প্রেম_তুমি,পর্ব-৭,৮

0
325

#প্রেম_তুমি,পর্ব-৭,৮
ফাবিহা নওশীন

কলেজের বাস্কেটবল সাইটে অর্ষা আর ওর বন্ধুরা বাস্কেটবল খেলছে। দর্শন কিছুক্ষণ আগে ওদের দেখে গেছে খেলতে। কিছুক্ষণ পরে এসে দেখে অর্ষার গ্রুপের কয়েকটা ছেলে সেকেন্ড ইয়ারের জুবায়েরের সাথে তর্কাতর্কি করছে। অর্ষা দুহাত ভাজ করে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা বিরক্তি গিয়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“এটা কেমন কথা? আপনি সিনিয়র আমরা জুনিয়র এই যুক্তিতে খেলতে হবে? আপনি সিনিয়র তাই যখন ইচ্ছে খেলতে পারবেন। যখন ইচ্ছে হবে খেলার মাঝে এসে অন্যের খেলা নষ্ট করবেন? এত ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে?”

একটা ছেলে বলল,
“অর্ষা, তুই থাম আমি দেখছি।”
অর্ষা চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“তোরা তো অনেকক্ষণ ধরেই দেখছিস। এইবার আমাকে দেখতে দে।”
জুবায়ের কটাক্ষ করে বলল,
“আরে, তোদের লিডার না-কি? লেডি লিডার!”
তারপর মুখ বাঁকিয়ে হাসতে লাগল।
অর্ষার বন্ধুদের কথাটা গায়ে লাগল।
“ও কে সেটা আপনার না দেখলেও চলবে। আপনি এখন যান আমাদের খেলতে দিন। ফালতু কথা শুনে সময় নষ্ট করতে চাই না।”
জুবায়ের জোর দেখিয়ে বলল,
“পারলে খেল তো। দেখি কত সাহস!”
অর্ষা ওর সামনে গিয়ে বলল,
“খেলব। একশো বার খেলব। আপনি যা পারেন করে নিন।”
“এই মেয়ে তুই আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিস? পারলে খেল।”
অর্ষা এইবার প্রচন্ড রেগে গেল। চোখ মুখ লাল করে গর্জে উঠে বলল,
“খেলব। কী করবি হ্যা? কী করবি? আমি কী তোকে ভয় পাই? এতক্ষণ অনেক রেস্পেক্ট দিয়েছে৷ জাস্ট এনাফ!”
জুবায়ের শার্টের হাতা ফোল্ড করে ওর দিকে এগিয়ে এসে আঙুল তুলে বলল,
“দেখতে চাস কী করব?”
অর্ষা দুহাত ভাজ করে আরো সামনে এগিয়ে নির্ভীক দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“হ্যা, দেখতে চাই। দেখা। অপেক্ষা করছি।”
জুবায়ের অর্ষার চোখের সামনে আঙুল নিয়ে বলল,
“সরে যা বলছি। এখনো সময় আছে। নয়তো….
অর্ষা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
” নয়তো কী?”
দর্শন দেখছে অর্ষা আর জুবায়েরের মধ্যে আধা হাত দূরত্ব। অর্ষা রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। জুবায়ের একটা ছেলে ও যদি রাগের বশে উল্টা পালটা কিছু করে বসে, যদি গায়ে হাত দিয়ে দেয়? তাহলে? এখুনি ওদের থামানোর দরকার। কিন্তু কাকে থামাবে? অর্ষাকে থামাতে গেলে সবাই প্রশ্ন তুলবে। পরবর্তীতে এর জন্য সাফাই দিতে হবে। তাই জুবায়েরকে থামাতে হবে। জুবায়ের অর্ষাকে দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে উদ্বত হলে দর্শন আকস্মিক ভাবে ওর হাত ধরে পেছনে নিয়ে আসে। জুবায়ের তাল সামলাতে না পেরে আরো কয়েক পা পিছিয়ে পড়ে।

দর্শন একবার অর্ষার দিকে চেয়ে জুবায়েরকে বলল,
“আর ইউ লস্টেড? এগুলো কী ধরনের বিহেভিয়ার? একটা মেয়ের সাথে…. তুই একটা মেয়েকে তার পারমিশন ছাড়া টাচ করতে যাচ্ছিলি? শেইম অফ ইউ।”

অর্পা সেটা শুনে আরো ক্ষেপে যায়। এগিয়ে গিয়ে বলল,
“হাও ডেয়ার ইউ? ইউ অন্না….
দর্শন, অর্ষার দিকে চেয়ে ধমকে উঠে বলল,
” শাট আপ! তুমি ওখানে গিয়ে দাঁড়াও।”
অর্ষা দাঁড়াল না। ওকে টাচ করতে চেয়েছিল শুনেই মাথায় আগুন ধরে গেল। তাই অগ্নি দৃষ্টিতে জুবায়েরের দিকে চেয়ে আছে। দর্শনের দৃষ্টি আবারও অর্ষার দিকে গেল।
“এই মেয়ে তোমাকে বলিনি ওখানে গিয়ে দাঁড়াতে? তুমি কী হ্যা? সেন্স নাই? মেয়ে হয়ে একটা ছেলের সাথে সংঘাতে জড়াও? কথা কাটাকাটি ইটস ওকে বাট মারামারি?”
অর্ষা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমি মারামারি কই করছিলাম? আমি তো কথাই বলছিলাম।”
“কথা বলছিলে? কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে থেকে গায়ে হাত তোলার ইন্ধন দেওয়াকে কথা বলা বলে?”
অর্ষা আবারও বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
“ইন্ধন? কে ইন্ধন দিচ্ছিল?”
“তোমরা দু’জন দুজনকে ইন্ধন দিচ্ছিলে। তোমাকে যদি ধাক্কাটা দিয়ে বসত তখন পড়ে গিয়ে শুধু কী ব্যথা পেতে? তোমার সম্মানটা কই থাকত? তোমার কাছ থেকে এমন বিহেভিয়ার একদমই এক্সপেক্ট করিনি।”
তারপর জুবায়েরকে ইচ্ছে মতো ধুয়ে দিচ্ছে।
ওদের কথার মাঝে অর্পা চলে এল। অর্পা এসে দেখল দর্শন প্রচন্ড রেগে গেছে৷ জুবায়েরকে যা নয় তাই বলছে। অর্ষা চুপ করে দাঁডিয়ে আছে।
“অর্ষা, এখানে কোন সমস্যা হয়েছে?”
দর্শন অর্পাকে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“এই যে অর্পা, তোমার কথিত ছোট বোন সে না-কি খুব বুদ্ধিমতী? সব সময় না প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকো? ওর তো কমন সেন্স পর্যন্ত নেই। কি অদ্ভুত মেয়ে! জুবায়েরের সাথে মারামারি করতে চলে যাচ্ছে। ওর কাছে গিয়ে ওর কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে থেকে শাসাচ্ছে। জুবায়ের তো রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আমি না থাকলে এখনি একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেত। তখন কী হত? সম্মানটা থাকত? ও যদি আমার কিছু হত তবে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতাম। বেকুব মেয়ে কোথাকার!”
অর্ষা ছলছল চোখে সব অপমান হজম করে নিচ্ছে। অর্পা ওর ছলছল চোখ দেখে দর্শনকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল।

দর্শনের ফ্রেন্ড সার্কেল আর অর্ষার ফ্রেন্ড সার্কেল এক সাথে বসে আছে। সবাই নীরব নির্বিকার। কেউ কোন কথা বলছে না। রুশান বিজ্ঞ ভাব নিয়ে সবার চেহারা একবার দেখল। তারপর দর্শনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি বুঝতেছি না তুই এত ক্ষেপেছিস কেন? অর্ষা আর জুবায়েরের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। ওরাও এতটা ক্ষেপেনি যতটা তুই ক্ষেপেছিস। তোর রাগটা আসলে কোথায়? মানে কার প্রতি?”
দর্শন আনমনে বেখেয়ালি হয়ে বলে ফেলল,
“অর্ষার প্রতি।”
তারপর খেয়াল হতে নিজেই চমকে গেল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“সামান্য একটা ইস্যু নিয়ে দুই ইয়ারের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখে একটু রেগে গেছি।”
“তুই তো পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছিস। তোর কী মনে হয় কে দোষী?”
“দুজনেই।”
অর্ষা ওর দিকে চোখ তুলে এক পলক দেখল। তারপর আবার চোখ নামিয়ে নিল।
অর্পা দর্শনকে প্রশ্ন করল,
“দোষটা কার বেশি ছিল? অর্ষা না জুবায়েরের?”
“আমি এখানে কারো পক্ষপাত করছি না। তবে বলব দোষ বেশি ছিল জুবায়েরের।”
“দোষ জুবায়েরের আর রাগ অর্ষার প্রতি? হুয়াই?”
“আই ডোন্ট নো। আই হ্যাভ টু গো নাও।”
দর্শন বসা থেকে উঠতেই পিয়ন এসে বলল,
“প্রিন্সিপাল অন্বেষা হাসান অর্ষা আর শেহজাদ খান দর্শনকে ডেকে পাঠিয়েছেন।”
অর্ষা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দর্শনের দিকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকায়। দর্শনের সাথে ওর চোখাচোখি হওয়ার পর পিয়নকে বলল,
“শুধু আমাদের?”
“সাথে জুবায়ের আহমেদও আছে।”
“আচ্ছা, আমরা আসছি।”
পিয়ন যেতেই দর্শন বলল,
“ওর জন্য এখন আমাকে প্রিন্সিপালের রুমে যেতে হচ্ছে।”
রুশান কৌতূহল নিয়ে বলল,
“তুই কী কিছু করেছিস? মারামারি টাইপ…. রুশান শেষের কথাটা একটু আস্তে করে বলল।
দর্শন ওর প্রশ্ন শুনে অবিশ্বাসের সুরে বলল,
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তোরা কেউ এটা ভাবতে পারিস। আমি আর মারামারি সে তো আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আমি এ-সব থার্ড ক্লাস কাজ করি না। আমি ঘটনা অব্জার্ভ করেছি তাই হয়তো।”

দর্শন, অর্ষা আর জুবায়ের তিনজন প্রিন্সিপালের রুমে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শন যা দেখেছে, শুনেছে সেসবের বিবরণ দিচ্ছে যথার্থভাবে।
প্রিন্সিপাল অর্ষার দিকে চেয়ে বলল,
“তুমি এ ব্যাপারে কী বলতে চাও?”
“স্যার, উনি সিনিয়র সেক্ষেত্রে বলব আমার উনাকে যথেষ্ট রেস্পেক্ট করা উচিত ছিল। কিন্তু উনি কী আদোও সে রেস্পেক্ট পাওয়ার যোগ্য? খেলা নিয়ে যখন আমার অন্য সতীর্থদের সাথে কথা বনাবনি হচ্ছিল না তখন আমি এগিয়ে যাই ব্যাপারটা মেটানোর জন্য কিন্তু কিছু বলার আগেই উনি আমাকে কুৎসিত ইংগিত দিয়ে কিছু কথা বলেন। যেটা সিনিয়র কিংবা বড় ভাই হিসেবে উনার বলা উচিত হয়নি। তারপর তুই তোকারি করেন তারপর আমিও বেয়াদবি করেছি। এটা আমি স্বীকার করছি। এর জন্য আমি যদি শাস্তি প্রাপ্য হই তবে মাথা পেতে নেব। কিন্তু তারপর উনি আমাকে ধাক্কা মারতে উদ্বত হোন। উনি (দর্শনকে দেখিয়ে) যদি তাৎক্ষণিক না আসতেন তাহলে আমি পড়ে গিয়ে ভীষণ ব্যথা পেতাম। তার চেয়েও বাজে ব্যাপার হচ্ছে উনি উইদাউট মাই পারমিশন আমাকে টাচ করতে চেয়েছিল। যদি সেটা হয়ে যেত স্যার আমি উনার নামে কেস ঠুকে দিতাম। আমার চাচ্চু একজন নামকরা আইনজীবী।”
অর্ষা দাপট দেখিয়ে বলল। দর্শন ইম্প্রেসড। কিভাবে পুরো বিষয়টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। এখন তো মোড় ঘুরে গেল। কিছুতেই অর্ষার উপর কোন চার্জ নেওয়া হবে না। কেননা সব ওর কন্ট্রোলে। দর্শন ঠোঁট বাকিয়ে হাসল।
প্রিন্সিপাল ওকে পর্যবেক্ষণ করে কি জানি ভাবল তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“দর্শন, অর্ষা কি ঠিক বলছে?”
“স্যার ওরা দু’জনই সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে আর্গুমেন্টে জড়িয়েছে। এটা এভাবে হওয়া উচিত হয়নি। তবুও হয়ে গেছে। জুবায়েরের কাজটা ঠিক হয়নি। হ্যা, অর্ষা যা বলল সেটা সত্যি।”
অর্ষা হাফ ছেড়ে বাঁচল। মনে মনে দর্শনকে এতগুলো ধন্যবাদ দিল। দর্শন, অর্ষার দিকে আবারও মুডি লুক নিয়ে তাকাল। অর্ষার মুখের হাসিটা চুপসে গেল।
প্রিন্সিপাল জুবায়েরকে বকাঝকা করে কিছু ভালো ভালো পরামর্শ দিয়ে সবাইকে চলে যেতে বলল।

দর্শন বন্ধুদের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল। শুধু তাই না ওকে গুটিবাজ মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত করল। কিভাবে সব খেল নিজেই খেলল। খুবই ভয়ানক মেয়ে!

অর্পা অকারণেই বন্ধুদের সাথে চিল করার জন্য একটা পার্টি থ্রো করল। আর তাতে ওর ফ্রেন্ড সার্কেল আর অর্ষাও আছে। অর্ষা একা আসবে না, সাথে প্রিয়াকে নিয়ে আসবে বলে জানায়।তাও শুধু আসবে দর্শনের জন্য। ওখানে দর্শনের দেখা পাবে। এমনিতেই দর্শনের কাছে ইমেজ খারাপ হয়ে গেছে। যে করেই হোক শুধরে নিতে হবে। এদিকে দর্শন হোয়াটসঅ্যাপে অর্পার ভয়েস ম্যাসেজ অন করে ক্লাস এইট পড়ুয়া বোনকে পড়াচ্ছে।
“দোস্ত, বিকেল ৫ টায় পার্টি থ্রো করেছি। বাড়িতে গ্রুপ স্টাডির কথা বলে চলে আসিস। টাইম মতো চলে আসবি কিন্তু।”
দর্শন দ্রুত মেসেজ অফ করে বোনের দিকে তাকাল। ওর বোন সহজ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।
দর্শন সব এড়িয়ে বলল,
“কোথায় ছিলাম আমরা? হ্যা এই অংকে….
” ভাইয়া তুই আজ পার্টিতে যাচ্ছিস এটা মাকে বলতে যাচ্ছি। বেস্ট অফ লাক।”
“এই না, আমার সোনা বোনটা। তুই কত ভালো একটা মেয়ে।”
দিশা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“উমম একটা শর্ত, এক হাজার টাকা দেও।”
“পাঁচশ…
” নো এক হাজার।”
“আচ্ছা সাতশো…
” নো এক হাজার।”
“সাতশো…
” এক হাজার এন্ড
(চিৎকার করে আম্মু….
দর্শন ওর বোন দিশার মুখ চেপে ধরে বলল,
“চুপ, দিচ্ছি।”
দর্শন ওয়ালেট থেকে চকচকা এক হাজার টাকার নোট বের করে দিল।
ওর বোন সেটা নিয়ে বলল,
“আর এখুনি ছুটি দিবে।”
” যা ছুটি। ভাগ! দূর হ!”

দর্শন রেডি হয়ে অর্পার পার্টিতে গিয়ে উপস্থিত হলো। কিন্তু সেখানে আচমকা অর্ষার এন্ট্রি দেখে চমকে যায়৷ অর্ষা কালো জিন্স, শট টপ্স, ক্রিম কালার জ্যাকেট আর সাদা সু পরে পার্টিতে উপস্থিত। চুলগুলো খোলা।

চলবে……

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৮

সন্ধ্যা পাঁচটা বেয়াল্লিশ। গ্রিন ডোর রেস্টুরেন্টের দোতলায় পার্টি চলছে। ১০-১৫ জন ছেলেমেয়ে মজ-মস্তিতে মেতে আছে। স্নো সাউন্ডে গান বাজছে। অর্ষা বিষন্ন, ভারাক্রান্ত মনে বসে আছে এক কোনায়। ও যার জন্য এসেছে, যাকে দু চোখ খুঁজে ক্লান্ত সে লাপাত্তা। তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। প্রিয়া ওর পাশে এসে বসে বলল,
“এই অর্ষা, থম মেরে বসে আছিস কেন? এভাবে বসে থাকার জন্য এসেছিস? তুই হচ্ছিস সব পার্টির প্রাণ। সবাইকে মাতিয়ে রাখিস আর আজ তুই নির্বিকার বসে আছিস কেন?”

অর্ষা বিরক্তি নিয়ে মুখ বাকিয়ে বলল,
“তাহলে কী ধেই ধেই করে নাচব? যার জন্য এসেছি সেই তো আসেনি। আমি কী অর্পার জন্য এসেছি? আমি এসেছি দর্শনের জন্য। এমনিতেই ওর সামনে আমার ইমেজ খারাপ হয়ে আছে। তাই চেষ্টা চালাচ্ছি দর্শনকে ইম্প্রেশ করার জন্য কিন্তু দেখ ও আসেনি। এখন আমি কাকে ইমপ্রেস করব?”
অর্ষার মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে মুখটা মেঘে ঢেকে পড়ছে।

“তুই শিওর দর্শন আসেনি?”

অর্ষা বসা থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়াকে প্রশ্ন করল,
“ভাই, এসেছি ৩০ মিনিট হবে। এই ৩০ মিনিটে ওকে এক পলক দেখেছিস?”

প্রিয়া ভাবছে আসলেই তো ওকে দেখেনি। এতক্ষণ একটা মানুষ পার্টির আড়ালে থাকতে পারে না। আর থাকবেই বা কেন? প্রিয়ার মুখ দেখে অর্ষা আবারও বসে পড়ল। তারপর কি একটা ভেবে বলল,
“প্রিয়া, এমন তো নয় ও ইচ্ছে করে আসেনি৷ অর্পার কাছে জেনেছে আমি আসছি তাই হয়তো আসেনি। আমাকে তো একদম পছন্দ করে না।”

প্রিয়া ওর কথা শুনে অবাক হয়ে চোখ উল্টালো। তারপর বলল,
“আরে গাধা, তুই নিজেকে এত ইম্পর্ট্যান্ট কেন দিচ্ছিস? তোর কাছে ও ইম্পর্ট্যান্ট ওর কাছে তুই না। ও তোর জন্য ফ্রেন্ডের পার্টি কেন মিস করবে? হয়তো অন্য ব্যাপার।”

অর্ষা ভেবে দেখল প্রিয়া ঠিক বলেছে। তারপর ঠোঁট উলটে অভিমান নিয়ে বলল,
“তাহলে এখানে বসে থেকে কী লাভ? চল, চলে যাই। আমরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েদেয়ে একটু ঘুরে বাসায় চলে যাই।”

“অর্পা কী ভাববে এভাবে চলে গেলে?”

“যা খুশি ভাবুক আমার কী?”

রুশান দূর থেকে মুচকি হেসে অর্ষার কাছে এল।
“হায়! কী অবস্থা অর্ষা? মুখটা বাংলার পাঁচ করে বসে আছো কেন? পার্টি এঞ্জয় করো। আসো আসো।”

অর্ষা ইতস্তত করে বলল,
“না ভাইয়া, আমি এখানেই ঠিক আছি।”

“বললেই হলো? এসো, এসো।”

“আপনি যান। আমি যাব না।”

এরি মধ্যে অর্পা চলে এল। রুশানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। তারপর বলল,ও
“ওকে বিরক্ত করছো কেন?”

রুশান না বোঝার ভান করে বলল,
“আমি আবার কী করলাম?”
এটা বলেই রুশান চলে গেল। রুশান যেতেই অর্পা বলল,
“কিছু মনে করো না।”

“আচ্ছা, আপু একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। আমি আবার কিছু চেপে রাখতে পারি না। তোমার বয়ফ্রেন্ডটা একটু ছ্যাচড়া টাইপ।”

“ও এখন আর আমার বয়ফ্রেন্ড না। ছ্যাচড়া দেখেই ব্রেক আপ করে ফেলেছি।”

অর্ষা বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেলল। ওর কথা বিশ্বাসই হচ্ছে না। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“সিরিয়াসলি?”

“হ্যা, সিরিয়াস। আজ তাই তো ট্রিট দিচ্ছি সবাইকে। ব্রেক আপ ট্রিট।”

“অদ্ভুত তো! ব্রেক আপ ট্রিট এক্সও পাচ্ছে। ভেরি নাইচ!”

অর্পা ইষত হেসে বলল,
“হ্যা, বাপের রেস্টুরেন্ট তো তাই ফ্রিতে দোতলায় পার্টি দিচ্ছি। এক্স-কেউ বাদ রাখিনি। ইউনিক ট্রিট আর কী। ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থেকো। ব্রেক আপ হয়ে গেছে এখন কিন্তু ছাড়া গরু। আর ছাড়া গরু কিসে মুখ দিয়ে বসে বলা মুশকিল।”

অর্ষা চোখ বড়বড় করে তাকাল। অর্পা হেসে ফেলল। তারপর অর্ষা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
“রুশান ভাইয়ার সাথে যে বন্ধুরা থাকে তাদের তো দেখছি না। উনারা আসেনি?”
অর্পা রুশানের দিকে চেয়ে বলল,
“কই? সবাই তো এসেছে। তুমি কার কথা বলছো রাতুলের?”
“না!”
“তাহলে তামিম? তামিমও এসেছে।”
“না, আমি উনার কথা বলছি না।”
“তাহলে কার কথা বলছো? আমি বুঝতে পারছি না।”
অর্ষা মনে মনে বিরক্ত হলো। অর্পাকে কেন এসব জিজ্ঞেস করছে এসব ভেবে নিজেরই রাগ লাগছে।
“ওসব বাদ দেও। অনেক তো হলো এখন আমি যাই।”
“কেন? এখুনি কেন? তোমাকে এখন কিছুতেই যেতে দেব না।”
অর্ষা বাড়ি চলে যাবে সেটা ভেবে বেশ খুশি হয়েছিল কিন্তু সে খুশিটা রইল না। অর্পা চুরমার করে দিল। অর্ষা মুখে চাপা হাসি ফোটাল। তবে মনে মনে বেশ বিরক্ত। এতটাই বিরক্ত যে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করছে।

দর্শন দূর থেকে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে। অর্ষাকে দেখা মাত্রই দর্শন ওর চোখের আড়ালে চলে যায়। রুশানের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল যখন অর্ষাকে দেখে তখনই ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে সরে যায়৷ এখনো দর্শন সবার মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে৷ কেন রেখেছে জানা নেই। জানতেও চায় না। তবে অনুভূতিটা ভালো লাগছে। এটাই হয়তো একমাত্র কারণ। তাই নিজেকে আড়াল করেই রাখছে। যতক্ষণ সম্ভব রাখবে। ফর্শন ওর ফ্যাকাসে মুখের রহস্যটাও জানে। সেটা জেনে গোপনে হাসছে। অর্ষাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে দর্শনের কাছে। অর্ষা অন্যদের মতো সাজগোজ করেনি তবুও অন্যদের তুলনায় ওকে বেশি মোহনীয় লাগছে।

দর্শনের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷ একটু কোল ডিংক দরকার। দর্শন নিজেই কোল ডিংক খুঁজছে। তখন হঠাৎ শুনতে পেল মাইক্রোফোনে হ্যালো ওয়ান টু চেক।

“তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার❣️

…..
বাকিটা ইউটিউবে শুনে নিয়েন।
গাইতে গাইতে অর্ষার চোখের কোনে পানি জমছে। দর্শনের মুখটা বারবার ভেসে আসছিল। দর্শনের বুকে কেমন ঝড় বইছিল। কেমন হুহু করছিল। ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। অর্ষার সুর থেমে গেল দর্শনকে দেখে। দু’জন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎই দুজনের দৃষ্টিভঙ হলো। মুখরিত শ্রোতাদের কল-ধ্বনিতে।

…..

অর্ষা কাঁধের ব্যাগটা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে খোলা চুলগুলো নাড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে জুতায় বাঁধ পড়া নুড়ি-পাথর, ইটের খোয়া লাথি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। রুশান ওকে দেখিয়ে একটা ছেলেকে জোর করে ধাক্কা মেরে ওর কাছে পাঠাল।
ছেলেরা নার্ভাস কন্ঠে পেছনে থেকে ডেকে উঠল,
” অর্ষা!”
অর্ষা পেছনে ঘুরে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“কী চাই?”
ওর কন্ঠ শুনে বেচারার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আরো দ্বিগুণ নার্ভাস হয়ে গেল।
আমতা-আমতা করে এক নাগাড়ে বলল,
“অর্ষা তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আই লাই ইউ। প্লিজ একসেপ্ট মি।”

অর্ষা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। তারপর কড়া গলায় বলল,
“নিজের লেভেল দেখেছিস? না দেখেই প্রপোজ করতে চলে এসেছিস? প্রপোজ করার আগে অন্তত নিজের লেভেল দেখা উচিত ছিল। নাক টিপলে এখনো দুধ পড়বে সে এসেছে আমাকে প্রপোজ করতে। একটা থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেব। এর পর যদি তোকে দেখি না তবে,, তবে কি করব সেটা তুই আমার সামনে আসলেই বুঝবি। প্রপোজ করতে এসেছে। আমি বাঁচি না আমার জ্বালায় সে এসেছে প্রপোজ করতে। ইচ্ছে করছে তোকে থিতলে ফেলি। একদল গুড়ো করে প্যাকেট করে ফেলি। বেয়াদব একটা। তুই এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস? অদ্ভুত তো! তুই কি চাস তোর মার্ডা*র করে ফেলি? হুহ!”
অর্ষা গর্জে উঠে ওর দিকে এক পা আগাতেই ছেলেটা দৌড় দিল। প্রিয়া হাসতে হাসতে ওর পেছনে এসে দাঁড়াল।
অর্ষার ওর হাসি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে।
“আরে, কওয়া নাই বলা নাই আই লাভ ইউ? এত সহজ? প্রেম ভালোবাসা এতই সহজ? পানিতে ডুবে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যদি ওর প্রপোজ একসেপ্ট করতাম তাহলে আমাদের দুজনকে দেখে সবাই কী বলত ছোট ভাই বড় বোন। ওয়াক! কি বিশ্রী! কমন সেন্স নাই। দৌড়ে চলে এসেছে প্রপোজ করতে।”
প্রিয়া ওর কথা শুনে আবারও হাসতে লাগল।
“বাদ দে, বাচ্চা ছেলে। বুঝেনি। হয়তো নাইন-টেনে পড়বে।”
“পেকে গেছে বেশি। অল্প বয়সে পাকলে কপালে দুঃখ আছে।”

রুশান দূর থেকে ওদের দেখে মুখ চেপে হেসে বলল,
“দেখছিস কত নির্দয়? ছেলেটা প্রেম নিবেদন করল আর কিভাবে রিজেক্ট করল?”
দর্শন ওর কথায় রেগে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তো কী করবে? যে সে প্রপোজ করবে আর তার সাথে ধেই ধেই করে প্রেম করতে চলে যাবে?”
“সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো আর যে সে না। আমাকেও তো পাত্তা দেয় না।”
“তোর মতো ছ্যাচড়া পোলাকে কেউ পাত্তা দিবে না। আর তাছাড়া ও আমাকে ভালোবাসে জানিস না?”
রুশান মুখ বাকিয়ে বলল,
“তুই তো আর বাসিস না। তাই আমিও হাল ছাড়ছি না। ওকে পটিয়েই ছাড়ব।”

….

দুপুর বেলায় অর্ষা ক্যানটিনে গেল। ওর আবার কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুধা লাগে। ব্যাগে সব সময় শুকনো খাবার রাখে এই কারণে। অর্ষা ক্যানটিনে অর্পা আর রুশানকে দেখে এগিয়ে গেল। ওরা দু’জন নাকি রিলেশনে নেই কিন্তু এত গলায় গলায় ভাব কী করে। ব্রেকাপের পর এত সুন্দর বন্ধুত্ব কী করে থাকে? ও তো শুনেছে ব্রেক আপের পর এক্সকে কালসাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাই অর্ষা সবটা দেখার জন্য ওদের কাছে গেল।
“হাই, অর্পাপু। কী করো এক্সের সাথে?”
অর্পা বিষম খেল। সাথে রুশানও। ও দাঁত কেলিয়ে বলল,
“কিছু না। আসলে একটা জরুরি টপিকে কথা বলছিলাম। সামনে পরীক্ষা তো।”
অর্ষা চেয়ার টেনে বসে বলল,
“তাই?”
“হ্যা, তাই তো। তাই না রুশান?”
রুশানও থতমত খেয়ে বলল,
“হ্যা, এখন আমি পিউর সিঙ্গেল। আমার সিট একদম খালি আছে। কারো লাগলে জানিও।”
তখনই দর্শন এসে আরেকটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর অর্ষার প্রতি রাগ,ক্ষোভ ঝেরে বলল,
“তুমি ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে হয়ে সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্টদের সাথে কী করো? কেন সব সময় আমাদের গ্রুপের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করো? বিশেষ করে ছেলেদের? কী দরকার তোমার হা?”

অর্ষা ওর কথা শুনে বাকরুদ্ধ। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। অর্পা আর রুশানও ওর ব্যবহার দেখে অবাক হচ্ছে। অর্পা কিছু বলতে গেলে দর্শন হাত উঁচু করে ওকে থামিয়ে বলল,
“তুই একদম তদারকি করবি না। তোর আশকারায় এত লাই পেয়েছে। লাই দিয়ে মাথায় তুলেছিস। তুই বোন পাতিয়েছিস সেটা পার্সোনাল লাইফে রাখবি। আমাদের গ্রুপে ওকে আনবি না। এরপর যেন ওকে আর গ্রুপে আনতে না দেখি। আর তোমাকে বলছি যদি লজ্জা বলতে কিছু থাকে তবে আমাদের পেছনে ঘুরঘুর করো না। দশ হাত দূরে থেকো।”
অর্ষা লজ্জায়, অপমানে কথা বলতে ভুলে গেল। ওর চোখে পানি ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে ছোট করে ঢোক গিলল। এত অপমান সহ্য করতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে খুব৷ হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যাকে ভালোবাসে সে কী বলছে এসব? সে কি জানে তার এই বাক্যে কতটা অপমান জড়িয়ে আছে? এতে ও কতটা আঘাত পাবে? অর্ষা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এত অপমান সহ্য করতে না পেরে এক দৌড়ে ওদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here