প্রেম_তুমি,পর্ব-১৮,১৯

0
264

#প্রেম_তুমি,পর্ব-১৮,১৯
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৮

অর্ষা কলেজে গিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়েছে। তার কারণ দর্শনের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার পর দু’জন দেখা করে, ক্লাসের ফাঁকে সময় কাটায়। কিন্তু আজ কলেজে গিয়ে দর্শনের দেখা পায়নি। কল করেও রেসপন্স পায়নি। ওর খুঁজে ক্লাসে গেলে ততক্ষণে ওর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। অপেক্ষা করতে করতে ওর নিজের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। দু ক্লাস শেষ করে দর্শনকে আবারও কল দেয় কিন্তু এবারেও কোনো রেসপন্স নেই। তাই নিজের পরের ক্লাস রেখে রাগান্বিত হয়ে দর্শনের ক্লাসে গেল। দর্শন ক্লাসে নেই, লাইব্রেরিতে নেই এমনকি ক্যান্টিনেও নেই। হঠাৎ যেন উধাও। কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। দর্শন কি ইচ্ছে করে ওকে এড়িয়ে চলছে? কিন্তু কেন? গতকাল অবধি তো সব ঠিক ছিল। আজ হঠাৎ কি হলো? অর্ষার মনে ভয়ের দানা বেঁধেছে। দর্শন এমন করছে কেন? মনটা অশান্ত, বিভ্রান্ত। চোখ ছলছল করছে। কিছু ভালো লাগছে না। চুপচাপ বসে আছে ক্যাম্পাসে।
দর্শন ওর বাম পাশ দিয়ে বন্ধুদের সাথে যাচ্ছে। দর্শনের কন্ঠ শুনে অর্ষা বামে তাকায়। দর্শন ওকে দেখেনি। দেখেনি না-কি দেখেও না দেখার ভান করছে? অর্ষা ওর দিকে চেয়ে আছে। কিছুদূর যাওয়ার পর যে যার মতো আলাদা হয়ে গেল। দর্শন লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে। অর্ষা দৌড়ে গেল দর্শনের কাছে। দর্শনের সামনে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করছে দর্শনকে। দর্শনের চেহারা দেখে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

দর্শন ওর ভাবনায় ছেদ ধরিয়ে বলল,
“কিছু বলবে? আমাকে লাইব্রেরিতে যেতে হবে।”

অর্ষা শুধু বলল,
“তুমি কি আমাকে এভয়েড করছো?”
অর্ষার চোখে কাতরতা।

দর্শন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“এভয়েড কেন করব?”

অর্ষা স্মিত হাসল,
“ফোন বন্ধ, দেখা করছো না, কথা বলতে চাইলে বলছো আমি কিছু বলব কি-না।”

দর্শন ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
“পড়ার চাপ যাচ্ছে প্রচুর। সামনে পরীক্ষা জানোই তো। পড়ার চাপ থাকলে তোমাকে সময় কম দেব এটা তো আগে থেকেই বলা। তবুও তোমার মনে হচ্ছে আমি এভয়েড করছি।”

দর্শন ক্ষনিকের জন্য থামল তারপর আবারও বলল,
“কিছুদিন পরে সময় দেই না এই অজুহাতে ব্রেক আপও করতে চাইবে। চারপাশে তোমাকে চাওয়ার মানুষ তো কম না।”

অর্ষা খানিকটা বিস্মিত হলো। দর্শন কোন স্বরে কথা বলছে? কেন বলছে? চাওয়ার মানুষ কম না মানে কি?

দর্শন অর্ষার চোখের দিকে তাকাল। এক ঝিল পানি টইটম্বুর সেখানে। তবুও কঠিন হলো। কঠিন স্বরে কথা বলবে আজ।
অর্ষার ছলছলে চোখে বলল,
“এমন করে কেন বলছো? আমি কি করেছি?”

কন্ঠে কাঠিন্যে এনে বলল,
“এত দ্রুত ভুলে গেলে? প্রতিটি সম্পর্কের মূল হলো ভরসা, বিশ্বাস। তুমি কি তার যোগ্য? গতকাল কেন মিথ্যা বললে অর্ষা? প্লাবন ছেলেটাকে কেন লুকালে?”

অর্ষা ধরা পড়ে যাওয়ায় মিইয়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিল। দর্শন তাহলে গতকাল জেনে ফেলেছে। জেনেও না জানার ভান করে ছিল। ভেতরে ভেতরে ফুঁসেছে। দর্শনের দিকে আড়চোখে তাকাল। তারপর আবার চোখ সরিয়ে নেয়। দর্শনের মুখে ব্যথাতুর হাসি।
“বলেছি না তোমাকে চাওয়ার লোকের অভাব নেই। আমাকে কী প্রয়োজন?”

অর্ষা ওর চোখের দিকে অসহায় ভাবে চেয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“তোমাকেই আমার প্রয়োজন। আমাকে ভুল বোঝো না। গতকাল শপিংমলের ছেলেদের উপরে রেগে গিয়েছিল। আমি চাইনি তোমার মুড খারাপ হোক। শুধুমাত্র তোমার মুডের কেয়ার করেছি আর কিছু না।”

“আচ্ছা, তোমাকে একটা পায়েল দিয়েছিলাম বলেছিলাম সব সময় পায়ে রেখো তুমি কি করেছো?”

অর্ষা মিনমিন করে বলল,
“আসলে আমি অভ্যস্ত নই আর তাছাড়া আমি চাইনি তোমার দেওয়া উপহারটি নষ্ট হয়ে যাক। আমি সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”

“উপহারদাতা কি তাই চেয়েছিল?”

অর্ষা নিশ্চুপ। কোন উত্তর নেই ওর কাছে। ওর চিন্তাভাবনা আর দর্শনের চিন্তাভাবনা যে এক নয়।
“আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। তাই বলে এভাবে শাস্তি দেবে?”

দর্শন প্রচন্ড রেগে গেল। চিৎকার করে বলল,
“আরে ভাই আমিও মানুষ। আমারও কষ্ট হয়, ব্যথা পাই। তুমি জানো গতকাল রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। কতশত চিন্তা মাথায় কিলবিল করেছে। তোমাকে তো কিছুই বলিনি। তুমি এর চেয়ে বেশি শাস্তির যোগ্য।”

দর্শন ওকে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্ষা ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছে।
আকুতি মিনতি করছে।
“দর্শন প্লিজ আমাকে মাফ করে দেও। তুমি যা বলবে আমি তাই করব। যেভাবে বলবে সেভাবেই চলব। প্লিজ আমাকে মাফ করে দেও। আমি আর কখনও এমন ভুল করব না।”

দর্শন থেমে গেল। ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে ধমকে বলল,
“দেখো আমার মাথা গরম হয়ে আছে। পেছনে পেছনে একদম আসবে না। লিভ মি এলোন।”

অর্ষা চুপসে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। না ঠিক দাঁড়াতে পারছে না। পায়ের তল থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে৷ দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে। দর্শন ওর দিকে আর তাকাল না। একবারের জন্যও তাকাল না। নিজের গন্তব্যে হেঁটে চলে গেল।

দর্শন লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে তো আছে কিন্তু পড়াশোনা কিছু করতে না। সবার থাকে আড়ালে থাকার জন্য। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে মাথা নিচু করে আছে। চোখ ফেটে কান্না আসছে৷ কিন্তু ও তো ছেলে! ছেলেদের কান্না করতে নেই। তাও আবার লোকালয়ে জনসম্মুখে। অর্ষাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। এতটা ভালো বেসেছে যে ওকে হারানোর কথা ভাবতে পারে না। ওকে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে চায়। অর্ষার মনে ওকে, ওর ভালোবাসাকে এমন ভাবে স্থাপন করতে চায় যাতে হাজার মাইল দূরে কিংবা হাজার হাজার দিন কথা না হলে, দেখা না হলেও যাতে ওকে ভুলতে না পারে, ওকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে না পারে। এর জন্য অর্ষাকে কষ্ট দিবে, বোঝাবে, অর্ষাকে নিজের মতো গড়বে।

….

অর্ষা কলেজের তিনতলা বিল্ডিংয়ের পেছনে চুপচাপ বসে আছে। ঝোঁপের মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকা দিন দুপুরে ডাকছে। অর্ষার কানে ভীষণ লাগছে। মাথা ধরে গেছে। মাথা ধরে চোখের পানি ফেলছে। প্রিয়াকে মেসেজ করেছে। প্রিয়া ওকে খুঁজতে খুঁজতে বিল্ডিংয়ের পেছনে চলে এসেছে। ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বুকটা ধুক করে উঠল। কিছু একটা হয়েছে তবে সেটা অবশ্যই সাংঘাতিক। প্রিয়া বিচলিত হয়ে ছুটে গেল অর্ষার কাছে।
ওর পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকাল অর্ষা। ওর লাল কান্নারত চোখ দেখে প্রিয়া আতংকিত হয়ে পড়ে।

ওর গালে হাত রেখে বিচলিত কন্ঠে বলল,
“কী হয়েছে অর্ষা? এখানে এভাবে বসে আছিস কেন? আর কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে বল। কি অবস্থা করেছিস চেহারার?”
প্রিয়া ওর কপালের উপর থেকে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিচ্ছে।

অর্ষা প্রিয়াকে সব খুলে বলল। প্রিয়া সব শুনে বলল,
“একটু রাগ হয়েছে ভাইয়ার। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই শান্ত হ।”

অর্ষা কান্না আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ওকে এত রাগতে কখনো দেখিনি। আমি ভুল করেছি কিন্তু তাই বলে…. ও যদি আমাকে ক্ষমা না করে? যদি ব্রেক আপ করে দেয়? আমি বাঁচব না প্রিয়া। অনেক কষ্ট সহ্য করে, অনেক সাধনা করে ওকে পেয়েছি। আবার যদি হারিয়ে ফেলি? আমার ভয় করছে প্রিয়া।”

প্রিয়া ওকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হবে না। ধৈর্য ধর। ভাইয়ার রাগ কমলে সামনে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলিস।”

অর্ষার চেহার হঠাৎ পালটে গেল। কান্না রাগে পরিণত হলো। তীক্ষ সুরে চোখে আগুন নিয়ে বলল,
“এসব তামিম করেছে। তামিম ওর মনে সন্দেহ ঢুকিয়েছে। ওর সাথে যা হয়েছে তা দর্শনের সাথে হবে সেটাই বুঝিয়েছে। দর্শনকে সম্মোহন করে নিয়েছে। দর্শন তাই ভাবছে আমিও ওকে ধোকা দেব৷ চলে যাব ওকে ছেড়ে। তামিমকে আমি ছাড়ব না।”

প্রিয়া ওকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“কাম ডাউন। বোকামি করিস না। এতে দর্শন আরো রেগে যাবে। কে কি বলল তাতে কী? তুই ওকে ভালোবাসিস এটা তো সত্য। তোর ভালোবাসা সত্য হলে দর্শন ঠিক বুঝবে। বুঝে নিজেই তোর কাছে আসবে। তুই একটু অপেক্ষা কর।”

“পারছি না আমি। কিছু ভালো লাগছে না। অসহ্য লাগছে সব। আমি বাসায় যাচ্ছি। আজ আর ক্লাস করব না।”

প্রিয়া দেখতে পাচ্ছে অর্ষা কিভাবে ভেঙে যাচ্ছে। ওর ভেতরের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
“ঠিক আছে বাসায় চলে যা৷ কিন্তু রাগের মাথায় কোন স্টেপ নিবি না। তামিমের সাথে উল্টো পালটা কিছু করবি না। রাতের আগে দর্শনকে কল দিবি না। আমি তোকে কল করে সব খোঁজ নেব। চল তোকে গেটের বাইরে ছেড়ে আসি।”
অর্ষার সাথে প্রিয়া গেট অবধি গেল। গেট পার করে একটা রিকশা নিল। গাড়ি আসতে অনেক সময় লাগবে। তাই রিকশা নিয়ে নিল।

….

কলেজ ছুটি। দর্শন ওর ববন্ধুদের সাথে বের হচ্ছে ক্লাস থেকে। বন্ধুরা হাসোজ্জল গল্পে মশগুল। রুশান এটা সেটা বলে যাচ্ছে বাকিরা সঙ্গ দিচ্ছে। হঠাৎ দর্শনের দিকে চোখ গেল। ও চুপচাপ, অন্য চিন্তায় বিভোর। ওকে দেখে বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হালকা হুচট খেল তবুও ভাবনা থেকে বের হলো না। রুশান ভালো করে ওর মুখের দিকে তাকাল। মুখটা ফ্যাকাশে, বিষন্নতায় ঘেরা।
রুশান ওর হাত ধরল। দর্শন চমকে গেল। চকিত দৃষ্টিতে রুশানের দিকে তাকাল।
“কি হয়েছে তোর? এমন মনমরা লাগছে কেন?”

দর্শন সামনের দিকে তাকাল। সামনের দিকে চেয়ে নিজেকে লুকিয়ে বলল,
“কই কিছু হয়নি। টায়ার্ড লাগছে খুব। তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।”

“কি লোকাচ্ছিস? অর্ষার সাথে কিছু হয়েছে?”

দর্শন নিশ্চুপ কোন উত্তর দিচ্ছে না। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। রুশান যা বোঝার বুঝে নিল। গেটের বাইরে বের হয়ে দর্শনকে রাস্তার এক পাশে নিয়ে গেল।
“এইবার ঝট করে কাহিনি বল তো?”

দর্শন ওকে সব খুলে বলল। রুশান সব শোনার পর এমন ভান করল যেন কিছুই হয়নি। তারপর প্রশ্ন করল,
“ওকে কারণ জিজ্ঞেস করিসনি?”

“হ্যা, বলে কি-না আমার মুড খারাপ করতে চায়নি। ওই মুহূর্তে নাকি আমার মুড ভালো থাকা জরুরি ছিল।”

রুশান মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“অর্ষাকে আমি বাচ্চা মানুষ মনে করতাম। ওর আচরণগুলোই এমন বাট ও অনেক বুদ্ধিমান।”

“মানে?”

“তুই আমাকে মানে জিজ্ঞেস করছিস? বেকুব একটা। ও তো ঠিকই বলেছে। তখন তোর মুড অফ হলে অর্ষারও মুড অফ হত। সব আয়োজন ভেস্তে যেত কিছুই হত না। এত প্লান, এত আয়োজন।”

“তাই বলে এতকিছু লুকাবে আমার কাছ থেকে? ওই ছেলে ওকে এতদিন ধরে বিরক্ত করছে, ঘটনা দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়ার পরও আমাকে জানায়নি। সিম চেঞ্জ করায় কথায় কথায় বলে ফেলেছিল। নিজ থেকে বলেনি। মানে আমার গুরুত্বই নেই?”

“তোকে বলেনি মানে তোর কোন গুরুত্ব নেই ওর কাছে এটা কোন লজিক্যাল কথা না। কারণ আরো অনেক থাকতে পারে। অল্প সময়ের সম্পর্ক তোদের। কতদিন হলো? এত অল্প সময়ে তুই ওর মনের কতটুকু জায়গা স্পর্শ করতে পেরেছিস? যতটুকু পেরেছিস ততটুকুই জেনেছিস সিম্পল।”

“মানে আমি সময় দিতে পারছি না। ভবিষ্যতে হয়তো আরো পারব না। আমার অবস্থাও কী তামিমের মতো হবে?”

রুশান হতাশ হলো ওর কথা শুনে। বিরক্ত নিয়ে বলল,
“উফফ! তামিম তামিম করে পাগল হয়ে যাচ্ছিস। তামিমের সাথে যা হয়েছে তা কি সবার সাথে হবে? এত ইনসিকিউর হলে হয় না। অর্ষা যদি তোকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে আর তুই নিজের ভালোবাসা দিয়ে ওকে ধরে রাখতে পারিস তবে এ-সব ফ্যাক্ট না। শুধু শুধু নিজের মাথাটা খারাপ করিস না। অর্ষার সাথে সব ঠিক করে নে।”

অর্ষা সারাদিন থম মেরে বসে থেকে রাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করেও কল দেয়নি দর্শনকে। ভীষণ অভিমান জমেছে মনে। অভিমানগুলো অশ্রু হয়ে ঝড়েছে। একটু না-হয় ভুল করেছে তাই বলে এত কথা শোনাবে, এমন রুড ব্যবহার করবে? ওকে না ভালোবাসে? ভালোবাসার মানুষকে কেউ এভাবে কষ্ট দেয়? খারাপ ব্যবহার করার পর একবার সরি পর্যন্ত বলল না। এতটা অবহেলা অর্ষা মেনে নিতে পারছে না। সব মেনে নিলেও মানুষের অবহেলা মেনে নিতে পারে না। যারা অবহেলা করে তাদের থেকে ডিস্টেন্স বজায় রাখে। একা থাকবে তবু কারো অবহেলা নিয়ে বাচবে না। তাই তো করে এসেছে ছোট থেকে।
এভাবে একটা দিন একটা রাত পার হয়ে গেল। দর্শন কল মেসেজ কিছুই দেয়নি। অর্ষা বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে কি করা উচিত। কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। কলেজে না গেলে বাবার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। তাই কলেজের ড্রেস পরে বের হয়েছে ঠিকই কিন্তু কলেজে যাবে না। শাহবাগ যাবে। ফুলের রাজ্যে গিয়ে হারিয়ে যাবে। তারপর টিএসসি চত্বরে ঘুরবে, ঢাকা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঘুরবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কলেজের সামনে গাড়ি থামায় রোজকার মতোই। কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। দর্শনকে দেখতে ইচ্ছে করছে। বাসায় থেকে যেসব প্ল্যান করেছে তার কিছুই এখন মনে ধরছে না। অর্ষা কলেজের গেট থেকে সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। হেঁটে চলেছে নিজের মতো। যখন ক্লান্ত তখন বাজে বেলা বারোটা। নিরিবিলি রাস্তা। মাঝেমধ্যে দু একটা মানুষ হেঁটে যায় আর উচ্চস্বরে সাইরেন বাজিয়ে টেক্সি, প্রাইভেট কার আর মোটর বাইক যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে সিএনজি আসছে দু একটা। অর্ষা রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বসল। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল। ক্ষিধে পেয়েছে খুব। আশেপাশে দোকানও নেই। ব্যাগ থেকে পানি বের করে পিপাসা মেটাল। অর্ষা দোকানের খুঁজে উঠে দাঁড়াল।

চলবে….

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৯

অর্ষা ফুটপাতে বসে বসে চিপস আর কোক খাচ্ছে। বড় রাস্তার উপারে একটা বাড়ি তার পাশে বড় পুরনো কোয়ার্টার। তার পাশে একটা অফিস। অর্ষা বাড়ি, অফিসগুলো দেখছে। ওর পেছনে সারি সারি নারকেল আর সুপারি গাছ। কিছুক্ষণ পর পর পাপচারীরা উদ্ভট দৃষ্টি দিয়ে ওর দিকে তাকায়। অর্ষা এসব কেয়ার করছে না। ও ওর মতো খাচ্ছে।
কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখেছে। ব্যাগের উপর একটা ড্রাই কেক। তার পাশে কোক। অর্ষা চিপ্সের প্যাকেট ফেলে ড্রাই কেকটা হাতে নিল। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। প্যাকেট ছিড়ে ভেতরের দিকে তাকাতেই মোবাইল বেজে উঠল। অর্ষা বিরক্ত হলো কিঞ্চিৎ। কে ওর শান্তি নষ্ট করছে। কেকটা রেখে মোবাইল বের করল। মোবাইল বের করে স্কিনের দিকে তাকাল। প্রিয়া কল করেছে। অর্ষা কল রিসিভ করল।

প্রিয়ার বিচলিত কন্ঠস্বর,
“অর্ষা কই তুই?”

অর্ষার বেখেয়ালি উত্তর,
“জানি না।”

প্রিয়া রেগে বলল,
“এই এটা কেমন উত্তর? তুই কোথায় বল।”

অর্ষার ভাবান্তর হলো না।
“আমি সত্যিই জানি না। একচুয়েলি জানার চেষ্টা করছি না। শুধু সময় আর পরিবেশটা উপভোগ করতে চাই।”

প্রিয়া ওর কথার আগামাথা বুঝতে পারছে না।
“কী উপভোগ করতে চাস? সময় আর পরিবেশ! মানে কী? কই তুই?”

অর্ষা রাগের সুরে বলল,
“বললাম তো আমি জানি না। কল কাট।”

প্রিয়া ওকে শান্ত করে বলল,
“ওকে ওকে। শুধু বল তোর সাথে কে আছে?”

“কেউ নেই। আমি একা। রাস্তার ধারে বসে কেক খাচ্ছি। খাবি?”
অর্ষা কেকে এক বাইট দিল।

প্রিয়া আতংকিত হলো। আতংকের সুরে বলল,
“কলেজে আসিস নি কেন?”

“কলেজেই এসেছিলাম কিন্তু ভেতরে যেতে ভালো লাগছিল না। অস্থির লাগছিল। মুক্ত বাতাসের প্রয়োজন ছিল। তাই একা একা হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছি।”

প্রিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
“এই অর্ষা কোথায় গিয়ে বসে আছিস তুই? আমার ভয় লাগছে খুব। ঠিকানা বল আমি আসছি।”

“কাউকে লাগবে না আমার। কল রাখ।”
অর্ষা কল কেটে দিল। প্রিয়া মোবাইলের স্কিনের দিকে চেয়ে রইল। অর্ষার মাথায় পাগলামি চেপেছে এখন কী করবে বুঝতে পারছে না।

দর্শন ক্লাসে দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে চুপচাপ খাতায় কি যেন লিখছে। প্রিয়া দ্রুতগতিতে ক্লাসে ঢুকে দর্শনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঝাড়ের বেগে আসার জন্য দর্শনসহ আশেপাশের অনেকেই টের পেল। দর্শন চকিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। প্রিয়া হাপাচ্ছে। কিছু একটা বলতে চাইছে। আগে ওর শ্বাস প্রয়োজন। ওর আশেপাশে অর্ষাকে না দেখে একটু অবাক হলো।
“কী হয়েছে প্রিয়া?”

প্রিয়া হাপানো বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আপনি এটা কী করলেন? অর্ষা পাগলামি করছে।”

দর্শন খাতা কলম রেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ওর কপালে চিন্তার রেখা। অজানা আতংকে বুক কেঁপে উঠল।
“কী করেছে?”

“সকালে কলেজের সামনে নেমেও ভেতরে ঢুকেনি। একা একা কোথাও একটা চলে গেছে। কিন্তু কোথায় তা জানে না। আমি কল করেছি ও বলল জানে না কোথায় আছে ইনফ্যাক্ট জানার প্রয়োজন মনে করছে না। ওখানে না-কি ওর ভালো লাগছে। অচেনা জায়গা কোন বিপদ হলে? আর ও যেমন মেয়ে কেউ এসে উল্টাপাল্টা কিছু বললে স্থান, পাত্র বিবেচনা করবে না। নিজেই গণ্ডগোল শুরু করে দিবে। ওর সাথে কেন এমন করেন? জানেন তো ও কতটা ক্রেজি।”

দর্শনের মনে অনুতাপের চেয়ে চিন্তা হচ্ছে বেশি। অর্ষা কোথাও চলে গেল। দর্শন মোবাইল বের করে কল করল। কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে সুইচড অফ বলছে। দর্শন আরো চিন্তায় পড়ে গেল। সেই সকাল থেকে মেয়েটা রাস্তায় ঘুরছে। ও ব্যাগপত্র গুছিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে গেল। বাইকে করে কলেজের ডানে-বামে রাস্তায় খুঁজে এসেছে কিন্তু পায়নি। ওকে না পেয়ে কান্না পাচ্ছে। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন ওর সাথে রাগারাগি করতে গিয়েছিল। ওকে না পেয়ে দুইটা নাগাদ কলেজে ফিরে এল। ওর বন্ধুদের সব জানাল। প্রথমত রুশান কতক্ষণ ওকে ঝারল তারপর সবাই এক সাথে খোঁজাখুঁজি করলো। প্রিয়া গেছে ওর বাসায় যদি বাসায় যায় কিন্তু না অর্ষা ফিরেনি। বাসায় না ফেরায় আরো ভয় পেয়ে গেল প্রিয়া। ওর বাবাকে জানাতে চাইল একবার তারপর আবার সময় নিল। প্রিয়া দর্শনকে জানিয়েছে অর্ষা বাসায় আসেনি। দর্শন কেঁদে দিচ্ছে প্রায়। ওর বন্ধুরা শান্তনা দিচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। অর্ষা এমন কেয়ারলেস, হাইপার মেয়ে জানা ছিল না।

পাঁচটা বেজে গেছে। দর্শন এখনো বাসায় ফেরেনি। ওর বন্ধুরা ওর সঙ্গ দিচ্ছে। সবার তাড়া থাকলেও বন্ধুকে এ অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারেনি। বন্ধুও তো সুখ-দুঃখের সঙ্গী। গাছের গুড়ির উপর চুপ করে বসে আছে দর্শন। ওর মোবাইল বাজছে। তামিম কল রিসিভ করল।
“হ্যালো ভাইয়া, অর্ষা কিছুক্ষণ আগে বাসায় এসেছে। আমি ল্যান্ডলাইনে কল দিয়েছিলাম।”
তামিম কল কেটে দিয়ে চিৎকার করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“অর্ষা বাসায় ফিরেছে।”

দর্শন ওর কথা শুনে যেন প্রাণ ফিরে পেল। ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ায়। শুষ্ক ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। চোখ চকচক করছে।
উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“আমি যাচ্ছি।”

……

অর্ষা গোসল করে লং স্কাট পরে ভেজা চুলে রুম থেকে বের হয়ে চিৎকার করে বলল,
“আমার মাথা ধরেছে একটু কফি দেন, খালা।”

তারপর ওর চোখ চড়কগাছ। দর্শন ওর বাড়িতে। সাথে প্রিয়া। প্রিয়ার মুখ থমথমে। দর্শনের দিকে তাকাল। ওর চোখমুখ লাল হ’য়ে আছে। মনে হচ্ছে আস্ত খেয়ে ফেলবে। অর্ষা ভয়ভয় চোখে তাকাল।
অর্ষা নার্ভাস হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“তুমি?”

প্রতি উত্তরে দর্শন ওর দিকে এগিয়ে গেল। অর্ষার দৃষ্টি দর্শনের দিকে। দর্শন ওর সামনে গিয়ে আচমকা কষিয়ে চড় মারল অর্ষাকে। অর্ষা আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত, হতবাক, হতবিহ্বল। বিস্ময়ে ওর মুখ হা হয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে অবিশ্বাসের চোখে দর্শনের দিকে চেয়ে আছে। প্রিয়া নিজেও হতবাক। প্রিয়া নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি। অর্ষা তারপর প্রিয়ার দিকে তাকাল। প্রিয়া ওর দিকেই চেয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তে সরিয়ে নিল। তারপর আবার দর্শনের দিকে তাকাল।

দর্শন চোখমুখ শক্ত করে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? সবাইকে টেনশন দিতে মজা লাগে? আমাকে শাস্তি দিচ্ছিলে তাই না? পেয়েছি তো আমি। চার চারটে ঘন্টা ছটফট করেছি, হন্য হয়ে এদিক সেদিক খুঁজে বেরিয়েছি।
তুমি জিতে গেছো। তালি দেওয়া উচিত। হ্যাপি নাও?”

অর্ষা কিছুই বুঝতে পারছে না। দর্শন ওকে খুঁজেছে! কেন? নিশ্চয় প্রিয়া বলেছে। অর্ষার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। কান্নারত অবস্থায় বলল,
“বেশ করেছি। আমাকে কষ্ট দিলে এভাবেই হারিয়ে যাব। আমাকে তুমি খুঁজে পাবে না যদি না ধরা দেই। অভিমান বেশি হলে ধরাও দেব না।”
অর্ষা ঠোঁটে ফোলাল। দর্শনের বুক ধুক করে উঠল। আচমকা অর্ষাকে জড়িয়ে ধরল। অর্ষা আরেক দফা বিস্মিত, হতবাক, হতবিহ্বল। চোখ গোলগোল করে চেয়ে আছে। শরীর কাঁপছে ব্যাপকভাবে। অর্ষার ভেজা চুলের পানি দর্শনের মুখে পড়ছে।
“আ’ম সরি অর্ষা। প্লিজ আর এমন করো না। প্রাণ পাখিটা উঠে যাচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একবার তোমাকে পেলে সারাজীবনের জন্য বুকে জড়িয়ে রাখব। কোথাও যেতে দেব না। তোমাকে বড্ড ভালোবাসি আমি।”
প্রিয়া ওদের এভাবে দেখে বসার ঘর থেকে রান্নাঘরে চলে গেল।
ওরা দু’জন দু’জনার মান-অভিমান মিটিয়ে নিচ্ছে।
দর্শন যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে ওর জন্য কেনা ব্রেসলেটটা ওর ঘরে রেখে যায়।

নভেম্বর একুশ। আগামীকাল দর্শনের আঠারোতম জন্মদিন। সবাইকে বাসায় ইনভাইটেশন দিয়েছে। অর্ষা ভেবে পাচ্ছে না দর্শনকে কি গিফট দেওয়া যায়। সবার সাথে আলোচনা করেও লাভ হয়নি। রাতে ভিডিও কলে কথা বলার সময় তাই দর্শনকেই জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা তোমাকে কী গিফট দেব?”

দর্শন ক্যালকুলেটরে কিছু একটা হিসাব করছিল। ওর কথা শুনে স্মিত হাসল। তারপর ওকে কিছুক্ষণ অপলক দেখে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
“তোমাকে দেবে। অন্য এক তোমাকে চাই যে নিজেকে আমার নিকট উপহার স্বরূপ সমর্পণ করবে, আমাকে মুগ্ধ করবে। পারবে তো?”

অর্ষা আগামাথা কিছু বুঝতে পারল না বোকার মতো শুধু মাথা নাড়াল। দর্শন আবারও হাসল।

অর্ষা পড়েছে বিপদে। দর্শনের কথা কিছুই বুঝেনি অথচ হ্যা বলে এসেছে। তাই প্রিয়াকে কল দিল।প্রিয়া সব শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে বলল,
“ছিহ! দর্শন ভাইয়া এটা বলেছে?”

“হ্যা, ছিহ এর কি হলো?”

“ছিহ নয়তো কী? আমার তো মনে হচ্ছে তোকে রুম ডেটে নিতে চায়।”

“থাপ্পড় খাবি। ও এমন না।”

“এ কথার মানে তো এটাই দাঁড়ায়। সমর্পণ মানে কী?”

দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকল। দু’জনের মধ্যে নিরবতা। অর্ষা নীরবতা ভেঙে সন্দেহ আর ভয় নিয়ে বলল,
“আসলেই কী দর্শন তাই চাইছে?”

প্রিয়া কনফিউজড হয়ে বলল,
“জানি না।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here