অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-৪৮

0
966

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-৪৮|

এক মাসের বেশি সময় ধরে ধারা ইভানের সামলে রেখেছে। মিতা বেগমের মৃত্যুর পরে ইভান কে সামলানো যাচ্ছিল না। পাগলামি শুরু করে দিয়েছিল ইভান। ইভানের আম্মুর মৃত্যুর পরে ইভান অনেক টা পাল্টে গেছে। এখন আর আগের মতো কারো সঙ্গে কথা বলে না, হাসে না, একা একা সারাক্ষণ ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ছাদ থেকে মিতা বেগমর কবর স্পষ্ট দেখা যায়। ইভান সারাক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ইভান নিজের খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম করা দেখে ধারা প্রতিবেলা নিজের হাতে ইভান কে খাইয়ে দেয় জোর করে। ইভানের বড় দুই ভাই নিজের সামলে নিয়েছে, তারাও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ইভান কে সামলানোর। সন্ধ্যার পরে ধারা সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে ইভানের রুমে যায়। মানুষটা কে ধারা এখন আর একদম চোখের আড়াল হতে দেয় না। একা থাকলেই মানুষ টা কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয়। ধারা রুমে এসে ইভান কে রুমে পায় না। পুরো রুম খালি। বাতাসের কারণে বেলকুনির পর্দা টা উঠছে। বাতাসটা গায়ে লাগতেই পুরো শরীর শীতল হয়ে যায় ধারার। আজ রাতে মনে হয় বৃষ্টি হবে বাতাসে তারই লক্ষণ বলছে। ধারা আর কিছু না ভেবে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। ইভান যদি নিজের ঘরে না থাকে তাহলে তাকে ছাদে ই পাওয়া যাবে তা ধারা খুব ভালো করে জানে। ধারা রুম থেকে বের হওয়ার আগে থমকে দাঁড়ায় ফোনের শব্দে। ধারা হেঁটে গিয়ে দেখে ইভানের স্টাডি টেবিল এর উপর ইভানের ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রিনে হেরির নাম দেখে ধারা ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে হেরি ধীর গলায় বলল,

‘ ইভান।’

ধারা মৃদু স্বরে বলল,

‘ ভাইয়া আমি উনি এখন রুমে নেই।’

হেরি নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ ভাবিজি তুমি? ইভান কোথায় গেছে?’

ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ কোথায় আবার ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’

হেরি করুন গলায় বলল,

‘ ও তো এখনো নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি ভাবিজি। আমরা আসতে চেয়েছিলাম ওর কাছে কিন্তু ওই তো বারণ করেছে আমাদের আসতে। আমরা আসলে না হয় একটা কথা ছিল। আমি রাহুল, মিহু, রোজা আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করে ওকে এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে বের করে আনতে পারতাম হয়তো। কিন্তু ইভান ই তো আমাদের কাউকে বাংলাদেশের যেতে বারণ করেছে। এদিকে আমাদের ওর টেনশনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’

ধারা মোলায়েম গলায় বলল,

‘ ভাইয়া আপনারা চিন্তা করবেন না, উনি আগের থেকে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছেন। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। উনি যেহেতু আপনাদের এখানে আসতে বারণ করেছেন তাহলে উনি কোন না কোন কিছু চিন্তা করেই নিশ্চয়ই বলেছেন। ভাইয়া আপনি রাহুল ভাইয়া, মিহু আপু, আর রোজা আপুকে চিন্তা করতে বারণ করুন। এখানে ভাইয়ারা ভাবি রা সবাই ওনাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করছেন।’

হেরি সূক্ষ্ম গলায় বলল,

‘ ঠিক আছে। আর একটা কথা এই মাসের শেষে কিন্তু আমাদের এক্সাম এর রুটিন দিয়ে দেবে। তাই যত দ্রুত পারো ইভান কে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো ভাবিজি।’

ধারা চিন্তিত গলায় বলল,

‘ এই মাস শেষে? তাহলে তো আর বেশি দিন বাকি নেই। ভাইয়া আমি এখন ফোন টা রাখছি। উনি কী করছেন দেখে আসি গিয়ে।’

হেরি ছোট করে বলল,

‘ হুম।’

ধারা ফোন কেটে পা বাড়ায় ইভানের কাছে যাওয়ার জন্য। ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে না উঠতেই ইভান কে দেখতে পায় ধারা। ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইভানের দিকে যায়। ইভান ছাদের পশ্চিম কোনে দাঁড়িয়ে সামনের কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে। ধারা নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে ইভানের পিঠে মাথা রাখে। ইভান কিছুটা চমকে ওঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ইভানের চোখে পানি। ধারা তা দেখে আলতো হাতে ইভানের চোখের পানি মুছে দেয়। ইভান নিজেকে সামলাতে না পেরে ধারা কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। ধারা এই এক মাসে ইভান কে যত দেখছে ততই বেশি অবাক হচ্ছে। একটা ছেলে তার মায়ের জন্য কী করে এত বেশি পাগল হয়? ছেলে জাতি তো হাজার কষ্ট পেলেও কাঁদে না। আর এই ছেলে তো প্রতি ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। ধারা ইভান কে ওর বুকে জড়িয়ে নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দোলনায় বসায়। আবার ইভানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

‘ কী হলো এমন বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদছেন কেন? আপনি জানেন আপনার থেকে রোহান অনেক ভালো। আপনার মত অন্তত রোহান কথায় কথায় কান্না করে না।’

ইভান হালকা হেসে বলল,

‘ বিল্লু রানী তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ আমাদের রোহান কেবল আট মাস হল পৃথিবীতে এসেছে। এর মধ্যে ও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর ভালো-মন্দ কী বোঝে শুনি?’

ধারা ইভান কে হাসানোর জন্য ভাব নিয়ে বলল,

‘ বোঝে বোঝে ও সবকিছু বোঝে। আপনি দেখেননি আমি যখন ওর সঙ্গে কথা বলি তখন ও কেমন হাত-পা নাড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ভাবি যখন ওকে বকা দেওয়ার অভিনয় করে তখন দেখেননি রোহান কেমন কান্না করে দেয়।’

ইভান মুখ বাঁকিয়ে বলল,

‘ ওহ বাব্বা তাই বুঝি?’

ধারা ইভান কে ভেংচি কেটে বলল,

‘ হ্যাঁ, তাই। এখন নিচে চলুন আমি নাস্তা রেডি করে কখন উপড়ে এসেছি এতক্ষণে বোধহয় সব নাস্তা ঠান্ডা হয়ে গেছে।’

ইভান ধারার কথায় উত্তর না দিয়ে ধারা কোলে শুয়ে বলল,

‘ আর কিছুক্ষণ পরে যাই নিচে। তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে আমার।’

ধারা আর কিছু না বলে ইভানের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে।

এক চল্লিশা অনুষ্ঠান শেষে হয়েছে আজ তিন দিন হয়েছে। তিন ভাই মিলে বিরাট আয়োজন করেছিল এক চল্লিশা অনুষ্ঠান। ধারা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটা বিষয়ে খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছে। ধারার পরিবার এক চল্লিশা অনুষ্ঠানের জন্য দুই দিন আগেই চলে এসেছিল ধারা শ্বশুরবাড়ি। তখন থেকেই ধারা ধারা আব্বাজান কে গম্ভীর দেখছে। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কারো সঙ্গে কথা বলছে না। ইভান যা জিজ্ঞেস করেছে সে শুধু হ্যাঁ, হুম তে উত্তর দিয়েছে। এসব বিষয় চিন্তা করে ধারার মনে খচখচ করছে। ধারা আর তার শ্বশুরবাড়িতে অল্পকিছুদিন আছে। এরপরে সে তার বাবার বাড়িতে চলে যাবে। সামনের সপ্তাহে ইভানের ফ্লাইট। সে এই মুহূর্তে দেশ ছেড়ে যেতে রাজি ছিল না। কিন্তু ধারার কাছে হার মেনে ইভান যাবে বলেছে। ইভান এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। তবে মাঝে মাঝে ওর আম্মুর কথা মনে করে মন খারাপ করে ফেলে।

ইভান আজ ধারা কে নিয়ে গ্রামে এসেছে। গ্ৰামে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেছে। ইভান আজি ফিরে যেতে চেয়েছিল একদিন পরে ওর ফ্লাইট। ধারার আম্মা জোড়াজুড়ির কারণে আজকের রাতটা থাকতে রাজি হয়েছে ইভান। ইভান ধারার বাড়িতে এসেছে পর থেকে কিছু কিছু বিষয় খুব ভালো করে খেয়াল করেছে। ধারার আব্বাজান ইভান কে এড়িয়ে চলছে। তার হাবভাব ও ইভানের ভালো লাগেনি। ইভান চলে যাওয়ার সময় ধারার হাত ধরে বলেছিলো,

‘ আমার আমানত তুমি। তোমার কাছে আমার আমানত গচ্ছিত রেখে গেলাম। যত্ন করে রেখো। তুমি ছাড়া এই বিশাল পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে আর কেউ নেই। তুমি আমাকে কখনো কষ্ট দিও না বিল্লু রানী, তোমার দেওয়া কষ্ট আমি কখনো সহ্য করতে পারব না। নির্ঘাত আমি মরে যাব।’

ধারা সঙ্গে সঙ্গে ইভানের মুখে হাত দিয়ে বলেছিলো,

‘ ছিঃ ছিঃ এসব কী কথা বলেন? আমি অনেক আগেই আপনার হয়ে গেছি, আপনার আছি এবং আপনাই থাকবো।’

ব্যস্ত সময় পার করছে ধারা। আর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু। কখনো কলেজে দৌড়াচ্ছে কোন সাবজেক্টের নোট আনতে কিংবা কখনো পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে ধারা। জোনাকি সে তার পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ধারার যথেষ্ট যত্নআত্তি করছে। এরমধ্যে ধারা একদিন কলেজ থেকে নোট নিয়ে ফিরে এসে দেখে ওর আব্বাজান সঙ্গে সম্রাট ভাইয়া, আম্মা আর দাদি আম্মার কিছু একটা নিয়ে খুব তর্কাতর্কি হচ্ছে। হঠাৎ করে ধারার আব্বাজান প্রচন্ড রেগে গিয়ে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

‘ আমার মেয়ে আমি বুঝে নেব তার কিসে ভালো আর কিসে ভালো না। তোদের এত মাথাব্যথা কেন ওকে নিয়ে? সবাই কান খুলে শুনে রাখ একটা কথা। ইভানের কাছে আমি আমার মেয়েকে দিব না। ইভানের মা বেঁচে থাকলে একটা কথা ছিল। কিন্তু এখন কোন মতেই না। আজকাল তো খবর কত কিছুই দেখায়, আমি চাইনা আমার মেয়ের সঙ্গে এমন কিছু ঘটুক। আমি আমাদের গ্রামের উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি খুব তাড়াতাড়ি এই বিয়ে বিচ্ছেদের কাগজপত্র ঠিক করে ফেলবেন। তারপরে আমার মেয়ের সঙ্গে এই গ্রামে কিংবা আশেপাশে কোন গ্রামের একটা ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবো। তাছাড়া মতিন ছেলেটা নিজে এসে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। ছেলেটা আজ দুই বছরের বেশি সময় ধরে আমার পিছন পিছন ঘুরে ধারা কে বিয়ে করার জন্য। ভাবছি এবার যদি ওদের কথাবার্তা ঠিক থাকে তাহলে মতিনের সঙ্গেই ধারার বিয়েটা দিয়ে দেব। এই নিয়ে আমি তোমাদের কোন কথা শুনতে চাই না।’

এই বলে ধারার আব্বাজান বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধারা কে দেখে এক নজর তাকিয়ে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। হাত-পা প্রচন্ডভাবে কাঁপছে ধারার। ধারা তার আব্বাজানের এসব কথা শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here