#প্রেম_তুমি,পর্ব-৩,০৪
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩
দর্শন অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখছে। ভর দুপুরের কড়া রোদ মেয়েটার গালে এসে পড়েছে। মুখটা ঘেমে আছে। সামনে ও পেছনের অপেক্ষাকৃত ছোট চুলগুলো ঘাড় ও কপালে লেপ্টে আছে।ডায়েরিটা হাতে নিতেই কেমন অদ্ভুত একটা আভা মেয়েটার মুখে ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে ওর প্রাণ পাখি ফিরে এসছে। মেয়েটা মিষ্টি হেসে পাশের মেয়েটাকে কি যেন বলছে। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরল। দর্শনের ব্রেইন কি যেন একটা বলছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা পরিচিত। না ঠিক পরিচিত না, ওকে কোথাও দেখেছে। কোথায় দেখেছে। ব্রেইনকে প্রেশার দিতেই মনে পড়ল।
দর্শন নিজে নিজেই বলে উঠল,
“এইরে! সকালে লাইব্রেরীতেই তো এই মেয়েকে দেখলাম। কেমন বিষন্নতা ছেয়ে ছিল মুখে। চোখ দুটো তার রাত জাগার প্রমাণ দিচ্ছিল। আচ্ছা ডায়েরির জন্য নয়তো?”
দর্শন গভীর ভাবে ভেবে অবাক হলো। একটা মেয়ে একটা ডায়েরির জন্য এমন ছটফট করতে পারে? মন খারাপ করে, রাত জেগে চেহারার এই অবস্থা করতে পারে? অনুভূতি কতটা প্রখর হলে, কতটা ভালোবাসলে এতটা পাগলামি করতে পারে। দর্শন আবারও অর্ষার দিকে তাকাল। সকালে অর্ষার চেহারায় যে বিষন্ন ভান ছিল সেটা এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না। চেহারায় আলো ঝলমল করছে। এর মানে এই না যে ও হাসছে। অর্ষা ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দর্শনের বুকটা ধুক করে উঠল। মেয়েটা কাঁদছে। কেন কাঁদছে? ওর বুকে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেন জানি খুব খারাপ লাগছে।
অর্ষাকে প্রিয়া শান্তনা দিচ্ছে। অর্ষা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ডায়েরি ছুয়ে ছুয়ে দেখছে আর মনে মনে বলছে,
“তোমাকে ছুতে না পারি তো কী হয়েছে তোমাকে নিয়ে লেখা অব্যক্ত নিগুঢ় অনুভূতি তো ছুতে পারি। রাখতে পারি নিজের কাছে। তাতেই সন্তুষ্ট এই আমি।”
সারারাত দর্শনের ঘুম এলো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছে। রাত জাগার কারণে চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। ভোর চারটা বাজে। চারদিকে অন্ধকার। দর্শন বিছানা ছাড়ল, কি করবে বুঝতে পারছে না। কোন ডিসিশন নিতে পারছে না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আট তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার আলিসান ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলায় উপর থেকে সবকিছু অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে শত শত জোনাকির স্রোতে ভাসছে। বারবার অর্ষার মুখটা ভেসে উঠছে। সেই তৃপ্তি মাখা মুখ। পড়াশোনার বাইরে কোন কিছু ভাবতে চায়নি। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ডাক্তারি পড়া, বড় ডাক্তার হওয়া। এ পথে কখনো কোন বাঁধা রাখেনি। যত বাঁধা এসেছে দু হাতে সরিয়ে দিয়েছে। প্রেম ভালোবাসাও ওর স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে পারে কিন্তু কেন জানি অর্ষার প্রতি টান অনুভব করছে। অনেক ভেবে দেখল কিন্তু কোন সমাধান করতে পারছে না। ওর চোখ জ্বালা করছে। চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। দর্শন রুমে গিয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখল। পাঁচটা বাজে। সকালে কলেজে যেতে হবে। তাই ঘুমানো প্রয়োজন। দর্শন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে এল। তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
.
লাল আর ফোলা চোখ নিয়ে দর্শন ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত হলো। রুশানের পাশে গিয়ে বসল। ওর চেহারা দেখে রুশান কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। গতকালের ব্যাপারটার জন্য কিছুটা রাগ করে আছে। নিজ থেকে কিছুতেই কথা বলবে না বলে বাড়ি থেকে পণ করে এসেছে। কিন্তু ওর চেহারা দেখে রুশান নিজের পণের কথা ভুলে গিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসে,
“দোস্ত, ঘুম কেমন হলো?”
দর্শন চমকে যায় ওর কথায়। নড়ে-চড়ে বসে। চুল আর চশমাটা ঠিক করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ঘুমিয়েছি তো। ভালো, বেশ ভালো।”
জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে নিল।
রুশান নাক কুঁচকে বলল,
“না ঘুমিয়ে যে চোখ-টোক ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে ফেলেছিস সেটা কী আয়নায় দেখিসনি? অবশ্যই দেখিসনি। দেখলে এমন অভিনয় করতি না।”
দর্শনের মুখটা চুপসে গেল। ক্লাসে স্যার চলে আশায় ওদের কনভারসনের ওখানেই সমাপ্তি ঘটল। রুশান পুরো ক্লাসে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
ক্লাস শেষে অফ পিরিয়ডে দর্শনের গ্রুপ ক্লাসের বাইরে আড্ডা দিচ্ছে। বন্ধুরা নানান কথা বলছে। দর্শন আনমনে কি যেন ভাবছে আর মাঝেমধ্যে হু হা করে যাচ্ছে। রাতুল ওকে অন্যমনস্ক দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“দোস্ত, মন খারাপ? কিছু হয়েছে?”
দর্শন চমকে উঠে। নড়ে-চড়ে মুখে হাসি ফোটাল। কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না ওর মনের কথা।
“কী হবে? ঠিক আছি।”
তামিম বলল,
“তোর যে কিছু একটা হয়েছে সেটা সবাই অনেকক্ষণ ধরে নোটিশ করছি। কি ব্যাপার বল তো।”
দর্শন ভাবল বলেই দেই। ওরা হেল্প করতে পারবে। কিছু সাজেশন পাওয়া যাবে।
দর্শন কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
“মেয়েটাকে পেয়েছি।”
সবাই এক সাথে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“কোন মেয়েটা?”
তারপর হতবাক হয়ে সবাই সবার দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। সবাই কৌতূহল হয়ে ওকে চেপে ধরল। দর্শন একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। পিনপতন নীরবতা। কেউ নক খুটছে, কেউ মাথা চুলকাচ্ছে। দর্শন হতাশ হয়ে বসে আছে। রুশান সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা জোরে বলল,
“আমি একটা কথা বলি?”
সবার দৃষ্টি রুশানের দিকে। দর্শন কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। কিছুটা আশা জেগে উঠেছে। রুশান পারমিশনের অপেক্ষা না করে বলল।
“দর্শন ট্রাই করে দেখতে পারিস। যা বুঝলাম মেয়েটা তোকে অনেক ভালোবাসে। জীবনে অনেক কিছু পেতে পারিস কিন্তু হতে পারে এমন ভালোবাসা জীবনে আর কখনোই এলো না। তখন আফসোস করবি। তুই যেই বিবরণ দিলি তাতে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী। ভালো একটা বয়ফ্রেন্ড পাওয়ার সব এবিলিটি আছে। সো হোয়াই নট?”
দর্শন কাচুমাচু মুখ নিয়ে বলল,
“এসব আমার প্লানে ছিল না।”
রুশান মুচকি হেসে ওর কাঁধে চাপট মেরে বলল,
“প্রেম ভালোবাসা প্লান করে আসে না রে বলদ। এর জন্য আলাদা প্লান করতে হয় না। হুট করে এসে লুট করে নিয়ে যায়।”
দর্শন সংশয় নিয়ে বলল,
“নারে, দোস্ত। আমি এখনো শিওর না। আমি পড়াশোনার বাইরে কিছু ভাবতে চাই না। যদি আমার পড়ার ক্ষতি হয়ে যায়?”
তামিম বলল,
“ইয়েস। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছিস। তোর ধ্যান জ্ঞান সবকিছু পড়াশোনা। প্রেমের ঝামেলায় যাস না। প্রেম ভালোবাসা অনেক প্যারা। তারপর সব হারাবি। ডাক্তার কেন কিছুই করতে পারবি না জীবনে। বরবাদ হয়ে যাবি।”
রুশান ধমকে উঠে।
“শা*লা, আমি কি বরবাদ হয়ে গেছি? আমারও তো জিএফ আছে। কই আমি তো কখনো রেজাল্ট খারাপ করিনি। এসব ভুলবার সাজেশন একদম দিবি না।”
দর্শনের ভালো লাগছে না। দুজন দু কথা বলছে।
“তোরা থাম, আপাতত এ-সব বাদ। পরে ভেবে দেখা যাবে।”
রুশান তাচ্ছিল্য করে বলল,
“তুই পরেই ভাবিস। তখন দেখবি পাখি অন্য খাঁচায়।”
দর্শন গম্ভীরমুখে বলল,
“তাহলে তো বেঁচে যাই।”
অর্ষার ফার্স ক্লাসের পর বাইরে এসেছিল একটা দরকারে। স্যার ক্লাসে চলে যাবে তাই দ্রুত ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। তখনই পাশ থেকে একটা ছেলে টিচ করে বলল,
“আরে, আরে! পরে গিয়ে পা ভাঙবে।”
অর্ষার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঘুরে নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে। কিন্তু সে সময় নেই। কিন্তু কিছু একটা জবাব না দিয়ে যাওয়ার মেয়ে ও না। তাই চোখ ছোট ছোট করে পাশে ঘুরে বলল,
“পা ভাঙলে আপনার ঘাড়ে গিয়ে চাপব না। নিশ্চিত থাকুন।”
“কেন? আমাদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় না?”
অর্ষা রাগে ওর দিকে ঘুরে ভালো করে না দেখে রাগী ফেস করে বলল,
“সিনিয়র হয়েছেন বলে কি ভেবেছেন যা খুশি বলবেন মাথায় তুলে নাচব? তাহলে ভুল ভেবেছেন। শ্রদ্ধায় যেমন মাথায় তুলতে পারি তেমনই প্রয়োজনে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মেরে মাটিতে ফেলতি পারি। নেক্সট টাইম আমার সাথে ফাজলামো করতে আসবেন না।”
আঙুল তুলে রাগ ঝারতেই দর্শনকে দেখতে পেল। যে ছেলেটা এসব বলছে তার ঠিক দুজন ছেলের পরে দর্শন দাঁড়িয়ে। দর্শন কেমন কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রুশানের দিকে চেয়ে। কি যেন বলতে চাইছে। হঠাৎ করেই ওর চোখ পড়ল অর্ষার সাথে। অর্ষা ভালো করে দেখল ওরা তো দর্শনের বন্ধুরা। অর্ষা চেহারার কাঠিন্য দূর করে মুখটা নরম করে তাকাল। চোখে যে আগুনের ফুলকি জ্বলছিল তা মুহুর্তেই নিভিয়ে মায়া মায়া চোখে তাকাল। রুশান সে দৃষ্টি লক্ষ্য করে মুখ চেপে হাসল।
রুশান গলা ঝেরে বলল,
“সরি সিস্টার। মজা করছিলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আসলে আমার বন্ধুর মন খারাপ তো তাই মন ভালো করার চেষ্টা করছিলাম। সরি। ( দর্শনের কাঁধে হাত দিয়ে)”
অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন? কী হয়েছে?”
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“ইটস ওকে।”
রুশান রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“এ বয়সে একটু একটু মন খারাপ হয়। সেটা ব্যাপার না। আসলে ও না…”
দর্শন দাঁতে দাঁত চেপে রুশানের কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“রুশান!”
রুশান হাসি ও কথা বন্ধ করে বলল,
“ইউ ক্যান গো। সরি! সরি!”
অর্ষা ইনোসেন্ট মুখ করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
অর্ষা দ্রুত ঘুরে গেল। কেমন লজ্জা লজ্জা অনুভূতি হচ্ছে। শরীর খারাপ লাগছে। বুকে হাত দিতেই অবাক হয়ে গেল। ওর হার্টবিট ফার্স্ট চলছে। আজকাল কী যে হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ কেন দর্শনের সামনে পড়ে যাই। আল্লাহ! আমি তো মরে যাব। বুক এত ধুকপুক করছে কেন?
অর্ষা যেতেই দর্শন কটমট করে রুশানের দিকে তাকায়। রুশান দাঁড় কেলিয়ে হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়। দর্শন ওকে ধরার জন্য ওর পেছনে যাচ্ছে।
“আজ তোকে মেরেই ফেলব বেয়াদব।”
চলবে…..
#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪
বেলায় বেলায় অনেকগুলো দিন পাড় হয়ে গেল। বিষাদের রাত কাটল নতুন দিন এলো। নতুন স্বপ্ন নিয়ে। অর্ষা কলেজে যাচ্ছে গাড়ি ছাড়া। আজ ওর বাবা দরকারী কাজে আগেই বের হয়ে গেছে তাই ও বাসা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। কিন্তু রিকশা আসছে না। ওর বাবা বলেছিল একটা ক্যাব বুক করে দিবে। কিন্তু অর্ষা জানায় ও রিকশা করে যাবে। আর রিকশা নিজেই ঠিক করে নিবে সমস্যা হবে না। রোজ কলেজে যাওয়ার সময় অনেক রিকশা দেখে ও। কিন্তু এখন ওর বিরক্ত লাগছে। একটাও রিকশা নেই। এই রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘেমে যাচ্ছে। অর্ষা সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে কপাল আর নাকের ঘাম মুছে নিল। টিস্যুটা ফেলে ডানে বামে চেয়ে রিকশা খুঁজছে। হঠাৎ সামনের দিকে একটা রিকশা থেমে গেল। রিকশা থেকে একটা মেয়ে বলছে,
“এই, আমার রিকশায় আসো। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার লেট হয়ে যাবে।”
অর্ষা পেছনে, ডানে-বামে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ওকে বলছে কি-না। অর্ষা আশেপাশে রিকশায় যাওয়ার মতো কাউকে দেখতে পেল না।
অর্ষা বুঝতে পারল ওকে ডাকছে। তবুও ফর্মালিটি পালন করার জন্য প্রশ্ন করল,
“আমাকে বলছেন?”
“হ্যা, তোমাকেই। আমি কলেজে যাচ্ছি। আমার সাথে চলে এসো। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে।”
অর্ষা খেয়াল করল মেয়েটার গায়ে ওদের কলেজের ড্রেস। কিন্তু অপরিচিত কারো সাথে যেতে ইচ্ছে করছে না। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু রিকশার জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য ওর নেই। তবুও বলল,
“ঠিক আছে, আপনি যান। আপনার অসুবিধা করতে চাই না। আমি আরেকটু অপেক্ষা করি।”
মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,
“কোন অসুবিধা নেই। চলে এসো।”
অর্ষা অগত্যা উপায় না পেয়ে রিকশায় উঠে বসে। আলাপচারিতার এক সময়ে জানতে পারল মেয়েটা সেকেন্ড ইয়ারের বিজ্ঞানের ছাত্রী। ওর নাম অর্পা। পড়াশোনায় দুর্দান্ত। কলেজের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ওর অবস্থান। তার মানে দর্শনের কাছাকাছি স্টুডেন্ট। অর্ষা মনে মনে প্লান করে ফেলেছে। এই মেয়ের সাথে ভাব জমাবে। গভীর ভাব। জমে খির হয়ে যাওয়ার মতো ভাব। ওর কাছ থেকে দর্শনের সম্পর্কে জানবে তারপর দর্শনের কাছাকাছি যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রাস্তায় এটুকু সময়ের মধ্যে অর্ষা মেয়েটার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল।
কলেজে এসে হাত ঘড়িতে সময় দেখল অর্ষা। এখনো দশ মিনিট সময় আছে। তবুও ফুলানোর জন্য বলল,
“ধন্যবাদ আপু, তোমার জন্য সময় মতো আসতে পেরেছি। অনেক ধন্যবাদ।”
“এত ধন্যবাদ দিতে হবে না। ক্লাসে যাও। ভালো করে পড়াশোনা করো।”
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললেও মনে মনে বলল,
“দূর! পড়াশোনা, এই টপিকটা নিয়ে যে পারে ফ্রিতে জ্ঞান দিয়ে যায়। বিরক্তিকর!”
….
দর্শন ক্লাসে যাওয়ার সময় অর্ষাকে দেখল। অর্ষা আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে। আর বারবার এদিক সেদিক দেখছে। পেছনে থেকে কে যেন ওকে ডাকছে। অর্ষা সেদিকে চেয়ে কি যেন বলল। তারপর আবার হেঁটে চলে যাচ্ছে। দর্শনকে অর্ষা দেখেনি। অর্ষাকে চুপিচুপি দর্শন দেখছে। কিন্তু সেটা আর চুপিচুপি রইল না। পেছনে থেকে রুশান ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“দোস্ত, কী করিস?”
দর্শন আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। কাচুমাচু মুখ করে বলল,
“এমনি দাঁড়িয়ে আছি। চল ক্লাসে যাই।”
“ক্লাসে যাওয়ার আগের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস শেষ?”
“মানে?”
রুশান আলতো হেসে বলল,
“কিছু না। চল ক্লাসে যাই।”
দর্শন মনে মনে ওকে গালাগাল করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“চল।”
ব্রেক টাইমে অর্ষা আর প্রিয়া এক সাথে হাঁটছে। ওরা ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছে। তখনই অর্পা ওকে ডাকল। অর্ষা যেতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে ওর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রিয়াকে বলল ক্যানটিনে গিয়ে ওর জন্য খাবার অর্ডার করতে। অর্ষা অর্পার কাছে গিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
“কেমন আছো আপু?”
অর্পা চুলের বিনুনি টানতে টানতে বলল,
“ভালো। তোমার কী খবর?”
“ভালো।”
“কই যাচ্ছিলে?”
“ক্যান্টিনে, খেতে। ক্ষুধা লাগছে খুব।”
“ওহ, আমিও তো যাচ্ছি। চল এক সাথে যাই।”
অর্ষা শুধু মনে মনে বলছে পড়াশোনার জ্ঞান যেন না দেয় বাকি সব ঠিক আছে। অর্পা আর অর্ষা নানান কথা বলতে বলতে ক্যানটিনে গেল। ক্যানটিনে গিয়ে অর্পা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর হঠাৎ অর্ষার হাত চেপে ধরে বলল,
“চল, আমার ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”
অর্ষা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের কাছে গেল। অর্ষা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চারটা মেয়ে এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে। তার পাশের টেবিলে কতগুলো ছেলে বসে আছে। অর্ষা প্রিয়াকে খুঁজছে। অর্পা ওর বান্ধবীদের দেখিয়ে বলল,
“ওরা আমার ফ্রেন্ড। আসো জয়েন করো।”
অর্ষা অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলল,
“তোমরা এঞ্জয় করো সমস্যা নাই। আমার ফ্রে… ”
অর্ষা কথা থামিয়ে দিল যখন রুশানের কন্ঠ পেল।
“অর্পা, কে হয় তোমার?”
রুশান ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্ষা রুশানকে দেখে একটু সরে দাঁড়াল। অর্পা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন? তোমার কী দরকার?”
রুশান আবারও ওদের পাসের টেবিলের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। সেদিকে চোখ যেতেই অর্ষা দর্শনকে দেখতে পেল। অর্ষার আবারও আনইজি লাগছে আবার দর্শনের কাছাকাছি থাকতেও ইচ্ছে করছে।
“জিজ্ঞেস করলাম। জিজ্ঞেস করতে পারি না?”
অর্পা বলল,
“ওর নাম অর্ষা। ফার্স্ট ইয়ার।”
“অর্ষা, অর্পা। তোমরা দুই বোন না-কি?”
রুশান ফাজলামো করে বলল।
অর্পা ওকে মেরে বলল,
“তুমি জানো না আমার কোন বোন নেই। একদিন রিকশায় লিফট দিয়েছিলাম তারপর পরিচয়।”
রুশান মার খেয়ে দাঁত কেলিয়ে হিহি করে হাসল।
তারপর বলল,
“অর্পা আর অর্ষা দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলব। একই মনে হচ্ছে।”
তামিম ওর পিঠে মেরে বলল,
“তোর কি মরার ইচ্ছে হয়েছে? অর্পার সাথে গুলিয়ে ফেলবি এটা আবার অর্পাকে বলছিস। অর্পা তোকে এখুনি গুলি মারবে।”
অর্পা তখনই চোখ পাকিয়ে তাকাল।
অর্ষা কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
“আমার কলেজের নাম অন্বেষা হাসান। আপনি এই নামে ডাকতে পারেন।”
রুশান মাথা চুলকে বলল,
“তাহলে অর্ষাই ঠিক আছে।”
অর্পা সব বাদ দিয়ে অর্ষাকে বলল,
“ওরা সবাই আমার ফ্রেন্ড। ও বাদে। (রুশানকে দেখিয়ে)”
অর্ষা বোকার মতো বলল,
“ও কি তাহলে তোমার ভাই?”
পুরো বন্ধু মহলে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই ওর কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুশানও মুখ টিপে হাসছে। অর্পা গোল গোল চোখ করে চেয়ে আছে। অর্ষা বোকা বনে গেল। সবাই কেন হাসছে বুঝতে পারছে না। মুখটা পেঁচার মতো করে রাখলেও ভেতরে রাগে ফুপাচ্ছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছে না।
অর্ষার বোকা বোকা চেহারা দেখে অর্পা চেঁচিয়ে বলল,
“স্টপ গাইজ! এত হাসির কিছু হয়নি। তোরা কিছু একটা পেলে চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে হো হো শুরু করে দিস৷ হাসির জন্য শুধু একটা টপিক খুঁজিস। জঘন্য।”
রুশান বলল,
“ইয়েস! গাইস, হাসি বন্ধ কর। অর্ষা, আমি ওর ভাই নই৷ আচ্ছা ভাই হলে কী করতে? আমার সাথে প্রেম করতে?”
দর্শন গোপনে রুশানকে ধাক্কা মারল।
অর্ষা ভ্রু কুঁচকালো। তারপর বলল,
“আমার এতটাও খারাপ দিন আসেনি। হুহ!”
অর্ষার কথায় আবার সবাই হেসে ফেলল। রুশান ইন্সাল্ট ফিল করার মতো ভাব করল। অর্পা বলল,
“ঠিক বলেছো। খারাপ দিন শুধু আমার এসেছে। তাই তো এক বছর ধরে ওকে সহ্য করছি।”
অর্ষা এইবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে ভীষণ লজ্জা পেল৷ অর্পার সামনে রুশানকে এসব কথা বলায়। জিভ কেটে সরি বলল।
“আরে, বাদ দেও। ও যে একটা ঢেরশ সবাই জানে। তোমার কথা বলো। আসো, বসো।”
অর্ষা প্রিয়ার কথা ভুলে ওদের সাথে আড্ডা দিতে বসে গেল শুধুমাত্র দর্শনের খাতিরে৷ হয়তো এভাবেই একদিন ওরা কাছাকাছি আসবে।
অর্ষা বলতে লাগল,
“আমার কথা আর কী বলব। পড়াশোনায় প্রচন্ড ফাঁকি দেই। পড়তে একদমই ইচ্ছে করে না। আমি আড্ডা আর পার্টি প্রিয়। বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করতে ভীষণ ভালোবাসি। আমি অনেক দুষ্ট। কেউ উলটা পালটা বললে প্রচন্ড রেগে যাই। আমার রাগ আর জেদ দুটোই বেশি। আর হ্যাঁ, আমার মধ্যে মেয়েলি গুণ কম। অতিমাত্রায় কম।”
অর্ষা অকপটে স্বীকার করল নিজের সব কিছু। অর্ষা আলাপের অজুহাতে দর্শনকে নিজের অনেক কিছুই বলে দিল।
সবাইকে অবাক হতে দেখে অর্ষা মিষ্টি হেসে বলল,
“আসলে আমি যেমন তেমনটাই সবার কাছে স্বীকার করি। ফেক মানুষ আমার একদম পছন্দ নয়।”
অর্পা জিজ্ঞেস করল,
“বয়ফ্রেন্ড?”
অর্ষা আবারও মিষ্টি হাসল। মিষ্টি হেসে বলল,
“নেই৷ আমি সিঙ্গেল। তবে একজনকে প্রচন্ড ভালোবাসি।”
অর্পা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কাকে? কে সে?”
অর্ষা গভীর অনুভূতি নিয়ে প্রেমের রাজ্যে হারিয়ে আসক্তি নিয়ে বলল,
“সে আমার একতরফা অব্যক্ত ভালোবাসা।”
রুশান, দর্শনের কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করে রহস্যময় হাসি দিল। দর্শনের ভেতরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ঠোঁটের কোনে ইষত হাসি ফুটল।
সবাই বুঝতে পারল অর্ষা তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। অর্পা তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
“তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”
অর্ষা চট করে উত্তর দিল,
“বাবা!”
“আর মা?”
“মা নেই,আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। বাবাকে নিঃস্ব করে চলে গেছেন।”
অর্ষার সহজ উত্তর। অর্ষার এই সহজ উত্তরটা সবাইকে আহত আর বিমর্ষ করল বিশেষ করে দর্শনকে। দর্শনের বুকে গিয়ে লাগল কথাটা। অর্ষার চোখে যে ব্যথা দেখতে পারছে সেটা ওর বুকে ক্ষতের সৃষ্টি করল। সেই ক্ষত থেকে তাৎক্ষণিক রক্ত ঝড়তে লাগল। সেই রক্ত যেন কেউ দেখতে না পায় তাই দর্শন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“সময় হয়েছে। আমাদের যাওয়া উচিত। এই অসমাপ্ত আড্ডাটা আরেকদিন সমাপ্ত করা যাবে।”
অর্ষা দর্শনের দিকে তাকাল। দুজন দুজনার চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল। তারপর অর্ষাও উঠে দাঁড়াল।
“আমার ফ্রেন্ড আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি যাই তাহলে।”
অর্ষা চেয়ার সরিয়ে ওর বেবি চুলগুলো কানের পেছনে গুজে আবারও মিষ্টি হাসল।সবার থেকে বিদায় নিল। দর্শন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
….
দুদিন পরের কথা,,
রুশান কাঁদো কাঁদো মুখ করে দর্শনকে বলল,
“দোস্ত, আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে। অর্পা আমার সাথে ব্রেকাপ করেছে। নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছে।”
দর্শন ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“তাতে কী?”
রুশান অবাক হয়ে বলল,
“তাতে কী মানে? আমার ব্রেকাপ হয়েছে। আমাকে এই মুহুর্তে শান্তনা দিবি। বলবি মন খারাপ করিস না। ওর চেয়ে ভালো কাউকে পেয়ে যাবি। ও তোর যোগ্য না।”
“এই চুপ কর তো৷ তোর কী শান্তনা সত্যিই প্রয়োজন আছে? আমি কী কিছু বুঝি না? নতুন কাকে জুটিয়েছিস বল তো?”
নাক কুঁচকে ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করল।
রুশান লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“অর্পার ছোট বোন ফার্স্ট ইয়ারের সেই মেয়েটা অর্ষা।”
রুশানের কথা শুনে দর্শনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কি রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। রুশান এসব কী বলছে!
চলবে…..