#কাননবালা,পর্বঃ৩১
#আয়েশা_সিদ্দিকা
নীতুকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করার পরদিনই মহিমা বেগম চলে গেলেন।মেয়ের কাছে থাকার ইচ্ছা থাকলেও স্বামীর অসুস্থতায় অপারগ হতে হলো।নিখিল ইতু মিলন তিনজন চলে গেলো মায়ের সাথে। নীতুর কাছে থেকে গেলো জায়েদ মিতু রিশা আর সেতু।
নীতুর দিন কাটে শুয়ে বসে আর গাদাগাদা ঔষধ খেয়ে! মাঝে মাঝে কাঁটা ছেড়ার স্থানে অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করতে মনে চায়! এক্সিডেন্টের বিভৎস দৃশ্যের কথা মনে হলে শিউরে ওঠে এখনো নীতু! সাথে সাথে ভেসে ওঠে অভীকের অসহায় মুখাবয়ব! কি মায়া নিয়ে তাকিয়ে ছিল মানুষটা! ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দশটাদিন গেলো তবুও একবার অভীক কোন খোঁজ নিল না।না চাইতেও এই ভাবনা নীতুকে ভাবায়।
শোয়া থেকে উঠে বসে নীতু।খাটে বসে ঠান্ডা ফ্লোরে পা রাখতেই পায়ের গোড়ালির টনটনে ব্যথাটা জানান দেয়। শিরশিরে ব্যথায় নীতুর মুখ কুঁচকে উঠে। তবুও জোর করে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়! একঝাঁক মিঠে রোদ নীতুর শরীর ছুঁয়ে দেয়!শরীরে চনমনে ভাব আসে।চোখ বুঁজে জোরে দম ফেলে নীতু! ভাবতে থাকে কোথায় যাচ্ছে তার জীবনের গাড়িটা?কালো একটা মেয়ে সে।কখনো কারো ভালোবাসা পায়নি।যখন পেলো তখন না পাওয়ার মত! তারপরে তাজ এলো।সে চলেও গেলো। এরপরে অভীক।যাকে নীতু ভালোবাসে না।কিন্তু অভীকের প্রখর মাদক দৃষ্টি নীতু প্রত্যাখানও করতে পারে না! নীতুর মত মেয়েদের জীবনে কখনো তাজ বা অভীক আসে না।কিন্তু নীতুর সৌভাগ্য,তার জীবনে প্রখর ভালোবাসা নিয়ে দুজনই এসেছে!একজন পাশে থাকতে না পারলেও আর একজন চাইছে।নীতুর কি করা উচিত?নীতু নিজেই বুঝতে পারে না।ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়!ভালোবাসায় যে বড্ড ভয় নীতুর।একটা জীবন ভালোবাসা ছাড়া কাঁটিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু নিঃসঙ্গ জীবন টেনে নেওয়া যে বড়ই কষ্টকর!মানুষ বড়ই অদ্ভুত জাতি।দিনশেষে একাকিত্ব ঘুচানোর জন্যও হলেও কাউকে না কাউকে চায়!
নীতু চোখ মেলে রাস্তার দিকে তাকায়। তখনই দেখতে পায় অভীক টিপটপ হয়ে বের হচ্ছে অফিসের উদ্দেশ্যে।নীতু চোখ ফিরায় না। তাকিয়ে থাকে!এই এক্সিডেন্টটা না হলে নীতু জানতেই পারতো না।তাকে হারানোর ভয়ে এই পুরুষটা কেমন ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়েছিল।তখনই কেন জানি অভীকও নীতুদের বারান্দার দিকে তাকায়।নীতু দূর থেকেই বুঝতে পারে অভীকের সুক্ষ্ম চাহনি।কেঁপে ওঠে নীতু! শীতের হিমেল বাতাসের তোড়ে যেমন কেঁপে ওঠে তেমন করেই কেঁপে ওঠে সমস্ত শরীর!
অভীকও তাকিয়ে থাকে।বারান্দার রেলিং ঘেসে সাদা ঢিলেঢালা মেক্সিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় মুখটির মানুষটার দিকে!যার লম্বা খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে! মুখটা ছুঁয়ে দিচ্ছে সকালের দুষ্টু রোদ।পদ্মদিঘীর মত চোখ দুটো কেমন চিকচিক করছে! অভীকের ইচ্ছে হয় রোদ হয়ে ছুঁয়ে দিতে তার কাননবালাকে!নীতু কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে। পাশে বসে হাতটা ধরে রাখতে ইচ্ছে করে ঘন্টার পর ঘন্টা! বুকের ভিতর জরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে!এত এত ইচ্ছে! চারপাশ মুখরিত করে রাখে অভীককে।গলা টিপে হত্যা করে অভীক শত ইচ্ছা! শক্ত পোক্ত ঢোক গিলে জোর করে!
রিশা নিঃশব্দে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়।নীতুর চাহনি লক্ষ্য করে নিচে তাকাতেই দেখে অভীক দাঁড়িয়ে আছে। রিশার মুখে দুষ্ট হাসি খেলে!রিশা চিৎকার করে হাত নাড়িয়ে বলে অভীকের উদ্দেশ্যে,” হাই হ্যান্ডসাম!”
রিশার চিৎকারে ধ্যান ভাঙে দুজনেরই।অভীক থতমত খেয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। অভীক চলে যেতেই রিশা আফসোসের সুরে বলে,”হাই না বলেই চলে গেলো।আজব!”
নীতু পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে বলে,”এত জোরে কেউ চিৎকার দেয়? ”
“এই রিশা দেয়।বুঝেছো ডার্লিং?”…… বলেই খচ করে দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরায়।
নীতু ছোঁ মেরে সিগারেটটা ছুরে ফেলে বলে,” এইসব ছাইপাঁশ কেন বন্ধ করছিস না, বলতো?”
রিশা হাসে।সাথে হেসে ওঠে টমবয় মুখশ্রী। রিশা ঠান্ডা ফ্লোরে পা ছরিয়ে বসে পড়ে।নীতুর পা টা কোলের উপর রেখে ব্যান্ডেজ খোলায় মনযোগ দেয়। তারপর ড্রেসিং বক্স এনে মনোযোগ সহকারে কাটা স্থানে ড্রেসিং শুরু করে। রিশাকে চুপচাপ দেখে নীতুও চুপচাপ চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দেয়। ড্রেসিং করছে বলে পায়ের কাছটা জ্বলছে।সাথে নীতুর বুকটাও!কার জন্য এই জ্বলন? নীতু বুঝতে পারে না!
রোজ অফিস শেষে তাজ আসে এই বাসায়। সেতু তখন দরজা আটকিয়ে বসে থাকে।সেতুর এককথা,কোথাও যাবে না।এখানে নীতুর জোর করার নেই। থাকলেও তা এখন সম্ভব না।তাজ একবারো নীতুর কথা জিজ্ঞেস করে না।তাতে অবশ্য নীতুর কোন মাথা ব্যথা নেই! তাজ সাথি আর জায়েদের সাথে কথা বলে চলে যায়।জায়েদ বলেছে নীতুকে,ওদের দুজনকে সময় দিতে!বাবা মা এখনো এই ব্যাপারে জানে না।যখন জানবে তখন? কি করবে নীতু?
নীতুর এলোমেলো চিন্তার মাঝেই রিশা হুট করে বলে বসে,”ভালোবাসো, ডার্লি?”
নীতু চমকে তাকায়। রিশার প্রশ্ন বোঝার চেষ্টা করে। নীতুর ড্যাবড্যাব চাহনি দেখে রিশা ফের বলে,”ভালোবাসো ওই হ্যান্ডসাম পুরুষটিকে?নাকি এখনো তাজ নামক গন্ডিতেই আঁটকে আছো?”
নীতু আৎকে উঠে বলে,”কিসব বলছিস?তাজ আমার বোনের বর।তাছাড়া যে গন্ডি আমার জন্য নয় সেখানে আমি কখনো পা দেই না।হ্যা একটা অনুভূতি কাজ করে।তবে তা কেবলই অনুভূতি। কোন চাওয়া পাওয়ায় নয়।”
“আর অভীক?”
নীতু চিন্তিত কন্ঠে বলে,”আমি বুঝিনা মানুষটাকে।ভালোওবাসি না তাকে।তবে ওই প্রখর চাহনি আমাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলে!তুই বল রিশা,যে মানুষটা একসময় আমাকে পছন্দ নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছে তার আমার প্রতি এই আকুলতার মানে কি?”
পায়ের ব্যান্ডেজ করা শেষ রিশার।একটু এগিয়ে নীতুর হাত ধরে বলে,”এ তোমার কেমন বিবেচনা ডার্লিং? কার কখন কাকে ভালো লেগে যায় কে বলতে পারে?অভীক স্পষ্ট স্বরে যেমন তার ভালো না লাগা বলেছে তেমন স্পষ্ট স্বরে তার ভালো লাগাও জানিয়েছে। তবে? ডার্লিং,..খুব পছন্দের জিনিসও একসময় অপছন্দের তালিকায় যোগ হয় আর অপছন্দের জিনিস হয়ে ওঠে খুব প্রিয়! নাকি তোমার ইগো তে লাগছে ডার্লিং?একসময় সে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাই তুমিও ফিরিয়ে দিতে চাইছো। সমানে সমান!তবে এটা সবার বেলা নয় কেন?”
নীতু রিশার করা প্রশ্নে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।নিজেকে কেমন টালমাটাল লাগে।রিশা পুনরায় বলে,”ডার্লিং, যখন অভীক তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে তখন তোমার আপনজন ছিল না।সে তার মতামত পেশ করেছে।তাই পর মানুষ কি করলো এটা তোমার মাথায় আসছে।আর তোমার আপন মানুষ গুলো যে তোমাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছে।কালো বলে কটাক্ষ করেছে।তবে তাদের বেলা কেন তোমার ইগো কাজ করে না?কেন খুব সহজে তারা ক্ষমা পেয়ে যায়? কারণ তার আমাদের কাছের মানুষ। আর অভীক যে তোমাকে চিনতো না, জানতো না।সেই ছেলেটাকে জোর করে তার মা কোন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে সে তখন কি বললো সবাই সেটা ধরে রেখেছো। আসলে কি জানো ডার্লিং?আমাদের আপনমানুষ গুলো আমাদের যত কষ্টই দিক তারা ক্ষমা পেয়ে যায় সম্পর্কের দোহাই দিয়ে! সাফার তো করে রক্তহীন সম্পর্কের মানুষগুলো!এই তাজের কথাই ধরো না। ভালোবাসতে সবাই পারে কিন্তু সেই ভালোবাসার জন্য, সম্মানের জন্য লড়াই করতে সবাই পারে না।যারা পারে দিনশেষে তারাই জিতে যায়।অথচ তাজ তোমার বোনের বর বলে কতসহজে তাকে তুমি ক্ষমা করে দিলে!তার কষ্টে ব্যথিত হলে।আমি বলছি না তাজ ইচ্ছে করে করেছে কিন্তু সে লড়াই করেনি। আমি তোমাকে জোর করছি না ডার্লিং।কিন্তু নিজেকে নিয়ে আবার একবার ভাবতে বলছি।যে কষ্ট গুলো একবার ভাসিয়ে দিয়েছিলে আজ সেই কষ্ট সুখ হয়ে তোমার কাছে ফিরতে চাইছে!হাত বাড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা মাত্র!”
নীতুর মুখটা অভিমানে ভার হয়ে আসে।চোখে মুখে কপট রাগ ফুটিয়ে বলে,”এ কেমন ভালোবাসা? একবারো আমার খোঁজ নিল না।আবার বলে কিনা, আমারো বিয়ের বয়স হয়েছে আর তারো।আর এখন কেমন ঘাপটি মেরে আছে।সব ভাণ বুঝলি?”
নীতুর বলার ঢঙে রিশা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে।চোখে জল এসে যায়।দাঁড়িয়ে নীতুকে জরিয়ে ধরে বলে,”তুমি দেখনি ডার্লিং,যে তিনটা দিন তুমি অচেতন ছিলে কি ভয়ংকর অস্থিরতায় কাটিয়েছে অভীক।না জেনে কিছু বলা ঠিক না।কে জানে অপরপক্ষের মানুষটা নিজেকে সামলিয়ে উঠতে পেরেছে কিনা?হারানোর ভয় যে সেও পেয়েছিল!তাছাড়া ব্যাটা রোজ তার মা ভাইকে পাঠিয়ে তোমার খবর তো ঠিকই আদায় করেছে।”
নীতু কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,”ভয় হয় আমার!ভীষণ! ”
রিশা হাইম তুলতে তুলতে বলে, “কিসের ভয়?আমি আছি না!উল্টা পাল্টা কিছু করলে এক ঘুষিতে ব্যাটার খাড়া নাক বোঁচা করে দিবো।জানে না তো রিশা কি চিজ!নো চিন্তা ডু ফুর্তি!অনলি ইনজয় ডার্লিং…..এখন চলো তো। খিদে লেগেছে। বাপরে বাপ…তোমাকে লেসন দিতে দিতে গলা শুকিয়ে গেছে।আজ বুঝলাম মাষ্টারদের এত মাথা গরম কেন থাকতো।”
নীতু হেসে ওঠে।সিগারেট খাওয়া পোড়া ঠোঁটে রিশাও হেসে ওঠে সাথে । জীবনে এরকম একজন বন্ধু থাকলে মন্দ হয় না!কি বলেন আপানারা?
***********–
মিলন বাসায় বসে অফিসের কাজ করছিল।ইতু এককাপ চা এনে সামনে রাখে।বউকে চলে যেতে না দেখে মিলন বুঝতে পারে বউয়ের কথা আছে।তাই চায়ের কাপ হাতে তুলে বলে,”কিছু বলবে?”
ইতু চিন্তিত ভঙ্গিতে শাড়িতে আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে বলে,” অভীককে দেখে কেমন বুঝলে?”
“কোন অভীক?”
মিলনের ভুলো মনের কারণে ইতুর মেজাজ খারাপ হয়। ঝাঁঝালো স্বরে বলে,”ছোট বাচ্চা সাজো আমার কাছে?”‘
মিলন দ্রুত নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলে,”আরে রাগো কেন?হুট করে বলেছো, তাই স্মরণে আনতে পারিনি।অভীককে তো ভালোই মনে হলো।”
“কেমন ভালো?শুধু ভালো নাকি অন্যরকম?”
মিলন ইতুর কথায় বোকা বোকা চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। ইতু কঠিন করে বলে,”একদম ন্যাকামি করবে না।আমরা মেয়েরা যেমন অন্য মেয়েদের নাড়ি নক্ষত্র বুঝি তেমন তোমাদেরও তো বোঝা উচিত।কোন পুরুষ কেমন?”
মিলন চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,”অভীককে আমার ভালো মানুষ মনে হয়েছে।কিন্তু যদি নীতু আপার জন্য বলো।তবে আমি বলবো এই ব্যাপারটা সম্পুর্ণ নীতু আপার উপর ছেড়ে দেও।এখানে থার্ড পারসন হয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া ঠিক হবে না।”
মিলনের কথা ইতুর মনপুত হলো। তাই কপাল কুঁচকে উঠে যাওয়ার সময় মিলনের হাত থেকে আধখাওয়া চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চলে গেলো।
মিলন অবাক কন্ঠে বললো, “আরে চা-টুকু তো পুরো খেতে দিবে?”
দরজার কাছে ইতু দাঁড়িয়ে বললো,”বাসায় এসেও অফিসের কাজ করার শাস্তি এটা।তাই অর্ধেক চা ই তোমার প্রাপ্য! “…..বলে ইতু চলে গেলো।
মিলন কতক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থেকে কাজে মনোযোগ দেয়।সে জানে ইতু এই বাকি চা ফেলে দিবে না বরং নিজে খাবে।কিন্তু মেয়েটা তা করবে অগোচরে!
ইতু ঠিক তাই করলো।কিচেনে বেসিনের পাশে দাঁড়িয়ে কাপের বাকি চা টুকুতে আয়েশ করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ।কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা ভালোবাসা দেখিয়ে বেড়াতে পছন্দ করেনা বরং আড়ালে রাখতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে !
*************
দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গেলো।নীতু এখন অনেকটা সুস্থ। এতদিন অফিসে না গেলেও আজ থেকে অফিস করবে।তাই তৈরি হচ্ছিল। রিশারা চলে গেছে দশদিন হলো।রিশার কথা মনে হতেই নীতুর মুখে হাসি ফুটে উঠে!
নীতু শাড়ির কুঁচি ঠিক করছিল তখন সাথি এসে বলে,”আপু তাজ ভাইয়া এসেছে।”
নীতুর কপালে কুঞ্চন দেখা দিল।প্রতিদিন তাজ আসে সন্ধ্যার পরে।এসে কতক্ষণ বসে চলে যায়।সেতু কখনো কথা বলে কখনো কথা বলে না। আজ সকালে কেন আসলো কে জানে?
নীতু চুল বাঁধতে বাঁধতে বললো,”আসুক।সেতু কথা বলে নিবে।তুই বস।ডক্টর তো বলেছে এই সপ্তাহের লাস্টে তোর ডেট।তাই একটু সাবধানে থাকিস।খারাপ লাগলেই কল করবি ঠিকাছে?”
সাথি তার বিশাল পেটটা নিয়ে খাটে বসে বলে,”তোমার পায়ের ব্যাথা তো পুরো সারে নি।তবুও যাচ্ছো?”
“বসে বসে বেতন খাওয়া ঠিক না।হাঁটা চলা করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
নীতু ঠিক করলো তাজ চলে যাওয়ার পরে বের হবে তাই সাথির সাথে গল্প করতে শুরু করলো।
ড্রয়িং রুমে তাজ বসে আছে অবিন্যস্ত ভাবে। আগের থেকে কিছুটা সাস্থ্য ভালো হয়েছে!পুরুষালী অবয়ব যেন চোখে পড়ার মত।সেতু কিছুক্ষণ তাকিয়ে এসব পর্যবেক্ষণ করলো।তারপর চোখমুখ শক্ত করে এসে সোফায় বসলো।
তাজ ফ্যাকাশে হেসে বললো,”কেমন আছো সেতু?”
“ভালো।”
“শরীর দেখি একদম ভেঙে পরেছে।বমি কমেনি নাকি? ডক্টরের কাছে যাবে?”
সেতুর তাজের এই অহেতুক চিন্তায় মেজাজ খারাপ হলো।তাই কাটা কাটা স্বরে বললো,”রোজ রোজ এসব নাটক করার মানে কি?এসব করলেই আমি ফিরে যাবো?যাবো না।এত ভালোবাসা আমাকে দেখাবেন না।”
তাজ নিরবে হেসে বললো,”আমি কোন ভালোবাসা দেখাচ্ছি না।কারণ ভালোবাসা থেকে আমার মন উঠে গেছে।আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকু পালন করতে চাই।!
“এটা আপনার আগে ভাবা উচিত ছিল।”
তাজ শান্ত কন্ঠে বলে,”কঠিন করে কথা বলবে না সেতু।সবাইকে সব কিছুতে মানায় না।তোমাকে সহজ কথাতেই মানায়। আমি বলছি না ফিরে চলো।জোরও করবো না।তবুও আমি রোজ আসবো।যদি কখনো মনে হয় আমার সাথে তোমার যাওয়া উচিত তোমার, তখনই যেও।”
সেতু কোন কথা বললো না আর চুপচাপ বসে রইলো।
“আজ বিকালে অফিসের কাজে সিলেট যাচ্ছি।চারদিন পরে ফিরবো তাই এখন দেখা করে গেলাম।ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো, ক্লাস করছো ভালো কথা।কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল রেখো।(কিছু টাকা টি টেবিলের উপর রেখে বললো)।টাকা রেখে গেলাম ডাক্তার দেখিয়ে নিও।আবার ভেবো না করুণা করছি।এসব ভালোবাসা, করুণা আমার আসে না।আসছি, ভালো থেকো।”…… বলে তাজ চলে গেলো।
তাজ চলে যেতেই সেতু হু হু করে কেঁদে দিল।নীতু বেড়িয়ে এসে দেখলো সেতু কাঁদছে।নীতু সেতুর পাশে বসে জরিয়ে ধরলো।সেতু ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,” আপি কেন আসে মানুষটা।আমার সহ্য হয় না।দায়িত্ব দেখায় এখন….এর একবিন্দুও যদি তখন দেখাতো তবে আমি ঠিক থেকে যেতাম।তবে এখন কেন?”
“দিনশেষে সবাই নিজের ভুল বুঝতে পারে।তুই কি ফিরে যেতে চাস?”
“আমাকে ফিরে যেতে বলো না।মন উঠে গেছে আমার।যদি এখানে থাকলে সমস্যা হয় তবে আমি হলে সিট নিবো।তবুও ওখানে যাবো না।”
নীতু রাগ দেখিয়ে বলে,”এক চড় দিবো।কোথাও যেতে হবে না।মন দিয়ে পড়াশোনা কর, আর নিজের খেয়াল রাখ।সময় বলেই দিবে কি করা উচিত তোর!”
সেতু নিজের চোখের জল মুছে বলে,”আপি তুমি অপেক্ষা করো,আমি তৈরি হয়ে আসছি।একসাথেই বের হবো।”
নীতু সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।সেতুর শরীর ভেঙে পরেছে।খেতে পারে না কিছুই।রাতেও ঠিকমত ঘুমায় না।যে মেয়ের পড়াশোনার নাম শুনলে জ্বর আসতো সেই মেয়ে রাতদিন পড়ে।কোথাও গিয়ে ঠেকছে সবার জীবন? কে জানে!
**************
নীতুকে অফিসে সবাই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো।এত বড় এক্সিডেন্টের পর ফিরে আসা ভাগ্যের ব্যাপার!নীতুর চোখে জল এসে গেলো। এত এত মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
নীতু এখনো হাঁটছে কিছুটা খুড়িয়ে। পলাশ এসে ফাইলের অনেক কাজই গুছিয়ে দিয়ে গেলো। একসময় নীতুর ডাক পড়লে অভীকের রুমে।নীতুর বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে লাগলো! ধীরে ধীরে রুমের উদ্দেশ্যে পা চালালো!
নক করে নীতু কেবিনে প্রবেশ করলো।অভীককে বসে থাকতে দেখলো চিরাচরিত অবস্থায়। কিছুটা কাত হয়ে শরীর এলিয়ে। স্টাইপের ফর্মাল শার্ট,কালো প্যান্ট,হাতে কালো ঘড়ি,চুল জেল দিয়ে পিছনে এলিয়ে সেট করা।ঠোঁটের কোণে সদা বিরাজমান কাঠিন্য,চোখের চাহনি দুর্ভেদ্য!একদম পরিপাটি লুক! নীতু ফাঁকা ঢোক গিললো।
নীতুকে দেখেই অভীক তাকালে।সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করলো একপলক।বাদামী রঙের শাড়ি পড়া।চুলে এলানো খোঁপা।ঘাড়ের কাছে চেপ্টা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ।যা বড় নেকের কারণে দেখা যাচ্ছে। নীতু কিছুটা খুঁড়িয়ে হেঁটে প্রবেশ করেছে।তারমানে এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়? অভীক গমগম স্বরে বললো, “বসুন মিস নীতু। কেমন আছেন আপনি?”
নীতু মৃদু হেসে বললো,”আলহামদুলিল্লাহ।”
“ওয়েলকাম মিস নীতু! আপনাকে সুস্থ দেখে সত্যি ভালো লাগছে।আশাকরি পার্ফেক্টলি কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন।”
নীতুর গা জ্বলে উঠলো।চোখের দৃষ্টিতে আগুন ঝড়ে
পড়লো।নীতুও অভীকের মত কাঠকাঠ স্বরে বললো,”ধন্যবাদ স্যার।আপনাদের ফর্মালিটিতে সত্যিই আমি আপ্লূত! ”
নীতুর কথার ধরনে অভীক সুক্ষ্ম ভাবে চাইলো।মেয়েটা কি রেগে গেছে?নিজের আবেগ সামলে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লো।একটা ফাইল নীতুর সামনে রেখে দেখিয়ে দিলো প্রজেক্ট সার্ভার! নীতু সব বুঝলো তবুও নিজের রাগ দমে রাখতে পারলো না।অভীকের কাছ থেকে ফর্মালিটি সত্যিই আশা করে নি নীতু।তবে কি আশা করেছে তাও বুঝতে পারছে না।তাই নিজের উপরও কিছুটা রাগ হচ্ছে বৈকি!
সব কিছু বুঝে নিয়ে নীতু চলে যেতে নিলো।ঠিক তখনই অঘটনটা ঘটলো।একেতো পায়ের ব্যথা সারেনি তারউপর শাড়ি পড়েছে।পায়ের যেখানটায় ব্যথা সেখানটায় শাড়ি পেঁচিয়ে পড়ায় ব্যথায় নীতু এলোমেলো পা ফেললো এবং যার ফলাফলে পড়ে যেতে নিলো।অভীক দাঁড়িয়েই ছিলো।নীতুকে যেন মুহুর্তেই লুফে নিলো নিজের বাহুডোরে।নীতু চমকালো।শক্ত করে অভীকের বুকের কাছের শার্ট খামছে ধরলো।অভীক নীতুর কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতেই মনের ভিতর এক অসভ্য চিন্তা হানা দিলো।নিজেকে সামলে নীতুকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ধমকে বললো,”ব্যথা পুরোপুরি সারেনি তবুও স্টুপিডের মত শাড়ি পড়েছেন কেন?”
“না মানে…. ” নীতুর স্বর কাঁপতে লাগলো।নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করতে পারে নি।একটু আগেও নীতু অভীকের বুকের খুব কাছটায় ছিলো ভাবতেই মাথায় চক্কর দিতে শুরু করলো!
“দেখি পা টা।”….. অভীক চিন্তিত কন্ঠে বললো।
নীতু না বলে দাঁড়িয়ে পড়লো।নীতুর মাথা ভনভন করে ঘুরছে তখন।অভীক ফের ধমকে বললো,” বসুন।কোথাও যাবেন না আপনি।”….বলে ফাস্টকিডের বক্স এনে নীতুর পায়ের কাছে বসলো।নীতু অস্বস্তিতে গুটিয়ে গেলো যেন।কিছুটা রাগও হলো।এতই যখন চিন্তা তবে এতদিন একটা খোঁজ কেন নিলো না?
শাড়িটা গোড়ালি থেকে কিছুটা উপরে উঠাতেই অভীক শিউরে উঠলো।একমাস হয়ে গেছে তবুও এখনো দগদগে ক্ষত।কেমন গর্ত হয়ে আছে!কতটাই না আঘাত পেয়েছিলো।মুখ থেকেই অজান্তেই বের হলো,”ইশ!কি অবস্থা। ”
নীতুর চোখে জল এসে গেলো।অভীক সেই ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে সুপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো।শাড়ির ঘসায় সদ্য ঘুচিয়ে আসা ক্ষতে আবার রক্ত এসে পড়েছে।যত্ন করে হেক্সোজেল দিয়ে অভীক তা পরিষ্কার করলো।তারপর হালকা পেচিয়ে দিলো।আহত স্বরে বললো,”এখনো ঘা শুকালো না কেন?ডক্টর কি বলেছে?”
“সময় লাগবে।যেহুতো ক্ষতটা অনেক হয়েছিলো।”….. নীতুর কথা কেমন ভেজা ভেজা শুনালো।
” আপনার অফিসে আসা ঠিক হয়নি।যত হাঁটবেন ততই আরো সমস্যা হবে।আরো কিছুদিন রেষ্ট নিতেন মিস নীতু?”
“এখন এত দরদ দেখাতে হবে না ।এতদিন যখন দেখাননি তবে আজ কেন?আপনার মেডিক্যালিটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার! “…… নীতু নিজের অজান্তেই মনের চাপা কথা বলে ফেললো।এবং পরক্ষণেই ভীষণ অস্বস্তিতে পরলো।
অভীক গভীর চাহনিতে নীতুর দিকে তাকালো।চোখ ছলছল,ঠোঁট কাঁপছে রাগে!কপালে কিছুটা চুল ছড়িয়ে পড়েছে।অভীক শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।নীতুর কপালে ছড়িয়ে পরা এলোমেলো চুল গুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে গালে আলতো করে হাত রেখে বললো,” আপনি কি কখনোই আমাকে বুঝতে পারবেন না মিস নীতু?শুধু ভুল বুঝেই যাবেন।নাকি ভুল বুঝা আপনার মুদ্রাদোষ?”
অভীকের কথা নীতুর কানে বড়ই ব্যথিত লাগলো।নীতু কি বলবে ভেবে পেলো না!
চলবে,