রংবদল পর্বঃ০১

0
375

গল্পঃ রংবদল
পর্বঃ০১
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

শপিংমলে হুবহু শর্মিলার মত মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই আবীরের পুরো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাড়ি এসে রুমের সবকিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলছে। কলেজের ক্লাস করিয়ে বাড়ি ফিরে আবীরের মা তার ক্লান্ত দেহ বিছানায় রাখতেই আবীরের রুম থেকে জিনিসপত্র ভাঙার শব্দ পেয়ে ভয় পেয়ে যান।তার ছেলের হঠাৎ কি হলো! এতদিন তো ভালোই ছিল।তিনি দৌড়ে আবীরের রুমে যান। গিয়ে দেখেন রুমের কোনকিছুই আর অবশিষ্ট নেই আর আবীর শর্মিলার ছবি নিয়ে পাগলের মতো কাঁদছে। ছেলের মাথায় হাত দিতেই আবীর ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

–মা,শর্মিলা মরে নি।ও এখনো বেঁচে আছে। ও কীভাবে বেঁচে আছে সেটাই বুঝতে পারছি না। ওকে তো আমার সামনে মেরে ফেলা হয়েছিল। আজকে আমার সাথে শর্মিলার দেখা হয়েছিল। ও আমার সাথে কথা না বলে পালিয়ে গেছে।

আবীরের মা বুঝতে পারে না আজ তিনমাস পর আবীর কেন আবার শর্মিলার কথা বলছে।ওকে তো তিনমাস আগেই সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলেছে। আবীরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

–ওটা তোমার হ্যালুসিনেশন।শর্মিলা আসবে কোথা থেকে বাবা? এই চিন্তা বাদ দাও আমি তোমার দুপুরের জন্য খাবার রেডি করছি, খেতে আসো…

আবীর ওর চুলগুলো টানতে টানতে বলল,
–না,মা ওইটা শর্মিলাই ছিলো আমার হ্যালুসিনেশন না। আমাকে এখন ওকে এনে দাও।

–কি সব পাগলের মত প্রলাপ করছো আবীর? যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।

আবীর চিৎকার দিয়ে বলল,
— আমি পাগল না,আমাকে শর্মিলাকে এনে দাও নাহলে আমি সবকিছু ধ্বংস করে ফেলব। তুমিও আমার চোখের সামনে থেকে যাও নাহয় তোমার সাথেও খারাপ হয়ে যাবে।

ছেলের কথা শুনে মিসেস রেশমা জাহান এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে রুম থেকে চলে আসেন। ওর একটু একা থাকা দরকার। শর্মিলা মরার পর থেকে শান্তশিষ্ট আবীর একবারে জেদী ও একরোখা হয়ে উঠেছে। আবীর কি আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না? কথাটা ভেবে মিসেস রেশমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আবীরের বাবার সাথে আবীরের দিনে দিনে পাগলামির বেড়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলবেন ভাবলেন রেশমা।
.
মিসেস রেশমা রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই আবীরের ফোনে ফোন আসে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে রাফি কল করেছে।

— হ্যালো, আবীর। রায়হানকে আমরা ধরতে পেরেছি। ওকে আমাদের সিক্রেট বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছি।
আর শোন, অর্পিতা নামের একটা মেয়ে, পেশায় মেবি সাংবাদিক। ও তোর গোপনে অনেক খোঁজ-খবর নিচ্ছে। কেনো নিচ্ছে জানি না তাই তুই একটু সাবধানে থাকিস।

–হুম।জানিস রাফি আজকে শর্মিলাকে আমি শপিংমলে দেখেছি। ও না আমার থেকে পালিয়ে গেলো।(কান্নামিশ্রিত কন্ঠে)

–আসলে তুই শর্মিলাকে অনেক ভালোবাসতি তো তাই ও তোর কল্পনায় এসেছিল।এনিওয়ে, রাখছি আমার একটু কাজ আছে দোস্ত।( শর্মিলার প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার জন্য)

–আচ্ছা।(নিচুস্বরে)

বলে আবীর কলটা কেটে দিল। সকলেই আবীরের কথাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু আবীর শর্মিলাকে ঠিকই দেখেছে।ও এতোটা ভুল দেখতে পারে না।শর্মিলাকে হারানোর পর আবীর অনেক হিংস্র হয়ে ওঠে। তারপর বিশস্ত বন্ধুদের নিয়ে একটা সিক্রেট টিম গঠন করে শর্মিলার হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য।
_____________________________

–তোকে এখন থেকে সবসময় কি অর্পিতা বলেই ডাকতে হবে? (আরাফ)

–হ্যাঁ,এই কথাটা আর কতবার তোকে বলব!

–সকলের সামনে অর্পিতা ডাকব, আর আড়ালে না হয় তোর আসল নামেই ডাকলাম।

–না করেছি না তোকে,আমাকে আসল নামে ডাকতে।দেখা যাবে আড়ালে আসল নামে ডাকতে ডাকতে লোকজনের সামনেও তুই আসল নামে ডেকে ফেলেছিস। (রাগ দেখিয়ে)

–তুই আর কয়দিন পরিচয় গোপন করে থাকবি?বিদেশ থেকে ফিরেই তুই নিজের নাম গোপন করে ছদ্মনাম ব্যবহার করছিস লোকজনের কাছে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিস,আন্টি- আংকেলও না জানে না তুই যে একমাস ধরে বিদেশ থেকে ফিরেছিস?

–ততদিন পর্যন্ত জানবে না যতদিন পর্যন্ত শর্মিলা আহমেদ এর মৃত্যুর হ*ত্যাকারীর সাজা আমি নিজ হাতে না দিব। প্রয়োজনে হাজারবার #রংবদল করব।আজকে একটুর জন্য আবীর রহমানের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম। আমার খালি সন্দেহ হয় শর্মিলাকে খু*নের পেছনে ওর কোন হাত নেই তো?

–আরে কি বলছিস? আবীর তো শর্মিলাকে ভালোবাসত!

–আমিও জানি। বাট মনের মধ্যে একটা সন্দেহ রয়েই গেছে। সেটা জানার জন্যই আজকে লুকিয়ে আবীরের আস্তানায় যাব। আজকে ওদের ওখানে গোপন কোন সভা বসতে পারে! তুই আমার সাথে যেতে পারবি?

–দেখ, তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস আবীরের আস্তানায় যাওয়ার কোন দরকার? শুনেছি ও এখন নতুন করে মাফিয়া দল গঠন করেছে। যদি একবার তোকে দেখে ফেলে তবে ভাবতে পারছিস কি হবে?

— যুদ্ধের আগেই পরাজয় বরণ করা আমি শিখি নি।তোকে শুধু জিজ্ঞেস করেছি তুই আমার সাথে যাবি কিনা? তোর কাছে কোন জ্ঞান চাই নি আরাফ। (ক্ষিপ্ত কন্ঠে)

–তুই এমন করিস কেন সবসময়। আমি তোকে ভালোবাসি, তোর কোন বিপদ হোক আমি তা চাই না। তুই কেন বুঝিস না?

— তোর ভালোবাসা এখন তোর কাছেই রাখ।আমি আছি আমার যন্ত্রণায়। আপনজন হারানোর যন্ত্রণা তুই বুঝবি না। আমাকে আজ রাতে যেভাবেই হোক আবীরের আস্তানায় পৌঁছাতে হবে।

–আচ্ছা, আমিও তোর সাথে যাব।(নিচু গলায়)
.
.
সন্ধ্যায় আবীর যখন ওদের সিক্রেট হাউসের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছে তখন আবীরের বাবা-মা ওকে ডেকে পাঠায়।

–আবীর, আমাদের একটা কথা রাখবে? (আবীরের বাবা)

–না শুনে বলতে পারব না।

–আমাদের একমাত্র ছেলে তুমি। আমাদের সবকিছু: বাড়ি-গাড়ি,টাকা-পয়সা, বিজনেস সবকিছু আমাদের অর্বতমানে তোমাকেই দেখতে হবে।তো বলছিলাম কি…

–কি বলবে সেটা খুব ভালো করেই জানি। এখন আমাকে বিয়ে করে ঘর-সংসারে মন দিতে বলবা,যেটা আমি পারব না।

–আর কতদিন ওই মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকবা? তোমার ভবিষ্যত বলেও কিছু আছে। আবেগে ভবিষ্যত নষ্ট কর না।

–যেই টাকা-পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না আমার জীবনে সেই টাকার কোন মূল্য নেই। আমার কাজ আছে আমি আসছি।
বলে আবীর বেরিয়ে গেল।
.
এদিকে ছদ্মনামধারী অর্পিতা এবং আরাফ দুজনেই আবীরের সিক্রেট হাউসে এসে পৌঁছেছে।অর্পিতা বাড়ির ভিতরে গেলেও আরাফকে নিয়ে যায় নি। অর্পিতার কথা- একসাথে বিপদ পড়ার কোন দরকার নেই। আরাফও অর্পিতার কথা মেনে নিয়েছে। ও বাইরে ১০/১২ জন গার্ডস নিয়ে ওয়েট করছে।
রায়হানকে যে রুমে আটকে রাখা হয়েছে সেই রুমের অবস্থান একবারেই বাজে।যেকোনো মুহূর্তে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। অর্পিতা ক্যামেরাটা চালু করে চুপচাপ লুকিয়ে রইল। একটু পর আবীরের সাথে আরো দুইটা ছেলে ঢুকলো।অর্পিতা দেখে চিনে ফেলল ; এদের একজন রাফি অন্যজন তামিম।
রায়হানকে চেয়ারে হাত-পা,মুখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়েছে,সেখানেও দুজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রায়হানকে দেখে আবীরের ফর্সা চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল। আবীর গিয়ে রায়হানের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরে বলল,

–খেলাটা শুরু করেছিলে তুই আর তোর প্রানের বন্ধু খেলাটা শেষ করব আমি। তোদের দুইজনকে তিলেতিলে মারব যেভাবে কষ্ট দিয়ে মেরেছিলি আমার শর্মিলাকে।
কথাটা বলে বলে আবীর একটা ধারালো ছুরি নিয়ে হাতের একটা আঙুল পোচ দিয়ে আঙুলটা কেটে ফেলল। এরপর তামিমকে বলল এসিডের বোতল দিতে। গ্লাবস পড়ে নিল আবীর হাতে। কাটা আঙুলের জায়গায় এসিড ঢালবে বলে।

আড়াল থেকে আবীরের এমন ভয়ংকর রূপ দেখে ছদ্মনামধারী অর্পিতা কেঁপে উঠল।তাহলে কি শর্মিলাকে হত্যার পেছনে আবীরের কোনো হাত নেই।আমাকে কি তাহলে ভুল ইনফরমেশন দেওয়া হয়েছে।
.
এদিকে অর্পিতার দেরী হচ্ছে দেখে আরাফ অর্পিতার ফোনে কল দিল। হঠাৎ করেই অর্পিতার কল বেজে উঠল। প্রতিদিন কল সাইলেন্ট করা হলেও আজকে তাড়াহুড়োয় ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছে। কথায় বলে না-
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
অর্পিতার ফোন বেজে ওঠার পরে কল কাটার আগেই আবীররা সকলে সর্তক হয়ে গেল। নয়ন নামের একটা ছেলেকে বলল,রায়হানকে ভিতরের রুমে নিয়ে যেতে। আর ওরা তিনজন ফোনের শব্দ শুনে অর্পিতার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। অর্পিতা বুঝতে পারল ও ধরা পড়ে গেছে। এখনই ওর পালানোর প্রয়োজন। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে পালানোর আগেই রাফি ওকে ধরে ফেলল। অর্পিতা ওড়না দিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলল। এরপর ওকে টেনেহিঁচড়ে রুমের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে রায়হানকে রাখা হয়েছিল। অর্পিতার ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

–কে তুমি? এখানে কেন এসেছো? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? (চিৎকার করে আবীর কথাগুলো বলল)
রাফি ওর মুখের ওড়নাটা সরা..

রাফি ওর মুখের ওড়না সরাতে গেল আর তামিম ওর পার্টস থেকে ওর আইডি কার্ডসহ কাগজ-পত্র বের করলো। আইডি কার্ড থেকে নাম দেখে বলল,

–আবীর, রাফি ওনার নাম অর্পিতা মুন।যে লুকিয়ে লুকিয়ে আবীরের খোঁজ নিচ্ছে।

রাফি অর্পিতার মুখ থেকে ওড়না সরাতেই ভয়ে লাফিয়ে দূরে সরে গিয়ে বলল,
–শ-শ-শর্মিলা?

আবীরের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
–দেখেছিস বলেছিলাম না আমার শর্মিলা বেঁচে আছে। আমি ওকে সেদিন শপিংমলে দেখেছিলাম।
তুমি আমাকে দেখে কেন পালিয়েছিলে শর্মিলা?

–কিন্তু কীভাবে আবীর? ওকে দাফন করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এই মেয়ে কে তুমি?(অর্পিতাকে উদ্দেশ্য করে)

অর্পিতা চুপ করে রইল।চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে হলো ওর কাছে।
এদিকে অর্পিতার কোন খবর না পেয়ে আরাফ আবারও ওর ফোনে কল দিল। আবীরের নির্দেশে তামিম কলটা রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিল ওপাশ থেকে আরাফ বলে উঠল,
–ঊর্মিলা আর কতক্ষণ ওয়েট করব? তোর আবার কোন বিপদ হলো না তো?

আরাফের মুখে ঊর্মিলা নাম শুনে আবীর,রাফি, তামিম তিনজনই অনেক অবাক হলো। তারপর তামিম আরাফকে বলল,

–অর্পিতা কিংবা ঊর্মিলা যেই হোক না কেন সে এখন আমাদের কাছে, তবে ভয় নেই আমার ওনার কোন ক্ষতি করব না।আপনি বাড়ির ভিতরে আসুন।

তামিমের কথা শুনে আরাফ কিছুটা ভয় পেল।কিছু বলার আগেই তামিম কল কেটে দিল।

–তুমি সত্যি করে বলো তোমার পরিচয় কি? অর্পিতা মুন, ঊর্মিলা নাকি শর্মিলা ? যদি তুমি শর্মিলা নাই হও তাহলে তোমার চেহারাই বা কি করে শর্মিলার মতো হলো? কিছু যদি না বলো

ছদ্মনামবেশী অর্পিতা বুঝতে পারে আবীর,রাফি,তামিম শর্মিলার হ*ত্যাকারীর ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়।যা সে নিজেও চায়।সুতরাং, আবীর,রাফি,তামিম ওরা অর্পিতার জন্য সেইফ। অর্পিতা দম নিয়ে বলে,
–সব বলব,আগে আরাফকে আসতে দিন।

আরাফ আসার পর অর্পিতা যা বলে সেটা শুনে ওরা তিনজনই অনেক অবাক হয়ে যায়..

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here