কাননবালা,২৫,২৬

0
553

#কাননবালা,২৫,২৬
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৫

জানালা গলে ভোরের পেলব রোদ এসে তাজের মুখে পড়লো, তাজ কপাল কুঁচকে চোখের উপর হাত রাখলো।পাশ ফিরতে গিয়ে অনুভব করলো শরীরের উপর ভারি কিছু।ভালো করে তাকাতেই তাজের দৃষ্টিতে বিস্ফোরণ ঘটলো যেন।সেতু লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে!দু’জনের পরিস্থিতি বিধ্বস্ত। তাজ বড় করে দম ফেললো। এটা না হলেই পারতো? বুক ভার হয়ে আসলো।আস্তে করে সেতুকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে পরলো।সারা রাতের জ্বরের কারণে মাথা ভার হয়ে আছে।তাজ ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে কটাক্ষ করে বললো,”তুমি এরপরও নিজেকে মানুষ বলে দাবী করো?এতটা অধপতন কবে হলো তোমার!”

ফ্রেশ হয়ে শার্ট প্যান্ট পরে তাজ বেড়িয়ে পরলো।শনিবার অফিস নেই। তবুও বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো।একরকম পালিয়ে বেড়ানো যাকে বলে!নিজেকে চোর চোর মনে হতে লাগলো তাজের!এর থেকে মৃত্যুও বরং ভালো!
তাজ চলে যেতেই সেতু চোখ মেললো।চোখের কার্নিশে জল জমেছে! তাজের প্রস্থানে সেতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটালো না!

বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো একটা নম্বরে।
নীতু চা করছিল।এই সময়ে সেতুর কল দেখে গ্যাসের আঁচটা কমিয়ে কল রিসিভ করে বললো,”হ্যা বল!এতো ভোরে কি মনে করে?”
সেতু শীতল কন্ঠে বললো,”আপা, একটা জীবন কাটিয়ে দিতে ভালোবাসা থাকা কতটা জরুরী? ”

নীতুর কপাল কুঁচকে গেলো।এরকম উদ্ভট প্রশ্ন শুনে।তবুও বললো,”সেতু, একটা জীবন কাটিয়ে দিতে ভালোবাসার থেকেও ভালো থাকাটা জরুরী! ”

“আপা রাখছি।”….. বলে সেতু কট করে লাইন কেটে দিলো।নীতু কিছুই বুঝলো না সেতুর আগামাথা হীন বক্তব্যের! ফ্যালফ্যাল করে করে তাকিয়ে রইলো টগবগ করে ফুটতে থাকা চায়ের পানির দিকে।

তাজ সারাদিনে বাসায় ফিরলো না।রাতে ফিরলো ক্লান্ত শরীরে! সিগারেট আর চা ছাড়া সারাদিন কিছুই খায়নি।পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। সেতু পড়ছিল।তাজকে দেখে খুবই স্বাভাবিক স্বরে বললো,” ভাত দিবো আপনাকে?”
তাজ একবার চাইলো সেতুর দিকে।অভিযোগ বিহীন স্বাভাবিক ব্যবহার। মনে হচ্ছে নিত্য নৈমেত্তিক ঘটনা।এতটা স্বাভাবিকতা কি আদৌও আছে এই সম্পর্কে? তাজ নিজেও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,”দাও।”

দুটো মানুষ টেবিলের দুপাশে বসে আছে।রুম জুড়ে পিনপন নিরবতা। সামনে খাবার।খিদে থাকা স্বত্বেও দুজনের কেউই খেতে পারছে না।একজন চাচ্ছে অপরপক্ষ আত্মসমর্পণ করুক,দুটো কৈফিয়ত দিক!আর একজন চাইছে কিছু না বলুক অপর পাশের মানুষটা! সবকিছু থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে।
খাবার নাড়াচাড়া করে গেলো দুজনেই।কেউই খেতে পারলো না।একটা সময়ে সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।কান্নার দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে! তাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। দুচোখের পাতা বন্ধ করে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।এর শেষ কোথায়?চেয়ার ঠেলে তাজ উঠে পরলো।সদর দরজা পেরিয়ে নেমে পরলো রাস্তায়! সারারাত বাহিরে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।দমবন্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো!

************
নীতু নিখিলের কাছে ভিডিও কল দিয়ে বললো,” ভাইয়া বাবার সাথে কথা বলিয়ে দাও।বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

বাবা ছলছল চোখে তাকিয়ে নীতুকে দেখছে।ঘড়ঘড় করে আওয়াজ বের হচ্ছে কন্ঠ থেকে।কিছুই বলতে পারছে না। নীতু বাবার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেললো। মহিমা বেগমও পাশে বসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে।বাবার চোখের মিনতি বলছে,”কবে আসবি মা?”
“আসবো বাবা।একদিন এসে তোমাকে চমকে দিবো।”
মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নীতু কল কেটে দিলো।নীতুর ফিরতে ইচ্ছা করলেও মন সায় দেয় না।বাড়িতে গেলেই সবার এক প্রশ্ন,”বয়স তো পেড়িয়ে যাচ্ছে, বিয়ে করবি কবে?”
আত্মীয়রা মাকে নানান কথা বলে অতিষ্ট করে ফেলবে তখন মা নামক মানুষটা বিষন্ন চোখে নীতুর দিকে তাকিয়ে থাকবে।কান্নাকাটি করবে।তার থেকে দূরে থাকাই ভালো!

**********
রাত দশটা।জায়েদ বাসার নিচে নেমেছিল ফ্লেক্সিলড করতে।অভীক তখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরছিল।জায়েদকে হাঁটতে দেখে পিছন থেকে অভীক বলে উঠলো,” দাদাভাই,একটু দাঁড়াবেন। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

জায়েদ থমকে দাঁড়ালো।অভীক বড় বড় পা ফেলে জায়েদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,”কেমন আছেন দাদাভাই? ”
জায়েদের শান্ত মেজাজ গরম হয়ে গেলো। গতকাল মেহমান ছিল বলে কিছু না বললেও আজ মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না।কিড়মিড়িয়ে বললো,”আমাকে দাদাভাই ডাকার অধিকার কেবল একজন মানুষের।আর সেই মানুষটা এবং তার দাদাভাই ডাক দুটোই আমার প্রিয়। বাহিরের কেউ আমাকে দাদাভাই বলে ডাকুক তা আমার একদমই পছন্দ নয়।”
অভীক জায়েদের থমথমে মুখ দেখে হাসলো।এরপর বললো,”আজ থেকে না হয় সেই একজন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দুজন হলো।মন্দ কি দাদাভাই? ”
জায়েদ মনে মনে বেয়াদব বলে গালি দিয়ে বসলো অভীককে।
অভীক এবার সিরিয়াস কন্ঠে বললো,”দাদাভাই আপনার আমার সাথে রাগ করা যৌক্তিক। কিন্তু আমাকে আমার বিষয়টা কনফেস করতে দিন।”
জায়েদ অভীকের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো,”তুমি নীতুকে পছন্দ করো?”
অভীক এমন সোজাসাপটা প্রশ্নে খানিক চমকালো কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই জায়েদ আবার বললো,”উত্তরটা আমি বলছি শুনো,তুমি নীতুকে পছন্দ করো। এবং তুমিই নীতুকে অযোগ্য বলেছিলে।সেই অযোগ্য মেয়েটাকে আজ তুমি পছন্দ করো,কি হাস্যকর তাইনা?”
চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসলো অভীকের।করুণ নেত্রে বললো,”দাদাভাই আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন! ”

জায়েদ মৃদু হেসে অভীকের কাঁধে নিজের ডান হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বললো,”নীতু সবাইকে খুব সহজে মাফ করে দিতে পারে।নীতুর প্রিয় জিনিস কেউ কেড়ে নিলেও নীতু তাকে ক্ষমা করে দিবে।কিন্তু আমি নই!আমার নীতুকে আবার কেউ দ্বিতীয়বার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে আসুক আমি তা চাই না।অনেক কষ্টে নীতু নিজেকে সামলিয়েছে,গাঢ় আধারে ডুবে যেতে যেতে নতুন ভোরের আলোয় নিজেকে রাঙিয়েছে!এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে আমি তাকে খুন করতে দু’বার ভাববো না!”…..বলে জায়েদ হনহন করে হেঁটে চলে গেলো।

অভীক এমন শান্ত কন্ঠের থ্রেট প্রথমবার শুনলো। মুখটা চুপসানো বেলুনের মত হয়ে আসলো। বাসায় প্রবেশ করতেই অনীক বললো,”কিরে কি হয়েছে তোর?কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। ”

অভীক সোফায় ধপ করে বসে বললো,”বড়ো, খুব কঠিন হবে নীতুকে পাওয়া! ”

অভীকের কন্ঠে হালছাড়া ভাব! অনীক ভাইয়ের পাশে বসে বলে,”আমিও চাই পথটা কঠিন হোক!”
অভীক কপাল কুঁচকে বলে,”বড়ো, তুমি কি ভাই নাকি শত্রু?”
“খুব সহজে অনেক আকাঙ্খিত কিছু পেয়ে গেলে আমরা তার মূল্যায়ন করতে জানি না! তাই নীতুকে জয় করতে না হয় খানিক কষ্টই করলি?”

অভীক সোফায় শরীর এলিয়ে বলে,”বড়ো,পথটা কঠিন হোক তবুও নীতু আমার হোক।কঠিন পথটা পাড়ি দিয়ে যদি আমায় শূন্য হাতে ফিরতে হয় তবে আমি শেষ হয়ে যাবো!স্রেফ মরে যাবো ভাই!মেয়েটা কখন আমায় এতটা কাবু করলো?আমার অজান্তে কখন এতটা কাছে আসলো?”

অনীক ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলো মায়া মায়া চোখে! অভীক ফের বললো,”আজ নীতুর দাদাভাই একটা ভয়ংকর কথা বলেছে বড়ো!অনেক কিছুই আমার অজানা!কেন দ্বিতীয়বার শব্দটা উচ্চরিত হলো জানি না?তবে এতটুকু জানি, নীতুকে আমার পেতে হবে!”

ঠিক সেই সময় রুমি সোফায় এসে বসলো।দুজনের দিকে তাকিয়ে আশাহত কন্ঠে বললো,”কালো একটা মেয়ের মাঝে তোমরা কি পেলে বলতো?যার জন্য এতটা মরিয়া হলে?অভীকের মত সুদর্শন পুরুষের পাশে নীতু নামের মেয়েটি বড্ড বেমানান!”

অনীক গরম চোখে চাইলো বউয়ের দিকে!অভীক শীতল কন্ঠে বললো,”ভাবি আমার অনুরোধ থাকবে দ্বিতীয়বার আর তুমি এমন কোন কথা বলবে না।না হলে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো, তুমি আমার ভাইয়ের বউ।”…….বলে অভীক হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

***************
দিন রবিবার। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে।নীতু নিজের ডেস্কে কাজ করছিল।অভীক নিজের কেবিনে প্রবেশ করার সময় আড়চোখে একবার লক্ষ্য করেছে নীতুকে।নীতুর মুখটা থমথমে!কিছু হয়েছে কি?প্রশ্ন জাগলো অভীকের মনে। মেরুন রঙের থ্রি পিস পরা নীতু। লস্বা চুলে এলানো বেণী।অলংকার বিহীন চোখের কাজলটুকুই অভীককে ঘায়েল করতে যথেষ্ট! অভীক দ্রুত পায়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করলো। কেবিনে বসতেই মানিক নামে একটা আঠারো উনিশ বছরের ছেলে অভীকের কেবিনে নক করলো।অভীক তাকে আসতে বলে নিজের কোটটা খুলে চেয়ারে রাখলো।পানি পান করলো। মানিক এই অফিসে ফাইল এক টেবিল থেকে আর এক টেবিলে আনা নেয়ার কাজ করে আর সবাইকে চা বানিয়ে দেয়।ছেলেটা খুবই চটপটে স্বভাবের! অভীক হাসি মুখে বললো,”কিছু বলবে মানিক?”
মানিক ঘটনা হুবহু বলতে প্রস্তুতি নিল।হাত নেড়ে নেড়ে বলতে শুরু করলো, “স্যার ঘটনা প্রথম থেইকাই বলি।হইলো কি নীতু আফায় অফিসে এসে বসলো।ওয়ার্কিং আওয়ার তখনো শুরু হয়নি।তখনি পলাশ ভাই এসে হাজির।নীতু আফারে হাসিমুখে কইলো,” নীতু আজ আমার জন্মদিন। ”
আপনেই বলেন হের জন্মদিন তা দিয়ে আফায় কি করবো?
অভীক বললো,”মূলটুকু বলো।কাহিনী পড়ে শুনবো।”

মানিক বলতে লাগলো, “এরপর নীতু আফায় হাসি মুখে বললো,শুভ জন্মদিন পলাশ ভাই। পলাশ ভাইয়ে তো খুশিতে গদগদ।এরপর বললো, নীতু জন্মদিনের ট্রিট চাই।
নীতু আফায় বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো।পলাশ ভাই ফের কইলো,বেশি কিছু না।কফি খাওয়াতে হবে। নীতু আফায় মুখে জোর করে হেসে কইলো, আজ তো সম্ভব না পলাশ ভাই।আমার পরিবার এসেছে।তারা আজ সন্ধ্যায় চলে যাবে।আমার সেখানে থাকাটা জরুরী।
আপনে বিশ্বাস করেবন না স্যার, এরপরও পলাশ ভাই কইলো, ঠিক আছে নীতু।আজ না হলেও হবে।আমরা না হয় আগামীকাল বসবো।
নীতু আফায় খাবি খাওয়া মাছের মত হাসফাস করতে করতে রাজি হলো।

পলাশের কান্ডে অভীকের মেজাজ গরম হলেও মানিকের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো।মানিব্যাগ থেকে দুটো দু’শ টাকার নোট মানিকের হাতে দিয়ে বললো,” গুড জব।চোখ কান এভাবেই খোলা রাখবে।”
মানিক কচকচা টাকার দিকের তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,”আপনার কথার নড়চড় হবে না।”
মানিক চলে যেতে যেতে ভাবতে থাকলো, স্যারে নীতু আফার কাছে কি পাইছে আল্লাহ জানে?তবে আমার জন্য যে আফায় লক্ষী তা নিশ্চিত!

অফিসে বসে অভীকের নীতুর দিকে লক্ষ্য রাখা মুশকিল।তাই মানিককে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।অভীকও দেখতে চায় নীতু কি করে পলাশের সাথে কফি খেতে যায়!
যাকে নিয়ে এই দ্বন্দ সে কি আদৌও এই খবর রাখে?

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৬

নীতু আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে! আয়নায় দেখতে পেলো সাথি ক্লান্ত ভঙ্গিতে খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।নীতু দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।একটা মাস চলে গেলো চোখের পলকে।আটমাস চলছে সাথির।প্রেগ্ন্যান্সির ছাপ পড়েছে। হাত পা কেমন ফুলতে শুরু করেছে।রিপনের বারণে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে সাথি। নীতু চুলে খোঁপা করে ঘাড়ের নিচে এলিয়ে রাখলো।কপালের দুপাশ থেকে কিছুটা চুল হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিলো গালের দু’পাশে । হাতে লোশন মাখতে মাখতে এসে বসলো সাথির পাশে।তারপর বললো,”ঠিক করেছি একটা কাজের লোক রাখবো। সারাদিন তুই বাসায় থাকিস।কখন কি হয়?আমার খুব চিন্তা হয়।বাসায় কেউ একজন থাকলে আমি নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারবো!”

সাথি হাসলো।নীতুর মনে হলেও এতেও মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে।সাথির ফোলা হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো মায়া চোখে।সাথি বললো,’আপু আমার পাশে এসে বসতো।দূরে বসেছো কেন?কাছে আসো।”

নীতু সাথির গা ঘেঁষে বসলো।সাথি নীতুর হাত ধরে বললো,”আপু শাড়িতে তোমাকে যে কি ভালো লাগে!মনে হয় দেখতেই থাকি।”

“হয়েছে ফুলাতে হবে না,কি বলবি বল?”

সাথি হুট করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো,নীতু হতভম্ব! কাঁদতে কাঁদতে সাথি বললো,”আপু আমার সন্তান প্রথম তুমি কোলে নিবে!কথা দাও।তাকে তোমার মত হতে হবে।একমদ তোমার মত!মা বাবা তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে,আমি যদি মরে যাই আমার বাচ্চাটা তুমি দেখে রেখো আপু।আমাকে ছুঁয়ে বলো,তুমি আমার কথা রাখবে।”

নীতু আৎকে উঠে সাথিকে বুকের মধ্যে জরিয়ে ধরলো।সাথি কাঁদতেই রইলো।নীতুর হুট করে মনে পরে গেলো,যে দিন তুতুন হলো নীতু তখন ইতুর পাশে। ইতুকে ওটিতে নেয়া হলো। মা আর ইতুর শাশুড়ী নামাজ পরছিল।নার্স এসে বাচ্চাটা নীতুর কোলে দিল।কি আদুরে মুখ!নীতু বুকের সাথে জরিয়ে ধরেছিল।তখনই ইতুর মামী শাশুড়ী নীতুর থেকে তুতুনকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলেছিল,”তুমি বাচ্চা কোলে নিলা কে?কি সর্বনাশ করেছো!নিষ্পাপ শিশু দুনিয়াতে এসেই তোমার মত অভাগীর কোলে প্রথম উঠলো!তোমার এমনিতেই অপয়া ভাগ্য! বিয়ে হয় নাই,ঘর সংসার তোমাকে টানে না।তোমার মত মেয়ের প্রথমেই বাচ্চা কোলে নেয়া ঠিক হয়নি।”
নীতু সেদিন কিছুই বলতে পারেনি।কেবল আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছিল মহিলার মুখের দিকে। কি ভয়ানক কথা মহিলা অবলীলায় বলে গেলেন!
আজ সাথির কথা শুনে পুরানো স্মৃতি মনে পরে গেলো। পৃথিবী যেমন সৃষ্টি হয়েছে বাহারি রঙে তেমন পৃথিবীর মানুষগুলোর স্বভাবও ভিন্ন ভিন্ন রঙের! নীতুর বুক চিড়ে নিঃশব্দ হাহাকার নির্গত হয়।তখনও সাথি কেঁদে চলছে নীতুর বুকে মাথা রেখে……….

************

জ্যামের কারণে নীতুর অফিসে পৌঁছাতে লেট হলো।ঢাকার শহরের জ্যামে নীতু অতিষ্ট!অভীকের ঝাঁঝালো কথা শুনার অপেক্ষায় তটস্থ হয়ে রইলো নীতু!কতক্ষণ পরই অভীক নীতুকে ডেকে পাঠালো।নীতু ধীর গতিতে অভীকের কেবিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো।এই অভীককে নীতু বুঝতে পারে না।মানুষটা একেক সময় একেকরকম!কাজের ক্ষেত্রে যেমন কঠোর তেমন নরম অফিসের বাহিরে!কখনো খুব সুন্দর করে কথা বলবে কখনো বা তিক্ত কথার ঝালে পুড়িয়ে ফেলবে।অভীকের কেবিনে ঢুকতেই বড় স্যারকে দেখে নীতু আরো সাবধানী হলো। অভীক এক আকাশ গাম্ভীর্য নিয়ে নীতুকে পর্যবেক্ষণ করলো।ভয়ে সিটিয়ে আসা আমচুরের মত নীতুর মুখটাকে দেখে অভীকের প্রচন্ড হাসি পেলো।কিন্তু বাহ্যিক গাম্ভীর্য দিয়ে অভীক হাসি গিলে ফেললো মুহুর্তেই! নীতুকে বসতে বলতেই নীতু বসে পরলো।এসির ভিতরেও কুলকুল করে ঘামছে নীতু!কোন ভুল হলো কি না?এই প্রশ্নে কপালে ভাঁজ পরলো।বড় স্যারকে দেখে সংশয় বেরে গেলো।মোটা গোঁফের নিচে অবস্থিত পুরুষ্ট ঠোঁট নাড়িয়ে বড় স্যার বলে উঠলে,”নীতু আমি সত্যিই তোমার ব্যপারে কনফিউজড ছিলাম।কিন্তু তোমার ওয়ার্কিং পারফরম্যান্স আমাকে মুগ্ধ করেছে।তার উপরে অভীক কারো উপরে সহজে সন্তুষ্ট হয় না!মাঝে মাঝে তো আমারো মনে হয়, অভীক বড় স্যার হিসেবে আমার প্রতিও সন্তুষ্ট না। কিন্তু আজ যখন অভীক তোমার কাজের প্রশংসা করলো।সত্যিই আমার ভালো লেগেছে!এভাবেই স্পৃহা রেখো তাহলে উপরে ওঠার সিঁড়ি খুবই সহজ হবে!”

নীতু আড়ষ্টভাবে অভীকের দিকে আঁড়চোখে চাইলো।অভীকের ঠোঁটে তখন ঈষৎ হাসি!কঠিন ইস্পাতের মত মুখটায় ওই ঈষৎ মৃদু হাসি যেন আরো বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে।নীতু চোখ ফিরিয়ে নিল!বড় স্যার আরো কতক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন।সে চলে যেতেই অভীক বলে উঠলো,”মিস নীতু আপনিও ভয় পেতে জানেন?”

নীতু কপাল কুঁচকে তাকালো! অভীক বললো,”প্রশংসায় গা ভাসিয়ে ফেলা বাঙালির স্বভাব!আর আমাদের বড় স্যার আমুদে মানুষ। উনি একটু সবসময় বাড়িয়েই বলেন।বয়স হয়েছে তো।বুঝেছেন?”
নীতু চোখা চোখে তাকিয়ে বললো,”স্যার কিন্তু বলেছে আপনিও আমার পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট! ”

অভীক আফসোসের সুরে বললো,”এটুকু তো বলতেই হয়,শত হলেও আপনি আমার প্রতিবেশী! ”

নীতু হতাশ হলো।অভীকের কাছ থেকে সরাসরি কোন উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন। “আমার মনে পরে না স্যার আপনি অফিসিয়ালি কোন ফেবার করেছেন প্রতিবেশী হিসেবে!”….নীতু বললো সরাসরি অভীকের চোখের দিকে তাকিয়ে।

অভীক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললো মুহুর্তেই।একটা ফাইল সামনে টেনে চোখ মুখ কঠিন করে বললো,”আজও কিন্তু আপনি লেট করেছেন মিস নীতু!আশা করি এসব ব্যাপরে আরো যত্নশীল হবেন!এখন আসুন আপনি।”

নীতু গোমড়ামুখে বেরিয়ে আসলো। নীতু চলে যেতেই অভীক বড়সড় দম ফেললো! মেয়েটা চোখের সামনে এলেই নিজের কঠোর ব্যক্তিত্ব কেমন হাওয়াই মিঠাইয়ের মত গলে যায়!নিজেকে আস্ত কাঙাল মনে হয়!গাম্ভীর্যের দেয়াল খসে পড়তে চায়! অভীকের ভয় হয় কখন যেন নীতু ধরে ফেলে তার দূর্বলতা!মেয়েটা কি তখন উপহাস করবে?মনে মনে হাসবে তাকে নিয়ে!অভীকের প্রায়ই মনে হয়, পদ্মদিঘির ন্যায় গভীর চোখ দুটো দিয়ে অন্তর্ভেদী চাহনিতে মুহুর্তেই পড়ে ফেলবে অভীকের ভিতরটা!যেখানটা কপট আস্তরে আচ্ছাদিত এই মেয়েটির জন্য এক টুকরো উদ্যান!কাননবালা ছাড়া সেই উদ্যানটুকু যে ধু ধু মরুভূমি! তা কি কখনো বুঝতে পারবে মেয়েটা? বড় বিপন্ন বোধ করে অভীক!এই অন্তর্জ্বালার শেষ কোথায় নিজেই বুঝতে পারে না!

************
লাঞ্চ আওয়ারের পর নীতুর ফোনে আননোন নম্বর থেকে একটা কল আসে।কলটা রিসিভ করতেই নারী কন্ঠের কান্নায় নীতু চমকে ওঠে! অপর পাশের মানুষটা কয়েকমিনিট কিছুই বলতে পারে না কান্নার দমকে!একসময় শান্ত হয়ে পরিচয় দিতেই নীতু আরো বিস্মিত হয়।তাজের মা কেন তাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি করছে? প্রশ্নটি আর করা হলো না তার আগেই ওপাশ থেকে রাবেয়া বেগম বলে ওঠেন কাঁদো কন্ঠে,”নীতু আমারে তুমি মাফ করে দিও। আমি ছেলের সুখের আশায় সুন্দর মেয়ে বউ করে আনছি।কিন্তু সুখ আমার কপালে নেই।ছেলেটা দিন দিন শুষ্ক কাঠে পরিণত হয়েছে।সেতুও ভালো নেই।এত কষ্ট আমি নিতে পারছি না।তুমি আমাকে ক্ষমা কইরো। তোমার বদদোয়া লাগছে….নাহলে এমন হইবো কেন?”

নীতু শান্ত কন্ঠে বলে,”আমার আপনার সাথে কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই।আপনাদের মত কিছু মানুষের জন্য আমাদের মত সন্তানদের সাফার করতে হয়।দিনশেষে নিজেকে মানিয়ে চলতে আত্মসুখের বলিদান দিয়ে! সবকিছু শেষ হওয়ার পর কান্না করা,মাফ চাওয়া অনার্থক!রাখছি।”

রাবেয়া বেগম দ্রুত কন্ঠে বলে,”রাইখো না মা।আমার কথা শেষ হয় নাই।সেতুকে খুঁজে পাচ্ছি না।সেতু কিছু না বলে বাসা থেকে চলে গেছে।তাজকে ফোনে পাচ্ছি না।আমি কি করবো? আমার মরণ হয় না কেন?”

“কি বলছেন আপনি?আমার বোন কোথায় গেছে?”…… নীতু চিৎকার করে বলে। ভয় আর উত্তেজনা মিশিয়ে নীতুর হাত পা কাঁপছে!

” আমি কিচ্ছু জানি না…..”…..বলে রাবেয়া বেগম ফের কাঁদতে শুরু করেন।
নীতু মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে।সেতু কোথায় গেলো?অফিসের ব্যস্ততার কারণে সেতুর সাথে এ কয়েকদিন বেশি কথা হয় নি।কল দিলেও হা হু ছাড়া বেশি কিছু বলতো না।বড় ভুল হয়ে গেছে! নীতু উদ্ভ্রান্তের মত ছুঁটতে শুরু করলো।এতবড় শহরে কোথায় খুঁজবে সেতুকে? পলাশ নীতুকে দৌড়াতে দেখে বলে,”কোথায় যাচ্ছো নীতু এমন করে।”

“আমাকে এখনই যেতে হবে পলাশ ভাই। আপনি স্যারকে দয়া জানিয়ে দিয়েন। “…… বলে নীতু বোতাম চেপে লিফ্টে উঠে পরে। পলাশ আহাম্মাকের মত চেয়ে থাকে নীতুর চলে যাওয়ার দিকে!
নীতু অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে সেতুর নম্বরে। পরক্ষণেই আবার কল দিচ্ছে তাজের নম্বরে।কেউ ফোন তুলছেনা।নীতু অজানা অাশংকায় কেঁদে ফেলে।সেতুর বয়সটা হলো আবেগের বয়স।কোন ভুল করেনি তো মেয়েটা? নীতুর চোখ মুখ গাঢ় অন্ধকারে গ্রাস হয়ে আসে! সেতুর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো?আর মা বাবা তো মরেই যাবে!নীতু দ্রুত কল দেয় জায়েদের নম্বরে…….সেতু কোথায় বোন আমার? বলে নীতু ফের কেঁদে ফেলে!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here