কাননবালা,২৯,৩০

0
571

#কাননবালা,২৯,৩০
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৯

রাতের শেষ ভাগ।পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে।কেবল ঘুম নেই হসপিটালে কাৎরাতে থাকা মানুষগুলোর। তারা ঘুমাতে পারে না।অসুস্থতা তাদের ঘুমাতে দেয় না।

রুশিয়া বেগম আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।অভীক যে ঠিক নেই তা বেশ বুঝা যাচ্ছে! ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় ছেলেকে কল দেন রুশিয়া!অনীক কতদূর এলো জানা প্রয়োজন। অভীকের যে এখন বড্ড প্রয়োজন তার ভাইকে।

অভীক বসে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়! চোখ মুখে বিষাদের কালিমা।শার্টের বুকের কাছে এখনো লেগে আছে নীতুর রক্ত।তাজা তাজা ফোয়ারার মত রক্তে ভেসে গিয়েছিল অভীকের বুকটা!এখন অবশ্য শুকিয়ে গেছে।কেবল ছোপ ছোপ লাল রংয়ের দাগ বসে আছে।কি আশ্চর্য!শুকিয়ে আসা রক্ত থেকে কেমন অদ্ভুত ঘ্রাণ আসছে!নীতুর রক্ত বলেই কি?রক্তের কি আলাদা কোন ঘ্রাণ থাকে?ভেবে কোন উত্তর পায় না অভীক!

কেবল জানে যতদিন বেঁচে থাকবে এই রক্তের দাগ বুকের ভিতর স্থায়ী দাগ হয়ে বসে থাকবে!অভীকের বুক ভার হয়ে আসে!চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীতুর নিস্তেজ দেহ! উফফ!কি অসহ্য ভয়ংকর দৃশ্য! অভীক এলোমেলো দৃষ্টিতে হসপিটালের করিডোরে চোখ বুলায়।কেমন অশান্তি অশান্তি অনুভূতি চারপাশে!বাতাসে অক্সিজেনের অভাব! দমবন্ধ হয়ে আসে অভীকের।কেন তার চোখের সাসনেই নীতুর এমন পরিস্থিতি হলো?কেন?
নীতুকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসছিল অভীক গাড়িতে করে।মেয়েটা কেমন বাবুই পাখির মত বুকে মুখ গুজে নিস্তেজ হয়ে পরেছিল।নীতুর শাড়ি রক্তে একাকার!যে শাড়ির ভাঁজে, এলোমেলো কুঁচিতে অভীক নিজেকে হারিয়ে ফেলতো ক্ষণে ক্ষণে, শাড়ির ওই লুটানো আঁচলে সদা আভিজাত্য খুঁজে পেতো… সেই সব লুকানো অনুভূতি কেমন ভেসে যাচ্ছিল রক্তের নহরে!সাথে অভীকের অদৃশ্য মনটাও। অভীক ফোঁস করে দম ফেলে।পালিয়ে যেতে মনে চায়! কিন্ত কোথায় যাবে নীতুকে ছেড়ে।কোথাও কি এমন কোন জায়গা আছে? যেখানে গেলে এই মেয়েটাকে তার মনে পড়বে না!কোথাও নেই….
অভীক বিড়বিড় করে বলে, “ফিরে এসো নীতু।প্লিজ, ফিরে আসো আমার কাছে..আমার কাননবালা!আমি অপেক্ষা করছি দেখো….কষ্ট হচ্ছে আমার!হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে অবিরত, তুমি কি বুঝতে পারছো না?এতটা পাষন্ড তো তুমি নও!”

নীতুকে রক্ত দেয়া হচ্ছে।বর্তমানে আই সিউ তে আছে নীতু!খুবই ধীর গতিতে শ্বাস ফেলছে অক্সিজেনের মাধ্যমে। ডক্টররা আশংকিত। এত বড় মেজর এক্সিডেন্টের পর কোন মানুষের ফিরে আসা কেবল মিরেক্কলের ব্যাপার।তিনঘণ্টা ওটি শেষে নীতুকে আই সিউ তে রাখা হয়েছে।সেই সময় শুধু অভীক উপস্থিত ছিলো হসপিটালে।বনপেপারে সাইন করার সময় কেমন হাত কাঁপছিল অভীকের!মনে হচ্ছিল নিজ হাতে মৃত্যুদন্ড লিখছে।অভীক পাথরের মত বসে আছে।কান্নার শব্দে করিডোরের বাতাস বিরক্ত লাগছে।বেশি কাঁদছে সাথি আর সেতু।থেকে থেকে কাঁদছে!অভীক বিরক্ত চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে তাজের দিকে তাকালো।এই ছেলেটা অভীককে ভীষণ অবাক করেছে।কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছে ফ্লোরে পা ছরিয়ে।অনবরত নিঃশব্দে কাঁদছে। বারবার শরীর কেঁপে উঠছে তাজের।মাথা নত করে বসে আছে।

নীতুর বাবাকে সুরভির কাছে রেখে পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে হসপিটালে।এত দ্রুত কি করে আসলো অভীক বুঝতে পারছে না। জায়েদ কোন কারণ ছাড়াই হুড়োহুড়ি করছে।ভীষণ অস্থির কর্মকান্ড।বুঝা যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পরেছে।মিলন গোমড়ামুখে তুতুনকে কোলে নিয়ে বসে আছে।মহিমা বেগম নামাজ পরছে।পাটিতে বসেই চোখের জল ফেলছে। নিখিল আই সিউ রুমের দিকে চেয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। নিখিল অপেক্ষা করছে নীতুর ফিরার।নীতুর জ্ঞান ফিরলেই নিখিল একটা কথা বলবে,….”নীতু তুই খুব ভুল ধারনা পুষে রেখেছিস এতদিন মনে।আমরা তোকে অগণিত ভালোবাসি।কেবল বলা হয়নি বলে তুই বুঝতে পারিস নি।”

ইতু ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো জায়েদের দিকে।ইতু ভীষণ শক্ত মেয়ে হয়েও আজ নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললো,”ভাইয়া তোমার সব কথা তো নীতু আপা শুনে।আজ কেন তাকে বলছো না?চোখ মেলে তাকাতে! তুমি না আপার দাদাভাই,তুমি বললেই আপা শুনবে।বলে দেখো না?”…..জায়েদ নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।ইতু জায়েদের কনুই পেঁচিয়ে ধরে কাঁদছে।হুট করে মিতু এসে জায়েদের বুকে মাথা গুজে কাঁদতে শুরু করলো।জায়েদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।তার দুপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা কাউকে কোন সান্তনা দিল না।একসময় নিজেও নিরবে চোখের জল ফেলতে শুরু করলো। প্রতিটি ব্যক্তি অপেক্ষা করছে নতুন ভোরের!যে ভোরে কমলা রঙা রোদের মত নীতু খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে!

ঠিক সেই সময় এলোমেলো পা ফেলে উপস্থিত হলো রিশা। রিশা হাঁটছে আর পাশ থেকে একজন নার্স বলছে,”ম্যাম হসপিটালে সিগারেট পান করা নিষিদ্ধ! ”
রিশা খেঁকিয়ে বললো,”এই বালের আইন কোন শালায় করছে?”
নার্স মেয়েটা হতভম্ব। রিশা সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললো ডাস্টবিনে।নার্স মেয়েটা থমথমে মুখে চলে গেলো। রিশা বড় বড় পা ফেলে জায়েদের সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো।তারপর বললো,”বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?”

সবাই গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো রিশার কথা শুনে।মিতু চেঁচিয়ে উঠে বললো, “কিসব অলক্ষণে বলছো? মাথা ঠিক আছে?”
রিশা যেন মিতুর কথা শুনলোই না।ফের বললো,”বেঁচে আছে?”
জায়েদ রুক্ষ স্বরে বললো,”বেঁচে আছে।”

রিশা মারমুখী হয়ে বললো,”তবে মরাকান্না করছেন কেন সবাই?আমার ডার্লিং বেঁচে আছে,তবে কিসের এত কান্না?ডার্লিং আমার ফাইটার!এতটুকু কষ্ট ঠিক সয়ে নিবে।”

অভীক খুবই অবাক হলো রিশার আচরণে কিন্তু কিছুই বললো না। রিশা সবার কান্নারত মুখের দিকে একবার করে চোখ বুলালো।তারপর নিজের উরুতে হাত দিয়ে বাড়ি মেরে বললো,”শালা একে বলে বাঙালি।নেতা মরলে তার কবরে ফুলের তোড়া দিয়ে ভরিয়ে ফেলি আর বেঁচে থাকতে গালি গালাজ, নিন্দে মন্দ করতে ছাড়ি না!আরেব্বাস,নীতু ডার্লিং দেখি নেতার কপাল নিয়ে জন্মেছো!ভালো,খুব ভালো। ”

জায়েদ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তারপর চলে গেলো রুমের এক কোণে।রিশার এই মানুষ গুলোর কান্না দেখে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল।ফ্লোরে বসা তাজকে দেখে রিশা সেদিকে এগিয়ে গেলো।তারপর মিচকা হাসি দিয়ে বললো,”আরে এ যে দেখছি, ডিজিটাল যুগের দেবদাস! পার্বতী,চন্দমুখী দুজনই তার চাই।একেই বলে ছেলেদের কপাল,ঘরে বউ রেখে প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে ভাববে।আর মেয়েরা করলে পরকিয়া হয়ে যায়!কেন রে ভাই? প্রেমিকাকে যদি এতই ভালোবাসিস তবে বিয়ে করলি কে? আর অপারগ হয়ে বিয়েই যদি করলি তবে মুক্ত করে দিচ্ছিস না কেন প্রাক্তনকে?কেন তাকে ধরে বেঁধে বারবার মনে করিয়ে দিস,ভালোবাসিস! প্রোপারলি বেঁধে রাখতে না পারলে প্রোপারলি ছেড়ে দিতে কেন পারিস না তোরা?প্রাক্তনকেও বাঁচতে দে।তা না খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরো কষ্টে বাড়িয়ে দিস তোরা।যেন সব ভুল একজনের।”
তাজ টকটকে লাল চোখে রিশার দিকে তাকিয়ে রইলো।হুট করে মনে হলো,নীতু যেন তার জন্যই এত কষ্ট পাচ্ছে। রিশা ঠিকই বলছে।মুক্ত করে দেয়া উচিত ছিল নীতুকে, যাতে উড়তে পারে খোলা আকাশে!

সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,”চুপ করো রিশাপু।আমরাও আপির জন্য কষ্ট পাচ্ছি। এরকম কথা বলো না।”

রিশা চেঁচিয়ে উঠে বললো, “মেয়েদের এই গদগদ ভাবই আমার পছন্দ নয়।আমি আজ বলছি আমার ডার্লিংয়ের কিছু হলে, প্রত্যেকটাকে জেলের ভাত খাওয়াবো শালা!ঢং দেখাস এখন তোরা?মেয়েটা যখন সব হারিয়ে শূন্য হয়ে গিয়েছিল তখন কই ছিলি।আর আজ যখন নিজের মত বাঁচতে চাচ্ছিল মেয়েটা তখনও তোরা তোদের মত ডিসিশন চাপিয়ে বেড়িয়েছিস সবাই!যেন মেয়েটারই সব দোষ!শালা হারামখোর!”

রিশার কথার তোড়ে কেউ কোন কথা বলতে পারলো না।রিশা ধপ করে এসে অভীকের পাশে বসলো।অভীক উরুতে হাতের ভর রেখ থুতনি বুকের কাছে গুজে রেখেছে।নীতুর কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত একদন্ডের শান্তি পাবে না।বার বার নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাচ্ছে!ঠিক তখনই একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডক্টর এসে বললো,”রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। রোগীর শরীর ব্লাড গ্রহণ করছে না।হাত পা নীল হয়ে আসছে।অক্সিজেন দেওয়ার পরও নিঃশ্বাসের উঠানামা খুবই কম।এরকম চললে….. ”

ডাক্তার কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই রিশা খেঁক করে উঠে বললো,”বাকি কথা মুখেও আনবেন না ডক্টর। তাহলে আমার হাত উঠে যেতে পারে।বাপ মায়ে ডাক্তারি পড়াইছে রোগীর সেবা করার জন্য, এত লম্বা প্যাচাল পাড়ার জন্য না।যান আপনার রোগীর কাছে যান।এত লম্বা প্যাচাল পারলে ট্রিটমেন্ট করবেন কখন?”

ডাক্তার আহাম্মকের মত চেয়ে থেকে চলে গেলো।এই প্রথম অভীক ভেঙে পরলো।হু হু করে কেঁদে উঠলো।রুশিয়া বেগম দৌড়ে এসে ছেলেকে জরিয়ে ধরলেন।অভীক শেষ কেঁদেছিল বাবার মৃত্যুতে আর আজ কাঁদছে কৃষ্ণবতী কাননবালার জন্য! পরিণত পুরুষের কান্না হয় ভয়ংকর! তাদের কান্না দেখলে মনে একধরনের মায়ার উদয় হয়!এরা সহজে কাঁদে না।যখন কাঁদে তখন চারপাশে তোলপাড় শুরু হয়।
রিশা টেনশনে উত্তেজনায় আবার একটি সিগারেট ধরালো।রিশা জানে নীতুকে ফিরতেই হবে।একটা মানুষ পৃথিবীতে এসে শুধু দুঃখ পেয়ে যাবে তা তো হয় না।শুধু দুঃখ কারো জন্য বরাদ্দ থাকেনা।একসময় সুখ আসে।সে পর্যন্ত কেবল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।সৃষ্টিকর্তাও হেরে যাওয়া পছন্দ করেন না।দুঃখের ঘড়া পূর্ণ হলেই সুখ আসবে।নীতুকে সেই সুখ উপভোগ করতে হবে……

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩০

নীতুকে নিয়ে পুরো ডক্টর বোর্ড যেন যমদূতে টানাটানি করলো।তবুও জ্ঞান ফিরলো না। বডি রেসপন্স করছে না।
তিনটা দিন কেটে গেলো চরম উৎকন্ঠা আর হারানোর ভয় নিয়ে।পুরো পরিবার ঠায় বসে রইলো হসপিটালের করিডোরে। একমাত্র অনীক আর রিশা শক্ত রইলো। অনীক শত চেষ্টা করে সবাই খাওয়ালো।তা শুধু নামমাত্রই ছিলো।কিন্তু অভীক শুধু কাপের পর কাপ চা পান করে তিনটা দিন পার করলো।অভীকের কার্যকলাপে অনীক যারপরনাই অবাক হলো।বাবার মৃত্যুতে অভীক কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু এমন করে ভেঙে পরেনি। অনীক মনে মনে শুধু প্রার্থনা করতে থাকলো নীতুর জন্য, না হলে তার ভাইটা বেঁচে থেকেও মৃত্যুসম কষ্ট পাবে!

রিশার হম্বিতম্বিতে পুরো হসপিটালের নার্স, ডক্টর বিরক্ত! একটা মিনিট কাউকে সুস্থ থাকতে দিলো না।রিশার ব্যবহারে এমন কিছু একটা থাকে যার প্রেক্ষিতে কিছু বলা যায় না।
রাতের শেষ প্রহরে যখন আজানের ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠলো তখন একজন নার্স এসে বললো,”আপনাদের রোগীর জ্ঞান ফিরেছে,সে এখন আউট অফ ডেঞ্জার! এখন অবজারভেশনে আছে সকাল দশটায় কেবিনে দিবো।”
মহিমা বেগম সাথে সাথে বলে উঠলেন,”আলহামদুলিল্লাহ! ”
সকলের চোখে খুশিতে পানি এসে গেলো।সেতু নিজের অজান্তেই তাজের হাত চেপে ধরলো।তাজ ফিসফিস করে বললো,”আমি জানতাম তুমি ফিরবে!তোমাকে যে ফিরতেই হতো নীতু!”

ঠিক সেই মুহুর্তে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অভীক করিডোরের মেঝেতে শোকরানা সেজদায় লুটিয়ে পরলো।প্রতিটি ব্যক্তির চোখ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। সাথে সাথেই জায়েদ অনুভব করলো,নীতুর প্রাপ্ত সুখ খুবই সন্নিকটে!আর সেই সুখ দু’হাত ভরে এনে দেওয়ার মানুষটা এই অভীক ছাড়া আর কেউ নয়!”

অভীক যখন সেজদা শেষে দাঁড়ালো তখন চোখ দুটো ভেজা!কন্ঠ অবরুদ্ধ! ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে!মাথা ঝিমঝিম করছে।অনীক ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,”ভাই তুই ঠিক আছিস?”
অভীক বড়সড় দম ফেলে বললো,”বড়ো,তুমি এদিকটা সামলে নিও প্লিজ।আমি আসছি।”……বলে অভীক বড় বড় পা ফেলে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে অনীক ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো! ভালোবাসার মত আগ্রাসী কিছু কি আর আছে?….অনীক জানে না!

অভীক বাসায় ফিরলো ক্লান্ত শরীরে। রুশিয়া বেগমকে নীতু ভালো আছে সে কথা বলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।আধা ঘন্টা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলো।বারবার চোখের সামনে নীতুর রক্তাক্ত মুখটা ভেসে উঠলো! নিজের উপর প্রচন্ড রাগে ওয়াশরুমের দেয়ালে পর পর চারটা ঘুসি মারলো।চিৎকার করে বলে উঠলো, “সব আমার জন্য হয়েছে!সব……আমি আর কখনো তোমাকে জোর করবো না।তবুও তুমি ভালো থাকো নীতু!ভালো থাকো।”
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।টকটকে লাল চোখে মুহুর্তেই ঘুম নেমে আসলো।আধো ঘুমেই শুনতে পেলো মা খাওয়ার জন্য ডাকছে।অভীক তার সাড়া দিতে পারলো না।সমস্ত ইন্দ্রিয় মুহুর্তেই ক্লান্তির ভারে ঘুমিয়ে পড়লো!

*************
নীতুর ঘুম ভাঙলো দুপুর দুটোয়।কাঁচের জানালা গলে দুপুরী রোদ এসে চোখে মুখে পড়লো।নীতু চোখ কুঁচকে তাকালো! চোখের পলক ফেলতে গিয়ে অনুভব করলো চোখের পাতা নাড়াতেও ব্যথা লাগছে।একটু পরই অনুভব করলো সমস্ত শরীর বিষের মত ব্যথা!হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ।মাথায় ব্যান্ডেজ,শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিঁচের আঘাতে কাঁটা চেরার দাগ।হাতটা নাড়াতে গেলেই ক্যানোলার জায়গায় ব্যাথা পেয়ে উহ করে উঠলো।সাথে সাথে মহিমা বেগম দৌরে এসে মেয়ের পাশে বসলো।নীতু মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।ফাটা ঠোঁট নিয়ে সে হাসি বড় বিদঘুটে লাগলো দেখতে! মহিমা বেগম হু হু করে কেঁদে উঠলো।কি দিয়ে তৈরি এই মেয়ে? ভেবে পেলেন না।এত ব্যথা নিয়ে কি করে হাসতে পারে।
নীতু মৃদু স্বরে বললো,”কেঁদো না তো মা!তোমার কান্না দেখতে ভালো লাগছে না।”
মহিমা বেগম সাথে সাথে চোখ মুছে ফেললেন। জায়েদ এসে মাথার কাছে বসলো।নীতুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।জায়েদের চোখে পানি।তা দেখে নীতু বললো,”তোমরা সবাই এভাবে কাঁদছো কেন?আমি তো সুস্থ এখন।”
জায়েদ কিছু বলতে পারলো না।উঠে চলে গেলো।মিতু ফোন বাড়িয়ে ধরতেই ফোনের স্ক্রিনে বাবার কান্না মাখা মুখ ভেসে উঠলো। বাবার মুখটি দেখার সাথে সাথেই নীতুর চোখে পানি এসে গেলো।ধীর কন্ঠে বললো,”বাবা!আমার বাবা!কেঁদো না।দেখো,আমি ভালো আছি।”
কান্নার কারণে নীতুর ঠোঁটের পাশের সেলাইতে টান লেগে রক্ত বের হতে শুরু করলো।মিতু দ্রুত ফোনটা কেটে দিলো।টিস্যু দিয়ে বোনের চোখ মুছে দিলো।ইতু এগিয়ে এসে নীতুর হাতের পিঠে চুমু খেলো।নীতু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।এই মানুষ গুলো এত ভালোবাসে তাকে এক্সিডেন্ট না হলে জানতেই তো পারতো না।নিখিল এগিয়ে এলো না।ঠায় বসে রইলো অপর পাশের বেডে।নীতু চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো।তারপরও এগিয়ে এলো না।নীতু এবার ডাকলো,”ভাইয়া…”
নিখিল অশ্রুসজল চোখে তাকালো।এরপর এগিয়ে এসে ধমকে বললো,”বড় হয়েছিস এখনো রাস্তা পেরোতে শিখলিনা।তবে কিসের বড় হলি, বলতো?”

নীতু হাসলো ভাইয়ের কপট রাগ দেখে।নীতু চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,”সেতু কই?”
মহিমা বেগম বললেন,”জামাইয়ের সাথে নিচে গেছে।”
নীতু ওহ বলে চোখ বন্ধ করলো।চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে।ঘুমের ঔষধের কারণে হয়তো!নীতু শত চেষ্টা করে জেগে থাকতে পারলো না।গাঢ় নিগুঢ় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলো।ঘুম জড়ানো চোখেই একটা স্বপ্ন ভেসে উঠলো! মনখারাপ করে অভীক দাঁড়িয়ে আছে।আশ্চর্য!মানুষটার কিসের এত মনখারাপ?
নীতু জিজ্ঞেস করলো,”আপনার মন খারাপ কেন মি.অভীক?”
স্বপ্নের অভীক কোন জবাব দিল না।কেমন ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগলো।আহা!নীতুর বড়ই মন খারাপ হলো।ইচ্ছে হলো চোখের জল মুছে দিতে।কিন্তু নীতুর তো হাতে ব্যথা!নীতুর এখন কি করা উচিত?….. কি করে চোখের জল মুছে দিবে?

************
তাজ আর সেতু পাশাপাশি বেঞ্চে বসে আছে।তাজের এক ডাকেই সেতু তার সাথে আসতে রাজি হয়েছে।এতে তাজ একটু বিস্মিতও হয়েছে।সেতুর হাতে একটা স্যান্ডউইচ আর পানির বোতল।তা ধরে চুপটি করে বসে আছে। তাজ সেতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”খাচ্ছো না কেন সেতু? দেখোছো শরীরের কি অবস্থা করেছো?নীতুর চিন্তায় এ কদিন তো কিছুই খাওনি।এবার খাও।”
সেতু নিরবে হাসলো। তা দেখে তাজ বললো,”হাসছো কেন?”
“আপনার কপট দায়িত্ব দেখে হাসি পাচ্ছে! ”
তাজ ভ্রু কুঁচকে বললো,”শোনো সেতু আমি লোক দেখানো কোন কাজ করিনা।এটা আশা করি তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।এখন কথা না বলে খাও।”

সেতু নিরবে স্যান্ডউইচটা খেলো কিন্তু পেটে রাখতে পারলো না।দৌড়ে ডাস্টবিনের কাছে গিয়ে গলগল করে বমি করে দিলো।তাজ কতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে পানির বোতল নিয়ে ছুটে গেলো।

কিছুক্ষণ পর সেতু ঠিক হলো।ঢকঢক করে পানি খেলো। তাজ ধীর কন্ঠে বললো,”এভাবে চলে এলে কেন সেতু?”

“আমার থাকার কোন প্রয়োজন ছিল কি?”….. সেতুর কাটকাট জবাব।

” তুমি অসুস্থ সে কথাটা তো বলতে পারতে?”…..

“কেন আপনাকে বললে কি হতো?আপনি আমাকে মেনে নিতেন?”….. সেতু ধারালো কন্ঠে বলে।

তাজ ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,” ফিরে চলো সেতু।”

সেতু আগ্নেয়গিরির মত জ্বলে উঠে বলে,”খবরদার করুণা করবেন না।আপনার করুণার উপর এই সেতু বমি করে। বুঝেছেন?বলুন বুঝেছেন?”

তাজ কৈফিয়তের সুরে বলে,”বুঝেছি। কিন্তু করুণা করছি না।করুণা তো তোমার আমাকে করা উচিত।সেই করুণা করেই না হয় ফিরে চলো?”

সেতু হাসলো।তারপর বলল,”আপনি তো আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসেন নি।এসেছেন আপনার সন্তানের মাকে ফিরিয়ে নিতে।ঠিকাছে যান…..বাচ্চা হলে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিবো তবু আমি ফিরবো না।”

তাজ অস্থির কন্ঠে বলে,”এবার কিন্তু জেদ করছো সেতু।”

“জেদ করলে জেদই সই।আপনি দিনের পর দিন অবহেলা করবেন।তারপর আবার ফিরিয়ে নিতে আসবেন তাও বাধ্য হয়ে।তা তো হবে না।বাধ্যতা দিয়ে বশ করে কতদিন থাকবেন?যদি ভালোবাসায় বশ না হয় কেউ!”

তাজ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। সেতু বলে,”আমি প্রেগন্যান্ট এ কথা নীতু আপি বলেছে আপনাকে?আর আমাকে ফিরিয়ে নিতে,তাও কি আপির বলা?তাই এসেছেন?”

“কেউ কিচ্ছু বলেনি।তুমি নীতুকে ভুল বুঝোনা প্লিজ! ”

সেতু শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,”পাগল আপনি।দুদিনের পরিচিত আপনার জন্য আমি আমার রক্তের বোনকে ভুল বুঝবো?এতটা না ভাবলেও পারতেন!শুনুন ভুল বুঝার হলে সেদিনই বুঝতাম যেদিন আমাতে বিলীন হলেন কিন্তু মুখে নিলেন অন্য কারো নাম!তবুও আমি থেকেছি, অপেক্ষা করেছি…..আজ বলছি জোর করবেন না।আমি ফিরবো না।মানিয়ে নেওয়ার বোঝা আপনার আর বইতে হবে না।”
তাজ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেতুর দিকে।সেতু সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে হনহন করে চলে গেলো।

গোল্লায় যাক তাজ আর তাজের সাথে সম্পর্ক!সেতু মনে মনে গালি দিতে দিতে হাঁটতে লাগলো।পেটের ভিতর খুদায় মোচড় দিতে লাগলো।বমির কথা মনে হতেই খুদার তাড়না কমে গেলো।

*********—
দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেলো।নীতু এখন কিছুটা সুস্থ। বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।সবাই সাথির ওখানে গেছে রেষ্ট নিতে।নীতুর কাছে কেবল রিশা।রিশার সাথে যখন দেখা হলো তখনই রিশা প্রথম যে কথা বললো তাহলো,”ডার্লিং ভেবেছিলাম বাচ্চাদের পোষাক কিনে তোমার সাথে হসপিটালে দেখা করতে আসবো,বাচ্চার কান্নার শব্দে চমকে চমকে উঠবো কিন্তু তুমি এটা কি করলে?নিজেই কাৎ হয় পড়লে।ভেরি ব্যাড!”
নীতু তখন হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না।
রিশা কমলার কোয়া ছড়িয়ে নীতুর মুখে পুরে দিয়ে বললো,”ফর্সা মালটা কে ডার্লিং?দেখতে তো ভীষণ হ্যান্ডসাম!একদম চকলেট বয়!”

“কার কথা বলছিস?”

“আরে অভী না কি যেন নাম?তোমার চিন্তায় কি না ভেঙে পরলো।এখন একদম লাপাত্তা! ”

তাইতো। হুট করেই নীতুর মনে হলো।নীতুর সাথে এখন পর্যন্ত অভীক দেখা করতে আসেনি।অফিসের সবাই এলো।রোজ দু বেলা অনীক,আন্টি এসে দেখে যায় কিন্তু অভীক আসে না।অথচ নীতু শুনেছে অভীক তার জন্য গোটা তিনটা দিন অপেক্ষা করেছে তবে এখন কেন এলো না?তখনই নীতুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো অভীকের উদ্বিগ্ন মুখশ্রী। জ্ঞান হারানো ঠিক আগ মুহুর্তে যখন নীতুর চোখ বুজে আসছিল তখন অভীকের ওই ঘোলাটে চোখে বেদনা মিশ্রিত হাহাকার,হারানো ভয়,অসহায়ত্ব দেখতে পেয়েছে নীতু।এমনটা শুধু খুব কাছের প্রিয়জনের জন্য হয়!তবে কি নীতু?অভীকের প্রিয়জন!খুব কাছের কেউ?নীতু সেদিন অভীকের চোখে করুণা নয় বরং একরাশ মায়া দেখতে পেয়েছিল।ভালোবাসা নামক যে জমিনটা চৈত্রের ফাঁকা মাঠের মত খাঁ খাঁ করছিল হুট করেই সেখানে ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো।নীতু চমকে গেলো!সর্বনাশ!নতুন ঝড়ের আগমনী বার্তায় নীতু কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here