পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা বিচ্ছেদ বিবরণঃ ৪৫+৪৬

0
307

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

বিচ্ছেদ বিবরণঃ ৪৫+৪৬

অন্ধকার ঘরটাতে কিঞ্চিৎ আলো আসছে বাহিরের উঠোন থেকে। এ আলো ই যেন যথেষ্ট একেক জনের মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি দেখার জন্য। চারজন নারী ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। একটু আগের চ*ড়ের পর এখন তুমুল নিরবতা। আক্রোশে শরীর কাঁপিয়ে ধমকে উঠে নিধি, দর্শিনীকে শাসানির স্বরে বলে,
“তুমি নিজে তো কখনো সংসার করতে পারো নি, প্রিয়। তাই বলে আমার বোনটাকে পালানোর বুদ্ধি দিবে?”

দর্শিনীর জবাব দিতে হয় না। নিধির কথার বিপরীতে নিপা মুখ খুলে। অবাক কণ্ঠে বলে,
“তোমার এমন রূপ বদলের খেলায় আমি হতবাক, বড়দি। প্রিয়কে ছোট-বড় যা কথা-ই বলো অন্তত আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজের বোনের কথা ভাববে। অথচ না, তুমি তো পাষ*ণ্ডী। আর তৃণাকে পালিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি আমিই দিয়েছিলাম দর্শিনী তো কেবল দাঁড়িয়ে ছিলো। তোমার কী সব ব্যাপারে ওরে না টানলে হয় না?”

“বাহ্ রে বাহ্ ছোট, তুই অবশেষে আমার শত্রু হচ্ছিস! আমার ভালো টা তোদের সহ্য হয় না, তাই না?”

শেষ বাক্যটুকু বলার সময় নিধির কণ্ঠে রুক্ষতার চেয়ে সিক্ততা বেশি ছিলো। কণ্ঠটাও কেঁপে উঠেছিলো। আঁধার ছাপিয়ে তার গালের রঙহীন অশ্রু গুলো দেখা গেলো। অথচ কারো মায়া হলো না সে অশ্রু দেখে। বরং নিধির প্রতি খুব সুক্ষ্ম বিরক্তবোধ অনুভব করলো সবাই। অতঃপর দর্শিনীই বললো,
“তোমার কোন ভালোতে আমরা বেগড়া দিয়েছি, বৌদিভাই? নিজের মন মতন কত সাত-পাঁচ ভেবে নিচ্ছো আর আমাদের তুমি নিজেই শত্রুপক্ষ বানিয়ে দিচ্ছো। অথচ আমরা তা না। তোমার ভাবনাচিন্তা আমরা বদলাতে পারবো না, তবে সাবধান করছি, তোমার ঐ হাত দিয়ে একদিন স্নেহের পরশ দিয়েছিলে আমায় তাই আজ অন্যায় ভাবে মেরেছো বলেও প্রতিবাদ করলাম না। কিন্তু ভবিষ্যতে একই ব্যাপার রিপিট হলে আমি বাধ্য হবো অন্য পদক্ষেপ নিতে।”

দর্শিনীর কথার ধরণ বেশ গায়ে লাগলো নিধির। আর কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দর্শিনীর ক্ষানিকটা বুক কাঁপলো, খুব গোপনে ডান চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রুর দানা ঝরে পড়লো নিঃশব্দে। কিন্তু তা আঁধারেই রইলো। সে তার বিশাল জীবন থেকে অন্তত এতটুকু শিখেছে যে, আলোর মাঝে কান্না করে নিষেধ। মানুষ দুর্বল পেলে ভেঙে দিয়ে যাবে।

নিধি বের হতেই ছোট্ট শ্বাস ফেললো নিপা। ক্লান্ত কণ্ঠে তৃণার উদ্দেশ্যে বললো,
“কী করবে এখন, তৃণা? পালানোর পথ নেই।”

“আমি এমনেতেও তো পালাতাম না, ছোটবৌদি।”

তৃণার সহজ,সরল, স্বাভাবিক উত্তরে অবাক হলো নিপা। মেয়েটা দৃষ্টান্তকে তো পাগলের মতন ভালোবাসে, তাহলে এমন কথার কারণ!

নিপা দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কেনো পালাবে না? তুমি না দৃষ্টান্তকে ভালোবাসো?”

“হ্যাঁ, বাসি। আবার আমি আমার বাবা-মা কেও ভালোবাসি৷ এক পক্ষের জন্য আমি দ্বিতীয় পক্ষের অমর্যাদা করতে পারবো না। আর আমি দৃষ্টান্তকে যতটুকু চিনি, ও রাজি হবে না কখনো।”

নিপা হাতাশার শ্বাস ফেললো। সত্যিই দৃষ্টান্ত রাজি হতো না। এই দৃষ্টান্ত আর আগের মতন নেই। আগের দৃষ্টান্ত হলে এতক্ষণে বাড়ি মাথায় করতো, অথচ এই দৃষ্টান্ত ঘরের কোণায় চুপ করে বিষাদ উড়াচ্ছে। এটাকেই বোধহয় বলে পরিবর্তন! তবে ছেলেটা তো আর কম চেষ্টা করলো না, যে বাবার মুখদর্শন করে নি এতবছর, সে বাবার কাছে মাথা নত করে ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়েছে, তৃণার বাবার পা ধরেছে। সবটাই সে জানে। কারণ দিন শেষে দৃষ্টান্তরে খুব গোপন তথ্য লুকানোর বাক্স যে সে! দর্শিনীও তো তৃণার হবু স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো কিন্তু তাকে দেখা করতে দেওয়া হয় নি। সবটাই যে উল্টো স্রোতে যাচ্ছে।

দর্শিনী তৃণার কাছে এলো, খুব ধীরে তৃণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তৈরী হয়ে নে। এ ছাড়া আর কিইবা করবি! জীবন যেদিকে ভাসাচ্ছে, আপাতত সেদিকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।”

কথা থামলো, দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো আঁধার। মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত!

_

গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান খুব দ্রুতই যেন শেষ হয়ে গেলো। একদম প্রাণহীন অনুষ্ঠান। কোনো আনন্দ নেই, উচ্ছ্বাস নেই কেবল হতাশা। রাত প্রায় পৌনে বারোটা। বিয়ে বাড়িটা এখন নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ আগের কোলাহল এখন আর নেই। সব চুপচাপ, স্তব্ধ রজনী।

দর্শিনী নিপার জন্য ভালো একটা ঘুমানোর ব্যবস্থা করে তবেই ক্ষান্ত হলো। গতকাল তারা যে একটি সুখবর পেয়েছে। নিপারও কোল আলো করে একজন আসতে চলেছে। সেই জন্যই দর্শিনীর মা তাকে নিয়ে গ্রামের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো। গতকাল রাতে বাড়িতে ছোটখাটো একটা আনন্দের স্রোত অবশ্য বয়ে গিয়েছিলো। এতদিন পর অবশেষে এত এত প্রার্থনা সফল হলো।

পুরো বাড়ি যখন ঘুমে ডুবে রইলো দর্শিনী তখন পা বাড়ালো তৃণার ঘরের দিকে। মেয়েটা আজ একা ঘুমানোর বায়না ধরেছে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ঘুমানোর জায়গা নেই অথচ সে তার রুমে কাউকে ঠাঁই দেয় নি। দর্শিনী জানে একা রুমে থাকার সিদ্ধান্তটা কেবল আবদারের জন্য না, একাকিত্বকে খুব গোপনে অনুধাবন করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত।

তৃণার ঘরের সামনে আসতেই পা থেমে যায় দর্শিনীর। মেয়েটার ঘরের লাইট জ্বলছে। ভেতর থেকে ধীর কণ্ঠের শব্দ শোনা যাচ্ছে অথচ সবাই ঘুমে! দর্শিনী কোনোরূপ শব্দ না করেই ধীর পায়ে উত্তরের জানালার দিকে এগিয়ে গেলো। জানালাটা খোলা। জানালা দিয়েই তৃণার ঘরের গতিবিধি বুঝা যাবে।

জানালার দিকে তাকাতেই দর্শিনীর চক্ষু চড়কগাছ। ঘরে টিভি চলছে কিন্তু কোনো জনমানসের চিহ্ন নেই। মেয়েটা গেলো কোথায়! দর্শিনী আবার দু’কদমে তৃণার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজার মাঝে বেশ জোর প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়েও কাজ হলো না, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দর্শিনীর অবাক ভাবটা আরও বাড়লো। ভিতরে কেউ নেই অথচ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কীভাবে! হঠাৎ স্মৃতির পাতায় ঝাপসা কিছু ভেসে উঠতেই চমকে গেলো সে। তবে কি তৃণা পালালো! তার জানামতে তৃণার ঘরের পেছন দিকে একটা দরজা আছে যেখান দিয়ে বারান্দা করে লাগোয়া বাথরুম করে দিয়েছে তৃণার বাবা যেন মেয়ের রাত বিরাতে অসুবিধা নাহয়। সেই বারান্দা দিয়ে বের হলেই উত্তরের মাঠ, মাঠের শেষে বড় রাস্তা।

দর্শিনী আর কাল বিলম্ব না করেই চুপসারে বাড়ির বাহিরে বের হয়ে গেলো, কারণ তৃণার বারান্দায় যেতে হলে বাড়ির বাহির দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। দূর থেকে শিয়ালের অনবরত ডাকে রাতটা আরেকটু নিশ্চুপ হলো, ছমছমে ভাবটা আরেকটু বাড়লো। কেমন রোমাঞ্চকর ভাব খেলে গেলো শরীর দিয়ে। ঠিক এই মুহূর্তে দর্শিনীর খুশি হওয়া উচিত, না ভয় পাওয়া উচিত, সে বুঝতে পারলো না। কেবল এতটুকু মনে হলো, যা ভাবছে তা হলে ভীষণ খারাপ কিছু হবে না। ছেলে-মেয়ে দুটি তো খুশি হবে।

বাড়ির পিছনে চাঁদের আলোর ঝিলিকে কেমন ঝলমলে সুন্দর লাগছে মাঠটা! কেউ বলবে এটা মধ্যরাত! ঠিক যেন মিষ্টি ভোর। আবেশ মাখানো বুকপকেটে যেন কেউ খুব যতনে এঁকে রেখেছে রজনীর ক্যানভাস। ভীষণ সুন্দর! ভীষণ তুলতুলে। হঠাৎ দর্শিনীর নজর আটকে যায় মাঠের কোণায় বটগাছটার দিকে। বটগাছে ঘেরা প্রাচীরের উপর কেউ একজন বসে আছে। নারীদেহের আকৃতি। সেই নারীদেহের পাশ ঘেষেই দাঁড়িয়ে আছে এক সুঠাম দেহী পুরুষ। দর্শিনী আরও একটু এগিয়ে যায় কৌতূহলবশত। সে ধারণা করতে পেরেছে এখানে কারা অবস্থানরত, তবুও সেখানে কী হচ্ছে দেখার জন্য সে আরও কয়েক কদম এগুলো। ঝাপসা নারী-পুরুষ দেহ এখন স্বচ্ছ হয়েছে। চাঁদের আলোয় তৃণার কোমল মুখ খানা দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর, কি স্নিগ্ধ। গায়ের হলুদের সাজ আগের মতনই আছে। একটুও ঘেটে যায় নি। দৃষ্টান্ত একটা সাদা ফকফকা টি-শার্ট শরীরে জড়িয়েছে।

হঠাৎ দর্শিনী হা হয়ে গেলো সেখানে ঘটা দৃশ্য দেখে। দৃষ্টান্ত খুব যতনে তৃণার গালে কপালে কি যেন মেখে দিচ্ছে। আরেকটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো হলুদের বাটি। কি যত্নে সে বাটি থেকে হলুদ নিয়ে মাখিয়ে দিচ্ছে৷ প্রেমিকা কাঁদছে আর প্রেমিক পরম আবেশে প্রেমিকার শরীরে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে তাও অন্য পুরুষের নামে। এমন করুণ, নির্মম দৃশ্য কেনো জন্ম নেয় পৃথিবীতে! কেনো প্রেম হারায় জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাসে! দর্শিনী খুব মনযোগ দিয়ে দেখলো সেই বিচ্ছেদ ক্ষণের প্রেম। ছেলে-মেয়ে দুটো কাঁদছে। হৃদয় নিংড়নো কান্না। কি যন্ত্রণা!

দৃষ্টান্ত হলুদের শেষ অংশ টুকু দিয়ে ক্ষান্ত হলো। তৃণার নিরব কান্না সরব হলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো দৃষ্টান্তের গলা। মুখ লুকালো বক্ষ মাঝে। প্রেমিকার চির প্রশান্তি যে প্রেমিকের বুকের পাজরের ধুকপুক শব্দ। এই পরিচিত বুকের মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়া হবে না আর। সময়ে-অসময়ে আর জাপ্টে ধরা যাবে না এই বক্ষ পাঁজর, এটাই যেন যথেষ্ট ছিলো প্রেমিকার কান্না আরও দ্বিগুণ বাড়ানোর জন্য। সাথে যোগ হলো প্রলাপ। ক্রন্দনরত স্বরে সে অনবরত বলে চলছে,
“আপনারে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারবো না, ডাক্তার সাহেব। নিয়ে যান না আপনার সাথে। আপনারে ছাড়া আমি নিজেরে কল্পনা করতে পারি না। আমার দমবন্ধ হয়। মরে যাবে যে। আমাকে একটু বাঁচিয়ে নিন না, ডাক্তার সাহেব।”

দৃষ্টান্ত খুব শক্ত রইলো। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, এই মেয়েটাকে সে দুর্বলতা দেখাবে না। তৃণার হাতের ব্ঁধন আরেকটু শক্ত হলো। শক্ত করে চেপে ধরলো দৃষ্টান্তের পিঠের জামাটুকু। যেন আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। সে কোনো মতেই তার এত জীবনের আগলে রাখা ভালোবাসা যেন ছাড়বে না। কিছুতেই না।

দৃষ্টান্ত খুব ধীরে হাত বুলিয়ে দিলো তৃণার মাথায়। আদুরে স্বরে বললো,
“কাঁদে না, তৃণাবতী। মাথা ব্যাথা করবে না? অসুস্থ হয়ে যাবে তো।”

দৃষ্টান্তের কথার বিপরীতে তৃণার অস্ফুটস্বর ভেসে এলো,
“আপনারে ছাড়া বেঁচে থাকাটাই আমার আজীবনের অসুস্থতা, সেই অসুস্থতা নিয়ে বাঁচবো কেমন করে, ডাক্তার সাহেব? আজীবনের অসুস্থতা নিয়ে বেঁচে থাকাটা যে কি কষ্টের! মৃত্যু এর চেয়ে শ্রেয় যে।”

“অসুস্থতা কী একা তোমার হবে? আমার হবে না! আমি যেমন করে বাঁচবো, তুমিই বাঁচবে তেমন করে। বেঁচে থাকতে হবে, ভালো থাকতে হবে তোমাকে।”

কথা থামলো, কান্নার শব্দে ভারী হলো প্রকৃতি। এই বিচ্ছেদের সাক্ষী হলো খোলা মাঠ, দিকশূন্য আকাশ, নিরব প্রকৃতি আর বিচ্ছেদের ভার বহন করা দর্শিনী।

হুট করে চুপচাপ থাকা তৃণা কেমন উন্মাদ হয়ে উঠলো। দৃষ্টান্তের মুখমন্ডল তার দু’হাতের আজলে নিয়ে বলে লাগলো,
“আমি আপনারেই আমার স্বামী মেনে এসেছি। আপনিই আমার স্বামী। একজনরে মনে সাজিয়ে রেখে আরেকজনরে কীভাবে নিজের মালিকানা দিবো? কীভাবে? আমি পারবো না, ডাক্তার সাহেব। অমন অন্যায় করতে পারবো না।”

উন্মাদ প্রেয়সীকে দেখে আর বাঁধ মানলো না দৃষ্টান্তের অশ্রুকণা। নিজের অঢেল অশ্রুর তোয়াক্কা না করেই তৃণাকে বুঝাতে শুরু করে। মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“এমন করে না। তুমি এমন করতে থাকলে আমার যে আরও কষ্ট হবে। এমন করো না প্লিজ।”

প্রেমিকের অশ্রু সহ্য হলো না প্রেমিকার। বারংবার মুছে দিতে দিতে বললো,
“আমার শরীরে প্রথম ছোঁয়া আপনারই হবে, ডাক্তার সাহেব। আমাকে গ্রহণ করুন। আমি মরে যাবো নাহয়। অন্তত আপনার ছোঁয়া গুলো তো জানান দিবে আপনি আছেন আমার সাথে। আমাকে ছুঁয়ে দেন। আলিঙ্গন করুণ গভীরে। আপনার ছোঁয়া যেন আর অন্য কোনো পুরুষ মুছে দিতে না পারে। আমাকে গ্রহণ করুণ।”

প্রেয়সীর এমন অনাকাঙ্খিত কথায় হতভম্ব দৃষ্টান্ত। মেয়েটা কি পা*গল হলো! মাত্রই তো দুঃখের সাগরে তরী ভাসিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি পাগল হলে হবে!

তৃণার পাগলামো ততক্ষণে সীমা ছাড়িয়েছে। দৃষ্টান্তের গাল,মুখ ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে খালি। দৃষ্টান্ত বুঝাচ্ছে, কিন্তু বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। তৃণা শুনছেই না কিছু। পাগলামো মাত্রাতিরিক্ত হতেই সশব্দে চ*ড় পড়লো। তৃণা শান্ত হলো। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো দৃষ্টান্তের দিকে।

দৃষ্টান্ত হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ভেসে এলো। দু’হাতের আঁজলে মুখ ঢেকে বললো,
“তুমি পবিত্র তৃণাবতী। ফুটন্ত ফুলের ন্যায় পবিত্র। তোমায় আমি ছুঁয়ে দিয়ে সে পবিত্রটা নষ্ট করতে পারি না। কখনোই না। চাঁদের কলঙ্ক থাকবে কিন্তু আমার তৃণার কলঙ্ক থাকবে না। আমার পবিত্র তৃণাকে আমি কী করে অপবিত্র করবো বলো? আমাদের ভালোবাসা কী ঠুনকো নাকি?”

“আপনি আমাকে তো অপবিত্র করবেন না। আপনিই তো আমার স্বামী। যারে এতগুলো বছর আমি হৃদয়ে পুষে রাখছি।”

তৃণার কথার বিপরীতে দৃষ্টান্ত ডানে-বামে অনবরত মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগলো,
“না, তৃণাবতী। আমি তোমার জীবনে কাল থেকেই কেবল পরপুরুষ হয়ে রবো। তোমাকে মানতে হবে এ সত্যি। আমি তোমার জীবনে পরপুরুষ ছাড়া কিছু না।”

তৃণাও হাঁটু গেড়ে বসলো, জড়িয়ে ধরলো মানুষটাকে। প্রেমিক থেকে পরপুরুষ হওয়ার গল্প এত যন্ত্রণা দায়ক কেনো? এত ভয়ানক কেনো? কেনো এত কাঁদতে হয়? যদি প্রেমিক ভাগ্যেই না থাকে তবে প্রেম গড়েছে কেনো? বিচ্ছেদ নামক বি*ষ সহ্য করে বেঁচে থাকার জন্য!

দর্শিনী আর দাঁড়ায় না। পথ ধরে নিজের গন্তব্যে। আজ কত গুলো দিন পর তার বুক ভার করা বিচ্ছেদের কথা মনে পড়লো। সেও তো ভালোবাসতো। বিচ্ছেদের স্বাদ সেও পেয়েছে। কি বিষাক্ত সে স্বাদ! তবুও তো তৃণা আর দৃষ্টান্ত এতটুকু জানবে যে ওরা দু’জনই দু’জনকে ভালোবেসেছে। অথচ দর্শিনীর ভাগ্যে সেটাও নেই। কেউ ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না বলে কাঁদে, আর কেউ পেয়েও অবহেলায় হারায়।

দর্শিনী হাসলো। গালের মাঝে লেপ্টে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছে ছোট কণ্ঠে গান ধরলো,
“আমরা প্রেম করিলাম দুইজনে হায়,
প্রেম করিলাম দুইজনে হায়
আমি একলা পুইড়া হইলাম ছাঁই,
তোমার মনে নাই রে, বন্ধু
তোমার মনে নাই।”

_

গোটা একটা দিন ব্যস্ততায় গিয়ে রাত নামলো ধরণীর বুকে। যে রাত লিখবে নতুন এক বিচ্ছেদের গল্প।

তৃৃণাদের বাড়ি ভর্তি মেহমান। তৃণার বাবা অথিথি আপ্যায়নে নিজের সবটুকু শ্রম দিয়ে যাচ্ছে৷ সাদা পাঞ্জাবিটা ঘামে পিঠের সাথে লেপ্টে আছে। ক্ষানিক বাদে বাদে ধুঁতি ঠিক করছে। মেয়ে বিয়ে দেওয়া কি আর চারটি খানি কথা? রাজ্যের দায়িত্ব। কথায় আছে, কন্যার ভার সবচেয়ে বড় ভার।

হাসি,ঠাট্টায় আলোকিত চারপাশ। গ্রামের মানুষ, আত্মীয় স্বজনের ভীড় পুরো বাড়িময়। ব্যস্ত পায়ে সবাই এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। একটু পরই জামাই আসবে অথচ এখনো কুঞ্জ সাজানো হয় নি বলে কতক্ষণ রাগারাগি করলেন তৃণার বাবা। সবাই ব্যস্ত। কিন্তু কনের মায়ের যেমন ব্যস্ততা থাকা উচিত বা যেমন ব্যস্ত থাকা উচিৎ, তেমন ব্যস্ততা দেখা গেলো না রমলা মানে তৃণার মায়ের ভেতর। সে সবকিছুতেই নির্জীব হয়ে আছে। কেমন ছন্নছাড়া ভাব। সবারই অবশ্য চোখে লাগছে এ বিষয় টা কিন্তু কেউ বিশেষ গ্রাহ্য করলো না।

দর্শিনীর আজ শরীরটা বেশ খারাপ। হাত-পায়ে জল উঠেছে। পা গুলো কেমন ফুলে গেছে! গর্ভকালীন সময়টা সে নির্ভেজালই পার করেছে, অথচ শেষ মুহূর্তে এসে সমস্যার সম্মুখীন হলো। নিজের শরীর অসুস্থতার জন্য তৃণারও আজ খোঁজ নেওয়া হয় নি। তবে আজ মেয়েটাকে বেশ হাসি-খুশি লেগেছে। এতটা হাসি-খুশি থাকাটা অস্বাভাবিক লাগলোই বেশ ভালো লাগছে। নিজের ভবিতব্যকে মেনে নেওয়াই চরম বুদ্ধিমত্তার কাজ। তৃণার চেহারায় আলাদা উজ্জ্বলতাও খেয়াল করা যাচ্ছে। নারী স্বত্তা পূর্ণতা পেলে যেমন উজ্জ্বল হয়, ঠিক তেমন। তবে কি! দর্শিনী তার ভাবনা আর আগায় না। যে প্রেমে বিচ্ছেদ অবধারিত সে প্রেম নিয়ে ভাবনা কেবল মিছে আস্ফালন।

ধূসর রঙের জামদানীটা শরীরে এলিয়েই ক্লান্ত হলো দর্শিনী। আজ এত ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। কোনো রকমের প্রসাধনী ব্যবহার না করেই সে উঠে দাঁড়ালো। উঠোনে মানুষে গমগম করছে।

ভারী শরীরটা নিয়ে উঠোনে দাঁড়াতেই পাশে হাজির হলো মৃত্যুঞ্জয়। কতক্ষণ পা হতে মাথা অব্দি পরোক্ষ করেই বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“হাত পায়ে জল উঠেছে দেখি!”

দর্শিনী এক পলক তাকালো পাশে দাড়ানো পুরুষটির দিকে। সাদা শার্টে বেশ সুপুরুষ লাগছে। মোহনীয়!

মৃত্যুঞ্জয় দর্শিনীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হলো? পা-হাত যে এমন ফুলেছে, জানান নি তো!”

“জানানোর মতন ব্যাপার না, তাই জানাই নি। দৃষ্টান্ত’দা কোথায়?”

মৃত্যুঞ্জয় ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটা ত্যাড়া কথা ছাড়া যেন কথা বলতে পারে না। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
“দৃষ্টান্ত বাড়িতে আছে। জোড় করি নি আসার জন্য। থাকুক, যন্ত্রণা বাড়িয়ে লাভ কি!”

দর্শিনী আর কিছু না বলে ধীর পায়ে তৃণার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আজ হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। নিজের ডান হাতে একটা শক্তপোক্ত হাতের আভাস পেতেই চমকে উঠলো দর্শিনী। পাশ ফিরে তাকাতেই বেশ স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুঞ্জয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।

দর্শিনী কপাল কুঁচকালো, বিরক্ত স্বরে বললো,
“হাত ছাড়ুন। মানুষ দেখবে।”

“আপনার তো যন্ত্রণা হচ্ছে, সেটা মানুষ যেহেতু দেখছে না তাই সে মানুষ কি দেখবে না দেখবে তার পরোয়া আমি করি না।”

মৃত্যুঞ্জয়ের কাঠ কাঠ জবাবে কোথাও যেন একটা ভালো লাগা কাজ করলো। দর্শিনী কথা বাড়ালো না। নিরব সম্মতিতে চললো তৃণার ঘরে।

তৃণার ঘরে গুটি কয়েক মানুষ। তৃণার বাবা, মা আর নিধি। দর্শিনী দরজা অব্দি গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো। তার হঠাৎ করেই মনে হলো এই মুহূর্তে এই ঘরে যাওয়া টা তার উচিৎ না। দর্শিনী দাড়িয়ে পড়তেই মৃত্যুঞ্জয়ও দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘরে উপস্থিত মানুষের কথা শুনে সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

তৃণার বাবা মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলাতেই ডুকরে উঠে মেয়ে। বাবাকে জাপ্টে ধরে বলে,
“তোমারে আমি অনেক ভালোবাসি, বাবা।”

তৃণার বাবাও আর শক্ত থাকতে পারলেন না। মেয়েকে ধরে মাথায় হাত বুলাতেই থাকে। রমলা কেমন করে যেন মেয়ে দিকে তাকিয়ে থাকে, দৃষ্টি তার নিষ্প্রাণ।

কতক্ষণ বাঁধ ভাঙা কান্নার পর শান্ত হয় তৃণা। ধীর পায়ে নিধির দিকে তাকিয়ে থাকে। এক, দুই করে কয়েক মিনিট পেরুতেই তৃণার নিশ্চুপ কণ্ঠ কথা বলে উঠে। টলমল চোখে, তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট নিয়ে বললো,
“আমি তোমারেও ভালোবাসি দিভাই। অনেক ভালোবাসি। আমি মায়ের পরে আরেকটা মা পেয়েছি, সেটা তুমি। মাটির বুকে পা রাখলেও মাটি হয়তো আর্তনাদ করতো, কিন্তু তুমি কখনো করো নি। কিন্তু হুট করেই কেমন যেন পাথর হয়ে গেলে তোমরা। এমনটা তো কথা ছিলো না। যার সাথে একসময় দুঃখ ভাগ করে নিতাম আজ সে-ই দু’হাত দান করে আমায় দুঃখ উপহার দিলো। জানো দিভাই, আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে। বুক ব্যাথা করার মতন কষ্ট। সব কষ্টের শেষ থাকলেও এ কষ্টের শেষ নাই গো, দিভাই। আমি যে সইতে পারছি না! তবে যাই হোক, তুমি কিন্তু আমার জন্ম জন্মান্তরের সই। অনেক ভালোবাসি।”

নিধি বোনকে আগলে নিতে গেলে দু’কদম পিছিয়ে যায় তৃণা। কি যেন বলে তার চোখ কিন্তু সে ভাষা কেউ বুঝে না। কেবল তার বাহ্যিক অশ্রুবিন্দু গুলো সবার হৃদয় মন্দিরে কড়া নাড়ে। কি যন্ত্রণার সে অশ্রু!

দর্শিনী আর ঘরে প্রবেশ করে না। উঠোনে এসে দাঁড়ায়। তার মিনিট কয়েক বাদেই তৃণার ঘর থেকে সবাই বের হয়ে আসে। যে যার মতন ব্যস্ত হয়ে পরে কোলাহলে কিন্তু মনের মাঝে কেমন ধারালো অনুশোচনা যেন ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। সেই অনুশোচনা নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাস্তবতায়। কিছু মানুষ আছে যারা অনুশোচনা স্বীকার করতে চায় না, যা তাদের জীবনে এক দারুণ ভুল হয়ে থেকে যায়।

তন্মধ্যেই উঠানে বর এসে হাজির হয়। কোলাহল বাড়ে। ক্রন্দনরত কন্যার মুখ ততক্ষণে ভুলে যায় সবাই। বরকে যখন বিয়ের আসরে বসানো হয় তখন সবার স্মরণে আসে কন্যার কথা। তৃণাকে ডাকতে গেলে দেখে তার ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। এক, দুই করে পুরো বাড়ির মানুষের মুখে ছড়িয়ে যায় সে কথা। সবাই ছুটে আসে দরজার দিকে। সবাই অনাকাঙ্খিত ভয়ে কেঁপে উঠে। ভিতরে কী হতে পারে এটা যেন সবারই বেশ ভালো করেই বোধগম্য। অথচ আগে তারা সচেতন হলো না।

বিয়ের বাড়ির হৈচৈ বাড়লো। তৃণার দরজায় একের পর এক ধাক্কা চললো। অবশেষে দরজা ভাঙতে সক্ষম তারা। দরজা ভাঙতেই একেক জনের চক্ষু চড়কগাছ। বিয়ের লাল বেনারসী পরিহিতা কন্যা নির্জীব শুয়ে আছে খাটের কিনারায়। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লালা। “মা রে” বলে চিৎকার দিয়ে উঠে তৃণার বাবা। সমন্বয়ে সবাই ছুটে যায় মেয়েটার দিকে। দর্শিনী কেবল এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসে। খুব ধীরে, নিরবে। মেয়েটার দিকে সে তাকিয়ে থাকে অপলক। এ জন্য ই বুঝি মেয়েটাকে আজ এত সুন্দর লেগেছিলো! মৃত্যুর স্নান শরীরে লেগেছিলো বলেই রূপ বেড়ে ছিলো! অথচ তারা বুঝলো না মেয়েটা এমন কিছু করতে পারে? কীভাবে এত অবুঝ হলো তারা!

তৃণার বাবা বুক ফাটিয়ে আহাজারি করছে। একটু আগের বলা “ভালোবাসি, বাবা” কথাটা তার কর্ণদ্বয়ে বাজছে। কি মিষ্টি সেই সুর! আর শোনা হবে না সেই সুর? বুক ছিঁড়ে যেন কেউ কলিজা আলাদা করে নিয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে সে তার মেয়ে দু’টির অত কদর করে নি কখনো, তবে আজ বুক ফাটছে কেনো? তবে কি তৃণা ইচ্ছে করেই আজ ভালোবাসি কথাটা বলেছে? যেতে যেতে অনুশোচনার আগুনে পুড়িয়ে দিতেই এই আয়োজন? তৃণার বাবা ছোট বাচ্চার মতন “মা রে, মা রে” বলে আর্তনাদ করে উঠলো। আর্তনাদ করলো নিধিও। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নব্য কিশোরী দুই বেনী ওয়ালা কন্যার মুখ। কি সুন্দর! কি অপরূপ!

মৃত্যুঞ্জয় তৃণার হাতে মুঠ করে রাখা ছোট চিরকুটটা খুললো,গোটা গোটা অক্ষরের লিখা শব্দ গুলো পড়লো,

“বাবা,
ডাক্তার সাহেবকে ছাড়া বেঁচে থাকা আদৌও সম্ভব না। তাই যেতে হচ্ছে আমাকে। কখনো খুব মনে পড়লে ছোট্ট বেলার মতন হাট্টিমাটিম কবিতাটি আওড়িয়ে যেও। দেখবে আমি আছি। তোমার সেলাই করে দেওয়া শার্টের বোতাম খানায় আমি আছি। তোমাদের সবাইকে তো আমি এত ভালোবাসি, কিন্তু তোমরা আমায় কেন ভালোবাসো নি বাবা। তোমরা আমাকে ভালোবাসো নি, বাবা।”

#চলবে

[৩০০০ শব্দ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here