প্রেম_তুমি,পর্ব-৫,৬

0
363

#প্রেম_তুমি,পর্ব-৫,৬
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৫

দর্শন প্রচন্ড শকড রুশানের কথা শুনে। শুধু শকডই না রীতিমতো মাথা ঘুরছে। কান ভনভন করছে। সিনেমার মতো একই লাইন বারবার বাজছে। দর্শন কান চেতে ধরল দুই হাতে। কান স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। আঙুল দিয়ে কানে খোঁচা দিয়ে বলল,
“আমি ভুল শুনছি?”

রুশান ফ্যাকাসে মুখ করে বলল,
“দোস্ত তুই বয়রা হয়ে গেছিস? অর্ষা, আমি অর্ষার কথা বলছি। তুই শুনতে পাচ্ছিস? হ্যালো ওয়ান টু চেক… ”

দর্শন রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকাল। রাগে গা কাঁপছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুই জানিস না অর্ষা আমাকে ভালোবাসে?”

“তাতে কী? তুই তো আর বাসিস না। ওইদিন না বললি অন্য খাঁচায় বন্ধি হয়ে গেলে তুই বেঁচে যাস? আমি তোকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। বন্ধু হয়ে বন্ধুর উপকার করছি। সমস্যা নেই একদিন ট্রিট দিয়ে দিস। তাছাড়া অর্পা আমার সাথে যা করেছে তার শোধ নেব না? ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে
অর্ষার সাথে প্রেম করব। খুব জ্বালাব।”

অর্পা জ্বলবে কি-না জানা নেই তবে দর্শন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বোম ফাঁটবে ফাঁটবে অবস্থা। সব চেয়ে বেশি জ্বালা করছে রুশানের নেকা হাসি দেখে।
“একটা লাথি মেরে তোর পেট ফাঁটিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলব। আরেকবার যদি অর্ষার নাম মুখে নিয়েছিস তো ঠোঁট কেটে ফালা ফালা করব। একটা গেছে আরেকটা ধরার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।”
দর্শন রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। যেতে যেতেও বিড়বিড় করছে। রুশান ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। দর্শন এ-সব কি বলে গেল মাথায় ঢুকছে না।


অর্ষা লাইব্রেরীতে বসে আছে। কিন্তু আজ সারাদিনও দর্শন লাইব্রেরীতে আসেনি। অর্ষা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে এলোমেলো হয়ে বসে আসছে। ক্ষনে ক্ষনে নিয়ম করে হাই তুলছে। বিরক্তি আর নিরাশা নিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। কত স্টুডেন্ট আসছে, যাচ্ছে, কেউ দাঁত কেলিয়ে হাসছে, কেউ বই খুঁজছে, কেউ বিরক্ত লুক নিয়ে লাইব্রেরী জুড়ে হাঁটছে, কেউ ফিসফিস করে গল্প করছে, কেউ কথার ফাঁকে চুপিচুপি হাসছে। অর্ষা এ-সব দেখতে দেখতে বোর হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে নিদ্রা আসছে৷ তখনই লাইব্রেরী গেট দিয়ে দর্শন ঢুকল। অর্ষা নড়ে-চড়ে বসে, চুলগুলো ঠিক করে বই খুলে এক্সট্রা ভাব নিয়ে বসল। এমন জায়গায় বসেছে যাতে লাইব্রেরীতে ঢুকেই অর্ষার দিকে প্রথম চোখ যায় অর্ষা অর্ষার চোখ বইয়ের দিকে এমন চাব যেন পড়াশোনায় গভীর মগ্ন। অর্ষা আড়চোখে দর্শনের দিকে তাকাল। কিন্তু হায়! দর্শন লাইব্রেরীতে ঢোকার পথেই একটা ছেলে ওকে আগলে নিয়ে কথা বলতে লাগল। অর্ষার এত ভাব নিয়ে বসে থাকার কোন লাভ হলো না। দর্শন ছেলেটার সাথে কথা বলছে তো বলছেই। ওদের কথা থামছে না। অর্ষা ভাবছে এই বুঝি শেষ হবে কিন্তু বারবার অর্ষা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। ওদের কথা শেষ হচ্ছে না। ওদের দেখে মনে হচ্ছে ওদের গল্প জমে গেছে। দর্শন তো রীতিমতো হেসে হেসে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। অর্ষার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কখন ওদের কথা শেষ হবে আর কখন দর্শনের দৃষ্টি ওর দিকে পড়বে। অর্ষার রাগ হচ্ছে ভীষণ। অর্ষা রাগে গাল ফুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে উঠে গেল। দর্শনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু দর্শন গল্পে মশগুল। অর্ষা কিছু দূর গিয়ে পেছনে তাকাল। দর্শনকে দেখে ওর আরো রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মার্ডা*র করে দিতে। ওর দিকে না তাকানোর দায়ে হ*ত্যা।
দর্শন মাথা ঘুরাচ্ছে। অর্ষা জানে না দর্শন পেছনে তাকাবে কি-না, যদি তাকায়? আর যদি অর্ষাকে দেখে ফেলে? কী লজ্জা! কী লজ্জা! এত লজ্জা কই রাখবে? তাই দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। প্রিয়াকে কল করছে কিন্তু ও রিসিভ করছে না। আজ কলেজেও আসেনি। অর্ষা আবারও প্রিয়াকে কল করছে। কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। ক্লাসের সামনে গিয়ে ওকে দেখতে পেল। প্রিয়াকে দেখে ওকে ডাক দিল।
প্রিয়া ওর ডাক শুনে থেমে গেল। অর্ষা ওর সামনে গিয়ে বলল,
“তুই বেঁচে আছিস? আমি তো ভেবেছি মরে গেছিস।”
প্রিয়ার সামনে যেতেই প্রিয়া বলল,
“আম্মুর সাথে শপিংয়ে গিয়েছিলাম। তাই শুধু লাস্ট ক্লাস পাচ্ছি৷”
অর্ষা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“মোবাইল কী গিলে খেয়েছিস? না দান করে এসেছিস? না-কি শপিংয়ের বিল দিতে পারিসনি তাই মোবাইল রেখে দিয়েছে? কোনটা? চটপট এন্সার মি।”
প্রিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আরো কিছু অপশন দে তারপর তোর কোশ্চেনের এন্সার দিচ্ছি।”
“ড্রামা বাদ দে, তোর মোবাইল কই?”
“আরে, তাড়াহুড়ায় বাড়িতে ফেলে আসছি। জানিসই তো আম্মু শপিং করতে গেলে কত তাড়া দেয়।”
“আমি না জানি তুই তো জানিস। কেন গিয়েছিলি?”
প্রিয়া বুঝতে পারছে কোন কারণে অর্ষা চটে আছে। তাই ঠান্ডা মাথায় বলল,
“যাওয়া দরকার ছিল, ইয়ার। তোর কী হয়েছে তাই বল। মাথা গরম কেন?”
অর্ষা ওর প্রশ্নে গলে গেল। যেন এতক্ষণ এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল।
“পুরো কলেজের দৃষ্টি আমার দিকে থাকলেও তার দৃষ্টি অন্যদিকে। আমাকে তার চোখেই পড়ে না। আমি এতবড় জলজ্যান্ত একটা মানুষ, গোল গোল চমশায় কী আমাকে দেখা যায় না? চশমায় কী পাওয়ার নেই?”
প্রিয়া ভোলাভালা মুখ করে বলল,
“আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসব?”
অর্ষা নেকা কান্না করে বলল,
“তুই আমার সাথে মজা নিচ্ছিস? তোর সাথে আড়ি আমার।”
প্রিয়াও নেকামি করে বলল,
“আহারে! থাক বাবুটা কাঁদে না।”
অর্ষা ওর পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলল,
“চোখের সামনে থেকে দূর হ।”
এটা বলে নিজেই চলে যাচ্ছে। প্রিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।

অর্ষা শেষ ক্লাস না করে গাছের নিচে বসে আছে। ভালো লাগছে না কিছুই। বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। মোবাইল অফ করে রেখেছে যাতে প্রিয়া কল দিতে না পারে। পরক্ষণেই মনে পড়ল প্রিয়া তো মোবাইল আনেনি। হুদাই রাগ করে মোবাইল অফ রেখেছে। মোবাইল অন করে একটা সেল্ফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিল। তখনই হোয়াটসঅ্যাপ থেকে নোটিফিকেশন আসল। কেউ একজন মেসেজ করেছে। অপরিচিত নাম্বার। “কেমন আছো তুমি?”। অর্ষা কয়েকবার মেসেজটি দেখে নাম্বার দেখল। তারপর আইসক্রিমে মনোযোগ দিল। এক কামড় দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ব্লক দিয়ে দিল। তারপর আবারও আইসক্রিম খেতে খেতে ফেসবুক স্ক্রল করছে। তখন রুশান এলো। ওর পাশে বসে পড়ে বলল,
” কী করো তুমি?”
অর্ষা মুখে জবাব না দিয়ে মোবাইল দেখিয়ে আবারও স্ক্রল করছে। রুশানকে একদম পাত্তাই দিচ্ছে না। রুশান ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“এই তোমার ফেবু আইডিটা দেও তো।”
অর্ষা ভ্রু কুঁচকে এক পলক ওকে দেখল। তারপর বলল,
“অন্বেষা হাসান লিখে সার্চ দিন। আমার পিক দেওয়া আছে পেয়ে যাবেন।”
রুশান ওর নাম লিখে সার্চ করল। একই সাথে কতগুলো মেয়ের আইডি আসল। তাই অর্ষাকে দেখিয়ে বলল,
“কোনটা তুমি?”
অর্ষা আবারও এক পলক দেখে বলল,
“তিন নাম্বারটা।”
দর্শন, অর্ষা আর রুশানকে এক সাথে দেখে হতভম্ব। ওর পিলে চমকে উঠে। হঠাৎ করে কপাল দিয়ে চিকন ঘাম ছুটতে লাগল। রুশান কী সত্যিই অর্ষাকে পটিয়ে ফেলেছে? ওরা এক সাথে কেন? এসব প্রশ্ন নিয়ে অর্ষা আর রুশানের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।
গিয়েই হন্তদন্ত হয়ে রুশানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“তুই এখানে কেন? এখানে কী করিস?”
তারপর আড়চোখে অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা চোখ উল্টালো তারপর আবারও ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগল। মনে মনে বিরবির করে বলছে,
“তার বন্ধু থাকায় আমাকে চোখে পড়ছে। দূর থেকেও চোখে পড়ছে। আর আমি একা সামনে থাকলেও চোখে পড়ে না। বদ ছেলে একটা। একবার বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারলে হারে হারে শিক্ষা দিয়ে দেব।”
রুশান হাসি হাসি মুখ করে বলল,
“এই তো অর্ষার সাথে একটু গল্প করছি।”
অর্ষা অবাক হয়ে ভাবছে ওর সাথে গল্প কখন করল।
দর্শন বলে উঠে,
“অনেক গল্প হয়েছে৷ এখন উঠ আর ক্লাসে আয়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এত গল্প কীসের? ওর না-হয় গল্প করে চলে যাবে তোর তো চলবে না। তুই তো যেন তেন স্টুডেন্ট না।”
কথাগুলো ঠেস মেরে অর্ষাকে বলল সেটা অর্ষা আর রুশান দুজনেই বুঝতে পারল। অর্ষা নাক ফুলিয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছে। অন্য কেউ হলে এই কথার উত্তরে একশো কথা শুনিয়ে দিত কিন্তু দর্শনের প্রতি ওর দুর্বলতা ওকে বলতে দিচ্ছে না। রুশান ওর দিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকাল। দর্শন ধমক দিয়ে বলল,
“এখনো বসে আছিস কেন? প্যান্টে কী আঠা লাগানো? উঠতে পারছিস না?”
রুশান দ্রুত বসা থেকে উঠে গেল তারপর বলল,
“হ্যা, অনেক বিদ্যাসাগর হয়ে গেছো।”
অর্ষা মনে মনে বলছে,
“শুধু তাই না? বিদ্যার সাগরে ডুবে যাচ্ছে। ভাব কত!”

রুশান যেতে যেতে দর্শনকে অর্ষার ফেসবুক আইডি দেখাল।
“দোস্ত, দেখ ডিপিতে কত সুন্দর একটা পিক দেওয়া। জিন্স-টপ্সে ওকে সেই লাগছে।”

দর্শন বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ওর আইডিও পেয়ে গেছিস?”

“মাত্রই নিয়ে এলাম৷ তারপর রাতভর জমিয়ে আড্ডা গল্প করব। এভাবে একদিন পটিয়ে ফেলব।”

দর্শন অর্ষার পিকটা দেখছিল। রুশানের কথা শুনে আবারও মেজাজ বিগড়ে গেল। ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে অর্ষাকে ব্লক লিষ্টে রেখে দিল। রুশান চোখ বড়বড় করে চেয়ে রইল। কিছু বলতে গেলে দর্শন ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।

ছুটির পর অর্পাকে দেখে দর্শন জিজ্ঞেস করল,
“তুই কি সত্যিই রুশানের সাথে ব্রেকাপ করেছিস?”

অর্পা রুশানের দিকে চেয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে আবারও মুখ বাকিয়ে বলল,
“এই ঢেরসের সাথে যে এক বছর ছিলাম এটাই ওর ভাগ্য। আমার মতো মেয়ে এই জীবনেও পাবে না।”
রুশান দর্শনের দিকে চেয়ে বলল,”দেখেছিস কী ব্যবহার?”
দর্শনের ওর ব্যবহার দেখার দরকার নেই। ঘটনা যে সত্য এটা জেনেই ওর মাথা ঝিমঝিম করছে।
তাই দাঁতে দাঁত চেপে রাগে ফুসতে ফুসতে বলল,
“ও যে তোর পাতানো ছোট বোন অর্ষার সাথে লাইন মারছে সেটা কি তুই জানিস?”
অর্পা চোখ বড়বড় করে বলল,
“কী? অর্ষা!!”
“হ্যা, অর্ষা।”
অর্পা চোখ লাল করে রুশানের দিকে তাকাল। রুশান ভয়ে চুপসে গেল।

চলবে……..

#প্রেম_তুমি
পর্ব-৬
ফাবিহা নওশীন

পড়ন্ত বিকালে যখন সূর্য তার তেজ হারিয়ে নির্বিকার ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমা আকাশে তখন ষোল বছর বয়সী এক কিশোরী মেহেদীতে হাত রাঙাতে ব্যস্ত। এ যেন শুধু মেহেদীর রং নয় তার হৃদয়ের গভীর রঙ, ঠোঁটের কোনে ইষত হাসি, গালে লাল গোধূলি আভা, দুনয়নে আষ্টেপৃষ্টে থাকা গভীর লজ্জা। প্রিয়া অর্ষার রুমে যেতেই ওর চোখে পড়ল সে কিশোরীকে। অর্ষা কোলে কোশন রেখে মুখে মিষ্টি হাসি রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে মেহেদী দিচ্ছে। প্রিয়া পা টিপে টিপে ওর কাছে গিয়ে বসতেই অর্ষা হঠাৎ চমকে গেল। শুধু চমকে গিয়ে স্থির হয়নি। চমকে গিয়ে ওর হাত হালকা সরে যায়। অর্ষা চোখ বড়বড় করে মেহেদীর দিকে তাকাল। তারপর দেখল না ঠিক আছে। কোন কিছুই নষ্ট হয়নি। প্রিয়া যেন জানে বাঁচল।
অর্ষা ওকে বলল,
“প্রিয়ু বেঁচে গেলি। আমার মেহেদী নষ্ট হলে পিষ্ট করে ভর্তা বানাতাম।”

প্রিয়া ভয় ভয় মুখ করে বলল,
“ওহে, বান্ধবী আমি বাঁচিয়া গেছি। তা তুমি বসিয়া বসিয়া এই অকাজ কেন করিতেছো জানিতে পারি কী?”

অর্ষা মেহেদী দেওয়া রেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“অকাজ! এমন অকাজ তুই পারলে করে দেখা তো। মেহেদী দেওয়াও একটা সৃজনশীল কাজ। যে গুন তোর নেই।”

“আচ্ছা, গুণবতী মেডাম। আপনার গুনের বিবরণ দেওয়া শেষ হলে চলুন একটু ঘুরে আসি। তোর এই সৃজনশীল কাজ দেখার জন্য অবশ্যই আমি আসিনি।”

অর্ষা আবারও মেহেদী দিতে দিতে বলল,
“বের হওয়ার মুড নেই। বড়জোর ছাদ অবধি যেতে পারি। তা যদি না পোষায় তবে বলব গো ব্যাক ইউর হোম।”

****
অর্ষা আর প্রিয়া ওদের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা ডান হাতে রেলিঙ ধরে বাম হাত উঁচু করে অতি সাবধানে রেখেছে। যাতে ওর হাতের মেহেদী নষ্ট না হয়। বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছে। ছাদের ওপাশে আরো দুটো মেয়ে গল্প করছে। অর্ষার দৃষ্টি ওই গোধূলি রাঙা আকাশের দিকে। ওর গোধূলি আকাশ খুব পছন্দ কিন্তু একার জন্য ছাদে আসা হয় না। আর না উপভোগ করা হয় এই মুহূর্ত। কেমন ঘোর লাগা মুহূর্ত। মনে হয় কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। দূর-দূরান্তে। ওই গোধূলি আকাশে। প্রিয়া রেলিঙ ধরে নিচের দিকে ঝুঁকে চেয়ে আছে। রাস্তার ছোট ছোট মানুষ আর যানবাহন দেখছে। ও ছাদের এক জায়গায় স্থির থাকছে না। পাখির মতো উড়াউড়ি করছে।

অর্ষা আকাশ দেখায় ব্যস্ত আর তখনই একটা ছেলের কন্ঠ,
“অর্ষা!”
অর্ষা চোখ ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ছেলেটা চুপচাপ ওর দিকে চেয়ে আছে। অর্ষা সোজা হয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী? কী চাই? আবার বিরক্ত করতে চলে এসেছো? তোমার জন্য কি বাসা থেকে বের হতে পারব না? জাস্ট বিরক্ত লাগছে। তুমি কি চাইছো তোমার বাবার কাছে বিচার দেই?”
ছেলেটা কনফিডেন্সের সাথে বলল,
” আমি জানি তুমি বিচার দিবে না।”
“কিন্তু কেন দেই না তা জানো? তোমার বাবা আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমি চাইনা তার ছেলের এই কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি লজ্জিত হোন, আমার সামনে এসে দাঁড়াতে না পারেন। তাই চুপ আছি। কিন্তু সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে। সে লিমিট ক্রস হয়ে গেলে আমি কিছুই মানব না। তাই সময় থাকতে ভালো হয়ে যাও।”
ছেলেটা অতিশয় ভদ্র ভঙ্গিতে বলল,
“আমি খারাপ কিছু করেছি? আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চাই।”
অর্ষা রাগান্বিত সুরে বলল,
“আমি বুঝতে চাই না। তুমি কেন বোঝো না? আমি কিছু বুঝতে চাই না।”
“আমার বিশ্বাস তুমি একদিন আমাকে বুঝতে পারবে। সে দিনের অপেক্ষায় আছি।”
অর্ষা চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে বলল,
“অপেক্ষায় থাকো আমার কোন সমস্যা নেই কিন্তু আমাকে বিরক্ত করো না। হোয়াটসঅ্যাপে তুমি টেক্স করেছিলে তাই না? আমি জানি তুমি। আমি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার চেঞ্জ করব না। শুধু ব্লক করব। আমিও দেখতে চাই তুমি কতদূর যেতে পারো।”
অর্ষা রাগে গজগজ করতে করতে হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। যেতে যেতে বলল,
“মুডটাই নষ্ট করে দিল। ডিজগাস্টিং!”
প্রিয়া ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছে।
যেতে যেতে প্রশ্ন করল,
“ও এখনো তোর পেছনে পড়ে আছে?”
“তাই তো দেখছি। কতদিন পরে ছাদে এলাম সেখানে এসেই হানা। ওর জন্যই ছাদে আসি না। কোথাও কোন ভাবে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে না। সিড়িতে কিংবা রাস্তায় দেখা হলেও কথা বলবে না। কিন্তু ছাদে আমাকে পেলেই হলো। এসে মুড অফ করে দিবে। বলছি বারবার তোমাকে ভালোবাসি না, কখনো বাসবোও না তবুও আসবে। হাল নাকি ছাড়বে না। অদ্ভুত!”
প্রিয়া ওর কথায় বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলল,
“ভালোবাসা জিনিসটাই অদ্ভুত! তাহারে চাই আমি, আমারে চায় অন্য আমি।”
তখনও প্রিয়া চেহারায় বিজ্ঞ ভাব বজায় রেখেছে। সেটা দেখে অর্ষা ওর দিকে রাগি ফেস করে তাকাল।

..
মেহেদী রাঙা হাত নিয়ে অর্ষার দুচোখ শুধু দর্শনকেই খুঁজছে। আজ এক বারের জন্যও দর্শনের মুখখানা দর্শন করতে পারেনি। মন খারাপ করে ক্লাসে গিয়ে প্রিয়ার পাশে বসল। প্রিয়া পাশের মেয়ের সাথে গল্পে মজে আছে। অর্ষা কনুই দিয়ে প্রিয়াকে আঘাত করে নিজের দিকে ঘুরালো। প্রিয়া কপাল কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কী?”
“এই শোন না, দর্শনকে দেখেছিস?”
“পাগল না-কি দর্শনকে কেন দেখতে যাব? তুই যাতে আমার চোখ গেলে দিস সেজন্য।”
“উফফ! আমি সিরিয়াসলি বলছি। আজ কোথাও ওকে দেখিনি। আসেনি না-কি। তুই দেখেছিস?”
প্রিয়া এক মিনিট সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে চোখ এদিক সেদিক করে বলল,
“উমম, নাহ। কোথাও দেখিনি।”
তারপর ফিক করে হেসে দিল। প্রিয়া ইচ্ছে করে অযথা সময় নষ্ট করল। অর্ষা পাশ ঘুরে বসে রইল। বাম হাতের মেহেদীর দিকে গভীর ভাবে চেয়ে আছে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে লগইন করল। গতকাল রাতে দর্শনকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনো রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করেনি। ওর মেজাজ তুঙ্গে।

অর্ষা বিরবির করে দর্শনকে গালি দিয়ে বলল,
“ব্যাটার ভাব কত! আমাকে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি যথেষ্ট লম্বা তাই ঝুলিয়ে রাখার কারণ দেখি না। আমারও ভাব কম না। আমি ডিরেক্ট ব্লক দেব।”
অর্ষা ওকে ব্লক দেওয়ার আগে নোটিফিকেশন চেক করল। ১৫+ নোটিফিকেশন শো করছে। একটা নোটিফিকেশন দেখে অর্ষার অবিশ্বাস্য চোখ বিস্ময় নিয়ে ঝলমল করে উঠল।
“লাভ রিয়েক্ট! মাই গড! আই কান্ট বিলিভ দিস!”
প্রিয়া ওকে এত উচ্ছাসিত দেখে প্রশ্ন করল,
“কী হলো? লাফাচ্ছিস কেন?”
“দর্শন আমার আইডি চেক করেছে। রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করেনি ভাব মেরে কিন্তু আইডি ঠিকই ঘেটেছে। তার মানে ও আমাকে নোটিশ করেছে।উফফ!”
প্রিয়া আতংকিত হয়ে প্রশ্ন করে,
“দোস্ত, আইডি ঘাটার জন্য কবে থেকে নোটিফিকেশন আসে? আমি তো রোজ কত মানুষের আইডি চেক করি। তাহলে আমিও….
” আরে থাম! দর্শন আমার মেহেদী দেওয়া হাতের পিকে লাভ রিয়েক্ট দিয়েছে এর মানে ও আমার আইডিতে চুপিচুপি টু মেরে গেছে কিন্তু প্রমাণ রেখে গেছে। দাঁড়া একটা সস নেই।”
অর্ষা খুশিতে গদগদ করছে।
প্রিয়া ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“তুই এখানে বসে না থেকে ওদের ক্লাসের সামনে থেকে চক্কর দিয়ে আয়। তবেই বুঝতে পারবি এসেছে কি-না।”
অর্ষা মলিন মুখ করে বলল,
“আতংকের আরেক নাম সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস। দর্শন এখন আমাকে চিনে। সামনে পড়ে গেলে? তাছাড়া অর্পা আর রুশান ওরাও তো আছে। অর্পা যদি আমাকে দেখে তাহলে বলবে,আরে অর্ষা কী খবর তোমার? কী করো এখানে? কাউকে খুঁজছো? ব্লা ব্লা ব্লা। আর রুশান ভাইয়া দেখলে পেঁচিয়ে ঘুচিয়ে নানান কথা বলতে শুরু করবে। শুধু তাই নয় কড়া জেরা করবে। ওদের জন্য এখন যেতে পারি না। পড়েছি বিপদে।”
প্রিয়া মিনমিন করে বলল,
“হুম, চোরের মন পুলিশ পুলিশ।”
অর্ষা বলল,
“কী বললি?”
“কিছু না।”

….

অর্ষা আর প্রিয়া কলেজ ছুটির পর ক্যান্টিন থেকে আইসক্রিম কিনে খেতে খেতে হাঁটছে। তখন প্রিয়ার দৃষ্টি গেল মাঠের কোনায়। একটা ছোটখাটো জটলা বেঁধেছে। অর্ষা মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করেনি। প্রিয়া, অর্ষাকে জটলাটা দেখাল। অর্ষা কৌতূহল হয়ে সেদিকে আগাচ্ছে।।কানে গিটার আর দলবদ্ধ কন্ঠস্বর ভেসে এল।
“ওরে রাধার প্রেমে মাতোয়ারা,
চাঁদ গৌর আমার রাধার প্রেমে মাতোয়ারা….

অর্ষা আর প্রিয়া জটলার কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারল একটা দল এখানে গান গাইছে। পাশে বন্ধুরা বসে এঞ্জয় করছে আর উৎসাহ দিচ্ছে। অর্ষা কাছে গিয়ে দেখল ওরা সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। দর্শনের ফ্রেন্ড সার্কেল। দর্শন আর আরেকটা ছেলের হাতে গিটার। ওর চোখে চশমা নেই, চুলগুলো এলোমেলো। চার-পাঁচজন মিলে গান গাইছে বাকিরা বসে শুনছে। দর্শনকে দেখে আরেক দফা ফিদা হয়ে গেল অর্ষা।

” তোমায় হৃদয় মাঝে রাখিবো ছেড়ে দেব না,
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেব না…।
ওরা গান শেষ করল। সবাই এক সাথে চেঁচিয়ে উঠল। দর্শন রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। ঘেমে গেছে গিটার বাজিয়ে। চুলগুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করে ঠিকঠাক করছে। অর্ষা দর্শনের দিকে চেয়ে আছে। ওকে দেখছে। অর্পা, ওকে দেখে ইশারায় ডাক দিল। অর্ষা ওর কাছে গেল।
“অর্পা আপু, এখানে কী হচ্ছে?”
“এই একটু আড্ডা হচ্ছে। পড়াশোনা করে হাঁপিয়ে উঠেছি কি-না তাই মাইন্ড ফ্রেশ করছি। আমাদের সাথে জয়েন করো।”
অর্ষার গ্রুপের বন্ধুরা বলে উঠল,
“অর্ষাও খুব ভালো গান পারে।”
সবাই অর্ষার দিকে তাকাল। সবার এহেন চাহুনি দেখে অর্ষার অস্বস্তি লাগছে। লজ্জাও লাগছে। তুলি নামের ক্লাসমেটকে কড়া একটা চড় মারার খায়েশ জাগ্রত হলো। ফট করে বলার দরকার কী অর্ষা গান পারে? কেউ কী জিজ্ঞেস করেছে? অযথা ইজ্জতের নিলাম হলো।
রুশান বলল,
“তাই না-কি? অর্ষা তুমি গান পারো? আমাদের একটা গান শোনাও না। প্লিজ।”
কিছুটা নেকামি সুরে বলে উঠল। অর্পা ওর দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলবে। দর্শনেরও রাগ হচ্ছে সব জায়গায় অর্ষাকে কেন চলে আসতে হবে? ওদের থেকে দূরে থাকতে পারে না?
অর্ষা কিছু বলার আগেই দর্শন গিটারের ব্যাগ খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“অনেক লেট হয়ে গেছে। আমাদের উঠা উচিত।”
অর্ষাও বলল,
“জি না ভাইয়া, আমি গান-টান তেমন পারি না। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে আমার জন্য গাড়ি চলে আসবে আমি যাই। আপনারা কেরি অন করুন।”
অর্ষা উঠে দাঁড়াতে লাগল।
রুশান কিছু বলতে যাবে তখন অর্পা ওর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“দু লাইন প্লিজ।”
অর্ষা ইতস্তত করে বলল, “এখানে পারব না।তোমাকে অন্য সময় শুনাবো।”
রুশান বলল,
“তা বললে হবে? ওকে শুনাবে আর আমরা কী দোষ করলাম?”
সবাই অনুরোধ করায় অর্ষা রাজি হলো। কিন্তু কিছুটা নার্ভাস লাগছে। এর আগে কখনো লাগেনি।
“আচ্ছা, তবে আমার একটা শর্ত আছে। কেউ শব্দ করবে না। নিস্তব্ধ পরিবেশে গানটা গাইতে চাই। অল্প কিছু কলি গাইব।”
“ওকে।”
“আমার একটা গিটার লাগবে।” অর্ষা উদ্দেশ্য করে কারো কাছে চাইতে পারছে না। অর্ষার খুব ইচ্ছে করছে দর্শনের গিটারটা ছুয়ে দিতে। অর্পা আগ বাড়িয়ে বলল,
“দর্শন তোর গিটারটা দে।”
দর্শন সাধারণত কাউকে নিজের গিটার ব্যবহার করতে দেয় না। আজ অর্পা বলার সাথে সাথে অর্ষার দিকে গিটার এগিয়ে দেয়। অর্ষা গিটার হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল তারপর সবার দিকে চেয়ে বলল,”শুরু করছি।” তারপর আবার গিটারের দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে সুর তুলল। খুবই স্নিগ্ধ সুর….. চোখ জোড়া আবেশে বন্ধ হয়ে গেল,

“ওহে কি করিলে বলো
পাইব তোমারে?
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে…
ওহে কি করিলে বলো
পাইব তোমারে?
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে….

ওহে এত প্রেম আমি
কোথা পাবো নাথ;
এত প্রেম আমি
কোথা পাব নাথ;
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে!

আমার সাধ্য কি বা তোমারে
দয়া না করিলে কে পারে ?
তুমি আপনি না এলে কে পারে ?
হৃদয়ে রাখিতে !

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না..
কি করিলে বলো পাইবো তোমারে?
রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে….

তারপর অর্ষা চোখ খুলল। সবাই বাহবা দিচ্ছে। অর্ষা কারো দিকে না চেয়ে স্নিগ্ধ হেসে অর্পাকে বলল,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আপু। আমি যাই।”
রুশান প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“ভালো গান করো তুমি। শিখো না-কি ?”
অর্ষা গিটার রেখে উঠে দাঁড়াল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বলল,
“স্কুলে থাকতে শিখেছিলাম। থ্যাংকস টু অল। টাটা।”
অর্ষা যেতে যেতে শুনল রুশান বলছে,
“ভয়েস মাশাল্লাহ।”
তারপর কে যেন বলছে,”অর্ষা পড়াশোনায় তেমন ভালো না হলেও নাচ-গান, খেলাধূলায় অনেক স্মার্ট।”
অর্ষা সে-সব পাত্তা দিল না। দর্শনের মন ছুয়ে যাচ্ছে। মুচকি হাসল। কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে। ভেবে আরো হাসি পাচ্ছে। চুলগুলো আবারও এলোমেলো করে নিল। গিটারটা হাতে তুলে নিল। ভালো লাগছে খুব। শুধু রুশানকে দেখলে রাগ লাগে। প্রচন্ড রাগ। হতে পারে জেলাসি! ইচ্ছে করে গুম করে দিতে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here