কাননবালা,শেষ পর্ব

0
440

#কাননবালা,শেষ পর্ব
#আয়েশা_সিদ্দিকা

ফাল্গুনীর পাতা ঝড়া বিকেল।প্রকৃতিতে মৃদুমন্দ সমীরণ। জ্বলজ্বলে সূর্যের আলো মিয়িয়ে আসছে।নরম সন্ধ্যা আলোর পেলবতা ছুঁয়ে দিচ্ছে চারপাশ।
সেই নরম আলোয় গা ভিজিয়ে,টুপটাপ ঝরে পরা পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ মিলিয়ে একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে।হাঁটার গতি মন্থর! পাড়টানা ছাই রঙা সুতি শাড়ির আঁচলখানি মাটি স্পর্শ করেছে মেয়েটির অজান্তেই!চোখ দুটো কেমন রুক্ষ, বিষন্ন! ঠোঁটের কোণে চাপা অভিমান।এই সুক্ষ্ম সূচালো অভিমান কার উপর?মেয়েটি বুঝতে পারছে না। নিজ ভাগ্য নাকি ওই উপরে বসে থাকা সৃষ্টিকর্তার উপর! কিছুই বুঝতে পারছে না। মেয়েটি হাঁটছে আলস্য পায়ে, ক্লান্ত শরীরটা টেনে টেনে। একটু খানি সুখ,একটু প্রাণোচ্ছল হাসি যেন কোন অলিক স্বপ্ন! বুকের ভাঁজে বিধ্বস্ত অনুভূতির হাহাকার। চোখ জ্বলছে।জ্বলছে মনভূমি অঞ্চল! মেয়েটি রাস্তার পাশের ফুটপাতে বসে পড়ে।নিঃশ্বাস আটকে আসছে যেন। হা করে বড় বড় শ্বাস নেয়। চঞ্চল চড়ুইর মত দিগ্বিদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নিজেকে বড় একা মনে হয়। আবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করে আকাশ পানে দৃষ্টি মেলে কষ্টমিশ্রিত চোখে হাসে! মেয়েটি বড় অদ্ভুত! ছোট থেকেই একদলা কষ্টে জড়াজড়ি করেও হাসতে জানে।
মুহুর্তেই মেয়েটির টনক নড়ে। সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাটি ছুঁই ছুঁই শাড়ির আঁচলটা যত্নে তুলে কাঁধে ফেলে।হাতের ইশারায় রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। ঠিক তখনই মেয়েটির সেলফোন বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালী গমগমে অস্থির স্বরে বলে ওঠে, “তুই ঠিক আছিস নীতু?”

“আমি ঠিক আছি দাদাভাই।এবং খুব ভালো আছি।” ভীষণ আত্মবিশ্বাসী কন্ঠ।

জায়েদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।
নীতু ফিসফিস করে বলে,”আমি সত্যিটা জানতে চাই দাদাভাই। সেই সত্যিটা যতই কুৎসিত হোক তবুও আমি জানতে চাই।এত দ্বিধা, সন্দেহ, কষ্ট নিয়ে বাঁচা যায় না।জানো তো দাদাভাই,তোমার বোন এতটাও শক্ত নয়!সব হারিয়েছি, এখন একটু স্বস্তির আফসোস আর করতে চাই না। ”

নীতুর বলার আঁচে জায়েদ কেঁপে ওঠে। আজকের রাতটা শুধু। এরপর হয়তো কিছু কুৎসিত সত্যি বেড়িয়ে আসবে নতুবা সব ঠিক থাকবে।অজানা ভয়ে জায়েদের শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। সব কিছু ঠিক হবে তো? নাকি আবার এলোমেলো হয়ে যাবে?

********

কলিং বেলটা বেজে উঠতেই রুশিয়া বেগম সচেতন হোন।তটস্থ পায়ে হেঁটে এসে সদর দরজা খুলতেই নীতুর শান্ত মায়াবী মুখটা দেখে একগাল হেসে ওঠেন। নীতুও ক্লান্ত ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে শাশুড়ীর হাসির বদলে হাসি দেয়। রুশিয়া বেগম বুঝে যান। নীতুর কিছু একটা হয়েছে। নীতু চুপচাপ নিজের ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে। হ্যান্ডব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে মেরে বিছানায় শুয়ে পড়ে।ভারী হয়ে থাকা চোখের পাতা ক্রমেই জড়িয়ে আসতে শুরু করে।

রুশিয়া বেগমের মন খারাপ হয়ে গেলো। নীতুর দৈন্যদশা তাকে ক্রমেই কাতর করে ফেলছে। ধীরপায়ে হেঁটে রুমে যায় তিনি।নীতুকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে ভাবেন চলে যাবেন।পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলে নীতুর শিয়রে বসে পড়েন। মা মা দৃষ্টিতে বুঝে ফেলেন, নীতু ঘুমায়নি। কিছু একটা হয়েছে তার মেয়ের।সেই কিছু একটা তার শক্ত মেয়েটিকে ভেঙে চূড়ে দিচ্ছে। রুশিয়া বেগম সরলেন না।আলতো হাতে মেয়ে সম ছেলের বউয়ের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলেন।

নীতু বুঝলো এই আদর মাখা মমতায় মিশে আছে তার জন্য গভীর চিন্তা। নীতু তবু নড়লো না।চাইলো না।কেবল চোখ বুঝে থম মেরে পড়ে রইলো।
নীতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুশিয়া বেগমের সেই ভয়ংকর সন্ধ্যাটার কথা মনে পড়ে গেলো।যেই সন্ধ্যায় তার ছেলের বউ নিয়ে ফেরার কথা।অথচ তার বদলে একটা দুঃসংবাদ এসেছিল তার দ্বোর গোড়ায়! কি ভয়ংকর সবকিছু।সবাই পাগলের মত ছুটেছিল সেই স্পটে।কিন্তু তিনি ঠায় বসে রয়েছিলেন বরণডালা নিয়ে। রুমি পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে তাকে ধরে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো।কত মানুষ করিডোর জুড়ে।কেউবা দুই পক্ষের আত্মীয় স্বজন। কেউবা কৌতুহলী হয়ে দেখছে মর্মান্তিক ঘটনা।সবার আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছিল চারপাশ।দুটো স্ট্রেচারের উপর শুয়ে আছে দু’জন। বিয়ের পোশাকে দুজন আবরিত! রক্তে রাঙায়িত তাদের অবয়ব!কি অদ্ভুত ভয়ানক দৃশ্য!
রুশিয়া বেগমের চোখ ভিজে আসে।আঁচলে চোখ মুছেন।সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে আজও তার বুক কাঁপে।

চিন্তিত মুখে কোলে সাত মাসের ছেলে নিয়ে রুমি নীতুর রুমে প্রবেশ করে।শাশুড়ীকে ভেজা চোখে বসে থাকতে দেখে বুঝে ফেলে সেদিনের সেই কাল রাতের স্মৃতি মনে করে কাঁদছে। রুমি নিজেও শান্ত ভঙ্গিতে পায়ের কাছে বসে থাকে।খাটের উপর বিধ্বস্ত মুখশ্রীর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রয় অপলক চোখে!
রুমির কাছে নীতু হলো এক আশ্চর্য মেয়ে।এত এত তীব্র কষ্ট অথচ মেয়েটা কতটা শান্ত,ধীর! রুমি নিজেও এতটা পারতো না।নীতুর মত মেয়েরা হয়তো কষ্ট সইতে সইতে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়।

রুমির চোখেও ভেসে ওঠে সেই কাল রাত্রি। অভীকের ইনজুরি ছিল বেশি।মাথায় তীব্র আঘাত।পাজর ভেঙে গিয়েছিল। হাতে পায়ে অজস্র জখম। নীতুর পেটে ছিল অজস্র কাঁচের টুকরোর আঘাত।ওভারিতে পর্যন্ত ঢুকেগিয়েছিল।অন্যান্য জখম আর প্রচুর রক্তক্ষরণে দুজনেই মৃতপ্রায়। ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।সেই মুহুর্তে রুমির মনে হয়েছিল কেয়ামত বুঝি এসে গেছে। দুটো নিঃস্ব মায়ের আহাজারি আর অভীক নীতুর ভাইবোনদের জড়াজড়ি কান্নায় পুরো হসপিটাল কেঁপে উঠেছিল।সবার একটাই মিনতি।বেঁচে ফিরুক স্বপ্নবাজ মানুষদুটো।যাদের একসাথে বাঁচার কথা ছিল,ভালোবাসার কথা ছিল,ঘর সাজানোর কথা ছিলো! কিন্তু একসাথে মরার কথা তো ছিল না!

অভীক কোমায় চলে গিয়েছিল। আর নীতু দীর্ঘ সাতাশ দিনের মরণ যন্ত্রণা সয়ে বেঁচে তো ফিরেছিল কিন্তু সেই সাথে হারিয়েছিল মাতৃত্ব! সেই নির্বাক নীতুকে দেখে কেঁদেছিল বুঝি পাষাণও। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে নীতু উঠে দাঁড়িয়েছিল।নিস্তেজ মানুষগুলো কে আশা দিয়েছিলো।অনীকের হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,”আমার অভী-কে মাদ্রাজ নেয়ার ব্যবস্থা করুন ভাইয়া।যতদ্রুত!আর না হলে আমার জ্যান্ত দাফনের ব্যবস্থা করুন!”

এই এতটুকুরই বুঝি দরকার ছিল। ডাক্তারের কথায় আশা ছেড়ে দেয়া প্রত্যেকে আবার আশা দেখেছিল।শাশুড়ী মা নীতুর কোমড় জড়িয়ে কেঁদেছিল শিশুর মত।সেই শিশু মাকে নীতু মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,”কাঁদবেন না মা।অভীক কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করবে না।ও ফিরবে!আমার কাছে,আপনার কাছে!আমাদের এখনো অনেক হিসেব বাকি যে! ওকে যে ফিরতেই হবে!”

সেই দূর্বল নিস্তেজ নীতু অভীকের জন্য গোটা পৃথিবীর সাথে লড়েছে।অনীক, জায়েদ মাদ্রাজে থাকাকালীন সময় অবাক হয়ে দেখতো ধৈর্য্যশীল নারীকে।যে জোর করে খেতো না খাওয়ার মত!যে নিভু চোখে চেয়ে থাকতো নতুন ভোরের জন্য! যে ঠোঁট নাড়াতো প্রিয় মানুষটার জন্য!

আল্লাহর ইচ্ছে হয়তো ছিলো অন্যরকম।ভালোবাসা ময় দুটো মানুষকে ভালোবাসার তীব্র দহনে ফেলে পরিক্ষা করছিলো।একমাস সতেরো দিন পর অভীক কোমা থেকে ফিরে।মাথা আর পাজরের জন্য করা হয় তিনটা অপারেশন।
রুমির মনে আছে অনীক তাকে ফোন করে সেই সময়ের ঘটনা বলতো আর কাঁদতো।অনীকের নীতুকে নিয়ে ভয় হতো।কখন যেন ডাক্তার দুঃসংবাদ দেয় আর অর্ধমৃত নীতু পুরোপুরি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। জায়নামাজের পাটিতে বসে রোজা রাখা স্ত্রীটিকে স্বামীর জন্য প্রার্থনায় মত্ত থাকতে দেখতো।অনীক,জায়েদ আশ্চর্য হতো।এত মনোবল!এত ধৈর্য্য! এত আত্মবিশ্বাস কি করে কোন নারীর থাকতে পারে!এই নারীকে উপেক্ষা করা কি এতই সহজ?

সৃষ্টিকর্তা উপেক্ষা করতে পারে নি।গোটা চারটা মাস লেগেছিল অভীকের পুরো সুস্থ হতে।সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটির জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করা নীতু অভীকের সুস্থতা শুনেও সামনে দাঁড়ালো না।অনীক, জায়েদ ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলো।এই খবরে গোটা পরিবার খুশিতে ভাসছিল অথচ নীতু ছিল নির্বেকার।হোটেল রুমে শুয়ে বসে থাকতো আর পড়ে পড়ে ঘুমাতো।অভীক কে প্রথম থেকে সব খুলে বলেছিল অনীক।সব থেকে বড় বিস্ময় অভীকও একবার বললো না, নীতুকে নিয়ে আসতে। জায়েদ, অনীকের বুক কেঁপে উঠেছিল।অজানা ভয়ে! আবার কোন ঝড় আসছে না তো? অভীক কি তবে নীতুর অক্ষমতা মানবে না?

ঠিক সাতদিন পর লাল রঙের একটা শাড়ি পরে,খোলা চুলে নীতু হসপিটাল করিডোরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো।স্নিগ্ধ রুপে!অনীকের মুখ আমচুর হয়ে গিয়েছিল। নীতুর অসম সাহসী রুপ অনীককে ততদিনে মুগ্ধ করেছিলো।ভাইয়ের এমন নিরাবতা যদি এই মেয়েটিকে কষ্ট দেয়? তবে?মরে যাবে তো নীতু!

নীতুকে একা ছাড়লো না।কেবিনে জায়েদ,অনীক তারাও প্রবেশ করলো নীতুর সাথে। ভয়ে তাদের কলিজা কাঁপছে।

অভীক হসপিটালের বেডে আধশোয়া হয়ে কাচের দেয়াল গলে দূরের আকাশ দেখছিলো।শরীর সুস্থ হলেও অসুস্থতার ছাপ এখনো দূর হয়নি। শুভ্র মুখটা কেমন মলিন।চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রাণ।
দরজা খোলার শব্দে অভীক তাকালো।নীতুকে দেখা মাত্র নিষ্প্রাণ চোখে যেন মৃদু ঝিলিক দিয়ে উঠলো। ঠোঁটের কোণটাও হালকা প্রসারিত হলো বুঝি? কে জানে!

নীতু শ্লথ পায়ে হেঁটে অভীকের বেডে গিয়ে বসলো। ঠিক অভীকের বুকের কাছ বরাবার। অভীকের কপাল কুঁচকে গেলো।দন্ডায়মান দুটো আহাম্মককে দেখে মেজাজ খারাপ হলো।সেই আহাম্মকেরা কিন্তু কিছু বুঝলো না।তারা দুরুদুরু বুকে চেয়ে রইলো।
নীতু পদ্ম ডাগর চোখে চঞ্চল দৃষ্টি মেলে অভীককে পরখ করলো।খুব সূচালো ভাবে!কখনো ভালোবাসার দৃষ্টিতে! কখনো ব্যথিত দৃষ্টিতে!
আলতো হাতে শুভ্র ব্যান্ডেজে হাত বুলালো।হাত বুলালো অভীকের শুভ্র মুখটিতে! কি তৃষ্ণার্ত চাহনি! পিপার্সাত মন।
আলতো করে অভীকের বুকে মাথা রাখলো।অভীক কেঁপে উঠলো! নীতু ফিসফিস করে বললো,””আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে আমি আপনাকে পেয়েছি!তবে কি আপনাকে আমি সত্যিই পেয়েছি, অভী?”

কি ব্যথাতুর অভিমানী কন্ঠ!

“পেয়েছো।”….. অভীকের কন্ঠস্বর ভেজা শোনালো।খানিকটা কাঁপলও বুঝি। নীতু কাঁদছে না।তবুও অভীক খোলা চুলে হাত বুলাচ্ছে। অভীকের চোখ দুটো কেমন অশ্রুসিক্ত!

অনীক জায়েদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।কি নির্ভার প্রাণোচ্ছল কথা।’আপনাকে কি আমি পেয়েছি?’ সত্যিই তো নীতু নারীর মূল অস্তিত্ব হারিয়েছে।মাতৃত্বহীন নারী কি সত্যিই অভীককে পেয়েছে? অভীকের ছোট্ট উত্তর বলে দিলো সবকিছু! দু’জনেই যেন জেনে গেলো শত প্রতিবন্ধকতা শেষেও তারা একে অপরের।ভালোবাসতে
সবাই পারে।কিন্তু সকল খারাপ পরিস্থিতিতে সেই ভালোবাসাকে ভালো রাখতে সবাই পারে না!

অনীক আর জায়েদকে জড়াজড়ি করে কাঁদতে দেখে অভীক কান্নামিশ্রিত কন্ঠে ধমকে বলে,” বড়ো,দাদাভাই তোমরা দু’জন এখানে কি করছো?তোমাদের জন্য বউটাকে একটু ঠিকমত জড়িয়ে ধরতে পারছিনা!কি বোকা তোমরা!”

ওরা দু’জন কান্না চোখে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো।অভীক নীতুকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো বুকের মাঝে।চোখ থেকে টপটপ করে পড়ছে অশ্রুকণা।কিন্তু আশ্চর্য! নীতু কাঁদছে না।একফোঁটাও না।চোখের দৃষ্টি কাচের দেয়াল গলে দূর আকাশে।ক্লান্ত মস্তক অভীকের প্রশস্ত বুকে। অভীক একসময় মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে ,”কাননবউ?”

“হুম।”

“ভালোবাসি!”

“আমিও!”…. নীতুর নিরব কন্ঠ।

অভীক আরো একটু শক্ত করে ধরে নীতুকে।নীতু ঘাপটি মেরে পরে থাকে বুকের ভাজে।খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়তে থাকে।নীতুর চোখে অদ্ভুত শান্তিতে ঘুম নেমে আসে। নীতু বিড়বিড় করে বলে,” এইখানটায় এত শান্তি কেন অভী? এত শান্তি এইখানটায় পুষে কেন রাখলেন?আপনি ছাড়া সকল কিছু কেন এত অশান্তিময়?কেন অভী?”

অভীক কিচ্ছু বললো না।শুধু শক্ত করে ধরে রাখলে তার কাননবউকে।

সেই সব স্মৃতি আজ শুধুই বেদনার। দেড় বছর আগের স্মৃতি না চাইতেও সামনে আসে। রুমি তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে শাশুড়ী মাকে রুম থেকে নিয়ে যায়।

রুশিয়া বেগম সোফায় বসে হাহাকার করে বলে,”ও রুমি আমার মেয়েটার আবার কি হলো? ”

রুমি নিজের চিন্তা আড়াল করে বলে,”কিচ্ছু হয়নি মা।আমাদের নীতু খুব সাহসী। কোন কিছু ওকে ভেঙে দিতে পারবে না। হয়তো মনটা ভালো নেই।”

রুশিয়া বেগমের চিন্তা দূর হয় না।রুমি অতুল কে কোলে নিয়ে নীতুর রুমের দরজার উড়ন্ত পর্দাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাদ্রাজ থেকে ফেরার পর এই বাড়িতে উৎসব লেগেছিল।কিন্তু সবাই যেন নীতুকে আক্রমণ করতেই লেগে পড়েছিল।নীতু অপয়া!বিয়ের দিন না হলে কেন ওমন ঘটনা ঘটলো?তারউপর মা হতে পারবে না।বন্ধ্যা!সকল কথা কানে গেলেও নীতু ছিল নির্বেকার।এক্সিডেন্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত নীতুকে কেউ কাঁদতে দেখেনি।সবার কথায় তখনও কাঁদলো না। শাশুড়ী মা সবার উপর রেগে গিয়েছিলেন।সবাইকে বলেছিলেন,”যাদের মনে হয় আমার বউ অপয়া তাদের বলছি,ওই গাড়িতে শুধু নীতু নয় অভীকও ছিল।তবে অপয়া দুজনেই।আর যদি বলেন নীতু বন্ধ্যা?তবে বলবো আমার সন্তানরা যদি আজ বেঁচে না থাকতো তবে কি এসব বলতে পারতেন?কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়।আমার সন্তান ফিরছে।এই যথেষ্ট। আর আজকাল বাচ্চা কত ভাবে আনা যায়।তাই যারা যারা এই অহেতুক চিন্তা করছেন তারা এখুনি বের হোন।আপনাদের কু নজর আমার পরিবারে আর চাই না।আমরা ভালো থাকতে চাই।”
শাশুড়ী মার কথায় সেদিন রুমি ভীষণ গর্বিত হয়েছিলো।এমন একটা পরিবারকে সে কি না আগে অবহেলা করতো?ছি!নিজের উপরও ঘৃণা হয়েছিল।

নীতুর কাছে রুমির অনেক ঋন।অতুল জন্ডিস নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিল।শিশু ওয়ার্ডে রাখতে হয়েছে টানা দশদিন।ওই সময় নীতু দিনরাত এক করে অতুলের কাছে থেকেছে।তাই তো আজ অতুলের মামণির স্থান পেয়েছে নীতু। অতুল উসখুস করে ওঠে। তার মামণি আজ তাকে একবারো কোলে নেয়নি।আদর করেনি।ছোট্ট শিশুটির এমন ছটফটে স্বভাবে রুমির মন খারাপ হয়ে যায়।রোজ অফিস শেষে নীতু বাড়ি ফিরে অতুলকে নিয়ে পরে থাকে।তখন হাতে পায়ে ঝাড়া দিয়ে রুমি ঘুরেফিরে।কখনো অনীকের সাথে বাহিরে যায়। নিজেকে সময় দেয়।

অভীক ফিরলো রাত দশটায়। অভীককে দেখে অনীক মেজাজ খারাপ করে বললো,”এত দেরি কেন করেছিস?অফিস কি তুই একলাই করিস? ”

অভীক সোফায় গা এলিয়ে বলে,”মেজাজ দেখাচ্ছো কেন বড়ো?কাল বিদেশি ক্লায়েন্ট আসবে। অনেক কাজ ছিলো।”

“তুই তোর কাজ নিয়ে থাক।নীতুর কোন খবর কি রাখিস? মেয়েটা বাড়ি ফেরার পর থেকে নিজের রুমে শুয়ে আছে।কোন কথা বলছে না।কি হলো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

অভীক আলতো হাসে।ভাইয়ের কপালে নীতুর জন্য চিন্তার ভাঁজ দেখে ভালোও লাগে।ভাবি আর মাকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে বলে,”চিন্তা করো না ভাইয়া।নীতুর মনোবল সবার মত না।ও নিজেকে ভেঙে চূড়ে গড়ে নিতে জানে।তাই তো তোমার ভাই তাকে এত ভালোবাসে। আর সবকিছুর জন্য আমি তো আছি!এত চিন্তা কিসের?”

‘আমি তো আছি’ এই বাক্যটা অনীকের চিন্তা দূর করে দেয়। অভীক টাইয়ের নটটা লুজ করতে করতে রুমে যায়। নীতুকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে বিছানার উপর ঝুঁকে নীতুর কপালে আলতো চুমু দেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় শাওয়ার নিতে। শাওয়ার নিয়ে ট্রাউজার পরে খালি গায়ে এসে নীতুর পাশে শুয়ে পড়ে।সদ্য গোসল করা ঠান্ডা শরীর দিয়ে নীতুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। হিম শীতল করা স্পর্শে নীতু কেঁপে ওঠে।সেই আলতো কাঁপন টুকু বুঝতে পেরে অভীক মৃদু হাসে।জোর করে নীতুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে গালের দু’পাশে আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বলে,”অভিনয়ে তুমি বড্ড কাঁচা কাননবউ।তবুও মিছে কষ্ট কেন করো?”

নীতু টিপটিপ করে তাকায়। অভীক টুকুস করে নীতুর নাকের ডগায় চুমু খায়। মৃদুহেসে অভীকের নগ্ন বুকে মুখ গুঁজে নীতু।অভীক একহাতে নীতুকে আরো কাছে টানে।আরেক হাতে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”জানতে চাইবো না এই মন বিষন্নের কারণ কি?জানতে চাইবো না কোন কষ্ট লুকাচ্ছো আমার বুকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে? তোমার যখন ইচ্ছে হবে তখন বলো।শুধু এতটুকু বলবো, তোমার কষ্ট মাখা মুখ আমার অসুখের কারণ কাননবউ!তা কি তুমি জানো না?নাকি জেনেও আমাকে অসুখে ভুগাতে ভালো লাগে তোমার?”

নীতু কিছু বলে না।নিজেও অভীককে আঁকড়ে ধরে জোড়ালো ভাবে।মিশে যেতে চায় ওই আকাশের মত প্রশস্ত বুকে। যেখানে কোন নোংরামি নেই,নেই কোন কপটতা! আছে শুধু নির্মল ভালোবাসা!

অভীকের কন্ঠে দুষ্টুমির আভাস।নীতুর কানে ফিসফিস করে বলে,”তুমি দিনদিন দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো কাননবউ!শুধু আদর নেয়ার বাহানা খোঁজো। বললেই তো হয়। আমি কি আর না করি?”

নীতু অভীকের বুক থেকে মুখ তুলে চোখ গরম করে তাকায়। অভীক ঠোঁট কামড়ে হাসে।নীতু মেজাজ দেখিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে।অভীক এবার গা দুলিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলে।

*********

নীতু যখন জায়েদের কল পেলো তখন মধ্য দুপুর।দুপুরী রোদে চরাচর খাঁ খাঁ করছে।অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নীতু বেড়িয়ে পড়ে।অভীক একবার জানতে চাইছিলো কিন্তু অফিসে আছে বলে কোন জোড় করতে পারে নি।

জায়েদ একটা নির্জন পার্কে বসে পায়চারি করছে।হাতে কিছু আশ্চর্য মূলক সত্য প্রমাণের কপি। জায়েদে মাথা ধরে আসে।ভোঁতা যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছে মাথা।দূর থেকে নীতুকে হন্তদন্ত পায়ে হেঁটে আসতে দেখে জায়েদ ফাঁকা ঢোক গিলে।মেয়েটিকে কি করে দেখাবে সব? বেঁচে থেকেও যে মরে যাবে মেয়েটা!

নীতু সামনে এসে দাঁড়ায়। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে নীতুর। নীতুর হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে জায়েদ ফাঁকা বেঞ্চ টাতে বসে পড়ে।নীতু স্তব্ধ দৃষ্টিতে কাগজে স্বীকারোক্তি মূলক বাণী পড়ে।চোখে তখনও একরাশ অবিশ্বাস। জায়েদ ব্যথিত দৃষ্টিতে নীতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা এ জীবনে আর কত আঘাত সইবে?

নীতু অস্ফুটে বলে, “দাদাভাই? আমার ধারণা মিথ্যে কেন হলো না?মিথ্যে কেন হলো না?”

ক্ষণকাল পরেই নীতু হাতের মুঠোয় কাগজটা শক্ত করে ধরে উল্টো পথে হাঁটা ধরে।জায়েদ হতভম্বের মত কতক্ষণ চেয়ে থেকে নিজেও নীতুর পিছু নেয়।

*******

এক্সিডেন্টের পর যখন সব কিছু ঠিক হতে চলছে তখন হুট করেই একদিন নীতু ফোন করে বললো জায়েদকে,”দাদাভাই ওই নির্জন রাস্তায় ওত বড় ট্রাক কি করছিল? আর পুরো রাস্তা ফাঁকা থাকতে কেন ধাক্কা দিতে হলো? আমার সন্দেহ হচ্ছে দাদাভাই।তুমি খোঁজ নেও।আমি সত্যিটা জানতে চাই।”

জায়েদ আপ্রাণ চেষ্টা চালালো।কিছুই জানতে পারলো না।সময় গড়াতে লাগলো।পরে এ ব্যাপরে রিশাকে নীতু বললো। রিশা কি করে যেন সেই ট্রাক ড্রাইভারকে ধরে ফেললো।আস্তে আস্তে টোপ ফেলে তাকে আয়ত্তে এনে সব জানলো।পুলিশের হেফাজতে কাল রাতে সব কিছু স্বীকার করেছে গাড়ি চালকটি।যেখানে সে স্পষ্ট ভাবে বলেছে,সব কিছু সে তাজের কথায় করেছে।

********
অনবরত কলিং বেলের শব্দে সেতুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।এত অধৈর্য্য হয় মানুষ!
সদর দরজা খুলতেই নীতুর মুখটা দেখে বিরক্তি উবে গিয়ে একরাশ খুশি ঝলমলিয়ে উঠলো। নীতুর তখন বিধ্বস্ত অবস্থা!কলিজা পুড়ছে!শরীর জ্বলছে!
বোনের খুশি মাখা মুখটা যেন আরো ব্যথিত করে তুললো। তেজস্বী কন্ঠে বললো,”তাজ কোথায়? ”

আপির বলার ভঙ্গিমায় সেতু চমকালো।আপির পিছনে চিন্তিত মুখে জায়েদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো অবাক হলো।সেতু কপালে ভাঁজ ফেলে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।

রুমের পর্দা সরিয়ে তাজ বের হলো। কে এসেছে দেখার জন্য। বসার রুমে আসতেই রুদ্রমূর্তি নীতুকে দেখে চমকালো।এরি মধ্যে রুমে তাজের বাবা মাও এসে হাজির। নীতু তাজের সরল,নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। নীতুর এমন রুপে সবাই অবাক! তাজ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না।মুহুর্তেই নীতু ঝড়ের মত ঝাপিয়ে পড়লো তাজের উপর।এলোপাতাড়ি চর থাপ্পড় দিলো।সবাই অবাক! তাজ চেষ্টা করলো বাঁধা দেয়ার কিন্তু পারলো না। নীতু যেন বদ্ধ উন্মাদ! তাজের দৃষ্টি ক্রমেই ভয়ে জড়িয়ে আসলো।নীতু থামলো।তাজের কলার চেপে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। বহু দিনের জমানো কান্না!

কান্না,রাগ মিলে মিশে চিৎকার করে বললো,”কেন তাজ?কেন? এভাবে শেষ না করলেও পারতে!….. তাজ মেরে ফেলতে চাইছিলে আমায়?এতটাই ঘৃণা জমেছিলো! কেন করলে?মরিনি তাজ কিন্তু বেঁচে থেকেও মরে গেছি আমি।আমার মাতৃত্ব কেড়ে নিয়েছো তুমি! যে মানুষটা শুধু একটু সুখ দিতে চেয়েছিল আমায় তাকে তুমি চরম আঘাত করেছো।চিরজীবনের জন্য বাবা ডাক মুছে দিয়েছো!কেন করলে তাজ?আমাদের সম্পর্কের শেষ হয়েছিল তাজ কিন্তু শেষটা তো সুন্দর ছিলো!তুমি কেন সব কিছু ধ্বংস করলে!…….আমার প্রথম প্রেম তুমি,প্রথম ভালো লাগা,প্রথম পুরুষ হয়ে কি করে পারলে আমার সব শেষ করে দিতে? বুক কাঁপলো না একবারও? ভয় হলো না।যাকে ভালোবাসো তার মৃত্যু কামনা কি করে করলে? ”

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নীতু।কৃষ্ণ মুখশ্রী রক্তাভ!কণ্ঠমণি তে স্পষ্ট তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি! শরীরে বিষের আলোড়ন! তাজ নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।নীতু পাগলের মত মেঝেতে বসে পড়লো।নিজের চুল খামছে ধরলো।বিড়বিড় করে বললো,”ঠকে গিয়েছি আমি।তীব্র ভাবে ঠকেছি।”

নীতু পুনরায় উঠে দাঁড়ায়। তাজের নত মাথা সোজা করে নিজ হাত দিয়ে।চোখে চোখ রেখে বলে,”বিশ্বাস করিনি তাজ।বারবার নিজেকে ভেঙেছি।তবুও বিশ্বাস করিনি। আমার সুখটুকু এভাবে কেড়ে নিলে!একদম নিঃস্ব আমি।তাকাও তাজ।লজ্জা পাচ্ছো?দেখো আমাকে।কি তীব্র হাহাকারে পুড়ছি।মা না হওয়ার যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়! যখনই কোন ছোট্ট বাচ্চা দেখি বুকের মাঝে চেপে ধরি। স্বার্থপরটা বুঝতে পারছো? আমাদের মারতে চেয়েছিলে দেখো কি সুন্দর মরে গেছি।সেদিন সেই আঘাতে মৃত্যু না হলেও আজ বেঁচে থেকেও মৃত আমি!…..তাজ আমার জীবনে তোমার আগমণ অমাবস্যার মত!ঠিক যেন কুৎসিত কোন অভিশাপ! ”

নীতু আর কিছু না বলে ছুটে বেড়িয়ে যায়। তাজ অবাক চোখে নীতুর ঘৃণামিশ্রিত প্রস্থান দেখলো।জায়েদ কি করবে ভেবে পেলো না। কাকে সামলাবে?নীতুকে নাকি দেয়াল ঘেষে মেঝেতে বসা স্তব্ধ সেতুকে।জায়েদ মোবাইল বের করে অভীককে সংক্ষিপ্ত টেক্সট করে সেতুর কাছে যায়।সেতু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে জায়েদের মুখপানে। জায়েদ বসে পরে।সেতু আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জায়েদকে ধরে।জায়েদ প্রাণপণে নিজের চোখের জল আটকায়।সেতু চিৎকার করে কাঁদছে।তাজ দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল! সেতুর এক একটা চিৎকারে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়।জায়েদ চোখ বুঁজে! এত কষ্ট কেন চারপাশে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here