পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ সাতচল্লিশ

0
312

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ সাতচল্লিশ

একটু আগের বিয়ে বাড়িটা এখন মৃত বাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। চারদিকে শোরগোল, কান্নার শব্দ। কেমন হৃদয় কাঁপানো আহাজারি! টকটকে লাল রঙের বেনারসিতে আবৃত তৃণার শরীরটা এখন উঠনোর মাঝখানে রাখা। তাকে ঘিরে মানুষের মেলা। কত আফসোসের দীর্ঘশ্বাস! কিছুক্ষণের বিবর্তনে একটা জলজ্যান্ত পুতুলের ন্যায় মেয়েটার কেমন নিস্তব্ধতা! কেমন নির্জীবতা!

দর্শিনী কেবল তাকিয়ে আছে তৃণার মুখের দিকে। গত কাল রাতেও মেয়েটা কতই না আকুতি করেছিল ভালোবাসা রক্ষার্থে, অথচ আজ সে মেয়েটা স্থির! হাজার হাজার গল্পের ঝুড়ি নিয়ে পরে থাকা মেয়েটা আজ কথা বলছে না।

তৃণার বাবা আজ কাঁদছে, খুব করে কাঁদছে। নিজের অবাস্তবিক জেদের জন্য পুতুলের ন্যায় মেয়েটা কেমন ঝরে গেলো! সে টেরও পেলো না সে কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে? কেমন বাবা হলো সে? এত নিষ্ঠুর বাবা হয়!

নিপা কাঁপা কাঁপা পায়ে দর্শিনীর দিকে এগিয়ে আসে। তার শরীর আজ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। আরও কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে, সেই ভয়ে তার অন্তর আত্মা কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়েছে। চারপাশটা তার কাছে মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। যেখানে আরও কারো লাশ হওয়া বাকি।

দর্শিনী খেয়াল করলো ছোট বৌদির কাঁপুনি। আগলে নিলো মানুষটাকে। এতটা কাঁপছে কেনো মানুষটা!

নিপার ততক্ষণে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আসছে। কোনোমতে চোখ-মুখ উল্টে বললো,
“দৃষ্টান্ত টাও বোধহয় এমন নির্জীব পড়ে আছে, প্রিয়। ছেলেটাও বোধহয় নেই।”

আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলো না নিপা। পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিলো দর্শিনীর উপর। হঠাৎ এমন কথায় হতভম্ব দর্শিনী। ছোট বৌদির আশংকা টা খুব যে ভুল হবে না সেটাও তার মন জানে।

নিপাকে নিয়ে আরও হৈচৈ পড়লো। দর্শিনী মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে গিয়ে দৃষ্টান্তের কথা বলতেই আরেকবার অনাকাঙ্খিত ভয়ে কেঁপে উঠলো মৃত্যুঞ্জয়। ছুট লাগালো বন্ধুর খোঁজে। দর্শিনী কেবল তৃণার লাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি সুন্দর মেয়েটাকে লাগছে! এত মিষ্টি কেন! মৃত্যু বুঝি মানুষকে সুন্দর করে তুলে!

_

ভোরের কোমল আকাশ। মেঘ জমেছে খুব গম্ভীর করে। থম মেরে থাকা প্রকৃতির সাথে মানুষের অনুভূতি গুলোর কেমন বিপর্যস্ত অবস্থা! আহাজারির ভয়াবহতার পর সবটাই এখন নিশ্চুপ। শ্মশানে দাউ দাউ করে পুড়ছে দুটো লাশ। যাদের গতকালকেও মানুষ বলা হতো আজ তাদের পরিচিতি কেবল লাশ! গতকালকের ধূসর রঙের জামদানীটা এখনো দর্শিনীর শরীরে আছে তবে বেশ এলোমেলো।

এতক্ষণ মানুষজনে ভরপুর থাকলেও এখন কেউ নেই। সবাই চলে গেছে নিজ গন্তব্যে। দর্শিনীই কেবল যেতে পারে নি। কেন পারে নি সে জানে না। তবে এখান থেকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার হয় নি। সেদিন ছেলে-মেয়ে গুলোর অমন হৃদয় ভার করা বিচ্ছেদ দেখতে পেরেছে আর আজ একসাথে হওয়াটা দেখবে না! এই যে, বেঁচে থেকে একসাথে জীবন পার করতে পারবে না বলেই তো মৃত্যুর পথে হাতছানি দিলো, এমন মধুর মিলন সচক্ষে না দেখলে হবে!

দর্শিনী নিজের হাতের মাঝে থাকা দুটি চিরকুটের দিকে তাকালো। একটি তৃণার, অপরটি দৃষ্টান্তের। দু’জনই দু’জনের অপূর্ণতায় থাকবে না বলে বিদায় নিয়েছে অথচ মানুষ জাতি চাইলেই এ প্রাণ গুলোর ইচ্ছের পূর্ণতা দিতে পারতো।

দর্শিনী হতাশার শ্বাস ফেললো। নিপার ধারণাটাই ঠিক ছিলো। দৃষ্টান্তের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে পৃথিবীর বুক থেকে ছুটি নিয়েছে চিরতরে। তৃণার তো অভিযোগ ছিলো, তাকে কেউ ভালোবাসেনি অথচ দৃষ্টান্ত কোনো অভিযোগ না রেখেই বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়েছে। তৃণার আগেই পৃথিবী ছেড়েছে প্রেমিক পুরুষ। দৃষ্টান্তের মৃত্যুতে তত আহাজারি পড়ে নি। ছেলেটার তো কেউ ছিলো না, কে করবে আহাজারি! মৃত্যুঞ্জয়ের মা একটু কেঁদেছে, এই অবশ্য ঢের। ছেলেটা বেঁচে থাকতেও একা ছিলো, মৃত্যুর পরও যে কেউ তার নেই সেটা যেন আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।

ফ্যানের সাথে নির্জীব হয়ে কেমন ঝু*লে আছে! কোনো অভিযোগ নেই, অভিমান নেই ছিলো কেবল একরাশ বিষন্নতা।

দর্শিনী দু’চোখ ভরে কেবল দেখে গেলো এই মানুষ গুলোকে। কি শান্তিতেই না দু’জন চির নিদ্রায় নিদ্রায়মাণ! কোনো অশান্তি নেই, অপূর্ণতা নেই। অথচ এই দৃষ্টান্তের পুরো জীবনটাই অপ্রাপ্তির এক নিষ্ঠুর দীর্ঘশ্বাস।

হরমোহন ছেলের দাহ্যের কাজে কোনোরকম ত্রুটি রাখে নি। তার একমাত্র ছেলেকে খুব ধুমধামের সাথে দাহ্য করেছে। এক রাতের মাঝে চন্দন কাঠ সংগ্রহ করেছে। ম্যালা টাকা খরচ করেই দাহ্য কাজ সম্পন্ন করেছে। অথচ ছেলেটার জীবনে সবচেয়ে বড় ত্রুটিটাই ছিলো সে। মৃৃত্যুর পর চন্দন কাঠে শুইয়ে লাভ কি? যদি বেঁচে থাকতে সুখের নিদ্রা না হয়!

হরমোহন ছেলের মৃত্যুর পরের কাজ গুলোতে যতটা কর্মঠ ছিলেন, তৃণার বাবা ঠিক ততটাই নেতিয়ে ছিলেন। অবশেষে ভদ্রলোক কি মনে করে যেন মুখ খুললে। এই প্রথম, এই প্রথম সে মেয়ের আনন্দের কথা ভাবলেন। হরমোহনের কাছে হাত জোর করে আকুতি মাখা কণ্ঠে বললেন,
“আমার মেয়েটারে আপনার ছেলের পাশে জায়গা দিবেন, দাদা? একটু শান্তির সাথে পুড়ুক সে। দিবেন জায়গা?”

হরমোহন এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। শ্মশানে পাশাপাশি দু’জনকে রাখা হলো। এই মধ্য রাতের দিকেই গ্রামের আশপাশে থেকে মানুষ ছুটে এলো। প্রেমের এক অসাধারণ ইতিহাস দেখে নিলো নিজের দু’চোখ ভরে। সবার মুখে মুখে ছড়ালো, ভালোবাসা কতটা সুন্দর! অথচ এই ছেলেমেয়ে গুলোই যখন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিবাদ করেছে তখন মানুষ ভালোবাসার মুখে কত গুলো মিছে কালি লেপে কলঙ্কিত করেছে সেই বন্ধন। হায়রে মানুষ! হারানোর পর বোধহয় সবই সুন্দর মনে হয়।

আহাজারি, আহাজারিতে ভারী হলো প্রকৃতি। আগুন জ্বললো দুটি দেহে, হা হুতাশ করলো মানুষ। তারপর ভীর কমলো, আহাজারি কমলো কেবল কমলো না আগুনের ছাট। হয়তো একটু পর থিতিয়ে আসবে সেই আগুনও, সাথে স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হবে প্রেমের এই করুণ পরিণতিটাও। তারপর আবারও ছেলে-মেয়ে প্রেমে জড়াবে, বাবা-মায়ের মিছে জেদ জাগবে তারপর অকালো ঝরবে আরও প্রাণ। এভাবেই নিত্য নতুন ভাবেই পুরোনো ঘটনা চলতেই থাকবে। প্রকৃতির কি নিয়ম!

আগুন থেকে উঠা ধোঁয়া গুলো আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে। দর্শিনী তার পাশে থাকা শুকনো ভেঙে পড়া একটা গাছের ডালে বসলো। দৃষ্টান্তের চিঠিটা মেলে ধরলো চোখের সামনে। এই চিঠিটা দর্শিনী কাউকে দেখায় নি। খুব গোপনে সরিয়ে নিয়েছে। তার কেন যেন মনে হয়েছে, এই চিঠির যোগ্য ব্যাক্তি সেখানে নেই। সে নিজেও হয়তো যোগ্য না, তবুও সে খুললো, দৃষ্টান্তের হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি গুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য চোখ রাখলো চিঠির শব্দ কণিকায়। নীল রঙের কলম দিয়ে লিখা,

“দু-চোখ আমার অন্ধ হোক,
বন্ধুর পাশে অন্যলোক–

কে জানতো জীবনটা গানের লাইন হয়ে রবে! বন্ধুর পাশে অন্যলোক দেখার মতন ভাগ্য নিয়ে আসবো, সোটাও বা কে জানতো? এই বিশাল পৃথিবীতে একা থাকার যে কি ভিষণ কষ্ট, কাকে জানাবে সে কথা? আমার যে কোথাও কেউ নেই। ছেলেদের কাঁদতে নেই বলে অনুভূতি প্রকাশ করাও বারণ আমাদের, কাকে জানাবো ভেতর আমার জ্বলে যাচ্ছে! খুব ছোট বেলায় যখন মাকে হারাই, সৎ মায়ের প্রথম চ*ড় খেয়েই বুঝেছিলাম জীবন এত সহজ না। কে জানতো জীবন যে এতটা কঠিন? আমার জীবনে প্রথম নারী আমার মা, যাকে হারিয়েছে সেই ছোট বেলায়, যখন হারানোর অর্থ জানতাম না। মা হারানোর পর বাবাকেও কেমন অপরিচিত মনে হলো। এই পরিত্যক্ত জীবনটা নিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দ্বিতীয় বারের মতন হারিয়েছি জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে। কতই না পাগলামি করেছি সেই ভালোবাসা আঁকড়ে রাখার জন্য! কারণ ততদিনে হারানোর অর্থ আমার খুব ভালো করে জানা হয়ে গিয়েছিলো। আটকাতে পারি নি তাকে। র*ক্তাক্ত হয়ে ফিরেছিলাম। কত রাত ঘুমাই নি, অগোচরে ভিজিয়ে ছিলাম বালিশ, কেউ জানবে না সে খবর। আমার উদ্দেশ্য বিহীন জীবনে হুট করেই দখল করলো আমার তৃণাবতী। আরেকবার, আরেকবার ভালোবাসা দহনে ঝাঁপ দিলাম। ভেবেছিলাম এবার আর পুড়বো না। কিন্তু আমি ভুল। বিশাল এই অপ্রাপ্তির জীবনে আমার যে প্রাপ্তি মিলবে না সেটা প্রায় ভুলতেই বসে ছিলাম। আরেকবার তাই হৃদয়ের ক্ষতটা জাগিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম আমার জীবনের শেষ ভালোবাসাকে। হ্যাঁ, তৃণাবতীই আমার শেষ ভালোবাসা। যাকে হারানোর আগেই আমি হারাবার ভয়ে থাকতাম। যাকে হারাবো না বলে নিজের বাবার পা ধরেছি। আকুতি করেছি প্রেমিকার বাবার পা ধরেও। অতঃপর শূন্য থালা নিয়ে ফিরে গেছি আমার শূন্যতা ভরা আঙিনায়। গোটা পৃথিবী আমায় কলঙ্কিত প্রেমিক বলবে। যে প্রেমিক আটকে রাখতে জানেনা ভালোবাসা। এই কলঙ্ক নিয়ে আদৌও বেঁচে থাকা যায়? তৃণাবতী শুনছো, তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি। এই যে দেখো, নিজের জীবনের চেয়ে বেশি। প্রেমিকের অশ্রু নিয়ে প্রেমিকা ভালো থাকতে পারে না। তাই তো চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো তৃণাবতী। তৃণাবতী ছাড়া যে আমাকে কেউ ভালোবাসে নি।”

চিঠি শেষ। দৃষ্টান্তের অনুভূতি গুলো কেমন খড়খড়ে! যার আঁচ কেউ পায় নি কখনো। দর্শিনী হুট করেই কেঁদে উঠলো। দৃষ্টান্তের জন্য তার কান্না আসছে। আকাশ-পাতাল এক করে কান্না যাকে বলে। ছেলেটার হাহাকার কেউ দেখে নি। কতটা যন্ত্রণা পুষে একজন মানুষ ভালো থাকে? ভালোবাসা এমন কেন? তরতাজা দু’টি প্রাণ কেমন ছিনিয়ে নিলো। এত নিষ্ঠুর কেন ভালোবাসা!

কান্নার এক পর্যায়ে দর্শিনীর হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। অবাক চোখে তাকাতেই মায়ার নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। এত ভোরে মেয়েটা কল দিয়েছে কেনো! তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ার উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সই, ভালো আছো?”

দর্শিনী অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এত সকালে যে! কিছু হয়েছে?”

“আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হচ্ছে। আশীর্বাদ করো, সই। কিডনির ডোনার পাওয়া গিয়েছে।”

দর্শিনী হা হয়ে রইলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“আজ তোমার অপারেশন? ডোনার কে জোগাড় করলো?”

“হৈমন্ত ভাই।”

মায়ার অকপটে স্বীকারোক্তিতে থমকালো দর্শিনী। কিছুক্ষণ মৌন থেকে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। মনে করো, তুমি ফিরে আসলে, কারো গোটা পৃথিবী জয় করা হবে।”

অপর পাশের ব্যস্ততা কানে আসতেই ফোন কাটলো দর্শিনী। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। দর্শিনী খেয়াল করলো সে বাদে এখানে আরেকজন উপস্থিত। নিপা বৌদি! যে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত অগ্নি শিখার দিকে। বিড়বিড় করে বলছে,
“আমি তোমায় রোজ নিয়ম করে ভালোবাসি, দৃষ্টান্ত।”

দর্শিনী হাসলো। ভালোবাসার সংজ্ঞা ঠিক কেমন হওয়া উচিত আসলেই তার জানা নেই। কেউ ভালোবাসা না পেয়ে মরছে, কেউ ভালোবাসার জন্য পৃথিবী থেকে পাপ লুকাচ্ছে আবার কেউ যুগের পর যুগ আস্ত ভালোবাসা পুষে রেখে আরেকজনের সংসার করছে। ভালোবাসার এত বৈচিত্র্যতা! তবুও ভালোবাসা সুন্দর।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here