কাননবালা,পর্ব:০২,০৩

0
690

#কাননবালা,পর্ব:০২,০৩
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২

নীতু চোখ মুখ শান্ত রেখে রুটি বেলছে।তার মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই মনের ভিতর কি চলছে।নীতু এরকমই! শান্ত! ধীর! শত অপমান নীতু হাসি মুখে মেনে নিতে পারে। এই যে সকাল থেকে ভাবি একটানা চেঁচামেচি করছে তাতে নীতুর কোন সমস্যা হচ্ছে না।ভাবির এক একটা কটু কথা চুপ করে শুনে যাচ্ছে। ভাবিকে রান্নাঘরে আসতে দেখে নীতু কিছুটা জোরে হাত চালায়।তারপরও ভাবি বলে ওঠে, ” নীতু এখনো হয়নি রুটি বেলা?কখন ভাজবে?তপুকে নিয়ে আমার স্কুলে যেতে হবে।আর এসব কি ভাজি করেছো?ঝুরা ঝুরা কেন হলো না।নীতু একটা কাজ অন্তত গুছিয়ে করো।শুধু গান্ডে পিন্ডে গিললেই তো হবে না।একেতো দেখতে সুন্দরী নও তারপর যদি সুন্দর করে কাজও না জানো তবে তোমাকে মানুষ কি দেখে বিয়ে করবে? যেখানেই যাবে গোঁদের উপর বিষ ফোড়ার মত থাকবে, বুঝলে?রোজ রোজ তোমায় পাত্র দেখতে আসে আর আমাদের কতগুলো টাকা গচ্চা যায়,নিজে তো একটা ছেলে পটাতে পারো, তাহলে আমাদের ঘাড়ের বোঝা কমে!”
নীতু ভাইয়ের বউয়ের কথা শুনে অবাক হলো না।এরকম করেই সে সবসময় কথা বলে কিন্তু আজ কেন যেন চোখটা ভিজে উঠলো।চোখের জলকে গুরুত্ব দিতে নেই,ঝরে যাওয়া কোন কিছুরই মূল্য নেই।তার থেকে বুকের ভিতর জমে থাক!তাই নীতু চোখের জল অতি সন্তপর্ণে আড়াল করে।চুলায় গরম তাওয়া রেখে রুটি ভাজতে শুরু করে।নীতুর নিজেকেও উতপ্ত রুটি মনে হয়! যে শুধু জ্বলছেই!

নীতুর মা বাবাকে খাবার খাওয়ার আগে ঔষধ খায়িয়ে সবে রুম থেকে বের হয়ছে তখনই ছেলের বউয়ের কথা শুনে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।নীতুর জন্য তার ভীষণ কষ্ট হয়,মেয়েটা এত কাজ করার পরও সবার গঞ্জনা শুনেন মা হয়ে তা চোখের সামনে দেখতে হয়।এই সংসারে নিখিলের টাকায় চলে বলে, নীতু কখনো কটু কথার জবাব দেয় না।যাতে পরিবারে কোর ঝামেলা না হয়। তারপরও ছেলের বউ সুরভীর মুখ চলে কেচির মত।অথচ সুরভী সংসারের কোন কাজেই হাত লাগাবে না।ছেলে ছোট থাকতে বাহানা দিত,ছোট ছেলে নিয়ে পারে না।আর এবছর ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর তো সারাদিন তাই নিয়ে থাকে। আর নীতু সকালের আর রাতের রান্না করে, দুপরের টা গুছিয়ে রেখে যায়,নীতুর মা রান্নাটা করে রাখেন তারপরও সুরভী একটা না একটা ছুতো ধরে নীতুর উপর চিল্লাবে।
সুরভী রান্নাঘর থেকে চলে যেতেই নীতুর মা মহিমা বেগম রান্নাঘরে ঢুকে।নীতু বাবার নাস্তা একটা প্লেটে গুছিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়।
মহিমা বেগম আমতা আমতা করে বলেন,”তোর একটা চাকরি কেন হচ্ছে না, বলতো নীতু?”
নীতু দুপুরের রান্নার তরকারি কাটতে কাটতে বলে,” মা তুমি যখন নামাজ শেষে তোমার পাঁচ সন্তানের জন্য দোয়া করো তখন আমার জন্য মিনিট পাঁচেক একটু বেশি দোয়া করবে। ঠিকাছে?যাতে আমারও একটা গতি হয় আর তোমাদেরও! ”
“তোর কি মনে হয় আমি তোর জন্য দোয়া করি না?”
“কই মা তোমার দোয়ায় তো কোন কাজ হচ্ছে না,শুনেছি মায়ের দোয়া নাকি বুলেটের মত লাগে তবে আমার বেলায় তা কেন হচ্ছে না?”…. শান্ত কন্ঠে বলে নীতু। মহিমা বেগম কতক্ষণ মেয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে চলে যান।সংসার সংসার খেলায় তিনি নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছেন।

***********
তাশরীফ অভিক যখন অফিসে প্রবেশ করে তখন ছোট বড় সকল কর্মকর্তারাও একটু নড়ে চড়ে বসেন।অভিক কাজে আর ন্যায্য কথায় কাউকে ছাড় দেয় না।এমনি কি অফিসের বড় স্যার পর্যন্ত অভিককে একটু সমঝে চলে।অভিক কাজে খুবই কর্মঠো!যে গরু বেশি দুধ দেয় তার লাথি খাওয়াও ভালো এই নীতি তিনিও মেনে চলেন। আর অফিসের মেয়ে কলিগদের তো নিত্য গসিপের পাঠ হচ্ছে অভিক।অভিকের পোশাক, হাঁটা চলা,কথা বলা, খাওয়া সব নিয়েই তাদের গসিপ।কিন্তু অভিক সেসব বুঝেও পাত্তা দেয় না।ন্যাকা সষ্টি অভিকের বড়ই অপছন্দ।অভিক যখন কোর্ট টাই হাকিয়ে ম্যানলি লুকে অফিসে প্রবেশ করে তখন মেয়ে স্টাফদের যে কতগুল হার্টবিট মিস হয় তার হদিস কি কঠোর অভিক রাখে? রাখে না।আজও অভিককে তার নিজস্ব কেবিনে ঢুকতে দেখে রিপা নিজেকে পরিপাটি করে অভিকের কেবিনে নক করে।অভিক একটা ফাইল খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল।নকের শব্দ পেয়ে বলে ওঠে, ” কাম ইন!” এক নজর একবার গেটের দিকে তাকিয়ে আবার ফাইলে মুখ ডুবায় অভিক।রিপা ক্রাশিত চোখে অভিককে পর্যবেক্ষণ করে।সুঠাম গড়নের লম্বা দেহের এই পুরুষ যে কতটা মারাত্মক সুন্দর তা কি সে জানে?রিপা হা করে তাকিয়ে থাকে অভিকের দিকে।
“মিস.রিপা এসির বাতাস খাওয়া হলে বলুন কি বলতে এসেছেন?”
রিপা নিজের আচরণে নিজেকে একশো রকমের গালি দেয়। তারপর বলে,”স্যার, বড় স্যার আপনাকে দেখা করতে বলেছে।”
“আচ্ছা, আপনি এখন আসুন!”
রিপা টলমল চোখে বেড়িয়ে পড়ে। অভিক বড় স্যারের রুমে প্রবেশ করতেই ষাটোর্ধ মানুষটা বলে ওঠে, “হেই ইয়াং ম্যান,তুমি দিন দিন আরো হ্যান্ডসাম হচ্ছো। ”
অভিক প্রতিত্তোরে হাসি দিয়ে বলে ওঠে, “কোন কাজ ছিল স্যার?”
“আহা অভিক আমি কি কাজ ছাড়া তোমাকে ডাকতে পারি না?তোমার মত ইয়াং বয়েসি একটা ছেলে এতটা কাজ পাগল হলে চলে।”
অভিক যারপরনাই বিরক্ত স্যারের কথা বার্তায়।
“তাহলে কি করা উচিত?”
“অভিক তোমাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করি তাই বলছি। আমার ভাই তার মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছে।আর পাত্র হিসেবে তুমি একশো তে একশো।আমি তোমায় কোন চাপ দিচ্ছি না। তোমার পছন্দ হলে তবেই আমরা আগাবো।”
“স্যার আমার বিয়ের ব্যপার সব মা হ্যান্ডেল করছেন।”
“সে তো খুলনা।আগে তুমি দেখো তারপর না হয় তোমার মাকে ইনফর্ম করবে।”
“মা ঢাকাতেই আছেন।সবচেয়ে বেটার হয় আপনি তার সাথে কথা বলুন।”
“তাহলে তো খুবই ভালো।দাও দেখি তোমার মায়ের নম্বর। “…. বড় খুবই উচ্ছাসিত কন্ঠে বলেন। অভিক নম্বর দিয়ে বিদায় হয়।

********
নীতু সবটা গুছিয়ে টিউশনির জন্য বের হবে তাই বাবার রুমে দেখা করতে আসে।বাবা বিছানা থেকে নড়তে পারে না।কথা বলতে কষ্ট হয়।যাও বলে তাও জড়িয়ে আসে।নীতুকে দেখে বাবা অশ্রু চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। নীতু বুঝে যায় বাবা ভাবির বলা প্রতিটা কথা শুনেছে। তাই নীতু বাবার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,” কাঁদছো কেন বাবা?কাঁদার মত কিচ্ছু হয়নি।তোমার নীতু তো কাঁদে না তবে তুমি কেন কাঁদবে?”
বাবা কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু তা কেবল গড়গড় করে আওয়াজের সৃষ্টি করে!

***********
নীতু বাসা থেকে বের হতেই তাজ কল করে।নীতু মুখে হাসি ফুটিয়ে কল রিসিভ করে।ছেলেটা যদি কথার সুর একটু অন্যরকম শুনে তবেই ক্ষেপে যায়।
“হ্যালো!”
“হ্যালো! কে বলছেন আপনি?আপনি কি নীতু?”
“কি বলছেন এসব তাজ?”…. নীতুর কন্ঠে বিস্ময়।
” আমি ঠিকই বলছি মিস!আমি তাজের বন্ধু নীতুকে চাচ্ছি। আপনি কি সেই?”
“হুম!আমিই সে।”…. বলে নীতু হেসে ওঠে।
” তুমি ভালো আছো নীতু? “…..আবেগি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাজ।তাজের কন্ঠে যেন একরাশ মাদকতা!
” আপনার কি হয়েছে তাজ?এমন করে কথা কেন বলছেন?”
“আমার যে কি হলো নীতু নিজেই বুঝতে পারছি না।কেমন জ্বর জ্বর লাগে,চোখে জ্বলে,বুক জ্বলে, ঘুম আসে না।কেমন অসুখ হলো বলতো? কেন তোমার শহর আমায় এতো টানছে নীতু? ”
“তো আসুন। কে মানা করেছে।”
“আসবো নীতু।একটু সবটা গুছিয়ে নেই।সবে চাকরিটা পেলাম।জয়েন করে কিছুদিন কাজ করবো।তারপর হুট করে একদিন এসে তোমার শহরে কড়া নাড়বো।সেদিনের জন্য প্রস্তুত থেকো নীতু!”….. তাজের কন্ঠের ব্যকুলতা নীতুকেও স্পর্শ করে প্রবল ভাবে!
নীতু আবারো স্বীকার করে তাজ খুবই সুন্দর করে কথা বলে।
” অফিস নেই আপনার?”
“এক সপ্তাহ পরে শুরু।আগের জবটা তো ছেড়ে দিলাম।তুমি নাস্তা করেছো নীতু?”
নীতু কি বলবে ভেবে পায় না।সকালে ভাবির কথা শুনে নীতুর খাওয়া হয়নি। তাই মিথ্যে করেই বললো,”খেয়েছি।”
“মিথ্যে কেন বলছো নীতু?খাওনি কেন?”…..ধমকে ওঠে তাজ।আজকাল তাজ যেন একটু বেশিই নীতুর প্রতি যত্নশীল।
” মিথ্যে বলিনি তো।”
“বলেছো নীতু।যদি তুমি সত্যি খেতে তবে বলতে এত সময় নিতে না।আমি তোমায় বলিনি নীতু, কারো জন্য নিজেকে কষ্ট দিবে না।নিজের ভালো থাকা নিজের হাতে!”
“আমি তো সেরকম মেয়ে হতে পারেনি।”
“পারবে নীতু,হতে হবে।তুমি নরম বলেই সবাই চেপে ধরে।একটু শক্ত হও নীতু।আর এখন লক্ষী মেয়ের মত কোন হোটেলে ঢুকে নাস্তা সেড়ে নাও।টাকা আছে তো হাতে? নাকি আমি বিকাশ করবো?”
তাজের এই অস্থিরতা, নীতুর জন্য চিন্তা হওয়া নীতুর ভীষণ ভালো লাগলো,ভীষণ।
“টাকা আছে,আমি খেয়ে নিবো।ভালো থাকবেন।”
“তুমিও।”

.***********
নীতু একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে।সামনে দাদাভাই বসে আছে। তাজের কল কাটতে না কাটতেই নীতু দেখে দাদাভাই বাড়ির এদিকে আসছে।দাদাভাই কোন কথা না বলেই নীতুকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসে।নীতু তখন কিছুই বলে নি।খাবারের অর্ডার দেওয়া হলে নীতু বলে, “তুমি এদিকে কি করছে দাদাভাই?সকাল বেলা দোকান রেখে এদিকে কি?”
জায়েদের একটা ছোট খাটো কাপড়ের দোকান আছে।তা থেকে যা আসে মোটামুটি সংসার ভালোই চলে যায়।
জায়েদ নীতুর কথায় হাসি মুখে বলে,”তোর জন্যই তো আসলাম।কাল দোকানে কাজ থাকায় চলে যেতে হলো। কালকের পর যে তোকে তোদের বাসার সবাই অমায়িক ট্রিট দিবে তা ভেবেই আসা।দেবি পার্বতীর মত তাদের কথা শুনে না খেয়ে যে তুই শুটকি মেরে থাকবি তাতো আমি জানি।এখন আমার সামনে খাবি। তোর জন্য বউয়ের হাতের রান্না মিস করেছি তার শাস্তি স্বরুপ দুটো পরোটা বেশি খাবি।”
নীতু জায়েদের কথায় হেসে দিয়ে বলে,”তবে কেন আসলে?বউয়ের হাতের মজাদার রান্না খেতে।”
জায়েদ টেবিলে চাপড় দিতে দিতে বলে,”আরে এই উসিলায় তোর বোনের থেকে বেশি ভালোবাসা পাবো।বর না খেয়ে কাজে গেছে এই ভেবেই সারাদিন চিন্তায় থাকবে তারপর বাসায় ফিরলে আদর যত্নও বেশি করবে।বুঝেছিস?”
নীতু মাথা নাড়িয়ে বুঝায় সে বুঝেছে।দাদাভাই মানুষটা এরকমই!হাসি মুখে থাকবে সবসময় আর সকলকে হাসি মুখে রাখতেই যেন এই মানুষটা পৃথিবীতে আসা।
জায়েদ ফের বলে ওঠে ,”তোর ভাই একটা গাধা বুঝলি।নাহলে শালা বাবু ওই ধারালো চিজ বিয়ে করে!”
“আহা দাদাভাই থামো তো!”
“ঢং!ভাবি ভক্ত ননদী! “…… বলতে না বলতেই পরোটা চলে আসে।জায়েদ নিজ হাতে গরম গরম পরোটা ছিড়ে নীতুর প্লেটে দেয়।জায়েদ এরকমই।নীতু তার কাছে ছোট বোন।যাকে যত্ন করতে কোন কুন্ঠা বোধ করে না জায়েদ।নীতু ছলছল চোখে বলে,”আমি এত গুলো পরোটা খেতে পারবো না দাদাভাই!”

“তুই খাবি সাথে যার সাথে ফোনে কথা বলছিলি দরকার হলে সেও খাবে!”
নীতু বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে থাকে জায়েদের দিকে আর জায়েদ চোর ধরা পুলিশের মত মিটমিটিয়ে হাসতে শুরু করে!

**********
অনীক মায়ের রুমে বসে আছে।মায়ের জন্য কেমন খারাপ লাগছে।নিজের চুল দুহাতে খামছে ধরে অনীক।বাবার মৃত্যুর পর মা কত কষ্ট করে মানুষ করলো তাদের অথচ তারা মানুষ না হয়ে অমানুষ হলো! রুমি এসে দেখে অনীক গম্ভীর মুখে বসে আছে শাশুড়ীর রুমে।এটা দেখেই রুমির মাথায় আগুন ধরে যায়।মা ন্যাওটা ছেলে কোথাকার!
অনীক রুমিকে দেখে প্রশ্ন করে,”কোথায় গিয়েছিলে রুমি?”
রুমি ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে,”সব ফ্রেন্ডরা আসলো।একটু ঘুরলাম,শপিং করলাম,একসাথে চিল করা আরকি!”
অনীক চিল্লিয়ে ওঠে,”সকালে ঘুমিয়ে রইলে।আমি না খেয়ে অফিসে গেলাম।বাসায় ফিরে দেখি তুমি নেই, এমনকি কোন রান্নাও করনি কেন?স্বামী সংসার সব ফেলে তুমি চিল করছো? ছি!”
“ছি!ছি! করবে না।খাবার অর্ডার করে নিলেই তো পারতে।এত হাইপার হওয়ার কি আছে?আমাকে তুমি দাসী পাওনি অনীক!”
অনীকের মনে হলো এক্ষুনি থাপ্পড় টাপ্পর মেরে রুমিকে ঘর থেকে বের করে দিতে।স্বামী সংসারের যত্ন নেয়াকে যদি বলে দাসত্ব, তবে এ কেমন নারী?
অনীকে প্রচন্ড রাগে হনহনিয়ে রুম থেকে চলে যায়।যাওয়ার সময় দরজার পাল্লায় বিকট আকাড়ে বাড়ি মেরে চলে যায়। সেই শব্দে রুমি সত্যি সত্যি কেঁপে ওঠে!

************
সেতু নীতুর সাথে জেদাজেদি শুরু করেছে।সেতুর নতুন একটা ড্রেস লাগবে।চার হাজার টাকা দাম।এত টাকা নীতু কোথায় পাবে?সেতু তা মানতে নারাজ।নীতু যে কয়টা টাকা পায় সবটা ঢেলে দেয় সেতুর পড়ালেখার পিছনে।নীতুর তো আর পড়ালেখা নেই।মোটে অল্পকটা টাকা হাতে রাখে নীতু নিজের কিছু ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য। কিন্তু সে কথা মানতে নারাজ সেতু।নিখিলের কাছে টাকা চেয়েছে সেতু কিন্তু তার উত্তর দিয়েছে সুরভি বলেছে,”এমাসে বাজার না করে তোমার টাকা দিবো, ঠিকাছে সেতু?” যার মানে টাকা দিবে না।সেতু এখন জেদ করছে নীতুর সাথে। নীতু ধীর কন্ঠে বলে,”আমি টাকা পাবো কই?যে টাকা পাই সবই তো তোর পড়ালেখার পিছনে খরচ করি!”
সেতু চিৎকার করে বলে,”একদম খোঁটা দিবেনা নীতু আপি।যে কয়টা টাকা দাও তার আবার ফুটানি করো।একটা ড্রেস দিতে পারছো না আবার আবার বড় কথা বলছো।”
সেতুর কথা শুনে নীতু হতভম্ব!
মহিমা বেগম রুমের বাহিরে থেকে ছোট মেয়ের এরকম কথা শুনে বিছানার ঝাড়ু হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।নীতু কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেতুকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে মা।নীতু আৎকে ওঠে বলে,”এসব কি করছো মা।এতবড় মেয়ের গায়ে হাত কেন তুলছো? ”
মহিমা বেগম মারের গতি বাড়াতে বাড়াতে বলে,”জানোয়ার ধরেছি পেটে।যেখানে নিজেদের চলতে কষ্ট হয় সেখানে সে শখ করে।আর একটা ধরেছি পেটে সেটা বোঝার মত লটকে আছে ঘাড়ে।আর ছেলেটা হয়েছে কুলাঙ্গার। মা বোনদের খাওয়ায় তা নিয়ে আবার হিসেব।এসব দেখার আগে মৃত্যু কেন হলো না আমার? ”
বলে মহিমা বেগম ঝাড়ু ফ্লোরে ফেলে চলে যান।নীতু মায়ের কথায় কষ্ট পেলেও তা গায়ে মাখলো না।নীতু ছুটে গেলো সেতুকে উঠকতে।কিন্তু সেতু প্রচন্ড রাগে নীতুকে ধাক্কা মেরে বলে,”একদম আদিখ্যেতা দেখাতে আসবে না আপি।এসব তোমার জন্য হয়েছে।”
নীতু আবারও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।তার আসলে কি করা উচিত তা নীতু বুঝে উঠতে পারছে না।

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩

মহিমা বেগম মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে আছেন। নীতু খাচ্ছে।আপাত দৃষ্টিতে এই দৃশ্য মায়া চোখে দেখার মত কিছু নয়।কিন্তু একজন মায়ের কাছে সন্তানের তুচ্ছ বিষয় গুলোও অতুলনীয় হয়!
নীতু চায়ের কাপে মচমচে পরোটা ডুবিয়ে খুবই আয়েশ করে খাচ্ছে। কি সুন্দর র চা দিয়ে পরোটা খাচ্ছে মেয়েটা!মহিমা বেগমের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। মেয়েটা দুধ চা খুবই পছন্দ করে কিন্তু গায়ের রঙ টা কালো বলে দুধ চা তিনি খেতে দেননা নীতুকে।কোথায় যেন একদিন শুনেছিলেন, দুধ চায়ে চেহারার লাবণ্যতা নষ্ট হয়!এরপর থেকেই দুধ চা নীতুর খাওয়া বন্ধ!
নীতু খুবই চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। ওর ইচ্ছার উপর যেকোন ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া যায়। তাতে নীতু প্রতিবাদ করবেনা।মনে কষ্টের পাহাড় জমাবে কিন্তু মুখ ফুটে বুলি আওড়াবে না।মহিমা বেগম এই জন্যই নীতুকে নিয়ে বড় চিন্তিত। মেয়েটা অন্য সবার মত নয়।কিছুটা আলাদা! পুত্রবধু সুরভি যে এতটা নোংরা ব্যবহার করে নীতুর সাথে অন্য কোন মেয়ে হলে ঝগড়া হত কিন্তু নীতু তা করে না। চুপচাপ শুনে যায়।
নীতু দেখতে হয়েছে মহিমা বেগমের শাশুড়ীর মত।মহিমা বেগমের মনে আছে,যেদিন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল সেদিন শাশুড়ী মা তার মুখ দেখে বলেছিল,”আমার আলমিরার সব সুন্দর শাড়ি গুলো এক্খন থেকে তোমার বউ।লাল টুকটুকে বউয়ের জন্য রঙ বেরঙের শাড়ি!”
মহিমা বেগমের চোখ ভিজে উঠে,তার শাশুড়ী মানুষটা দেখতে কালো হলেও মানুষটা বড় ভালো ছিল।সবসময় মহিমাকে আগলে রাখতো!নীতুর যেদিন জন্ম হলো শাশুড়ী নাতনির মুখ দেখে মহিমাকে বলেছিল,”বউ আমার সই আসছে!আমি মরলে তুমি ওর মুখ দেইখো!”
মহিমা বেগমের সব সন্তানরা দেখতে তার মত ফর্সা হলেও শুধু নীতু হয়েছে ব্যতিক্রম!
নীতু যখন নবম শ্রেণিতে পড়ে একদিন এসে বায়না করে বলেছিল,”মা আমার একটা লাল থ্রিপিস চাই!” পাশেই নীতুর খালামণি বসে ছিল।সে হাসতে হাসতে বললো,” হ্যারে নীতু তুই কি জোকারের রোল করবি নাকি?লাল জামায় তোকে একদম কাকতাড়ুয়ার মত লাগবে। দর্শক সেই মজা পাবে!” নীতু সেদিন ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল মায়ের দিকে, ভেবেছিল মা প্রতিবাদ করবে কিন্তু মহিমা বেগম নিজের বোনকে কিছুই বলতে পারেন নি। তার জন্য নীতুর দাদী বেজায় রাগ করেছিল মহিমার উপর!
এরপর থেকে যা হলো নীতু সব ধরনের লাইট কালার ড্রেস পড়া শুরু করলো।মেয়েটার জীবন থেকে সমস্ত রঙ হারিয়ে গেলো!

***********
সুরভির ঘুম থেকে উঠেই মেজাজ চড়ে গেলো।একে তো আজ শুক্রবার। নিরবের স্কুল নেই।একটু বেশিই বেলা করে ঘুমাবে করে।কিন্তু পারলো না।ইতু এসেছে সাথে তার ছেলে তুতুন। আর ইতুর ছেলের কন্ঠ পেয়ে নিজের ছেলেও চিল্লাপাল্লা শুরু করেছে।রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো শাশুড়ী মা নীতুর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে।কালো একটা মেয়েকে দেখার মত কি আছে সুরভি ভেবে পেলো না।নিজের মনেই ভেঙচি কেটে রান্নাঘরে পা বাড়ালো খাবারের খোঁজে। ইতু সেতুর সাথে কথা বলছিল সোফায় বসে। নিখিলও এসে বসলো সোফায় টিভি অন করে। মন দিলো সকাল দশটার নিউজে।স্বামীকে টিভি ছাড়তে দেখে সুরভিও হাতে খাবারে প্লেট নিয়ে এসে বসলো তার পাশে।খাবার মুখে দিয়েই সুরভি হাসতে হাসতে বললো,” কি ব্যপার ইতু?এত সকাল সকাল বাপের বাড়ি?ঝগড়া করে এসেছো নাকি?”
ইতুও হাসতে হাসতে বললো,”সকাল দশটা যে এত সকাল তা জনতাম না তো ভাবি? তোমাদের জন্য হতে পারে কারণ তোমার তো আবার বিনে পয়সার দাসী আছে!”
সুরভি ফোঁস করে বললো,”তুমি কি বলতে চাচ্ছো ইতু?আমি এ বাসায় কাকে দাসী মনে করি?”
“আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না ভাবি ডাইরেক্টলি বলছি আমি নীতু আপা নই যা কিছু একটা বলবে আমি সয়ে নিবো।তাই ঠেস মারা বন্ধ করো।আমার বাপের বাড়ি আমি যখন খুশি আসবো তোমার বাপের বাড়ি তো আর যায়নি!”

সুরভি তেজ নিয়ে বলে,”এত যে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছো শশুড় বাড়ি থেকে ঝগড়া করে এসে বড় বড় কথা বলতে লজ্জা লাগছে না?দুজন তো ঘারে উঠে বহাল তবিয়তে আছে এবারে তুমিও যোগ দাও,পারো তো শুধু অনিষ্ট করতে!”

নিখিলের সামনে বসে এত কথা হলেও নিখিলের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।সে খুবই মনোযোগের সহিত টিভি দেখছে। নিখিল এমনই।কৌতূহল হীন মানুষ।অযথা ঝামেলা, দায়িত্ব কোনটাই তার পছন্দ নয়।

ইতুর চড়া কন্ঠ শুনে নীতু আর মহিমা বেগম ছুটে আসেন।এসে দেখেন ইতু চড়া কন্ঠে বলছে,” লজ্জা কেন হবে ভাবি? আমি তো আর চুড়ি করে আসেনি।এসেছি তাদের চোখের সামনে থেকে। আর আমার ঘরেও অবিবাহিত ননদ আছে তাকে তো আর আমি দাসীর মত খাটাই না। বিবাহিত দুজন ননদ যখন রোজ বিকেল হলে বাসায় এসে আড্ডা দেয় তখন তাদের দেখে তোমার মত কপালও কুঁচকাই না।চুপচাপ ধরনের শাশুড়ী পেয়েও যখন তার সাথে তুমি কাজের মহিলার মত ট্রিট করো তাও করি না।তবে লজ্জা কিসের? হ্যা আমি রাগ করে এসেছি কারণ আমি মিথ্যে কথা সহ্য করতে পারি না।আমার শাশুড়ী অনবরত মিথ্যে কথা বলেন।তাই নিয়ে ঝামেলা বাঁধে কিন্তু তোমার মত তার সাথে আমি মুখরা আচরণও করি না।মাথা গরম হয়েছে নিজের পরিবারের কাছে এসেছি মাথা ঠান্ডা হবে চলে যাবো।সেখানে তুমি বলার কে?আমরা কি কখনও তোমাকে বলেছি তুমি খাটো আমার লম্বা ভাইয়ের সামনে তোমাকে মানায় না।বলেছি?তবে তুমি কোন সাহসে নীতু আপাকে কটাক্ষ করো?তাকে খাওয়ার খোঁটা দাও? তুমি এই সংসারে কোন কাজ করো না ছেলের অযুহাতে, আমার ছেলে নেই?আমি কাজ করি না।ছেলেকে স্কুলে দিয়ে তুমি সারা শহর ঘুরে বেড়াও,গাল গপ্প করো তা আমি জানি না ভাবছো? শুনো ভাবি তুমি যদি হও বুনো ওল তবে আমি বাঘা তেঁতুল। তাই আমার সামনে চোটপাট কম!”

ইতু এমনই।উচিত কথায় মাকেও ছাড় দিবে না। সুরভি ইতুর সাথে না পেরে স্বামীকে ধরলো,”দেখলে তোমার বোন কিরকম করে বললো?তুমি কিছু বলছো না কেন?”

নিখিল কি করবে ভেবে পেলো না।ইতু তার ছোট বোন হলেও সে ইতুর কথার ধাঁচকে ভয় পায়।আর এখন চুপ হয়ে থাকলে বউ বাপের চলে যাবে তখন আবার নিখিলের একগাদা টাকা পয়সা খরচ করে শশুর বাড়ি থেকে বউকে আনতে যেতে হবে।টাকা বাঁচানোর উদ্দেশ্যই বলে উঠলো নিখিল,”আহা ইতু কি শুরু করেছিস?এসেছিস শান্তি মত কিছু দিন থাক।”
ইতু সেই আগের মত তেজি স্বরে বলে উঠলো, ” একদম কোন কথা বলবে না ভাইয়া।মিনমিনে পুরুষ আমার কোন কালেই পছন্দ নয়। এখন আমায় থামতে বলছো কেন?যখন তোমার বউ আমার মা বোনদের খাওয়ার খোঁটা দেয় তখন কই থাকো তুমি?তা শুনে যখন আমার অসুস্থ বাবা চোখে জল ফেলে তখন কই থাকো?(এই পর্যায়ে এসে ইতু কেঁদে দিয়ে বলে) ভাইয়া, বাবার পড়ে বাবার স্থান নেয় বড় ভাই।আর তুমি কিনা?শোনো ভাইয়া কয়টা টাকা পয়সা দিলেই দায়িত্ব নেয়া হয় না।দায়িত্ব জিনিস টা আরো বড়।আজ তুমি যদি তুমি দায়িত্ব শীল হতে তবে আমার বোনকে যে পরিবার কালো, মোটা বলে তুচ্ছ করেছে সেই পরিবারে আমার বিয়ে হতো না।আমার নীতু আপাকে ছোট হতে হতো না। তুমি কিচ্ছু পারো নি ভাইয়া।কিচ্ছু না!”

ইতুর কান্না যেন নিখিলকে ছুঁয়ে দিলো।সে কাতর স্বরে বললো,”কাঁদিস না।”
মহিমা বেগম অবাক হলেন না।তার এই মেয়ে যেমন আগুন তেমন পানি!
ইতু চোখের জল মুছে বললো,”শোন ভাইয়া, আমরা তোদের কাছে খেতে আসি না।মিতু আপা ভুত ভবিষ্যতে এই বাসায় আসে।সেতুর গায়ের রঙ ফর্সা তার জন্য তার জন্য পাত্রের অভাব হবে না তা তো তোরাই বলিস।তাই বলছি নীতু আপাকে কেউ কিছু বলিস না।আপা কষ্ট পায়, কাউকে বলে না।কাউকে কষ্ট দিয়ে আর যাই হোক ভালো থাকা যায় না।
নীতুর চোখদুটো ও ভিজে উঠে।তার এই বোনটা যে তাকে এত ভালোবাসে কই তাতো কখনো মুখ ফুটে বলেনি।যখন তাকে দেখতে এসে ইতুকে বিয়ে করতে চাইলো পাত্র পক্ষ তখন কেবল অঝোরে কেঁদেছিল মেয়েটা।এরপর তো অনেকটা সঙ্কোচেই দুই বোনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলো।কেউ আর সহজ হতে পারলো না!

ইতু মায়ের উদ্দেশ্য বলে ওঠে, “শোনো মা আমি তোমাকে বলিনা ভাবির সাথে খারাপ আচরণ করো।বলি না প্রতিবেশী কারো সাথে দূর্ব্যবহার করো।শুধু বলি তোমার মেয়ের দিকেও একটু খেয়াল রেখো।সেতু জেদ করতে পারে,আমি মুখ ফুটে বলতে পারি,বড় আপা এসবের জন্য দূরে থাকে কিন্তু নীতু আপা না কোথাও চলে যেতে পারে, না বলতে পারে।তোমরা তাকে তিলে তিলে মারছো মা। আর ভাইয়া শোন বড় আপাকেও আসতে বলেছি আজ আমরা সব বোনেরা আড্ডা দিবো।তুমি বাজার করে নিয়ে আসো, টাকা আমি দিচ্ছি।আজ বাবার রুমে বসে আড্ডা দিবো। আর সব নাতনিদের খেয়াল মা রাখবে তাই তোমার বউর কোন চিন্তা করতে হবে না।তাকে বলো আজ রান্না করতে। আজ তো আর না আছে স্কুল না আছে কোন বাহানা!! ”

নিখিল আর কথা বাড়ালো না।সে সুরভিকে নিয়ে রুমে চল গেলো এবং বললো,”আজ কোন বাহানা করো না সুরভি।ইতু অন্যরকম।তা তুমিও জানো আমিও জানি।তাই চুপচাপ রান্নাটা করো আমি বাজার করে এসে তোমায় সাহায্য করবো তবু ওদের আজ ওদের মত ছেড়ে দাও।আর কাল থেকে কাজের বুয়া রাখার ব্যবস্থা করো।যখন তুমি কিছু পারবে না তখন তোমার কাজ টাকার বিনিময়ে অন্য কেউ করুক।”
সুরভি আর কথা বাড়ালো না কিন্তু ঠিকই ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।

*********
নীতু এসে ইতুকে জরিয়ে ধরলো।ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! ইতু বিরক্তির ঢং করে বললো,”আহা আপা কি করছো, মরে যাবো তো।ছাড়ো!আর আপা তোমার জন্য পেইন্টিং এর সব মাল মসলা নিয়ে এসেছি।সুন্দর করে একটা ছবি আর্ট করে দিয়ে তো।আমার বসার ঘরে টাঙিয়ে রাখবো।সবাই বুঝুক কাকে পায়ে ঠেললো।

“আমি তো অনেক দিন ছবি আঁকি না ইতু।”

“তাতে কি?এখন আঁকবে।”
তারপর সেতুর উদ্দেশ্য বলে উঠলো ইতু,”সেতু তুই নাকি সেদিন নীতু আপার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস?এখন আমাকে বল,কে বড়?জামা বড় না বোন বড়?বল?

সেতু পড়ল মহা বিপাকে।এ তো মিতু আপা নয় যে ভুজুংভাজুং বুঝাবে বা নীতু আপা যে জেদ দেখালে থেমে যাবে।এ তো স্বয়ং কঠিন মহিলা!তাই মিন মিন করে বললো,”বোন বড়।”
“তাহলে আর কখনো বেয়াদবি করবি? সরি বল।”
সেতু ঝামেলা এড়াতে চটপট বলে ফেললো,”সরি আপি।”

একটুপরই মিতু এসে হাজির হলো সন্তানদের নিয়ে। জায়েদ আসতে পারেনি।সে দুপুরে খেতে আসবে দোকান বন্ধ করে।বাবার ঘরে আড্ডা চললো সব বোনদের। কখনো বা খুঁনসুটি কখনো হাসাহাসিতে মাতিয়ে তুললো গুমোট পরিবেশ।চুপচাপ স্বভাবের নীতুও খিলখিল করে হেসে উঠলো।একমুহূর্তেই ভুলে গেলো সকল কষ্ট, অপমান। বাবা নড়াচড়া না করতে পারলেও অনুভব করলো মেয়েদের সুখ দুঃখের গল্প।

কিছুক্ষণ পর নীতু নিজের ঘরে একমনে ছবি আঁকতে বসলো।বহুদিন প্রাকটিস নেই।তাই কিছুটা বেগ পেতে হলো।লম্বা সিল্কি চুল গুলো হাত খোপা করলো,লাইট গোলাপি ওড়না টা কোমরে পেঁচিয়ে নিলো।তারপর খুবই মনোযোগের সহিত ছবি আঁকায় মন দিলো।কৃষ্ণবর্ণ হাত দুটো যেন যন্ত্রের মত চলতে লাগলো ক্যানভাসের পাতায়! একসময় নীতু প্রচুর ছবি আঁকতো।এরপর পরিস্থিতি বদলে গেলো।নিজেকে এতটা ছোট মনে হত যে সকল কিছু থেকে মন উঠে গেলো।একের পর এক প্রত্যাখ্যান নীতুর ভিতর বাহির সব এলোমেলো করে দিলো!

বিকেলে চার বোন ঘুরতে বের হলো,সাথে বাচ্চারা।বাসার কাছেই একটা সিটিপার্ক আছে সেখানে বসলো।সাথে জায়েদ।ইতু খুবই ভালোভাবে জায়েদের পকেট ফাঁকা করলো।জায়েদ অসহায় কন্ঠে বললো নীতুকে,”তোর এই বোন ডাকাত!আমাকে পুরো লুটে দিলো!”
নীতু হাসি মুখে প্রতিত্তোরে বললো,”দাদাভাই সবাই তো আর আপনার বউ মিতুর মত না।যে বর যা বলবে চোখ বুজে মানবে আবার সবাই আমার মতও না যে মুখ ফুটে চাইবে না।কেউ কেউ ইতুর মতও হয়।”
জায়েদ সম্মতির কন্ঠে বলে,”ঠিকই বলেছিস নীতু।তোর আপা যদি ইতুর মত হত তবে আমার সর্বনাশ হতো।”
ওদের কথা বলতে দেখে মিতু বলে,”দু জনে কি ফিসফিস করছো?”
ইতু বাদাম চিবাতে চিবাতে বলে,”আমার নামে তোমার বর আমার বোনের কাছেই নিন্দে করছে আপা।!”
সবাই একসাথে হেসে উঠলো।

সকলে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখে মিলন বসে আছে।ইতুর বরের নাম মিলন।মিলন ইতুকে দেখে ভ্যাবলার মত হেসে দিলো।তা দেখে জায়েদ মিতুকে বললো,”দেখেছো, তোমার বোনের ভালোবাসায় আমার ভায়রা ভাই হাসতেও ভুলে গেছে!” মিতু চোখ গরম করে চাইলো জায়েদের দিকে। ইতু খেয়াল করলো মিলন চার পদের ফল নিয়ে এসেছে সাথে মিষ্টি। ইতু সেগুলো হাতে করে বাবার রুমে নিয়ে রাখলো।ফ্রিজে রাখলে একটাও পাবে না।মিলনকে নাস্তা দেয়া হলে মিলন চোখ ঘুরিয়ে ইতুকে খুঁজলো কিন্তু দেখা পেলো না।ভেবেছিল এখানে আসলে ইতু চিল্লাপাল্লা করবে।কিন্তু ইতুকে স্বাভাবিক দেখে আরো খারাপ লাগছে।
সকালে মিলনের দ্বারা ভয়ংকর একটা কাজ হয়ে গেছে।সে ইতুকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিল। এটা বলা ঠিক হয়নি।মিলন জানে মিলনের মায়ের মিথ্যা বলা রোগ আছে।সে অনবরত মিথ্যে বলে। আজ সকালে মিলন দেখে তার পকেটে টাকা নেই।ইতু যে নেয়নি তা মিলন শিওর।কেননা এই পাঁচ বছরে ইতু কখনো পকেটে হাত দেয় নি।নিয়েছে বড় আপার ছোট ছেলেটা।স্বভাবে ছেলেটা বাদর। মাকে বললে, সে অস্বীকার করলো।ইতুর উপর দোষ চাপালো।ইতু মায়ের উপর পাল্টা জবাব না দিলেও রুমে এসে মিলনকে কত গুলো গালি দিলো।যার একটা গালি মিলনের খুব গায়ে লেগেছিল,মিথ্যুকের বাচ্চা! মিলন রাগ সামলাতে না পেরে বলেছিল বাসা থেকে বের হয়ে যেতে।এখানেই গন্ডগোল বেঁধেছে। ইতু সত্যি সত্যি বের হয়ে এসেছে।ইতু চলে আসার পরই মিলন বুঝতে পেরেছে কতটা বোকামি হয়ে গেছে!

রাতের খাবার খুবই স্বাভাবিক সবাই সাড়লো।আজ নীতুও মিলনের সাথে খেতে বসেছে।আগে তা করতো না।আজ করেছে।মিলন খাওয়ার টেবিলে বসে ইতুকে একবার বললো,”কাল আমার অফিস আছে ইতু।তুমি আমার সাথে চলো।সারাদিন তো থাকলেই।”
ইতু হ্যা না কিছুই বললো না।কিন্তু খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ পরই রেডি হলো ইতু। তুতুন ঘুমিয়ে পড়েছে।রাত দশটার সময় ওরা বের হলো।বড় আপারাও একসাথে বের হলো। নীতুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশায় ইতু বসে আছে হাতে নীতুর করা পেইন্টিং। শক্ত করে ধরে আছে।ইতুর চোখে জল।ইতু কাঁদছে নিঃশব্দে!মিলনের কাঁধের উপর তুতুন ঘুমিয়ে আছে।এক হাতে তাকে আগলে ধরে আছে মিলন।ইতু শব্দ না করলেও মিলন বুঝে গেলো ইতু কাঁদছে।মিলনের কষ্ট হচ্ছে। ইতু কঠিন কিন্তু মেয়েটা ভালোবাসতে জানে ভীষণ! মিলন একহাত ইতুর হাতের উপর রাখলো,তারপর মৃদুস্বরে বলে উঠলো,”সরি!সরি!ভীষণ ভাবে সরি ইতু!তুমি কি আমাকে একটা বার ক্ষমা করবে!”
ইতু মুখে জোরে না বললেও শব্দ করে কেঁদে ফেললো।মিলন একহাতে সন্তান আর অন্য হাতে পরম নির্ভরতায় আগলে ধরলো স্ত্রীকে!

আজ সারাদিন তাজ কল করেছে কিন্তু নীতুকে পায়নি।চিন্তায় চিন্তায় তাজ রাতের খাবারটাও ঠিকমত খেতে পারলো না। অবশেষে আবার কল দিতেই নীতু রিসিভ করলো।তাজ ভেবেছিল নীতু কল রিসিভ করলেই একশো টা ঝাড়ি দিবে কিন্তু কিছুই পারলো না।নীতু ফোনের ওপাশে মিষ্টি করে ততক্ষণে সরি বলা শুরু করেছে।
“হ্যালো তাজ। আমি ভীষণ সরি।সরি, সরি, সরি!একদম খেয়াল ছিলনা আজ ফোনের কথা।বিশ্বাস করুন,মন থেকে সরি!”

তাজ গলার স্বর কঠিন করে বললো,”কি এমন করেছো নীতু যে মোবাইলের দিকে তাকাতে পারো নি?

নীতু কন্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে সারাদিনের ঘটনা বলা শুরু করলো।বলা শেষে নীতু বললো,”জানেন আমি ভাবতাম বাবা আর দাদাভাই ছাড়া আমাকে কেউ ভালোবাসে না।কিন্তু আজ জানলাম লিষ্টে আর একটি নামও যোগ হয়েছে, ইতু!”

তাজ এবার নরম হলো।নীতুর খুশি যেন নিমিষেই তাজকে ভিতর থেকে ছুঁয়ে দিলো।তাজ ভারী স্বরে বলে উঠলো,” নীতু,সবসময় ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশে বিদ্যমান থাকে না,কিছুটা অপ্রকাশিতও থাকে!আর দিনশেষে জিত কিন্তু অপ্রকাশ্য ভালোবাসারই বেশি ঘটে!সারাদিন ভালোবাসি, ভালোবাসি বলে মুখে বুলি আওড়ানোকে ভালোবাসা বলে না।ভালোবাসা উপলব্ধি করতে হয়!সত্যিকারের ভালোবাসা অনুভূতির জোরে উপলব্ধি করতে হয়,আবেগ দিয়ে নয়!”

নীতু বিমুগ্ধ স্বরে বলে,”আপনি ভীষণ সুন্দর করে কথা বলেন তাজ!”

তাজ নীতুর কথায় হো হো করে হেসে দেয়। নীতু বুঝতে পারেনা এত হাসির কি হলো?

*********-
অভীকের মা ডিম ভাজি করছে আর মুখে গজরগজর করছে।অভীক অবাক হলো।রাত বাজে দশটা আর মা এখন ডিম ভাজি করছে।অভীক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। তার মায়ের কান্ড কারখানায় অভীকের মাথা ঘুরাচ্ছে। বড় স্যারের কথা মত আজ অভীক গিয়োছিল তার মাকে নিয়ে বড় স্যারের ভাইয়ের বাসায়। সেখানে ডিনার করার কথা ছিল।কিন্তু মা শেষ মুহুর্তে এসে পাল্টি খেলেন।খাওয়ার আগ মুহুর্তে মা এমন ভাবে অসুস্থতার ভান করলো যে অভীক বুঝতেই পারেনি মা ভান করছে।বড় স্যার তো থতমত খেয়ে গেলেন।অভীক কোন রকমে মাকে নিয়ে ডক্টরের উদ্দেশ্যে বের হলো সেই বাসা থেকে। নিজেকে যে কিরকম বিব্রতকর লাগছিল।গাড়ি চালিয়ে কতদূর আসার পরই মা সোজা হয়ে বসলেন।বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাতে বললেন।আর এখন সে রাতের খাবারের জন্য ডিম ভাজি করছে।এসবের মানে কি?

খেতে বসে অভীক কটমট করে বললো,”মা এসবের মানে কি?”
“আমার সাথে এমন চোখ গরম করে কথা বলবি না।আমি তোর মা বুঝেছিস।চোখ নামা।”

অভীক হাল ছাড়ার ভঙ্গিতে সত্যি চোখ নামিয়ে ফেললো।খাবারের প্লেটে আঁকিবুকি করতে শুরু করলো।
অভীকের মা এবার বলা শুরু করলেন,”ঐ মেয়ে দেখেছিস।কি যেনো নাম। হ্যা ঐশী! মেয়েটার রুমে যেয়ে তো আমি টাসকি।সারা রুমে শার্ট প্যান্ট পড়া ছবি।কতগুলো ছেলেমেয়েদের সাথে। তারউপর কি করলো দেখলি না।রাত নয়টার সময় হুট করে একগাদা বন্ধু বান্ধব চলে আসলো।কি জানি পার্টির কথা বললো।সব গুলোর পোশাক দেখেছিলি।তার উপর তিনটা ছেলেও ছিল।ঐশী মেয়েটা সবার সাথে গলাগলি শুরু করলো।তুই এসব খেয়াল করবি কি।তুই তো শুধু তোর বড় স্যার আর তার ভাইয়ের কথা গিলছিলি।এই মেয়েকে আনবো আমি বউ করে?কখনো না।”

অভীক ফোঁস করে দীর্ড়শ্বাস ছাড়লো,”মা সেটা বললেই তো হতো।এতকিছু করার কি দরকার ছিল?তাছাড়া মা এ যুগে এটা কমন!”

“মেয়ের হয়ে এত ওকালতি কেন করছিস?তুই এই যুগের কোন মেয়ের পেটে হোসনি হয়েছিস আগের যুগের মেয়ের পেটে।তাই কথা বন্ধ। আর পছন্দ হলে তখন অন্য বিষয়।”

!”উফফ! মা থামো তো।আমি কখন বললাম আমার পছন্দ হয়েছে?আমি বড়োর মত ভুল করছি না।বিয়ে আমি তোমার পছন্দেই করবো কারণ তখন বউ কোন অন্য্যায় করলো আমায় আর দোষ দিতে পারবে না উল্টো তোমায় আমি দোষ দিবো।”…..বলে অভীক হেসে দিলো।

“হয়েছে এখন নাটক কম কর।আর খা! মা ছেলের দুজনের পছন্দেই বউ আনবো।”

“এমন মেয়ে তুমি জীবনেও পাবে না।সো বিয়ে আর আমার করা হলো না।”

“তুই বিয়ে করবি সাথে তোর বাপও বিয়ে করবে!”

অভীক চরম অবাক হওয়ার ভান করে বললো,”মা তুমি আমার মৃত বাপকেও ছাড়লে না।সে কি করে বিয়ে করবে?”

অভীকের মা চোখ গরম করে ছেলের দিকে চাইলেন।অভীক মায়ের চাহনি দেখে হেসে ফেললো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here