যন্ত তার ছেলের নাম পর্যন্ত রাখা হয়নি। কী নাম রাখবে! তার ছেলেকে নিয়ে যার অঢেল স্বপ্ন ছিল সেই মানুষটাই নেই। জয়ীতা শুধু ভাবে একটাই তো জীবন! সেই জীবনে এত না পাওয়া এত অপ্রাপ্তি এত কষ্ট কেন? কেন পল্লব এভাবে চলে গেল? বুক ভেঙে কান্না আসে। কান্নাটাকে খুব আটকাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না! রাতভর তার চোখের পানিতে বালিশ ভিজে।
সাজেদা চৌধুরীর কথায় জয়ীতা কোন উত্তর না করায় সে আবারো বলল, শুনতে পেয়েছ আমি কি বলেছি? খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলবে। নেক্সট উইকে তুমি ঢাকাতে যাচ্ছ। আমার বাসায় থাকবে। এই পরিবেশে আমার নাতীকে রাখা যাবে না। এমনিতেই ও আন্ডার ওয়েট। তার উপর যত্নআত্তি ঠিকমত হচ্ছে না। তুমি বাচ্চাদের যত্নই ঠিকমত বোঝো না। আমার যা মনে হয় ওর জন্য একটা প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার। প্রপার এনভায়রনমেন্ট দরকার। আমি আমার নাতীকে শহরের বেস্ট ডাক্তার দিয়ে ট্রিটমেন্ট করাব ওর জন্য যা যা দরকার সব করব। ওর জন্য একটা ভালো পরিবেশ দরকার।
অতএব এখানে একমুহূর্ত না। তেমাকে সাত দিন সময় দিলাম সবকিছু গুছিয়ে ফেলো। অবশ্য এখান থেকে কোনকিছুই নিতে হবে না। শুধুমাত্র তুমি তোমার কাপড় চোপড় নেবে আর যা কিছু আছে সেগুলো কী করবে না করবে সেটা তোমার ব্যাপার।
জয়ীতা সাহস সঞ্চার করে বলল, আমি এখান থেকে যেতে চাই না। আমি এই সংসারের আনাচে-কানাচে যেখানে যাই দেখছেন সবখানে আমার পল্লবের হাতের ছোঁয়া পাই। আমি এসব কিছুই হারাতে চাই না আর আমি বাসা থেকেও যেতে চাই না আমি এখানেই থাকব। আমি এখানে পল্লবের গায়ের ঘ্রাণ পাই যা অন্যখানে পাব না।
– এসবের মানে কী? তুমি বললেই হলো? ও বাসাতে যেয়েও পল্লবের ভাবনায় ডুবে থাকবে সমস্যা কোথায়? ওখানেও তো তুমি ছিলে একসময়।
– হ্যাঁ ছিলাম। কিন্তু যে সময়টা ওখানে ছিলাম ওই সময় তো ছিল সম্পূর্ণ তিক্ততায় ভরা । ওই বাসাতেই কোন সুখস্মৃতি আমি হাতরে হাতরব মরে গেলেও পাব না। আমি এই বাসাতেই থাকতে চাই কারণ এখানে আমি যতটুকু সময় ছিলাম পল্লবকে নিয়েছিলাম।
আমাদের দু’জনের জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি সময়টুকু এখানেই কাটিয়েছি।
আমি চাই আমার বাচ্চাটা এখানে ওর বাবার ছায়া, কায়া, ঘ্রাণ খুঁজে পাক।
সাজেদা চৌধুরী এবার কিছুটা ক্ষেপে গেলেন! তবে নিজেকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, তুমি কি পাগল হয়েছ? এটা কি তোমার বাপের বাড়ি যে তুমি এখানে পড়ে থাকবে? এটা একটা বাসা হলো! কাল বাড়িওয়ালা তোমাকে তাড়িয়ে দিলে থাকবে কই আর কোথায়ই বা হাতড়ে বেড়াবে তোমার সুখের স্মৃতি। আর বাসার খরচই বা চালাবে কি করে? আলাদিনের চেরাগ নিশ্চয়ই নেই তোমার কাছে?
– আমি যেভাবে হোক ম্যানেজ করব।
আমাকে একদম ক্ষেপিও না। আমি তোমাকে তুমি যাবে কি যাবে না সেটা একবারও জিজ্ঞেস করিনি তোমাকে বলেছি সবকিছু প্যাক করো। আর কোনো কথা নেই। এই নোংরা পরিবেশে আর এতোটুকু ঘরে আমার নাতী বড়ো হবে এটা তুমি ভাবলে কি করে? তুমি কি করবে কি না করবে এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তুমি যদি ভালোভালো আমার সাথে যেতে চাও যাবে। না গেলে আমি আমার নাতিকে নিজেই নিয়ে যাব!
জয়ীতা কিছু বলতে যাবে অমনি তার মা ইশারায় নিষেধ করল।
সাজেদা চৌধুরী বেরিয়ে যাওয়ার সময় জয়ীতার মাকে বলল, মেয়েকে বোঝান। নিজের ভালো চাইলে আমার কথার যেন কোনো হেরফের না হয়।
সাজেদা চৌধুরী বেরিয়ে যাবার পরে জয়ীতার মা তার পাশে যেয়ে বসল। সে জয়ীতার চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজেই কেঁদে ফেলল।
– মা রে! আমরা গরীব। গরীবের কথার কোনো মূল্য নেই এই পৃথিবীতে। তুই ওনার সাথে পারবি না মা। আগে তো পল্লব ছিল এখন তুই একা। ওনার সাথে যুদ্ধ করে পারবি না। শুধুই কষ্ট পাবি। তুই তোর ছেলেকে নিয়ে ওনার বাসাতে যা। উনাকে তো জানিসই। ওনার কথার ব্যত্যয় হলে কী করতে পারে জানিসই তো!
আমরা ওনার সাথে পারব না, মা। তাছাড়া বাবুর তো আসলেই ভালো ডাক্তার দরকার! তুই একা কীভাবে কী করবি? একটু ভাব মা।
– তোমার কী মনে হয় উনি আমাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবে? কখনোই না। কী করব বুঝতে পারছি না। বাবুকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তুমিও বাড়ি ফিরে যাও।।
– তুই কি পাগল? তোর শাশুড়ির হাত যে লম্বা। তুই যে জঙ্গলেই যাস না কেন সেই জঙ্গল থেকে টেনে নিয়ে আসবে।
শুধুই অশান্তি বাড়বে। তাছাড়া বাবুর জন্য আসলেই ওই বাসা অনেক কম্ফোর্টেবেল। তুই ওনার সাথে চলে যা। আগে দেখ না কী করে! ভালো না হলে পরে দেখা যাবে! আমরাতো আছি।
জয়ীতা বুঝতে পারছে না কী করবে? তার মা তো সত্যি কথাই বলেছে তার পক্ষে এই মহিলার সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব না! একেতো এখন সে সম্পূর্ণ একা। তার উপর সাথে এত ছোট বাচ্চা!
আর কত সহ্য করতে হবে তাকে? উপরওয়ালা এত নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে তার সাথে?
তুহিন রুমে বসেই তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে বললো গত মাসের সব মিটিংয়ের ফাইলপত্র আর সফট কপি তার কাছে জমা দিতে।
তুহিন একটার পর একটা ফাইলপত্র, মেইল ঘেটে ঘেটে নানা ধরনের ডাটা কালেকশন করছে। হাতের কাজ শেষ করে এরপর তুহিন বিভিন্নসময় হওয়া মিটিংগুলোর ভিডিও ওপেন করল। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রেজেন্টেশন দিয়েছে অনেকেই। তুহিন সেগুলোকে সামারাইজ করবার জন্যই ভিডিও দেখছে।
ভিডিও দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জায়গায় তার চোখ আটকে গেল। এ সে কাকে দেখছে?
এদিকে সাজেদা চৌধুরীর বাসায় ফিরে সার্ভেন্টদেরকে বলল, পল্লবের রুম রেডি করতে। মনে মনে ভেবেছিল সপ্তাহখানেক পরে তার নাতীকে নিয়ে আসবে কিন্তু আজকে জয়ীতার ব্যবহারে সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। জয়ীতাকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়ার মতো মানসিকতা এখন আর তার নেই। আগামীকাল বা পরশু দুই-একদিনের মধ্যেই জয়ীতাকে আর তার নাতীকে এখানে নিয়ে আসবে।
সে নিজে যেয়ে তদারকি করছে রুমের কোথায় কী সাজানো হবে, কোথায় কী রাখা হবে। তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে আরো কী কী ফার্নিচার এখানে সংযোজন করতে হবে সে বিষয়ে অর্ডার দিলো।
এতক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে চৈতী শাশুড়ির কর্মকাণ্ড দেখছিল। গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।
– কী ব্যাপার! কিছু তো বলবে? তোমাকে দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি কিছু জানতে চাচ্ছ!
– না, মানে আমি বলছিলাম কি পল্লবের রুমটা এভাবে সাজাচ্ছেন ওখানে কে থাকবে? এত তোড়জোড় করে রুম সাজাচ্ছেন এজন্য বলছিলাম আরকি!
– স্ট্রেঞ্জ! তুমি এখনো বুঝতে পারোনি? আমি এ বাড়িতে এ বাড়ির ভবিষ্যৎ ওয়ারিশকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি, পল্লবের ছেলেকে নিয়ে আসছি । কী বলো!
শাশুড়ির এমন ধরনের কথায় চৈতি কিছুটা হোঁচট খেলো এভাবে কথা শুনবে সে আশা করেনি কখনো।
মনে মনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো চৈতী । তার মানে পল্লবের ছেলে আসছে সাথেও জয়ীতাও আসছে। মেয়েটার দম আছে ভেবে মনে মনে এক চোট প্রশংসাও করল জয়ীতার।
তার শ্বাশুড়ীর সাথে যুদ্ধ করে জয়ী দল জিতেছে এটা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু তার শ্বাশুড়ীর যেভাবে ওয়ারিশ নিয়ে আসছি, অমুক করছি, তমুক করছি এসব শুনে মেজাজটা চরম বিগড়ে যায়।
চৈতী সেখানে আর কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। কল্লোলের কাছে সবকিছু খুলে বলল।
রাতে খাবার টেবিলে কল্লোল জয়ীতার ব্যাপারে তার মায়ের কাছে প্রশ্ন তুলল।
– আমি শুনলাম তুমি নাকি ওই জয়ীতাকে আবার এ বাড়িতে ঢোকাতে চাচ্ছ?
সাজেদা চৌধুরী ভাত মাখতে মাখতে প্লেট থেকে মাথা না তুলেই বললেন, সমস্যা কি তোমাদের?
– আম্মি, তুমি ওকে কী করে হজম করতে পারবে? ভুলে গেছ সব?
– কিছুই ভুলিনি। ওকে হজম করছে কে?
– মানে?
– আমি শুধুমাত্র বাচ্চাটার জন্য এটা করছি। সে আমাদের বংশের রক্ত। আমার নাতী তো যে সে স্থানে থাকতে পারে না
– তার মানে ওই বাচ্চাটার জন্য করছ?
– হুম। এটাই তো বললাম।
– তাহলে ওই জয়ীতা?
– বাচ্চাটা তুমি আর চৈতী এডাপ্ট করবে! তোমাদের পরিচয়ে সে বড়ো হবে!
।
আচ্ছা এসব চিন্ত পরে করি। আগে তো নিয়ে আসি। আল্লাহ আল্লাহ করো। পরে দেখা যাবে কী দিয়ে কী করি। একটা ছেলে তো জন্ম দিতে পারোনি। এবার পল্লবের বাচ্চাটাকে বাবার আদর আর মায়ের আদর দিয়ে তোমরাই মানুষ করবে। ওই জয়ীতা তো জাস্ট দুই দিনের মেহমান।
কল্লোল এবং চৈতীর মুখে যেন হাসি ফুটে ওঠে। এটা তো তারা ভাবেনি! তার মা আসলেই জিনিয়াস। এই সময়ের মাঝে কত কী ভেবে ফেলেছে। বাহ!
চলবে…..
পর্ব-২৯
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/525341402581867/