#প্রেম_তুমি,পর্ব-১৬,১৭
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৬
রাতের শহর। মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশ। মিটমিট করে জ্বলছে অসংখ্য তারকারাজি। তার মাঝে গোলাকার শুভ্র নির্মল চাঁদটা উঁকি দিয়ে আছে। তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে পিচঢালা রাস্তায়। দূর দুরান্ত পর্যন্ত স্বচ্ছ পরিস্কার রাস্তা। এক্সট্রা আলোর প্রয়োজন হচ্ছে না। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সে বাতাসে দুলছে দর্শনের কুঁকড়া চুল আর গায়ের শার্ট। কাঁধে ব্যাগ, চোখে চশমা, কানে হেডফোন গুঁজে রাতের শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইকে করে। এই সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশে গান শুনতে শুনতে বাড়িতে যাচ্ছে। সাথে কেউ হলে মন্দ হত না। কিন্তু সেই কেউটা কে? অর্ষা? হয়তো অর্ষা। অর্ষাকে নিয়ে এই মোহনীয় আলোয় বাইকে করে একটু ঘুরে বেড়ালে মন্দ হত না।
দর্শন মোবাইল বের করে অর্ষাকে কল দেয়। বাইক চালাতে চালাতে কল রিসিভের অপেক্ষায় আছে। অর্ষা কল রিসিভ করল কয়েক সেকেন্ডের মাথায়।
“হ্যালো!”
“দশ মিনিটের জন্য বের হতে পারবে?”
অর্ষা ওর প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে রইল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় রাত ন’টা বেজে এগারো মিনিট। কন্ঠে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন? কী হয়েছে?”
“আরে আসো না। আমি রাস্তায় আছি। তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।”
ওর সাথে দেখা করতে আসছে শুনেই ভালো লাগছে।
“হ্যা, পারব।”
“আচ্ছা আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি নিচে আসো।”
….
প্রায় বারো মিনিট পর দর্শন অর্ষার বাড়ির সামনে এল। অর্ষা আগে থেকেই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। দর্শনের জন্য অপেক্ষা করছিল। দর্শন বাইক থামিয়ে নেমে এল। তারপর অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করল। অর্ষা যেভাবে ছিল সেভাবেই চলে এসেছে। জিন্স আর লেডিস্ শার্ট পরা। চুলগুলো ঝুঁটি করা। পায়ে স্লিপার স্যান্ডেল। মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এলে নিজেকে পরিপাটি করে আসে। চোখে একটু কাজল দেয়, ঠোঁটে লিপস্টিক, কানে দুল, হাতে চুরি অথবা ব্রেসলেট, চুলগুলো গুছিয়ে আসে আর শরীরে সুগন্ধি। কিন্তু অর্ষা এর ব্যতিক্রম। দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অর্ষাকে অন্যভাবে দেখতে চায়, কত স্বপ্ন ছিল ওর প্রেমিকা কিংবা ভবিষ্যৎ স্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু অর্ষা এর বিপরীত। দর্শন পরক্ষণেই ভাবল, ছিহ! কী ভাবছি? ভালোবাসার মতো স্নিগ্ধ অনুভূতিতে বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় সুন্দর মন খুঁজতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা ও অর্ষাকে ভালোবাসে।
দর্শন মৃদু হাসল। তারপর বাইকে গিয়ে বসল। বাইকে বসে চাবি হাতে নিয়ে বাইক স্টার্ড করতে করতে বলল,
“উঠে বসো।”
অর্ষা ওর কথা শুনে কিছুটা ভয় পেল।
“এত রাতে কোথায় যাব?”
“ভয় পাচ্ছো কেন? আমাকে বিশ্বাস করো না?”
“বিশ্বাস অবিশ্বাস নয়। বাবা খুঁজবে আমায়। যদি জানে তাকে না জানিয়ে….
” দশ মিনিট। দেখেছো কত রোমান্টিক ওয়েদার? তোমাকে নিয়ে দশ মিনিট বাইকে ঘুরব বলে বাড়িতে না গিয়ে তোমার বাসায় এলাম। প্লিজ।”
“দশ মিনিট হলে মেনেজ করে নেব কিন্তু এভাবে?” (অর্ষা নিজের দিকে চেয়ে বলল)
“কিছু হবে না। এত রাতে কে দেখবে? চলে এসো।”
অর্ষা গিয়ে দর্শনের বাইকে উঠল। প্রথম বার ওর বাইকে উঠেছে। অস্বস্তি হচ্ছে কিছুটা। ওকে ধরতেও কেমন ইতস্তত করছে।
দর্শন ওকে নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় বাইক চালাচ্ছে। দশ মিনিট বলে নিয়ে এসেছে কিন্তু সারারাত ওকে নিয়ে বাইকে ঘুরতে ইচ্ছে করছে। অর্ষাও সব ভুলে সময়টা অনুভব করছে। প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম রাতের শহর ভ্রমণ।
….
অর্পা ওর ক্লাসমেটদের সাথে আলোচনায় বসেছে। রুশান সেটা দেখে দর্শন, রাতুল আর তামিমকে বলছে,
“আচ্ছা বল তো আমি কীসে পার্টিসিপ্যান্ট করতে পারি?”
রাতুল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“তুই এক কাজ কর, তুই গান দে। ও সখিনা গেছোস কি-না ভুইলা আমারে আমি এহন রিকশা চালাই ঢাকা শহরে কি জানি একটা গান আছে না এটা গাইতে পারিস।”
তামিম সাথে যোগ দিয়ে বলল,
“আরে নাহ, এটা না। তুই গাইবি ও মাইয়ারে মাইয়া তুই অপরাধী রে…..
তারপর সবাই অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ল। রুশান মুখ গম্ভীর করে বসে রইল। অর্পার দিকে আবারও আড়চোখে তাকাল।
দর্শন ওকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল,
” ঘটনা কী বল তো? অর্পার সাথে কিছু হয়েছে?”
“হয়েছে বলেই তো তোরা এমন মজা করছিস। আমারও সুযোগ আসবে, আমিও মজা করব।”
“আচ্ছা, করিস। তা কী হয়েছে তোদের?”
“কাল রাতে একটু ঝগড়া হয়েছে।”
রাতুল খোঁচা দিয়ে বলল,
“কোন মেয়ের সাথে ধরা খেয়েছিস?”
“সর,সব সময় ফাজলামি করিস না। আমি অন্য মেয়েদের সাথে ফাজলামো করি ঠিক তবে অর্পাকে ভালোবাসি খুব। ও আমার সাথে রাগ করে থাকলে ভালো লাগে না।”
অর্ষা পেছনে থেকে বলল,
“আহ! কত প্রেম! এত প্রেম তো ঝগড়া করো কেন?”
“ঝগড়া কী আমি করি? অর্পা করে।”
“তাহলে অর্পা আপুকে কেন রাগাও? তাকেই রাগানো উচিত যার রাগ সহ্য করতে পারবে।”
“হ্যা, এখন তো সব দোষ আমার। সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে।”
অর্ষা কিছু বলল না। মৃদু হাসল। তারপর দর্শনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অর্পা আপুর কাছে যাচ্ছি। প্রোগ্রামের দায়িত্ব নাকি আপুদের উপর।”
দর্শন অর্পার দিকে একবার চেয়ে বলল,
“হ্যা, তুমি কী কিছু দিবে?”
“হ্যা,সব সময় যা করি গান আর নাচ।”
দর্শন ক্লাসের ভেতরে যাওয়ার জন্য অর্ষাকে ইশারা করল। দুজনে এক সাথে অর্পার কাছে রুমের ভেতরে গেল।
অর্পার কাছে গিয়ে জানতে পারল অর্পার শুধু গানের দায়িত্ব পড়েছে। নাচ করতে চাইলে আলিশা আর রাবেয়ার কাছে যেতে হবে। অর্পা দর্শনের দিকে তাকাল। ওর চোখে মুখে বিরক্ত। অর্ষাও কেমন করছে ওর কাছে যেতে।
অর্পা ওদের মনোভাব দেখে বলল,
“আচ্ছা, সমস্যা নেই আমি নাম লিখিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু নাচে নাম দেওয়ার পর প্রত্যেক প্রসেসে আলিশাকে সহ্য করতে হবে।”
অর্ষা দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর হাসিমুখে বলল,
“আমার কোন সমস্যা নেই। ওর সাথে তো আর আমার লড়াই যুদ্ধ চলছে না।”
দর্শন অর্ষার কথা শুনে বলল,
“আর ইউ শিওর?”
“ইয়েস। হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
“তুমি যদি পারো সমস্যা নাই। অর্পা তুই ওর নাম লিখিয়ে আয়।”
অর্পা গিয়ে অর্ষার নাম লিখিয়ে এল। রাবেয়া অর্ষার নাম লিখছে। আলিশা আড়চোখে অর্ষা আর দর্শনকে দেখছে। ওরা দু’জন এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে। আলিশা অর্ষার দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত লাগাচ্ছে আর চোখ ছোট ছোট করছে।
…
অর্ষা আর প্রিয়া আলিশার ব্যাপারে কথা বলছে। অর্ষাকে প্রিয়া বারবার সাবধান করছে।
“দেখ অর্ষা বি কেয়ার ফুল। তোকে কিন্তু ও জ্বালানোর অনেক চেষ্টা করবে, ঝামেলায়ও ফেলবে। ও কয়েকবার অপমানিত হয়েছে কিন্তু চুপচাপ ছিল। নীরবতা বড়সড় ঝড়ের লক্ষণ। তাই ওর থেকে সাবধানে থাকবি। ওকে একদম ক্ষেপানোর চেষ্টা করবি না।”
অর্ষা এ-সব একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। আর না আমলে নিচ্ছে।
“আরে দূর! ও কিছু করতে এলে আমি ছেড়ে দেব? ওকে থিতলে ফেলব। আর দর্শনের দিকে যদি আবারও চোখ দেয় আমি ওর চোখ গালিয়ে ফেলব চিনে না আমায়।”
প্রিয়া বিরক্ত নিয়ে বলল,
“উফফ! তুই চিনিস না ওকে? ও চাইলে কি করতে পারে? এক তাল পাকিয়ে তোকে কলেজ থেকে বের করে দিলে?”
“এত সহজ?”
“ওর জন্য সহজ। ও চাইলেই পারবে। আর ও যে হাত গুটিয়ে বসে নেই সে আমি জানি। শুধু তুই বুঝতে চাস না।”
“আমার বুঝে কাজ নেই। তুই বুঝ। আমি ওর ফালতু কার্যকলাপ একদম সহ্য করব না। তাতে যা হোক।”
অর্ষা রাগ দেখিয়ে চলে গেল। প্রিয়া হতাশ হলো। ওকে কেন বোঝাতে পারে না।
অর্ষা ক্যান্টিনের দিকে যেতে গিয়ে বাগানের কাছে থেমে গেল। অর্পা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ওর বরাবর রুশান দাঁড়িয়ে। রুশানও কি যেন বলছে কিন্তু অর্পার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু। সিরিয়াস কিছু না হলে এভাবে চিৎকার করত না। রুশান ওর হাত ধরে কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্পা ঝারা মেরে হাত সরিয়ে নিচ্ছে আর আঙুল তুলে রাগী মুখ করে কিছু বলছে। অর্ষা ব্যাপারটা বোঝার জন্য আরেকটু এগিয়ে গেল।
এগিয়ে যাওয়ার পর শুনতে পেল অর্পা বলছে,
“তুই কখনো ঠিক হবি না। তোর তো একটা দিয়ে মন ভরে না। যা দশটা নিয়ে মেতে থাক আর আমার থেকে দূরে থাক।”
“অর্পা, তুমি বেশি রিয়েক্ট করছো। আমি বললাম তো….
” কিছু বলার দরকার নাই তোর। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ৷ আমার আশেপাশে যেন তোকে না দেখি।”
অর্ষা ওদের কনভারসন শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু হয়েছে। ওদের মধ্যে সাধারণ কিছু হয়নি৷
অর্ষা মোবাইল বের করে দর্শনকে কল দিল। দর্শন মোবাইল সাইলেন্ট করে লাইব্রেরিতে পড়ছে। অর্ষা কি করবে বুঝতে না পেরে নিজেই এগিয়ে গেল। ওকে দেখে রুশান চুপ করে গেল।
অর্ষা রুশানের দিকে চেয়ে দেখে ও মাথা নিচু করে আছে। অর্পা রাগে ফুসফুস করছে। ওর শরীর কাঁপছে। ওর চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। চোখে শুধু আগুনই না পানিও ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এখুনি টপ করে পড়ে যাবে।
অর্ষা ওকে ধরে বলল,
“আপু এমন করছো কেন? কি হয়েছে? ভাইয়া কিছু বলেছে?”
অর্পার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ে গেল। গালের অর্ধেকে গিয়ে আঁটকে আছে। ওর ঠোঁট কাঁপছে।
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ও আমাকে ভালোই বাসে না। ভালো যদি বাসত তাহলে আমার সামনে অন্য মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করত না।”
অর্ষা রুশানের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি দিল। রুশান চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা ওকে আর কোন প্রশ্ন করল না। অর্পাকে শান্ত হতে বলছে। রুশান অর্পার দিকে একবার চেয়ে স্থান দ্রুত ত্যাগ করল।
….
“আরে আমি কী জানতাম সিচুয়েশন এতটা জটিল হবে? যদি জানতাম কস্মিনকালেও এমন কাজ করতাম। আমি তো মজা করছিলাম।”
রুশান পাইচারি করছে আর কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছে। দর্শন, রাতুল আর তামিম এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ঘটনা শুনে ওকেই দোষারোপ করছে। তাই রুশান নিজের পক্ষে কথাগুলো বলল।
রাতুল এগিয়ে গিয়ে বলল,
“শোন যতই জোর গলায় বলিস দোষ তোরই। তুই জানিস অর্পা এগুলো পছন্দ করে না। তবুও তুই মেয়েদের সাথে ফাজলামো করতে যাস। আর আজ ওর সামনে। ও রাগ করবে স্বাভাবিক।”
তামিম চুপচাপ। ও কাকে দোষারোপ করে কথা বলবে জানে না। নিজের লাইফটাই যখন এলোমেলো তখন কাকে কি বলবে।
দর্শন রুশানের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“অর্পাকে গিয়ে সরি বল। ভালো ভাবে বুঝিয়ে বল ও বুঝবে।”
“ও তো আমার কথাই শুনছে না। ওর আশেপাশে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে।”
দর্শনও কিঞ্চিৎ ক্ষেপে গেল।
“বেশ করেছে। গার্লফ্রেন্ডের সামনে অন্য মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করিস কোন সাহসে? তোর অভ্যাস আর ভালো হলো না৷ যা খুশি কর।”
“তোরাও ভুল বুঝছিস। আমি ফ্লার্ট করিনি। অর্পার সাথে ঝগড়া হয়েছে, আমার সাথে কথা বলছে না তাই ওকে জেলাস ফিল করানোর জন্য ওকে দেখিয়ে…..
দর্শন ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” হ্যা, জেলাস ফিল করাতে গিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছো। এখন সামলা ঠেলা। আমি অর্পার সাথে কথা বলে দেখি।”
রুশান অসহায় কন্ঠে ওর দিকে ঘুরে বলল,
“দেখ দোস্ত প্লিজ। একটু গিয়ে কথা বল।”
….
দর্শন অর্পার সাথে কথা বলতে গিয়ে অর্ষাকে ওর সাথে দেখতে পেল। অর্ষাকে পেয়ে কাজটা সুবিধার হবে ভাবতেই মুখে হাসি ফুটল। এতক্ষণ নার্ভাস ছিল এখন অনেকটা সাহস সঞ্চারিত হলো।
অর্ষাকে ইশারা করে ডাকল দর্শন। অর্ষা কাছে এসেই বলতে শুরু করল,
“রুশান ভাইয়া কি করেছে জানো?”
“জানি তো। তাই তো এসেছি অর্পার সাথে কথা বলতে। রুশানের এখানে দোষ নেই। ও তো চেয়েছিল অর্পাকে জেলাস ফিল করাতে। বেচারা বুঝতে পারেনি পরিস্থিতি এতটা জটিল হবে।”
“এটা কেমন কথা? ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। নিজেরা মিটিয়ে নেবে। একজন রাগ করে থাকতে অন্যজন মানানোর চেষ্টা করবে তা না করে অন্য মেয়ের সাথে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ফ্লার্ট করে জেলাস ফিল করাবে? কি লজিক তোমার। এত সুন্দর লজিক কে দেয় তোমাকে?”
দর্শন দেখছে অন্যের সম্পর্ক জোড়া লাগাতে গিয়ে নিজেরটা ভেঙে যাচ্ছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার।
“আমি তো তাই বলি। আমি একা না আমরা সবাই মিলে রুশানকে বকাবকি করেছি। ওকে ওর ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছি। ও ভুল বুঝতে পারছে। এখন কি আমাদের উচিত না ওদের ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে দেওয়া?”
অর্ষা অর্পার দিকে তাকাল। কেমন মুখ কালো করে বসে আছে।
“হ্যা মেটানো দরকার। তবে সময় প্রয়োজন। অর্পা আপুর মন খুব খারাপ। রেগেও আছে খুব। তাই পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়া অবধি অপেক্ষা করো। ততক্ষণে রুশান ভাইয়াকে বুঝাও। অর্পা আপু তো অল্পতে ছেড়ে দিয়েছে, আমি হলে…
দর্শন আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
“তুমি হলে?”
“আমি হলে মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে হকি স্টিক দিয়ে বেধম পেটাতাম। হাড়গোড় ভেঙ্গে হাসপাতালে এডমিট করে দিতাম। নে এবার হাসপাতালে বসে চিল মার। ভালো না?”
অর্ষা দাঁত কেলিয়ে বলল। দর্শন ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বলল, “খুব ভালো।”
চলবে……
#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৭
অর্ষা আর দর্শন প্ল্যান করেছে কি করে অর্পা আর রুশান দু’জনকে মুখোমুখি করে ওদের সমস্যার সমাধান করবে। ভেন্যু হিসেবে সিলেক্ট করেছে অর্ষার বাসা। ওর বাবা রাতে ফিরেন সে হিসেবে বাসা সারাদিন ফাঁকা থাকে। অর্পাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসবে। রুশান আর দর্শন আগে থেকেই থাকবে। গেস্টরুমটা সুন্দর করে সাজাবে। পুরো রুম জুড়ে সরি এণ্ড লাভ প্লেকার্ড দিয়ে সাজাবে। সাথে থাকবে বেলুন। অর্পার জন্মদিন আজ। ফ্রাইডে হওয়ায় অর্পা বাসায় বসে আছে। অর্ষা আর দর্শন শপিংয়ে গেছে। অর্ষা নরমাল পোশাকে। কালো জিন্স, সাদা টপ আর কালো সু। কাঁধে দু বেলের মিনি লেডিস্ ব্যাগ, চুলগুলো ছাড়া। দর্শন ওর সাথে। জিন্স প্যান্ট, চেক শার্ট, সু পরে। ওরা দু’জন এক সাথে হেঁটে যাচ্ছে। অর্ষা একটা শপে ঢুকল। শপে গিয়ে পছন্দ মতো কেনাকাটা করছে। দর্শন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু এদিক সেদিক দেখছে। কেনা শেষ করে দর্শন আর অর্ষা অন্য শপে গেল। দর্শনের চোখে একটা ব্রেসলেট পড়ল। সাদা পাথরের ব্রেসলেট। দূর থেকেই চিকচিক করছে। দর্শন সামনে এগিয়ে গেল। অর্ষা ওর মতো ব্যস্ত। দর্শন ব্রেসলেট হাতে নিয়ে দেখছে। ওর ভীষণ ভালো লাগছে। অর্ষার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। ব্রেসলেটের জন্য প্রে করে পকেটে রাখল। অর্ষার কাছে যেতেই খেয়াল করল পেছনে দুটো ছেলে। অর্ষাকে দেখিয়ে কি যেন বলছে। দর্শন অর্ষার সাথে গিয়ে দাঁড়াল।
দুটো ছেলের মধ্যে একটা ছেলে অন্য আরেকটা ছেলেকে ধাক্কা মারছে ক্ষনে ক্ষনে। কি যেন বলছে দুজন ফিসফিস করে। মনে হচ্ছে অপর ছেলেটিকে কিছু করার বা বলার জন্য ফোর্স করছে। দর্শন সেটা খেয়াল করছে।
অর্ষা এয়ারিং কেনার পর একটা হেয়ার ব্যান হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। হেয়ার ব্যান কম ব্যবহার করে। ও সাধারণত হেয়ার রাবার ব্যান্ড ব্যবহার করে।
দুটো ছেলের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আছে আর আরেকজন অর্ষার দিকে এগিয়ে এল। দর্শন ছেলেটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অর্ষা তখনও খেয়াল করেনি।
“এক্সকিউজ মি…”
অর্ষা নিজের বাম পাশে কারো অস্তিত্ব আর গলার স্বর অনুভব করে তাকাল।
ছেলেটার দিকে বিস্ময় নিয়ে একবার চেয়ে দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর ইতস্তত করে ছেলেটাকে বলল,
“জি আমাকে বলছেন?”
ছেলেটাও কেমন ইতস্তত করছে। এক হাতে আরেক হাত ঘষতে ঘষতে বলল,
“জি। আমি একটু আপনার সাথে কথা বলতে পারি?”
অর্ষা কিছুই বুঝতে পারছে না। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দর্শনের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল। তারপর ছেলেটাকে বলল,
“আমি কি আপনাকে চিনি?”
“জি না। আগে আমার পরিচয় দেই আমি সাদিফ। আপনার নামটা জানতে পারি?”
অর্ষা ছেলেটার দিকে চেয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল। দর্শন আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। ছেলেটা যখন বলেছে অর্ষা ওকে চিনে না এর মানে ছেলেটা অপরিচিত। রাগে ওর কপালের রগ ফুটে ওঠে।
অর্ষা কিছু বলতে যাবে তখনই দর্শন ওকে সরিয়ে সামনে এসে বলল,
“ডোন্ট ইউ সি দ্যাট আ’ম উইথ হার? হাও ডেয়ার ইউ?”
ছেলেটা দর্শনের দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ ভয় পেল। তারপর ওর বন্ধুর দিকে তাকাল। কোন ঝামেলা হচ্ছে বুঝতে পেরে বন্ধু এগিয়ে এল।
দর্শন কোন উত্তর না পেয়ে আরো রেগে গেল। কান দিয়ে যেন ধোয়া বের হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল,
“আমার সামনে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে লাইন মারতে আসো?”
ছেলেটা ঢোক গিলে বলল,
“সরি ভাই, আমি বুঝতে পারিনি যে আপনি উনার সাথে এসেছেন।”
“বুঝতে পারেননি? আমাকে কি চোখে দেখা যায় না? এতবড় জলজ্যান্ত মানুষকে চোখে দেখে না আর মেয়েদের ঠিকই দেখা যায়। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি ওর দিকে বাজেভাবে তাকাচ্ছেন। দুজন মিলে ফুসুরফাসুর করছেন।”
ছেলেটার বন্ধু বলল,
“সরি ভাই, সরি আমরা বুঝতে পারিনি। মাফ করেন আমরা আসি।”
দর্শন ওদের ছাড়ছেই না।
“বুঝতে পারেননি? সবই বুঝতে পেরেছেন। মেয়ে দেখলে চুলকানি শুরু হয়। তার সাথে ভাই, বাবা, স্বামী, বয়ফ্রেন্ড যেই থাকুক না কেন চোখে পড়ে না। ইনফ্যাক্ট কেয়ার করেন না। আপনাদের নামে আমি কমপ্লেইন করব। আপনার নাম সাদিফ তো।”
“আরে ভাই, কি বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। বললাম তো বুঝতে পারিনি। আপু, বোঝান আপনার বয়ফ্রেন্ডকে।”
দর্শন ওর কথা শুনে তেড়ে যাচ্ছিল। দোকানের সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে।
অর্ষা তাড়াতাড়ি দর্শনের হাত ধরে থামিয়ে দিল। তারপর জোর করে বাইরে নিয়ে গেল।
“দর্শন বাদ দেও। চলো চলো। ওদের কাজই এমন।”
অর্ষা জোর করে দর্শনকে মার্কেটের বাইরে নিয়ে এল। দর্শন তখনও রাগে গজগজ করছে।
“দর্শন, কুল। বাদ দেও। আমরা যে কাজ করছি তাতে কনসেন্ট্রেশন করো।”
“আমাকে না-কি দেখেই নি? কথা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
দর্শন বাইক নিয়ে এল। অর্ষা ওর বাইকে চেপে বসল। পুরো রাস্তায় দর্শন কোন কথা বলেনি। অর্ষাও কোন কথা তুলেনি। ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে বাইক থামাল। অর্ষা বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। দর্শন চাবি হাতে নিয়ে নামছে। গেট দিয়ে একটা ছেলে বের হয়ে অর্ষা আর দর্শনের দিকে তাকাল। ওর দৃষ্টিটা কেমন জানি ছিল। অর্ষা সামনের দিকে চেয়ে দেখে প্লাবন বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে। অর্ষার বুক ধুক করে উঠল। দর্শনের দিকে তাকাল। দর্শন চাবি পকেটে রাখছে। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করল। অর্ষা প্লাবনকে দেখেও না দেখার ভান করছে। ওরা দুজন ব্যাগ ভাগাভাগি করে নিল। প্লাবন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় ওরা যেতে পারছে না। দর্শন ওর দিকে চেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আরে ভাই, সাইড না দিলে ভেতরে যাব কী করে?”
প্লাবন চকিত হলো। তারপর মিনমিন করে কি যেন বলল সেটা ওদের বোধগম্য হয়নি। দর্শন সামনে আর অর্ষা পেছনে। অর্ষা প্লাবনের দিকে আরেকবার তাকাল। ও তখনও স্থির দৃষ্টিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। দর্শনকে অনুসরণ করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল। অর্ষা আর দর্শন লিফটে ঢুকে পড়ল। স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় অর্ষা। অনেকদিন পরে সামনে পড়েছে প্লাবন। তাও এমন একটা দিনে। সাথে দর্শন ছিল। এভাবে চেয়ে থাকার পরেও কিছু বুঝতে পারেনি সেটাই সৌভাগ্য। লিফট থেকে নেমে আরেক বিপত্তিতে পড়ল অর্ষা। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্লাবন। দর্শনের দৃষ্টি পড়ল প্লাবনের উপর। কিছুক্ষণ আগে নিচে দেখে এসেছে সেটাও স্মৃতিতে বিরাজমান। নিচ থেকে উপরে এসে আবার লিফটের সামনে অপেক্ষা করছে কেন সেটা মাথায় ঢুকছে না। দর্শন ছেলেটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ছেলেটা যে বারবার অর্ষার দিকে তাকাচ্ছে সেটা বুঝতে বাকি নেই। শুধু তাকাচ্ছেই না আড়চোখে ফলো করছে ওর কার্যকলাপ।
অর্ষার ফ্লাটের দরজার সামনে পৌঁছে গেছে। দর্শন সেখানেই দাঁড়িয়ে। প্লাবনের দিকে চেয়ে আছে। প্লাবন অর্ষাতে এতটাই বিভোর যে ওর সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি ওরই দিকে সেটা খেয়ালই করেনি।
“কী ভাই?”
প্লাবন পুনরায় চকিত হলো। ধরা পড়ে যাওয়ায় কাচুমাচু হয়ে উত্তর দিল,
“জি।”
“ওদিকে কী দেখছেন? ফলো করতে করতে নিচ থেকে উপরে চলে এসেছেন।”
“আমি ফলো কেন করব? ওকে তো আমি চিনি। আর ও আমাকে চিনে। সো ফলো করার কী আছে? আমি তো উপর তলায় যাচ্ছি।”
প্লাবন দ্রুতগতিতে সিড়ির দিকে গেল। অর্ষা দরজার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দর্শন কিছুই বুঝতে পারল না। কোন একটা গড়বড় তো আছেই। নয়তো ছেলেটা ওদের পেছনে পেছনে সিড়ি দিয়ে এল। তারপর লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল। অর্ষার দিকে নজর রাখল। তারপর আবার এক সিড়ি পার করে উপরে গেল। সরাসরি সিড়ি দিয়ে উপরে না গিয়ে এই ফ্লোরে কেন থামবে? আর কেনই বা লিফটের সামনে এসে দাঁড়াবে?
দর্শন অর্ষার দিকে তাকাল। ও দৃষ্টি লোকাচ্ছে, ওকে নার্ভাস লাগছে। বারবার ঘাম মুছছে টিসু দিয়ে।
দর্শন ওর সামনে যেতেই বলল,
“তুমি ভেতরে আসবে?”
“ছেলেটা কে?”
অর্ষা তোতলালে তোতলাতে বলল,
“কোন ছেলেটা?”
“মাত্র উপর তলায় যে ছেলেটা গেল। কে সে? তুমি না-কি চিনো? ওয়েট ওয়েট উপর তলা মানে সেই ছেলেটা নয়তো?”
দর্শনের প্রশ্ন শুনে অর্ষা হকচকিয়ে গেল। কপাল বেয়ে চিকন ঘামের রেখা ফুটে ওঠে। ঠোঁট নড়াচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। এই মুহুর্তে দর্শনকে রাগাতে চায় না। চায় না দিতে কোন টেনশন। তাই অন্যকিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করতেই দর্শন বলল,
“বুঝে-শুনে বলবে কিন্তু।”
দর্শনের একরোখা দৃষ্টির দিকে চেয়ে নির্বিঘ্নে মিথ্যা বলে ফেলল অর্ষা।
“না, উনারা উপর তলায় থাকে। আমি ছোট থেকে এখানেই বড় হয়েছি তাই চেনাজানা আছে। একটা ছেলেকে সাথে দেখে উনার কৌতূহল হচ্ছে তাই হয়তো এভাবে দেখছে।”
দর্শন আর কথা বাড়ালো না। ওরা ভেতরে গেল। প্রিয়া ওদের দেখে এগিয়ে এল।
“আমি গেস্ট রুম গুছিয়ে ফেলেছি। কিন্তু অর্পা আপু আসবে তো? আমাদের প্ল্যান সাকসেস হবে তো?”
অর্ষা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই হবে। আমি যে করেই হোক অর্পা আপুকে নিয়ে আসব। এখন চল কাজে লেগে পড়ি।”
দর্শন ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। অর্ষা আর প্রিয়া বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকাল।
দর্শন ওদের দু’জনকে এভাবে তাকাতে দেখে বলল,
“এভাবে চেয়ে আছো কেন তোমরা? ভূত বা এলিয়েন দেখছো? এতক্ষণ ধরে শপিং করে এতটা পথ জার্নি করে এলাম গলা ভেজাতেও বলবে না?”
অর্ষা জিভে কামড় দিল। এই জিনিসটা কখনোই ওর মাথায় থাকে না। কেউ বাসায় এলে তাকে চা- কফি, কোল্ড ড্রিংক অফার করতে হয় এটা বুঝেই উঠতে পারে না।
“সরি সরি আমি তোমার জন্য ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা কিছু নিয়ে আসছি।”
“না একটা ব্লাক কফি বানিয়ে আনো। মাথা ধরেছে খুব।”
অর্ষা আর প্রিয়া চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর অর্ষা নিচু কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা।”
প্রিয়ার কাছ থেকে গোপনে কফি বানানো শিখে কিচেনে গেল। প্রিয়া শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে গেস্ট রুমে গেল। অর্ষা কি দিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। খুব নার্ভাস লাগছে। ঠিকমতো কিছু খুঁজেও পাচ্ছে না। কখনো কিচেনে কাজ করেনি। দর্শন এই প্রথম বড় মুখ করে কিছু চাইল ওকে হতাশ করা যাবে না। অর্ষা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। বুয়া বাজারে গিয়েছে। অর্ষা সুন্দর দেখে একটা মগ নামাল তাক থেকে। হাত থেকে আচমকা কফির মগ পড়ে গেল। শুধু পড়ে যায়নি। পড়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দর্শন ড্রয়িংরুমে বসে থাকায় শব্দ পেয়ে দৌড়ে আসে। এসে দেখে কিচেনে এলাহি কারখানা। জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অর্ষার দিকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকাল। অর্ষা চোখ নামিয়ে নিল।
দর্শন ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে বলল,
“এক মগ কফি বানাতে গিয়ে এই হাল করেছো? দেখি দেখি কী কফি বানিয়েছো?”
দর্শন একটা মগে কফি নিয়ে মুখে দিল। এক ঢোক খেয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা ফ্যাকাশে মুখে ওর দিকে চেয়ে আছে।
“আমি কখনো কফি বানাইনি।”
দর্শন মৃদু হাসল। কফি ভালো হয়নি। কিন্তু অর্ষা ওর জন্য চেষ্টা করেছে এটাই অনেক। এর চেয়ে বড় পাওয়া হয়না। দর্শন মুচকি হেসে বলল,
“অনেক ভালো হয়েছে।”
…..
বিকেল চারটা। অর্ষা আর প্রিয়া রেডি হচ্ছে অর্পাকে আনতে যাবে। অর্ষা ড্রেসের সাথে ম্যাচ করে কানে দুল পরল। যেটা সকালে কিনে এনেছে। স্টনের ছোট দুলও ওর কাছে ভারী লাগছে। ও কানে কিছু পরে অভস্ত্য নয়। তাই হয়তো এমন লাগছে। প্রিয়া দেখে বলল,
“বাহ! ভারী সুন্দর তো। ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দে। দাঁড়া আমি দিচ্ছি।”
প্রিয়া অর্ষার ঠোঁটে জোর করে লিপস্টিক দিয়ে দিল। অর্ষা নিজেকে আয়নায় দেখে হাসফাস করছে।
“প্রিয়ু ভালো দেখাচ্ছে তো? আমার কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে বিশ্রী লাগছে। মুছে ফেলি?”
“মুছবি না খবরদার! সুন্দর লাগছে ট্রাস্ট মি।”
“আমার লজ্জা লাগছে। ধুর, দর্শন দেখলে কি বলবে?”
“বলবে সুন্দর লাগছে। এখন চল।”
অর্ষাকে ওই অবস্থায়ই জোর করে প্রিয়া নিয়ে গেল।
অর্পাকে এক প্রকার জোর করেই অর্ষা আর প্রিয়া ওদের বাসায় নিয়ে আসে। অর্পা ওদের সাথে এসেছে ঠিক কিন্তু অর্ষার বাসায় আসার পর কেমন অস্বস্তি লাগছে। অর্পা ওকে বলছে,
“আমাকে হঠাৎ বাসায় কেন আনলে? রুশানের কথায় না তো?”
“আপু তুমি যদি বলতে দর্শনের কথায় কি-না তবে মানা যেত কিন্তু রুশান ভাইয়া? কে আমার আপন বেশি তুমি না রুশান ভাইয়া?”
অর্পা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। অর্ষা ওর হাত ধরে বলল,
“আসো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই ভয় পাবে না তো?”
“কি দেখাবে?”
ভ্রু কুঁচকে অর্পা বলল।
“চলোই না।”
অর্ষা জোর করে ওর হাত ধরে গেস্ট রুমে নিয়ে গেল। গেস্ট রুম পুরো অন্ধকার।
“রুম অন্ধকার কেন?”
“আমি লাইট অন করছি ওয়েট।”
অর্ষা লাইট অন করার আগেই ঠাস করে বেলুন ফুটে। অর্পা ভয়ে চিৎকার করে। সাথে সাথে লাইট জ্বলে উঠে। অর্পার মাথার উপর ফুলের পাপড়ি আর জড়ি কাগজ। অর্পা হতবাক, হতবিহ্বল। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সামনে চেয়ে দেখে রুশান। রুশান রেড কালার লাভ সেপ বেলুন হাতে সামনে এগিয়ে আসে।
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে ডেয়ার অর্পা।”
অর্পা রুশানকে দেখে রেগে যায়। রুশান ওর রাগের ইয়ত্তা না করে ওর একদম কাছে এসে বলে,
“হ্যাপি বার্থডে জান। সরি এন্ড আই লাভ ইউ। প্লিজ সরি। আর হবে না।”
অর্ষা আর প্রিয়া পেছনে থেকে সরে যায়। দর্শন কিচেনে কফি বানাচ্ছে। অর্ষা কিচেনে গেল। দর্শন যত্ন সহকারে কফি বানাচ্ছে। একটা জিনিসও এলোমেলো নেই। সব গুছানো, সাজানো। কিচেন একটুও নোংরা হয়নি। অথচ সকাল বেলায় কফি বানাতে গিয়ে ও পুরো কিচেন নাজেহাল করে ফেলেছিল। দর্শন ওকে দেখে বলল,
“খালাকে জিজ্ঞেস করে সরঞ্জাম কি কোথায় আছে জেনে নিয়েছি। তোমাকে বিরক্ত করিনি নিজেই বানাচ্ছি।”
অর্ষা মনে মনে বলছে আমি ভালো পারি না তাই নিজে বানাচ্ছো আমি বুঝেছি মিস্টার।
দর্শন কফিতে একবার চুমুক দিয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে এল। অর্ষা ওর কাছে আসায় ঘাবড়ে গেল। বুক ধুকপুক করছে। ওর মোহনীয় চাহুনিতে হকচকিয়ে গেল। দর্শন এভাবে দেখছে কেন ওকে।
“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নিজেকে এভাবেই সাজাবে ভালো লাগবে।”
অর্ষার কিছু মুহুর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। দর্শন মুচকি হেসে সরতেই শ্বাস এল।
রুশান অবশেষে অর্পাকে মানাতে সক্ষম হয়েছে। অর্পার রাগ ভেঙেছে। ওরা সবাই মিলে কেক কেটে আড্ডা দিয়ে যে যার বাড়ি গিয়েছে।
দর্শনের ঘুম হচ্ছে না। ছটফট করছে। অর্পা আর রুশানের সম্পর্ক তো ঠিক করে এল কিন্তু ওর আর অর্ষার সম্পর্ক? কেমন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। অর্ষা আজ ওকে মিথ্যা বলেছে। অর্ষার চোখ দেখেই বুঝেছে অর্ষা মিথ্যা বলেছে। দর্শন সব জেনে-বুঝেও চুপ ছিল। অর্ষা কেন মিথ্যা বলল? ছেলেটা যে প্লাবন কেন বলেনি? শপিংমলে, কলেজে, রাস্তাঘাটে এমনকি ওর বিল্ডিংয়ে কত মানুষ আছে যারা ওকে চায়। একদিন তো দর্শন ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সামনে ওর প্রি টেস্ট তারপর টেস্ট তারপরই এইচএসসি পরীক্ষা। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। কত লড়াই, কত পরিশ্রম, কত টেনশন। এতকিছুর মধ্যে যদি অর্ষাকে সময় দিতে না পারে অর্ষাকে কি ওকে ভুলে যাবে? বেছে নেবে এদের মধ্যে একজন? ওর ভালোবাসার পরিণতি কি হবে? তামিমের মতো?
দর্শন অন্ধকারে হাতরে ব্রেসলেটটা বের করল। অর্ষাকে আজ দিতে ভুলে গেছে। দর্শন ব্রেসলেটের দিকে গভীর ভাবে তাকাল। তারপর চোখে ভয়াবহতা ফুটিয়ে বিরবির করে বলল, “এর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে অর্ষা।”
চলবে…..