প্রেম_তুমি,পর্ব-২৫,২৬

0
243

#প্রেম_তুমি,পর্ব-২৫,২৬
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২৫

দর্শন প্রথমে রেগে-মেগে অর্ষার কাছে যেতে চাইলেও কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ডিসিশন চেঞ্জ করে। ওর আগে আলিশার সাথে কথা বলা দরকার। ওকে থামানোটা জরুরি। ও কি করবে সেটা জানতে হবে। ওর সাথে কথা বলবে, ওকে যদি বুঝিয়ে কাজ হয় পরে অর্ষার সাথে কথা বলে নিবে।
আলিশা কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে। ওর বন্ধুরা ওকে সামলাচ্ছে। লাল চোখমুখ দেখে ভয়ংকর লাগছে। মনে হচ্ছে চারপাশ জ্বালিয়ে দিবে। আলিশা যে কত জেদি সেটা অজানা নেই। কোটিপতি, বড়লোক বাবার একমাত্র আদুরে মেয়ে। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। দর্শন বারবার আঁতকে উঠছে। আলিশা কি ওর কথা শুনবে? যদি না শুনে? যদি বড় কোন ঝামেলা পাঁকিয়ে ফেলে? উফফ! কিছুই ভাবতে পারছে না।
দর্শন আলিশার কাছে এগিয়ে গেল। আলিশা ওকে দেখে ক্ষেপে গেল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল চোখমুখ দ্বিগুণ লাল করে বলল,
“তোমার ওই অসভ্য গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে আমি কোন কথা বলতে চাই না। আমি ওকে ওর যোগ্য শাস্তি দেব।”

দর্শন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করার জন্য কিছু বলতে চাইলে আলিশা চেঁচিয়ে উঠল,
“ওকে আমি কলেজ থেকে বের করে দেব। ওর লাইফ ডেস্ট্রয় করে দেব। ওর এত বড় সাহস! আমার গায়ে হাত তুলে! পাব্লিক প্লেসে অপমান করেছে আমাকে। ওকে আমি ছাড়ব না। পাপা আসছে।”
আলিশা চোখের পানি মুছল৷

দর্শন মনে মনে ভয় পাচ্ছে ওর আচরণে। কিন্তু দমে গেলে চলবে না। অর্ষার জন্য ওকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
“আলিশা, প্লিজ কুল! একটু আমার কথা শুনো। প্লিজ মাথাটা ঠান্ডা করে বসো।”
দর্শন ওকে বসার জন্য অনুরোধ করছে। আলিশা চোখ মুছে বসল। দর্শন কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
“দেখো আলিশা, তুমি তো জানো অর্ষা একটু পাগলাটে টাইপের। ও…

” পাগলাটে! ও একটা অসভ্য ম্যানার লেস। কোন শিক্ষা নেই ওর। বেয়াদব মেয়ে একটা। আমি ওকে ছাড়ব না।”

“আলিশা প্লিজ প্লিজ! একটু বোঝার চেষ্টা করো। ব্যাপারটা আমরা মিটিয়ে নেই। বিষয়টি ফ্যামিলি পর্যন্ত যাওয়া কী দরকার ছিল?”

“ও যে মেয়ে তাতে ওর সাথে কেউ কিছু পার্সোনালি মেটাতে পারবে না। এর জন্য বড়দের প্রয়োজন। গার্জিয়ান আসবে, প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে সব হবে।”

দর্শন কিছুতেই আলিশাকে বুঝাতে পারছে না। অনুরোধের সুরে বলল,
“প্লিজ আলিশা, একটু বোঝার চেষ্টা করো। অবুঝের মতো আচরণ করো না। আমার অনুরোধ রাখো, ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেও। মাত্র কয়েকদিন তারপর আমরা এই কলেজ ছেড়ে চলে যাব। যাওয়ার আগে ভালো কিছু রেখে যাওয়া উচিত কি-না? ”

আলিশা কিছুক্ষণ ভাবল। ভাবছে কি করা যায়? কোন সুযোগ কি পাওয়া যাবে? যদি বাবাকে ছাড়াই ওকে শায়েস্তা করা যায়, আর দর্শনের মনও রাখা যায়। আলিশা নিজের মাথাটা কাজে লাগিয়ে কুবুদ্ধি আঁটটে লাগল। দর্শন ওর দিকে অতি আগ্রহের সাথে চেয়ে আছে। মনে মনে প্রে করছে যেন মেনে নেয়।

“ওকে, আমি বাবাকে আসতে মানা করে দিচ্ছি। আর ওকে কলেজও ছাড়তে হবে না। তবে ওকে একটা কাজ করতে হবে।”

দর্শন জানে কাজটা সহজ হবে না তবুও চট করে প্রশ্ন করল,
“কী কাজ?”

“ওকে মাফ চাইতে হবে। আমাকে থাপ্পড় মারার জন্য অনুতপ্ত, নিজের বেয়াদবির জন্য মাফ চাইবে আর সেটা পাব্লিক প্লেসে। মানে যেখানে থাপ্পড় মেরেছে সেখানে।”

দর্শন জানে অর্ষার অনেক ইগো, আলিশার কাছে ক্ষমা কিছুতেই চাইবে না। কিন্তু ওকে বুঝাতে হবে, মানাতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। নয়তো অর্ষার বাবাকে ডাকবে, মেয়ের জন্য তিনি অপমানিত হবে। অর্ষাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে। অন্য কলেজে এডমিশন নেওয়াও সম্ভব হবে না। এতে ওর ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। অর্ষাকে সরি বলাতেই হবে।অর্ষাকে অনুরোধ করলে ওর অনুরোধ ফেলতে পারবে না।
তাই দর্শন এত ভাবল না। অন্তত এই অপশনটা অর্ষার জীবন তছনছ করবে না। আলিশা দুদিন পর চলে যাবে৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন শুধু অর্ষাকে রাজি করানো জরুরি।
“ওকে। ও মাফ চাইবে।”

আলিশা আলতো হাসল। খানিকটা তাচ্ছিল্য।
“তোমার গার্লফ্রেন্ডকে তুমি চিনো না? অদ্ভুত! ও কখনোই আমাকে সরি বলবে না।”

“বলবে, অবশ্যই বলবে।”
দর্শনের কন্ঠে বেশ কনফিডেন্স, চোখে দৃঢ়তা।

“এত কনফিডেন্স?”

“উহু! বিশ্বাস, ভরসা। যত যাইহোক ও আমার কথা ফেলতে পারবে না।”

“আচ্ছা দেখা যাক। তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা প্রমাণ হোক।”

“অবশ্যই। তোমাকে প্রমাণও দেব।”

“তাহলে স্টার্ট করো।”

দর্শন আলিশার সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে চায়না। তাই বলল,
“তুমি তোমার কথা রাখো।”

….

অর্ষা প্রিয়াকে কল করছে কিন্তু প্রিয়া কল রিসিভ করছে না। মনে মনে ওকে গালি দিচ্ছে। ও গতকাল রাঙামাটি গেছে কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে। এই বিয়ের উছিলায় অনেক বছর পরে দাদাবাড়ীর সবাই একত্রিত হয়েছে। আর সবাইকে পেয়ে প্রিয়া ওকে ভুলে গেছে। দুই-তিন বার কল দেওয়ার পর কল রিসিভ হলো। কল রিসিভ করে ব্যস্ততার সুরে বলল,
“হ্যা, অর্ষা বল।”

“কল রিসিভ করতে এত দেরি হলো কেন?”

“কাজিনদের সাথে বের হয়েছি।”

দাঁতে দাঁত চেপে অর্ষা বিরবির করে কিছু বলল কিন্তু প্রিয়া বুঝতে পারল না।
“কবে আসবি?”

“মাত্র তো এসেছি। আরো চারদিন দিন পর বিয়ে। বিয়ের পর অন্য রিলেটিভিটদের বাসায় বেড়াবো, রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গা ঘুরব। তারপর ঢাকায় ফিরব। অন্তত ১৫ দিনের মতো লাগবে।”

“সারাজীবন থেকে যা। আন্টিকে বল একটা ছেলে দেখে ওখানে বিয়ে দিয়ে দিতে। কল কাট!”
অর্ষা কল কাট বলে নিজেই কল কেটে দিল। ওদিকে কি হচ্ছে কিছুই ধারণা নেই। আজ যে এতবড় একটা ঘটনা ঘটিয়েছে সেটা দিব্যি ভুলে বসে আছে।

দর্শন ওকে খুঁজতে খুঁজতে পানির কলের সামনে পেল। কল দিচ্ছিল কিন্তু বিজি আসছিল। দর্শন এমনিতেই রেগে আছে তার উপর এতক্ষণ ধরে কল দিয়ে পায়নি, খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে।
ওর ডান বাহু চেপে ধরে বলল,
“কই থাকো তুমি? তোমাকে খুঁজে মরছি। মোবাইলেও বিজি। এত কেয়ারলেস কেন তুমি?”

অর্ষা আচমকা ঘটনায় হকচকিয়ে গেল। দর্শনের কন্ঠস্বরে রাগ বিদ্যমান। এত রেগে আছে কেন? অর্ষার কাছে উত্তর না পেয়ে আরো জোরে চেপে ধরল। অর্ষা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। ওর মুখ দিয়ে কিঞ্চিৎ শব্দ হলেও দর্শন পাত্তা না দিয়ে নিজ প্রশ্নে বহাল।
“এন্সার মি।”

অর্ষা দ্রুত বলল,
“প্রিয়ার সাথে কথা বলছিলাম।”

“এতবড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে এখানে বসে প্রিয়ার সাথে কথা বলছিলে? মনে ভয়-ডর বলে কিছু নেই? বড়-ছোট, সম্মান বলেও তো কিছু একটা আছে সেটা জানো না, স্টুপিড? বড়দের গায়ে হাত তোলা মানে কী জানো? বেয়াদবি, অসভ্যতা। অন্তত ভদ্র মানুষ এসব করে না। যাই হয়ে থাক আলিশার গায়ে হাত তোলা তোমার উচিত হয়নি। এখুনি আমার সাথে যাবে আর ওকে সরি বলবে।”

অর্ষার মনে পড়ে গেছে আজকে আলিশাকে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মেরেছে। অর্ষা কপাল কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“আমি সরি বলব?”

দর্শন কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলল,
“হ্যা, বলবে। পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। মন মেজাজ যথেষ্ট খারাপ আছে। তাই প্লিজ সিন ক্রিয়েট না করে ভালো মেয়ের মতো সরি বলবে। কারণ তুমি অন্যায় করেছো।”

তাহলে আলিশা যা বলেছে তাই সত্যি। দর্শনের পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে। আগেরগুলোও কি খারাপ হয়েছে? দর্শন কি লুকিয়েছে?
এতসব ভাবনা বাদ দিয়ে অর্ষা বলল,
“আমি কোন অন্যায় করিনি। তাই সরি বলার প্রশ্নই ওঠে না। ও বারবার যেচে এসে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে। তোমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে। আমাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে তুমি সহ্য করতে পারলেও আমি পারি না।”

“তাই বলে থাপ্পড় মারবে?”

“হ্যা, মেরেছি। বেশ করেছি। আমি মরে গেলেও ওকে সরি বলব না। শুনেছো?”

“ওর বাবা আসছে। কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে। বুঝতে পারছো তুমি?”

“করুক। যা খুশি করুক। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি সরি বলতে পারব না ওই জঘন্য মেয়েটাকে। তুমি আমাকে অন্য যা কিছু করতে বলবে আমি করব। বাট এই রিকুয়েষ্ট করো না আমি রাখতে পারব না। এতে আমার যা ক্ষতি হওয়ার হোক।”

দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অর্ষা যে নিজের প্রতি, নিজের ভবিষ্যত, পড়াশোনার প্রতি কতটা উদাসীন সেটা অজানা নয়। ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলেও আফসোস করবে না। ওর আরো ভালো হবে। ও বেখেয়ালি মেয়ে। ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই ওর। তাই ওকে অন্যভাবে সরি বলানোর জন্য রাজি করাতে হবে। যত যাই হোক অর্ষা একটা অন্যায় করেছে আর এই অন্যায়ের জন্য আলিশাও অন্যায়ভাবে ওকে শাস্তি দিবে। একটা থাপ্পড় মারার জন্য কেউ কাউকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে না। দর্শন কি করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিল। অর্ষাকে রাজি করানোর জন্য মিথ্যা বলতে হবে, রুড ব্যবহার করতে হবে।

“আমি বহিষ্কার হলে তোমার কিছু যায় আসে না? সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা। কত বছরের স্বপ্ন, লড়াই, কঠোর পরিশ্রম সব নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে? তোমার কিছু আসে যায় না?”

অর্ষা অবাক হলো ভীষণ। ও তো ভেবেছিল নিজের বহিষ্কার কিন্তু দর্শনকে বহিষ্কার করবে কোন ইস্যুতে? দর্শন কী করেছে?
অর্ষা উদ্বিগ্ন আর উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,
“তোমাকে বহিষ্কার করবে? বাট হোয়াই?”

“তোমার জন্য। তোমাদের ঝামেলার ইস্যু অবশ্যই আমি ছিলাম। আলিশা আমার লাইফ হেল করে প্রতিশোধ নিবে। তুমি জানো তো পড়াশোনাটা আমার কাছে কত ইম্পর্ট্যান্ট। আমার লাইফের প্রথম স্বপ্ন কী? জানো তো তাই না? তাহলে জেনেশুনে কেন আমাকে এহেন ঝামেলায় ফেলো? তোমার বেয়াদবির জন্য আমি কেন নিরপরাধ হয়ে বহিষ্কার হবো? এন্সার মি।”

অর্ষা আমতা-আমতা করে বলল,
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

দর্শন কঠিন গলায় বলল,
“তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না। তুমি যাবে আর ওকে সরি বলবে। আমাকে বহিষ্কৃত হতে বাঁচাবে।”

“তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছো। এমন কিছু হবে না। তোমার রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেছে। টেস্ট পরীক্ষা শেষের দিকে। এখন বহিষ্কার করা সম্ভব না। ভয় দেখাচ্ছে তোমাকে।”

“ওর বাবাকে কল করে কেঁদে কেঁদে কথা বলতে শুনেছি আমি। ওর বাবা আসছে। আর আলিশা চিৎকার করে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা আর বহিষ্কারের কথা বলেছে। তুমি ছাড়া পুরো কলেজ শুনেছে ওর চিৎকার।”

অর্ষা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজ সিদ্ধান্তে অটল। আলিশার সামনে মাথা নত করবে না কিছুতেই। নিজেকে কখনো কারো সামনে ছোট করেনি, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়নি। আজও দেবে না। কিন্তু দর্শনের কোন ক্ষতি হতে দেবে না।
“দর্শন, রিলেক্স! আমি মেমের সাথে কথা বলে আসছি৷ আলিশা কিছু করতে পারবে না। তুমি খামোখা চিন্তা করো না।”

“তুমি যেসব কাহিনি করো তাতে চিন্তা না করে থাকা যায়? মাঝেমধ্যে কি তোমার মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়?”

অর্ষা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। দর্শন না হয়ে অন্য কেউ হলে কঠিন গলায় উত্তর দিত।
দর্শন উত্তর না পেয়ে বলল,
“তোমার অনেক আত্মসম্মানবোধ, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বাট তোমার এই আত্মসম্মানবোধের জন্য আমার কোন ক্ষতি আমি মেনে নেব না। আমার লাইফের ফার্স্ট প্রায়োরিটি ডাক্তার হওয়া আর সে পথেই এগিয়ে যাওয়া। সে পথে কারো বাঁধা আমি মেনে নেব না এমনকি তোমারও না। তুমি আলিশার কাছে মাফ চেয়ে সব মিটিয়ে নিবে।”
শেষের কথাগুলো দর্শন উচ্চস্বরে রাগান্বিত হয়ে বলল। অর্ষা কি করবে বুঝতে পারছে না। আলিশার কাছে কি করে মাফ চাইবে? এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু আছে? মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

দর্শন চেঁচামেচি করে চলে যাচ্ছে। পেছনে থেকে শুধু মৃদুস্বরে বলল,
“যদি আমাকে ভালোবাসো তবে আলিশার কাছে এই মূহুর্তে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। আর সেটা ওর বাবা আসার আগে।”

দর্শন চলে গেল। অর্ষা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে। ভীষণ দোটানায় ভুগছে। তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। ওর কাছে এতটা তুচ্ছ? দর্শনের কাছে ওর আত্মসম্মানের কোন দাম নেই? নিজের স্বপ্নের চেয়ে বড় আর কিছু নেই?

….

আলিশা ঠোঁটের কোনে পৈশাচিক হাসি নিয়ে দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা ওর সামনে। যাকে কিছুক্ষণ আগে উচ্চস্বরে শাসিয়ে গেল এখন তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর ন্যায়। আশেপাশে অনেক মানুষ মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে নিশ্চয়ই আলিশা জোগাড় করে এনেছে অর্ষার অপমান দেখে মজা পাওয়ার জন্য। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
আলিশা ফিসফিস করে বলল,
“বলেছিলাম না তোর বারোটা বাজাব? এখন সবার সামনে আমার কাছে মাফ চা। যার জন্য আমার সাথে অকথ্য ভাষায় কথা বলে গেলি সেই এখন তোকে সরি বলাচ্ছে তাও আমাকে। এখন বুঝে নে কে ওর কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে যার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করলি সেই এখন মজা দেখার জন্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে।”
আলিশা আঙুল দিয়ে বাম পাশে দেখাল।

অর্ষা আলিশার আঙুলের দিকে তাকাল। দর্শন আর রুশান ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে বিচলিত লাগছে। দর্শন মাত্রই এসেছে। এখানে এত ভীড় দেখে হতবাক। নিশ্চয়ই আলিশার কাজ। অর্ষার দিকে তাকাল। ওকে ভীষণ অসহায় আর ভঙ্গুর লাগছে। দর্শন ওর দিকে এগিয়ে এল। আলিশা পাব্লিক প্লেসে ওকে হেনস্তা করার প্ল্যান করেছে। আলিশা এতটা প্ল্যান করেছে সেটা ওর জানা ছিল না। ভেবেছিল অর্ষা আসবে ওকে সরি বলবে ব্যস!
অর্ষা জলভর্তি লাল চোখে দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর আলিশার দিকে ঘুরল। আজ অপমানিত হবে, ভীষণ অপমানিত হবে যাতে কখনো মাথা উচু করে কারো দিকে তাকাতে না ইচ্ছে করে। গলা ধরে আসছে। কান্না মিশ্রিত ভারী কন্ঠে বলল,
“আলিশা, আ’ম সরি। তোমার গায়ে হাত তোলা আমার উচিত হয়নি। সরি এগেইন।”
দর্শন ওর কাছে আসার আগেই কথাগুলো বলে শ্বাস নিল। এখন ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। গলা আঁটকে আছে। ছোট করে ঢোক গিলল। দর্শন ওর পাশে এসে দাঁড়াল। ওকে বাঁধা দেওয়ার জন্য এসেছিল কিন্তু পারল না। অর্ষা দর্শনের দিকে তাকাল। লাল চোখজোড়া হতে দু ফোঁটা পানি গাল বেয়ে পড়ল। অর্ষার চোখের দিকে চেয়ে নীরবে কিছু ভাঙার শব্দ পেল। দর্শন হাত বাড়িয়ে ওকে ছুতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। অর্ষা ওর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল।

চলবে……

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২৬

একটা বিষন্ন বিকেল আর একটা ছবির ফ্রেম অর্ষার মন খারাপের সঙ্গী। কলেজ থেকে ফিরে চেঞ্জ করেনি এখনো। আধ ভেজা চুল গালে লেপ্টে আছে। কোলের উপরে ফ্রেমটা রেখে নিথর হয়ে ফ্লোরে বসে আছে। হঠাৎ কলিং বেল বাজল।
কলিং বেলের বিদঘুটে শব্দটা কান ও মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল অর্ষার।
কোলের উপরে ছবির ফ্রেম রেখেই চিৎকার করে বলল,
“খালা, বাবা ছাড়া অন্য কেউ আসলে দরজা খুলবে না। দিস ইজ মাই অর্ডার।”

কয়েক সেকেন্ড পরে খালা দৌড়ে এল অর্ষার রুমে। অর্ষা নিষ্পলক চোখে ফ্রেমের দিকে চেয়ে আছে। খালা ওকে কিছু বলতেই ইতস্তত বোধ করছে। আঙুলে আঙুল ঘঁষে ভয়ে ভয়ে বলল,
“মামনি, তোমার সেই পোলা বন্ধু আইছে। দরজা খুলুম?”

অর্ষা বুঝতে পারছে পোলা বন্ধুটা দর্শন। সমস্ত রাগ খালার উপর ঝেরে বলল,
“তোমার কানে কি সমস্যা? কি বলছি শুনোনি? বাবা ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিবা না।”

খালা মাথা চুলকে বলল,
“কিন্তু বেল বাজাইতাছে যে?”

অর্ষা দাঁত খিচিয়ে বলল,
“কানে তুলা দেও আর আমার সামনে থেকে দূর হও।”

খালা ওর কথা শুনে বুঝতে পারল ও প্রচন্ড ক্ষেপেছে তাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে না থাকাই শ্রেয়। খালা দরজার দিকে একবার চেয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। দর্শন কখন থেকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এতবার বেল বাজানোর পরেও দরজা খুলছে না। অর্ষার নাম্বার অফ। অর্ষা ওর সাথে কথা তো দূর ওর মুখও দেখতে চায় না। কেনই বা দেখবে? আজ ওর জন্য চরম অপমানিত হতে হয়েছে। ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে অর্ষা জিতে গিয়ে ওকে হারিয়ে দিয়েছে। ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। ভালো লাগছে না কিছুই। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পুরো দিনটাই খারাপ গেল ওর। দর্শন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিরুপায় হয়ে বাসায় চলে গেল। আজ অর্ষা দরজা খুলবে না আর কথাও বলবে না। তাছাড়া আগামীকাল পরীক্ষা আছে। রাতে একবার কল করে কথা বলবে অথবা আগামীকাল কলেজে আসলে কথা বলে নিবে।

অর্ষা ওর মায়ের ছবির ফ্রেমটা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
“আম্মু আজ আমাকে একটা মানুষ ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। ওই মানুষটাকে আমি সব সময় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছি। কিন্তু তার বিনিময়ে কি পেয়েছি জানো? ভরা মজলিসে অসম অপমান। এত অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আম্মু। যেদিন আমি বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান আশ্রয়, স্নেহ ভালোবাসার অফুরন্ত ভাণ্ডার মমতাময়ী মা আমার নেই সেদিনও এত কষ্ট পাইনি। যে জিনিস আমার কখনো ছিল না সে জিনিস নিয়ে আমি কেন কষ্ট পাব? নিজেকে বুঝিয়ে এসেছি। কিন্তু যে মানুষটা আমার ছিল, যাকে আমি এত ভালোবেসেছি সে আজ আমাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তার জীবনে আমার অবস্থান আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ এতদিন আমি তাকে নিয়ে মিথ্যা গর্ব করে এসেছি। সে যাই করুক আমাকে কখনো নিচু করবে না। আমাকে কখনো অবহেলা করবে না। কিন্তু করেছে। আমাকে ওর লাইফে একটা অপশনের মতো রেখেছে। আমি কী করে কলেজে এই মুখ দেখাব? কি করে মানুষের সামনে যাব? এত অপমান যে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
অর্ষার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরেছে। নিজের গাল খাঁমচে রক্ত বের করে ফেলেছে।

অর্ষা মুখে মাস্ক পরে কলেজে এসেছে আজ। তিনদিন পরে আজ কলেজে এসেছে বাবার জোড়াজুড়িতে। গালের অনেক জায়গায় কেটে গেছে। ক্ষত মুখ দেখলে অনেকে অনেক প্রশ্ন করতে পারে। তাই মাস্ক পরে এসেছে। বারবার নাক টেনে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে ওর ঠান্ডা লেগেছে। এই তিনদিন দর্শন অনেক চেষ্টা করেছে ওর সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু সম্ভব হয়নি। অনুতাপের তপ্ত আগুন দগ্ধ হচ্ছে নিত্যদিন। এ অনুতপ্তের দগদগে ঘা তখনই শোকাবে যখন অর্ষা ওকে মন থেকে মাফ করবে। অর্ষাকে দেখার জন্য চোখদুটো বেশ তৃষার্ত হয়ে আছে। চাতক পাখির মতো এদিক সেদিক করছে। পরীক্ষা শেষে যখন জানতে পারল অর্ষা কলেজে এসেছে তখন পুরো কলেজ অর্ষাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে এমনকি লেডিস্ ওয়াশরুমেও। কিন্তু কোথাও অর্ষার হদিস মেলেনি। যে নিজেকে নিজ থেকে লুকিয়ে রাখে তাকে কী করে খুঁজে পাওয়া যায়? ওকে না পেয়ে দর্শন ডিপ্রেশনে ভুগছে। নিজের প্রতি প্রচুর রাগ হচ্ছে। অর্ষা কী ওকে কখনো মাফ করবে? কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

পরের দিন দর্শন পেছনে থেকে অর্ষাকে দেখে কালো মেঘের ভেলায় একটুকরো ভাসমান আলো
দেখতে পেল। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ করে জাগরিত হলো। দৌড়ে ওর সামনে গেল। কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। অর্ষা ওকে দেখে ইগ্নোর করে চলে যাচ্ছে। ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সে ঝড় এখন ওর হাঁটার মধ্যে বিদ্যমান। দর্শন অনুনয় করতে করতে ওর পেছনে পেছনে গেল।
“অর্ষা, দাঁড়াচ্ছো না কেন?”

“আমার কাজ আছে। তার চেয়ে বড় কথা আমি তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। সো প্লিজ পেছনে পেছনে ছ্যাচড়ার মতো আসবা না।”

ছ্যাচড়া বলায় দর্শন কিছু মনে করেনি কারণ ও জানে অর্ষা রেগে আছে আর ছ্যাচড়া কেন এর চেয়ে বড় কিছু বলাও এখন অর্ষার জন্য জায়েজ।
“তোমার যা খুশি বলো, যত রাগ আছে সব ঝারো শুধু আমার সাথে একটু কথা বলো। আমি যা করেছি তার জন্য অনুতাপের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। একটু দয়া করো।”

অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দয়া! সে তো তুমি করবে আর সেটা আমাকে। আমি তোমাকে দয়া করার কে? আমি সাধারণ একজন মানুষ। তোমার মতো অসাধারণ নই।”

দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে বিরক্ত হলো। মাস্ক পরে মুখ ঢেকে রেখেছে। একটু দেখতেও পারছে না। দর্শন এক টানে ওর মাস্ক খুলে ফেলে আঁতকে উঠে। মুখ থেকে পারমিশন ছাড়া মাস্ক খোলায় অর্ষা রেগে আগুন। দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। গালে আঁচড়ের দাগ। সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে। দর্শন ওর গালে হাত ছোয়াতেই অর্ষা ওর হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“হাও ডেয়ার ইউ টু টাচ মি? কাউকে ছুতে হলে পারমিশন নিতে হয়। আমি তোমার পার্সোনাল প্রপার্টি নই।”

দর্শন হাতটা মুঠ করে নিল অপমানে আর লজ্জায়। থমথমে মুখে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“এমন কেন করেছো?”

অর্ষা কিঞ্চিৎ দূরত্বে গিয়ে বলল,
“আমার ফেস আমি যা খুশি করব। আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করবে না প্লিজ। সে সম্পর্ক আর আমাদের নেই।”

দর্শন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“নেই?”

অর্ষা তাচ্ছিল্য হাসল। তারপর বলল,
“আদৌও আছে কি? সেদিন যা করেছো তারপরেও সবটা ঠিক আছে? আমি তোমার লাইফের কোথাও কি আছি? মনে তো হয় না আছি। যদি থাকতাম….. সূদুর ভবিষ্যতে একদিন তোমার ক্যারিয়ারের জন্য আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবে। কারণ তোমার কাছে ভালোবাসা ও মানুষের চেয়ে তোমার পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। এর জন্য সব জায়েজ তোমার কাছে। একদিন বলেছিলাম সব সহ্য করতে পারি কিন্তু অবহেলা নয়। একা থাকব কিন্তু কারো লাইফে অবহেলার পাত্র হয়ে থাকব না। ”

“অর্ষা, এটা ভুল। আমি বুঝতে পারিনি এতকিছু হয়ে যাবে। সত্যিই বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ।”
দর্শন অর্ষার দু’বাহুতে হাত রেখে বলল। অর্ষা ওকে আবারও ঝারা মেরে সরিয়ে বলল,
“ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি। একদম দূরে। তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়।”

দর্শন ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইল। অর্ষা ছলছলে চোখে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“তোমাকে পুরো পৃথিবী দিয়েছিলাম তার বিনিময়ে কী দিয়েছো? একাংশও দাওনি। অথচ দেখো আমি কত বোকা সবটা দিয়ে বসে আছি।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here