#কাননবালা,পর্বঃ৪২ ( শেষাংশ ১ম)
#আয়েশা_সিদ্দিকা
রাত দুটো। গভীর ঘুমে যখন সবাই নিমজ্জিত তখন অভীক ফিরলো বাড়িতে।অনেকটা হেলে দুলে আয়েশি ভঙ্গিতে। মুখে লেগে আছে ঈষৎ হাসি,চোখে এক কৃষ্ণবতীর মায়া আর সমস্ত হৃদয় জুড়ে কাননবউর মিষ্টি সুবাস! অভীক আনমনেই আরো একটু জোড়ালো হাসে। নীতু নামের মেয়েটি তার সর্বস্ব গ্রাস করেছে বুঝতে পেরে খানিকটা পুলোকিতও বোধ করে!হুট করেই ভালো লাগে অকারণেই।যখনই ডাগর ডাগর চোখে তাকায় মনে হয় বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিলো এখখুনি ।
চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই থমকে যায় অভীক।মা, বড়ো,ভাবি বসে আছে ড্রয়িং রুমে। অভীক হালকা স্বরে বলে,”এখনো ঘুমাওনি তোমরা?”
মুহুর্তেই তেতে ওঠে রুশিয়া বেগম।রাগত্ব স্বরে বলে,” যে ছেলের কাল বিয়ে আর সে রাত দুটো পর্যন্ত টইটই করে বেড়ায় তার পরিবার কি করে ঘুমায়? কোথায় ছিলে তুমি জানতে পারি?”
মায়ের কড়া কথায় অভীক বেকায়দায় পড়ে যায়।নিজেকে টিনেজার মনে হয়। অনীকের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় ভাই তার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। অভীক ভাইয়ের পাশের খালি সোফাটায় বসে মিনমিন করে বলে,” মা এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
ছেলের মিথ্যে কথায় রুশিয়া বেগম অবাক হলেন।চোখা স্বরে বললেন,”বন্ধুটি বুঝি খুবই স্পেশাল?যে নিজের হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতে দেখা করতে যেতে হলো!তাও এত রাতে?”
অভীক কিছু বলার আগেই অনীক ভাইকে ফিসফিস করে বলে,”আজ তুই শেষ!”
অভীক চোখ গরম দেয় ভাইকে।অনীক তাতে নিভেনা বরং গা জ্বালানো একটা হাসি ছুড়ে দেয় ভাইয়ের দিকে। অভীক আত্মসমর্পণের কন্ঠে বলে,” সেরকমই,স্পেশাল বলতেই পারো মা!”
“সেই স্পেশাল বন্ধুটি বুঝি নীতু?”…. কটাক্ষ করে বলে মা।
অভীক খুক খুক করে কেশে ওঠে।রুমি এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার সেও মিটমিট করে হাসতে শুরু করে। অভীক হালছাড়া কন্ঠে বলে,” এত রাগছো কেন মা? আমার বউকে হলুদ সাজে আমি দেখবো না?এটা কখনো হয়? দুনিয়া সুদ্ধ লোক আমার বউকে দেখবে অথচ আমি বর হয়ে না দেখলে কেমন দেখায় না ব্যপারটা,তাই তো গেলাম!ঠিক করেছি না মা?”
রুশিয়া বেগমের ইচ্ছে করছে ছেলের গালে কষে একটা থাপ্পড় দিতে।কিন্তু এত বড় ছেলের সাথে উচ্চ গলায় কথা বলতেও বাজে।কতটা লজ্জা শরম হীন হলে কোন ছেলে এমন কথা বলে?
অনীক এবার আর হাসি চেপে রাখতো পারলো না।উচ্চ স্বরে হেসে ফেললো।মায়ের কড়া দৃষ্টি আর ভাইয়ের এমন হাসি দেখে অভীক মুখ কাচুমাচু করে বসে রইলো। রুশিয়া বেগমের খানিকটা মায়াও হলো কিন্তু সেই চাপা মায়া টুকু চেপে রেখেই বললেন,”আত্মীয় স্বজনরা কি মনে করলো বলতো? আমারই হয়েছে যত কপাল খারাপ। দুই দুইটা ধলা বলদ ধরেছি পেটে।যারা বউ ছাড়া কিছু বুঝে না।হয়েছিস তো একদম বাপের……”
বাকিটুকু বলতে পারেন না তিনি।দুই ছেলে আর রুমির বড় বড় চোখে তাকানো দেখে বুঝে ফেলেন ভুল সময়ে ভুল কথা বলে ফেলেছেন। অনীক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”তুমি একদম ঠিক বলেছো মা।ছোটকে আর বকেই বা কি করবে?ওরই বা কি দোষ বলো?এসব তো আমরা বংশ সূত্রেই পেয়ে এসেছি।বউ ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না।যেমন আমার বাপ তার বউ ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না।রক্ত কথা বলে, তাই না ছোট?আমি কি ভুল বলেছি মা?”
অভীক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েই চাপা হেসে ফেলে।হেসে দেয় রুমিও।রুশিয়া বেগম রাগ করে উঠে পড়েন।রুমির দিকে তাকিয়ে খ্যাক করে বলেন,”দুই বদমায়েশের সাথে তুমি খিকখিক করে হাসছো কেন?রাত কটা বাজে, ঘুমাতে হবে না?অসুস্থ শরীর নিয়ে বসে আছো কোন আক্কেলে?” রুমি চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে। রুশিয়া বেগম চলে যেতে নিলেই অভীক আর অনীক মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে একসাথে বলে,”আমরা দুই ভাই আমাদের মাকে ভীষণ ভালোবাসি!তা কি তুমি জানো মা?”
রুশিয়া বেগমের চোখ ছলছল করে ওঠে।ছেলে দুটো এমন পাগল কেন? নিজের খুশিটুকু আড়াল করে গম্ভীর মুখেই ছেলেদের বলেন,”মাকে কি করে ভুলাতে হয় তা তোমাদের দুইজন কে না দেখলে আমি জানতামই না।ন্যাকামো ছেড়ে ঘুমাতে যাও।”…… বলে হন হন করে নিজের রুমে চলে যান তিনি। রুমিও শাশুড়ীর পিছু পিছু চলে যেতে নিলে অনীক বিস্মিত স্বরে বলে,”তুমি কই যাচ্ছো?”
“ঘুমাতে।”
“তাহলে ওদিকে কেন? ”
“মায়ের সাথে ঘুমাবো।”……. হাই তুলতে তুলতে বলে রুমি।
অভীক আর অনীককে একরাশ বিস্ময়ে ডুবিয়ে রেখে রুমি ঢুলুঢুলু চোখে শাশুড়ীর রুমে ঘুমাতে চলে যায়।
অভীক মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,” বড়ো,ভাবির হটাৎ কি হলো?”
অনীকও ভাইয়ের মত মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”কিছুই বুঝতে পারছি না ছোটো।মা এখানে আসার পর থেকেই রুমি তার সাথে ঘুমাচ্ছে।সারাদিন মায়ের পিছু পিছু ঘুরে।এই রুমিকে আমি চিনতে পারি না।একদমই না।”
অভীক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। ভালোবাসা সবাইকে বদলে দেয়। ভালোবাসার ঘাত-প্রতিঘাত ভালোকে খারাপ,খারাপ কে ভালো তে রুপান্তরিত করে!
রুশিয়া বেগম শুয়ে পড়েছিলেন।এই বাড়িটা তার শশুড়ের। বিশাল বড় বাড়ি,পর্যাপ্ত রুম থাকায় যত মেহমানই আসুক সমস্যা হয় না।ঠিক তখনই রুমি এসে শুয়ে পড়লো তার পাশে।রুশিয়া বেগমের কপাল কুঁচকে গেলো। মেয়েটা রোজ রোজ এসে তার পাশে ঘুমাচ্ছে কারণ কি কে জানে? স্বামীকে ফেলে এখানে ঘুমাতে আসার কি কারণ?
রুমি মোড়াতে মোড়াতে শাশুড়ীর শরীরের সাথে লেপ্টে শুয়ে পড়লো।রুশিয়া বেগম খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন,”নিজের রুম ছেড়ে এখানে কি?”
রুমি শাশুড়ী পিঠে মুখে গুঁজে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,”ও রুমে কিসের যেন গন্ধ মা।গন্ধে পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে।একদমই ঘুম হয় না।”
রুশিয়া বেগম এপাশে ফিরেই সন্তুষ্টির হাসি হাসেন।রুমি নাক মুখ গুঁজে আছে রুশিয়া বেগমের পিঠের কাছে।রুমি নাক টেনে বড় বড় নিঃশ্বাস নেয়।মা মা গন্ধে কেমন বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে! প্রশান্তিতে চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।
**********
সকাল সকাল সাথির তীব্র চিৎকারে বিয়ে বাড়ির সবার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। তখন ভোর ছয়টা। দরজার কাছে রিপন দাঁড়িয়ে আছে লাগেজ,সুটকেস সহ। নীতু সেতু দুজনেই খুশিতে সাথিকে জড়িয়ে ধরে।রিপন মিষ্টি হেসে বলে,”সারপ্রাইজ!নীতু আপার বিয়েটা মিস করতে ইচ্ছে হলো না।তাই চলে আসলাম।”
সাথির চিৎকারে শানের ঘুম ছুটে গেছে।সাথি তীব্র খুশিতে কাঁদছে।হাউমাউ করে কাঁদছে।মায়ের কান্না দেখে সাথে কাঁদছে ছোট্ট শান। রিপনের চোখটাও জলে ভরে আসে।এত সুখ কেন চারপাশে।তার মত এতিম ছেলেকে আল্লাহ একটা পরিবার দিয়েছে এই খুশিতে তার হাজার বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে! নীতুর চোখটাও ছলছল করে ওঠে। সাথির কোল থেকে শানকে নিয়ে রিপনের কোলে দিতেই রিপন বাচ্চাদের মত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়। রিপন খানিকটা লজ্জাও পাচ্ছে এখানের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু সে নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারছে না!কি লজ্জাজনক ব্যপার! তবুও সে কাঁদছে।লজ্জা আর নিজ অস্তিত্বের প্রাপ্তি মিলে মিশে তাকে বাচ্চাদের স্তরে নিয়ে এসেছে!
************
আত্মীয় স্বজনের হাঁক ডাক আর সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে চারপাশ ম ম করছে।অল্প বয়সই মেয়েদের সাজগোজ আর খিলখিল হাসিতে বিয়ে বাড়ি মুহূর্তেই ঝলঝল করে উঠলো।সবাই কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত।কেউ খোশ গল্প করছে,কেউ বা তদারকি করছে কেউ বা সাজ গোজ করছে।এ যেন অন্য রকম এক দিন।
মহিমা বেগম শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সেতুকে প্রশ্ন করলো,”হ্যা রে সকাল থেকে তাজ কে দেখতে পাচ্ছি না।কোথায় ও?”
সেতু আমতা আমতা করে।মাকে কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না।মেয়ের এমন মুখ দেখে অবশেষে রাবেয়া বেগমকে ধরেন তিনি।একরাশ চিন্তিত কন্ঠে বলেন,”বেয়ান তাজ কোথায় গেছে?আপনি কিছু জানেন?”
রাবেয়া বেগম হতাশা মিশ্রিত চোখে সেতুর দিকে তাকায়। সেতু গোলমেলে স্বরে বলে,”মা তাজের হুট করেই একটা কাজ পড়েছে তো তাই একটু বাহিরে গেছে।এখুনি এসে পরবে হয়তো।”
” সে কিরে খুলনায় ওর কি এমন কাজ?তাছাড়া তাজ তো ছুটিতে এসেছে।তবে?”
সেতু ফাঁকা ঢোক গিলে।মাকে কি দিয়ে বুঝ দিবে ভেবে পায় না।তাজ ভোর সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে।কোথায় গেছে,কখন ফিরবে কিছুই বলে যায় নি।সেতুও জিজ্ঞেস করেনি।বরংচ সেতুর অন্যরকম একটা স্বস্তি হচ্ছে।তাজ এখানে উপস্থিত থাকলেই চোখের সামনে তার কষ্ট মিশ্রত অবয়ব দেখতে হতো।তার থেকে এই ভালো।অস্বস্তির থেকে স্বস্তি ভালো!কিন্তু এখন মাকে কি বলবে?
উদ্ধার কর্তা হিসেবে সেখানে হাজির হয় জায়েদ।শাশুড়ীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,”মা আপনি এখানে।ওদিকে মামারা আপনাকে ডাকছে।আর অযথা টেনশন নিয়েন না।তাজ আমাকে বলে গেছে।পরের চাকরি করা তো আর মুখের কথা না!অফিসিয়াল কিছু ডকুমেন্টস পাঠিয়ে চলে আসবে।আপনি চলুন তো!”
মহিমা বেগম সন্তুষ্টি চিত্তে চলে যান।সেতু ফোঁস করে নিঃশ্বার ছাড়ে।শাশুড়ীর ওমন আলাভোলা চাহনি দেখেও কেমন গা জ্বলে ওঠে।তাই কোন রকম কোন ভদ্রতার ধার না ধরে রাবেয়া বেগমের সামনে থেকে গজগজ করে চলে যায় সেতু!মনে মনে বদ মহিলা বলে বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে নিজের মনেই ভেঙচি কাঁটে!
********
নীতু খাটের উপর বসা।আর তার সামনে কসমেটিকসের পসরা সাজানো।নীতু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়।তার এমন চাহনিতে কারো মন গলে না। নীতুর ভারি মেকাপ পছন্দ না।তাই পার্লারে যায় নি।তার একটা কাজিন ভালো মেকওভার পারে তাই সেই ঘরে বসে সাজাবে।নীতু ভেবেছিলো হালকা সাজ দিবে।কিন্তু শিফার মেকাপ কিড দেখে তার আক্কেল গুড়ুম! নীতুর রুমে নীতুকে ঘিরে বসে আছে সকল কাজিনরা।আর সাথে আছে ইতু,সেতু,সাথি,রিশা। সবাই টুকটাক রেডি হচ্ছে আবার শিফাকেও সাহায্য করছে। নীতু মিনমিন করে বলে,” শিফা এত কিছু নিয়ে কেন বসেছিস?বেশি সাজ দিবি না খবরদার! ”
শিফা পুরো পাক্কা প্রফেশনাল মুডে আছে।কপাল কুঁচকে বিরক্ত কন্ঠে বলে,”ব্রাইডদের এত কথা বলতে কখনো দেখেছো?চুপ করে বসে থাকো।”
সবাই সাজচ্ছে কিন্তু রিশা পায়ের উপর পা তুলে মোবাইল চালাচ্ছে। সবার সাজ দেখে তার মাথা ধরে গেছে! নীতু আদেশের স্বরে বলে,”রিশু তুই রেডি হোস না কেন?”
রিশা নিজের দিকে তাকায়। সে তো রেডি হয়েই আছে। আর কি হবে? বরাবরের মতই জিন্স আর ফতুয়া! রিশা নীতুকে এক চোখ মেরে বলে,”আই অলওয়েজ রেডি ডার্লিং!”
“আজকের দিনে অন্তত এসব পরিস না রিশু।”
“বিয়েটা তোমার আমার নয় ডার্লিং।তাছাড়া ওমন মেয়েলি লুকে আমার বড্ড অস্বস্তি হয়!” রিশার ভাবলেশহীন কন্ঠ।
নীতুর চোখ বন্ধ। শিফা আই মেকাপ করছে।ইতু নীতুর নখে নেলপলিশ লাগাচ্ছে। ঠিক তখনই নীতুর মোবাইলে রিং বেজে ওঠে।স্ক্রিনে অভীক নামটা ভেসে উঠতেই রুমের সবাই হৈ হৈ করে ওঠে।নীতু কিছু বলার পূর্বেই সেতু কল রিসিভ করে লাউডস্পিকার অন করে। নীতু হতভম্ব।
অভীক গমগমে স্বরে বলে,”হ্যালো! ”
নীতু যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে।সবার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সবাই।সকলের কানখাড়া মনোযোগ অভীক কি বলে। নীতুর কোন সাড়া না পেয়ে অভীক পুনরায় বলে, “হ্যালো নীতু শুনতে পাচ্ছো?”
বোনদের সবার গরম চাহনিতে নীতু অসহায় কন্ঠে বলে,” জ্বি বলুন!”
“কথা বলছিলে না কেন?”
সবাই মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে নিষেধ করে।মোবাইল ইতুর হাতে,যা নীতু নিতেও পারছেনা। নীতু লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলে,” এমনিতেই!”
“তোমার কি ফুল পছন্দ বলো তো নীতু? বাসর ঘর ডেকোরেশন করতে লোক এসেছে। ওদের ঠিক ঠাক ডিরেকশন দিতে পারছি না তোমার পছন্দ না জেনে। ‘” অভীকের জড়তা হীন কন্ঠ ভেসে আসে।কন্ঠে যেন প্রবল তাড়া!
নীতু এক মহা সমুদ্র লজ্জায় আচ্ছাদিত হয় ।বেহায়া পুরুষটার বেসামাল কথায় নিজেকে ভীষণ বিপন্ন বোধ করে।বুকের ভিতর অজানা চড়ুই পাখিটা ছটফট করে ওঠে!চোখ মুদে আসে! শ্বাস প্রশ্বাসে তীব্র উষ্ণতা!
তা দেখে সবাই মুখ টিপে হাসে।
” আপনার ইচ্ছা! “….চাপা স্বরে বলে নীতু।এতটুকু বাক্য বলতেই নীতুর ভীষণ কষ্ট হলো।
ফোনের ওপাশে অভীকের কপালে ভাঁজ পড়ে।নিজের রুমের দিকে তাকিয়ে এক হাতে চুল পিছনে ঠেলে দিয়ে বলে,”শুধু আমার ইচ্ছে,তোমার নয় কেন? এ ঘরটা আমাদের নীতু!এই ঘরের প্রতিটা মুহূর্ত তুমি আমি মিলে সন্ধিক্ষণে বেঁচে থাকবে! কাননবউ এই ঘরটা তোমার ইচ্ছেতে সেজে উঠুক। তোমার রঙে,তোমার গন্ধে! তোমার পছন্দের ফুলে আমি আমাদের ঘরের প্রথম রাতটা সাজাতে চাই!বুঝেছো?”
নীতু প্রবল আবেগে মাথা কাত করে।সে সব বুঝেছে তা যেন অভীক দেখছে। মুখে কথা ফুটে না।রিশা বিড়বিড় করে বলে,” বস তো হেব্বি জোস! ”
নীতুর গাঢ় শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ অভীক মনোযোগ দিয়ে শুনে ফিসফিস করে বলে, “তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো নীতু?”
নীতুর তখন আকুলিবিকুলি অবস্থা! লজ্জায় শেষ বিকেলের রক্তিম আভা যেন ছড়িয়ে পরেছে সারা মুখে।নিজেকে তীব্র অসহায় মনে হচ্ছে!
অভীক শব্দ করে হেসে ফেলে। ফোনের ওপাশ থেকেই নীতুর লজ্জাবতী মুখটা যেন দেখতে পাচ্ছে সে। অভীকের ভীষণ ভালো লাগছে।আর কিছু মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপরই তো তার কাননবালা তার কাছে আসবে।
অভীকের আনমনেই চোখ মুদে আসে।জড়িয়ে আসে কন্ঠ। জড়ানো গলায় আদুরে সুরে বলে,”লজ্জাতে অভ্যস্ত হও নারী।এখন থেকে তোমার প্রেমিক বরের সকল কর্মকান্ডই তোমাকে লজ্জায় সিক্ত করবে!বি প্রিপায়ার্ড নীতু! তোমাকে লজ্জায় ডুবিয়ে ফেলবার ইচ্ছে আমার!ভীষণ ইচ্ছা! তোমার বরের অসভ্য সব ইচ্ছে তোমাকে অসভ্য সব লজ্জায় রাঙাবে!”
নীতু কেঁপে ওঠে।হাত পায়ে কেমন ঝিমঝিম অনুভূতি।নাক কপাল ঘেমে ওঠে।কানের পাশটা ঝা ঝা করতে থাকে অনবরত!
অভীক একটু থামে।প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে বলে,”ট্রাস্ট মি নীতু।তোমাকে প্রতিটা প্রহরে লজ্জায় হাবুডুবু খায়িয়ে সেই জলে যদি নিজেই ডুবে না মরি তবে আমি তাশরীফ অভীক নই!একদমই নই”
নীতু চোখ বন্ধ করে ফেলে।এতটা বেসামাল, ঠোঁটকাঁটা কি করে হয় এই পুরুষ?মুহুর্তেই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার বোনেরা একটা আর একটার গায়ের উপর শব্দহীন হাসিতে লুটিয়ে পরছে।
নীতু চোখ মুখ কঠিন করে চাপা স্বরে বলে,”অভীক থামুন।”
“কোন থামাথামি নাই।আজ থেকে তো সবে শুরু।”….. অভীকের কন্ঠে দুষ্টুমি।
“আপনি আসলেই অসভ্য! ” নীতুর কন্ঠে কপট রাগ।কিন্তু চোখে মুখে একসমুদ্র জড়তা আর লজ্জার ভীর!
“আমি কখন বললাম, আমি সভ্য?আদিমতা পুরুষকে অসভ্য করেছে, তাহার তুমি কি বুঝবে বউ?”
পাশ থেকে রিশা বলে,”ডার্লিং কিছু না বুঝলেও আমরা সবটাই বুঝিছি বস।”
রিশার কথায় সবাই খিলখিল করে হেসে দেয়।অভীক ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে।তার মানে শালিকা দল তার আলাভোলা বউকে জ্বালাচ্ছে!অভীক অভিযোগের সুরে বলে,” আমি অসভ্য হলেই দোষ নীতু।আর তোমার বোনেরা যে চুপিচুপি আমাদের কথা শুনে অসভ্যতামির চূড়ান্ত করলো, তার বেলা?ভেরি ব্যাড!বিনা নোটিশে পার্সোনাল জায়গায় ঢুকে পড়লো একদম!”
নীতু থম মেরে বসে রইলো।যেমন অভীক তেমন এই বিচ্ছু বাহিনী।এখানে সে নাদান শাবানা টাইপ রোল প্লে করছে মাত্র!ইতু মৃদু হেসে বলে, “ভাইয়া আপা ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।”
“তোমার আপা লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কি জানে?”
সেতু বলে, “ভাইয়া আমাদের গিফট দিতে হবে, না হলে আপিকে ভূতনি সাজিয়ে পাঠাবো আপনাদের বাড়িতে।”
“ভূতনি বউ দেখে কি করে মুগ্ধ হতে হয় তা তোমাদের ভাইয়া ভালো মত জানে বালিকারা!”….. ফোনের ওপাশে কলার নাচিয়ে বলে অভীক।
সবাই ফের হেসে দেয় অভীকের দুষ্টুমিতে।
অভীক বলে,” নীতু তোমার বোনদের বলে দাও, আমার হৃদয়টা ভীষণ বড়।সেই বড় হৃদয়ের দুলাভাই তার ছোট ছোট শালিকাদের ভীষণ ভালোবাসে। এটাই তাদের গিফট। ”
সবাই এক সাথে খিলখিল করে হেসে দেয়। শিফা ভেংচি কেটে বলে,”কিপ্টু দুলাভাই!”
“তোমাদের ব্যপারে কিপ্টা হলেও বউয়ের ব্যপারে কিন্তু আমি ভীষণ দিলখোলা!বুঝেছো বালিকারা?”
নীতু কিছু না বলে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ইতু প্রশান্ত মুখে বলে,”ভাইয়া… আপার দোলনচাঁপা, বেলি আর গোলাপ ফুল পছন্দ।”
“ধন্যবাদ শালিকা।যাও তোমাদের একটা আকর্ষণীয় গিফট পাওনা রইলো।”
বলেই অভীক ফোন কেঁটে দেয়।শিফা সাজানোতে মনোযোগ দেয়।ঠিক তখনই টুং করে একটা মেসেজ আসে।নীতু ইনবক্স ওপেন করে। ” বউ সাজে তোমাকে দেখার তীব্র অপেক্ষা এই প্রেমিক বরের! ”
নীতু টেক্সটটা পড়ে আলতো হাসে।অভীক পাগল! বদ্ধ পাগল!
***********–
কবুল, কবুল, কবুল এই তিনটি শব্দ অথচ কি জোড়ালো তার বন্ধন শক্তি! অভীক ব্যস্ত কন্ঠে তিন কবুল বলেই হেসে ফেললো। অনীক ভাইয়ের কানে ফিসফিস করে বললো,” ছোটো, মান ইজ্জত শেষ করে দিলি।এত তাড়া তোর?”
অভীক কিছুই বলে না।তার চোখের দৃষ্টি ব্যকুল।নীতুকে এখনো বউ সাজে দেখতে পারে নি।মেয়েটা কই? অভীক বিড়বিড় করে বলে,”দ্রুত আসো কাননবউ।তোমাকে দেখে শীতল হোক আমার নেত্রদ্বয়!”
নীতুর কবুল বলতে গিয়ে ভীষণ কষ্ট হলো।বুকের ভিতর কেমন অজানা কষ্ট। চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের সকল অধ্যায়।যা ভীষণ বিষাক্ত! পরক্ষনেই চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো অভীকের শুভ্র মুখখানি। নীতুর সকল কষ্ট মুছে গেলো একমুহূর্তে। এক চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।নীতু মৃদুস্বরে বললো,”আলহামদুলিল্লাহ, কবুল!”
সকলের মোনাজাতে নব দম্পতিকে একরাশ দোয়া করা হলো।মহিমা বেগম খুশিতে কাঁদলেন,রাবেয়া বেগম আফসোস করলেন,আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই কিছুটা ভাবাবেগে তাড়িত হলো।আহারে! কালো মেয়েটার একটা গতি তো হলো!
শুভ্র শরীরে ডিপ কালো রঙের শেরওয়ানী। মাথায় সোনালী টোপর।পায়ে নাগড়া। যেন কোন রাজপুত্র বসে আছে । খানিক আগেই বিয়ে পড়ানো শেষ।অভীক স্টেজে বসে আছে।পাশে রুমি নাকে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বসে আছে। এত এত খাবারের সুগন্ধিতে পেটে পাক দিচ্ছে।এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে রুমির।অনীককে সেই কখন পাঠালো একটু লেবু আনতে।এখনো আসছে না! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রইলো। অভীক ভাবির দিকে তাকিয়ে অধৈর্য্য হয়ে বললো,”ভাবি এখনো নীতু আসছে না কেন? ”
রুমি কপাল কুঁচকানো অবস্থায় তাকালো।অভীকের চিন্তিত মুখটি দেখে এবার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।আহা!
ঠিক তখনই নীতুর আগমন। বউ সাজে নিচের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা হেঁটে আসছে।নীতুকে ঘিরে হেঁটে আসছে তার বোনেরা আর ভাবি।অভীক তাকিয়ে রইলো।মুহূর্তেই বিয়ে বাড়ির কোলাহল ছাপিয়ে নীতু নামের মুগ্ধতা তার বুকে আঁচড় কাঁটলো।সিঁদুর রঙা লাল বেনারসী শাড়ি, স্টোন বসানো অফ হোয়াইট দোপাট্টা, হাতে কানে গলায় ভারী গহনা।নাকে টানা নথ।যেন কোন মহারাণী তার রাজ্যে প্রবেশ করছে।অভীক গাঢ় চাহনি ফেলে তাকিয়ে রইলো।নীতুর প্রতিটা পদক্ষেপে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। হুট করেই নীতু তাকালো। অভীকও তাকিয়ে ছিল।দুজনের দৃষ্টি ক্ষনিকের জন্য একত্রিত হলো।কেঁপে উঠলো দুজনেই!আষাঢ়িয়া ঘোর বর্ষার মত একরাশ ভালোবাসা ঝুপ ঝুপিয়ে ভিজিয়ে দিলো দু’জনের মন,শরীর! দু’জনেই বুঝলো,জানলো! শুদ্ধতম ভালোবাসার বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজলো!
“অভীকের রুচি বোধ এতটা যে নিম্ন জানা ছিলো না।শেষে কিনা একটা কালো মেয়ে বিয়ে করলো!কি দেখলো কে জানে?”
মুহূর্তেই অভীকের চেহারার রঙ পাল্টে গেলো।ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো স্টেজের খানিক পাশে দাঁড়িয়ে তার স্কুলের লাইফের দুই বন্ধু এমন মন্তব্য করছে।ক্রোধে হাত মুষ্টি বদ্ধ হলো।নাক মুখ শক্ত হয়ে গেলো।অনীক পাশে এসে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বললো।অভীক ফ্যাকাশে হাসলো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। স্টেজ থেকে নেমে হেঁটে নীতুর মুখোমুখি দাঁড়ালো।নীতু তাকালো। অভীক ডান হাত বাড়িয়ে দিলো নীতুর দিকে। নীতু বোকার মত তাকিয়ে রইলো।অভীক সবার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,”সু-স্বাগতম বেগমসাহেবা!আমার জীবনে আপনার পদার্পন সুখের হোক!”
নীতু গভীর চাহনিতে তাকিয়ে পরম নির্ভরতায় অভীকের হাত ধরে স্টেজে উঠে বসলো।নীতুকে বসিয়ে অভীক পাশে দাঁড়ানো বন্ধু দু’জনের কাছে চলে গেলো।দুই হাত দুজনের কাঁধে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে হেসে বললো, “আমি ভেবেছিলাম তোরা আমার বন্ধু। কিন্তু এখন স্বীকার করতে বাধ্য হলাম।আমার ভুল হয়েছে।একসাথে মিশলেই তাকে বন্ধু ভাবা উচিত না।খাওয়া দাওয়া হলে সোজা বিদায় নিবি।আফসোস হচ্ছে আমার শশুড় বাড়ির দুটো খাবারের প্লেট নিম্ন মনের মানুষের পেটে যাচ্ছে বলে!আর শোন আমার ত্রিসীমানায় আর কখনো যেন তোদের না দেখি।”
ছেলে দুটো আহাম্মকের মত তাকিয়ে রইলো!
*********
তাজ ফিরলো বিধ্বস্ত শরীরে।মনের অবস্থা কাহিল! নিজের ভিতর অদ্ভুত অস্থিরতা!
সময় টা পড়ন্ত বিকেল। তাজ ভেবেছিলো নীতুর বিদায় পর্ব হয়ে গেছে হয়তো।এসে দেখলো আয়না দেখা পর্ব চলছে মাত্র।মুহুর্তেই মনটা বিষিয়ে গেলো।
সেতু ফোলা শরীরে শাড়ি পরেছে।মেয়েটাকে পুতুলের মত লাগছে! এক হাতে প্লেট আর এক হাতে শাড়ি ধরে ছুটে আসলো তাজের কাছে। তাজ বিরক্ত হয়ে বললো,”এই শরীরে শাড়ি কেন পরছো?”
“”কেন ভালো লাগছে না?” সেতুর অকপট প্রশ্ন।
তাজ তাকালো। নিজের বিধ্বস্ত মন নিজের ভিতর লুকিয়ে রেখে আলতো হেসে বললো,”লাগছে।”
তাজ খাবারের প্লেট দেখে বললো,” এখন খাবো না সেতু।আমি একটু ঘুমাবো।”
সেতু জিদ ধরলো না।চলে যেতে নিলো।তাজ পিছু ডাকলো। সেতু ফিরে তাকাতেই বললো,”মন খারাপ করো না।মাথা ধরেছে এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।ঘুম থেকে উঠে খাবো।তুমি বরং বোনের বিয়েটা ফুলফিল ইনজয় করো!তবে একটু সাবধানে! ”
সেতু আশস্ত ভঙ্গিতে হেসে চলে গেলো।
*******
মেহেদি জারুল রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে।পিঠের কাছটা ঘামে ভিজে গেছে।হন্যে পায়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে মেহেদি নিচে নামলো।ছাদে অনুষ্ঠানের কাজ হওয়াতে ভীষণ ভির।নিচে নেমে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
আশে পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রিশা আয়েশি ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে।মেহেদির কপাল কুঁচকে গেলো। কুঁচকানো কপাল নিয়েই রিশার পাশে দাঁড়ালো।রিশা তাকালো। ববকাট চুল গুলো দুলে উঠলো। রিশা বললো,”কিছু বলবে?”
“এসব কেন খাও?”
“অনাধিকারচর্চা করছো?”
“করছি।” মেহেদির অকপটে উত্তর।
“যদি বলি তোমরা পুরুষই এর জন্য দায়ী। তবে?” রিশা গাঢ় চাহনিতে বললো।
“অন্যের জন্য কেন নিজেকে পুড়াতে হবে?কেন নিজের জীবন নষ্ট করবে?”
“বাদ দাও।আমার জীবনটা এমনিতেই নষ্ট। শুধু একজনকে ওয়াদা করেছিলাম বলে এই বালের জীবনটা বয়ে বেড়াচ্ছি! ” রিশা অবহেলার সুরে বললো।
মেহেদি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।রিশা একটা সিগারেট শেষ করে অন্যটা ধরালো।কিছু সময়ে পড়ে রিশা বললো,” সেতুকে খুব ভালোবাসো,তাই না?”
মেহেদি বজ্রহত চাহনিতে চমকে তাকালো।রিশা হাসলো। মেহেদির দৃষ্টি ক্রমেই অপরাধ বোধে জড়িয়ে আসলো। রিশা বললো,”মানুষটা ভুল হতে পারে, ভালোবাসা কখনো ভুল হয় না! জানো তো?তবে কেন অপরাধ বোধে ভুগছো?”
মেহেদি কিচ্ছু বললো না।বিষন্ন চোখে তাকিয়ে রইলো কেবল।রিশা অনবরত সিগারেট টানছে। মেহেদি তাকিয়ে রইলো।মেহেদির হুট করে মনে হলো, রিশা নামের মেয়েটি নিজেকে যতটা বেপরোয়া, খারাপ ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে সে ততটা খারাপ নয়।হয়তো রিশার জীবনে কোন মন খারাপের গল্প আছে।গল্পটা কেমন?রক্তাক্ত? নাকি বিষাক্ত? জানতে ইচ্ছে হলেও অনাধিকার চর্চা হবে বলে আর জিজ্ঞেস করা হলো না!
*********
একটা আয়না দুটো মুখ।দুটো মানুষ একটি স্বপ্ন! একটি ঘর! নত মস্তকে বসে থাকা লাল শাড়ি পরিহিত কাননবালা। সম বয়সী মেয়ে ছেলেরা চিৎকার করে অভীককে বললো,”কি দেখা যাই ভাইয়া আয়নায়? ”
অভীক আয়নায় প্রতিবিম্বিত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলো। কি স্নিগ্ধ মায়াময় একটা মুখশ্রী! অভীক ঈষৎ হাসলো। অনীক তাড়া দিয়ে বললো,”ছোটো বলছিস না কেন?”
অভীক ফাঁকা ঢোক গিলে বললো,”বলবো?”
অভীকের বোকা কথায় অনীক রুমি সহ সকলে হাসলো। অভীক ভারী পুরুষালী গমগমে স্বরে বললো,”পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর নারী! আমার বউ কে!
‘আমার বউ’কি সুন্দর অধিকার সূচক শব্দ! নীতু চমকে আয়নায় চাইলো।অন্তচক্ষু ভিজে উঠলো! এই মানুষটা কি বলে?সে বুঝি সুন্দর?
অভীক তার একটি বাক্যে বুঝিয়ে দিলো তার জীবনে নীতুর অবস্থান! কতটা সম্মানের।কতটা ভালোবাসার।
এবার সবাই নীতুকে জিজ্ঞেস করতেই নীতু দ্বিধায় পড়লো।কি বলবে সে? এই পুরুষ কে কি কোন শব্দ বা বাক্যে ব্যাখ্যা করা যায়? যায় না তো।
নীতু চোখ বুঁজলো,ফের চাইলো।আয়নার ওই মুখটির দিকে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বললো,” প্রিয় মুখ!বহু অপেক্ষিত প্রিয় মুখ! ”
অভীক আলতো হাতে নীতুর হাত চেপে ধরলো।সকলে হৈ হৈ করে উঠলো। শুধু দু’জন মানুষ আয়নায় দুজনের দিকে চেয়ে রইলো!
*********
বাবার ঘাটতি যেন নিখিল ভাই হয়ে পূরণ করলো।বোনকে বিদায় দিবার সময় ভীষণ শক্ত থাকতে চেয়েও পাঞ্জাবির হাতায় অনবরত চোখ মুছতে রইলো।মহিমা বেগম কাঁদলেন তবে মেয়ের সুখের জন্য। তার কালো মেয়ের এমনতর সুখ দেখে খুশিতে কাঁদলেন। ভাই বোনের সবার কান্না দেখে নীতু হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। নীতুর কান্না দেখে অভীক নাক মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো পুরোটা সময় ।
নিয়ম মতে জায়েদ নীতুকে কোলে তুলে নিলো।কোলে করেই গাড়িতে উঠিয়ে দিবে।জায়েদের গলা পেচিয়ে ধরে নীতু ফোঁপাতে থাকে।জায়েদ দুষ্ট হেসে বললো,”শোন ভায়রা ভাইকে আমার সব সময় টাইটের উপর রাখবি।যেমন তোর বোন আমাকে রাখে। বুঝলি? ”
নীতু কাঁদো মুখেই হেসে দিলো।জায়েদও হাসলো।তবে ভেজা চোখে। কৃষ্ণবতী নীতুর বিদায়ক্ষণে সকলর চোখ ভিজে উঠলো। গাড়িটা চলে যেতেই উপরের বারান্দা থেকে তাজ সরে গেলো।বিড়বিড় করে বললো,”আমার কৃষ্ণবতী! তোমার বিদায়ে আমার চোখ ভিজলো না!তবে বুকটা কেন এত পুড়ছে? সুখী হতে পারবে তো কৃষ্ণবতী? ভাগ্য আর সুখ সবার থাকে না কৃষ্ণবতী!তুমি পাবে তো?”
***********
ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটা শাঁ শাঁ করে ছুটছে।নীতু অবশ্য এখন কাঁদছে না তবে চোখের কোণটা ভিজা। অভীক গালে হাত দিয়ে মাথা কাৎ করে নীতুর কান্না দেখছিলো। গাড়িতে ড্রাইভার আর ওরা দু’জন। অনীক রুমিরও সাথে আসার কথা ছিলো কিন্তু তারা শেষ মুহূর্তে অন্যদের সাথে পিছনের গাড়িতে উঠছে।
নীতু তাকিয়ে দেখলো অভীক গুড স্টুডেন্টের মত মনোযোগ দিয়ে তার কান্না দেখছে।নীতুর খারাপ লাগলো। তার কান্না না থামিয়ে বরং দেখছে। নীতু চোখ মুখ কুঁচকে বললো,”তাকিয়ে আছেন কেন?”
“দেখছি তোমার কান্না।” বলে হাসলো অভীক।
“আমার কান্না দেখে আপনার হাসি পাচ্ছে অভীক? তার উপর এমন করে তাকিয়ে আছেন যে কখনো কারো কান্না দেখেন নি আপনি!” নীতু রাগ নিয়ে বললো।
অভীক এবার গা দুলিয়ে হাসলো। নীতু বিস্মিত। অভীক আলতো হাতে নীতুর হাতটা চেপে ধরে বললো,”তুমি বউ বউ আচরণ করছো নীতু!আমার ভালো লাগছে।খুব!”
নীতুর হুট করে লজ্জা লাগলো। অভীক নীতুর ধরা হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিলো।একদম আলতো করে। নীতু চোখ পিটপিট করে জানালা গলে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। ওই মাদক চোখে তাকানো যাবে না।একদমই না!
অভীক আবার চুমু দিলো নীতুর হাতের উল্টো পিঠে।চুড়ি গুলো রিনরিন করে শব্দ তুললো।একটা, দুটো,তিনটে করে মোট সাতটা চুমু দিলো অভীক।নীতু চোখ বন্ধ করে রেখেছে।অভীক নীতুর হাতটা ঠোঁটের উপর থেকে এবার বুকের উপর রেখে চেপে ধরে বললো,”তুমি ভীষণ মিষ্টি কাননবউ!একদম রসগোল্লার মত!”
নীতু লাজুকতা ভুলে চমকে চাইলো। অভীক চোখ টিপে ঈষৎ হেসে বললো,”ড্রাইভার ভাই। গাড়িটা ধীরে চালান।আর আমাদের পিছনের গাড়ি গুলো আগে যেতে দিন।নতুন বউকে নিয়ে একটু জার্ণিটা উপভোগ করি।কি বলেন?
ড্রাইভার হেসে গাড়ির গতি শ্লথ করলো।অন্য গাড়ি গুলো চলে যেতেই অভীক চোখ মুদলো।তার কেমন নেশা নেশা লাগছে।অদ্ভুত ঘ্রাণে চোখে ঘুম নেমে আসছে।আচ্ছা এখন ঘুমালে কি নীতু রাগ করবে? তখন?বউয়ের রাগ ভাঙানো টেকনিক শিখে রাখা উচিত ছিল!
প্রকৃতি, সময়, ভাগ্য এই শব্দ গুলো যেন কেমন ভয়ংকর ।কখনো ভীষণ সুখের কখনো চরম নিষ্ঠুরতার! গাড়িতে বসা দুটো নর নারীর চোখে যখন হাজারো স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়ার রুপ নিচ্ছিলো।তখন প্রকৃতি অন্য কিছু চাইলো। একদমই অন্য কিছু! বড় রাস্তা ছেড়ে শর্টকাট নিতে গাড়িটা নির্জন রাস্তায় ঢুকতেই পিছন থেকে অন্য একটা মাঝারি সাইজের ট্রাক ভীষণ শব্দে ধাক্কা দিলো।জ্যামহীন পরিষ্কার রাস্তায় এ যেন সাজানো গুছানো এক্সিডেন্ট! গাড়ির ভিতরের তিনজনই কেঁপে উঠলো প্রচন্ড শব্দে।পিছনের ট্রাকটা ধাক্কা দিয়ে পিষে চলে গেলো ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর গাড়িটাকে। নীতুর চিৎকার আর অভীকের ভয়ার্ত মুখশ্রী ক্রমেই মিয়িয়ে গেলো। ড্রাইভার ছিটকে পড়লো অদূরে।নীতু নিভে আসা চোখে চেয়ে দেখলো তার স্বপ্ন, সুখের জলাঞ্জলি! নীতু। কৃষ্ণ মুখশ্রী। যার আধার কালো জীবনটা প্রচন্ড ঝলকানিতে ঝলসে গেলো!
কতক্ষণ সময় পেরোলো কে জানে? নীতু যখন চোখ মেললো মাথার ভিতর তখন অসহ্য ভোঁতা যন্ত্রণা! শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে।নীতু ফ্যাকাসে চোখে তাকাতেই দেখতে পেলো অভীক দু-হাত দূরে উবু হয়ে পড়ে আছে।নীতু ভাঙা স্বরে ডাকলো,”অভীক?অভী…ক!”
নীতুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটে রক্তের স্বাদ। বুকটা কেঁপে উঠলো নীতুর।অভীক উঠছে না কেন? নীতু নড়তে গিয়েই প্রচন্ড চিৎকার দিলো।তার পেটে কয়েক খন্ড কাঁচ ঢুকে পড়েছে। নীতু ফুপিয়ে উঠলো। সমস্ত শরীর ব্যথা।তীব্র আঘাতের চিহ্ন! নীতু চোখ বন্ধ করে কাঁচের টুকরা টেনে বের করলো।গলগলিয়ে রক্তের নহর বইলো যেন।নীতু পাগলের মত নিজের ছিন্নভিন্ন শাড়ি কোমড়ে পেঁচিয়ে অভীকের কাছে ছেঁচড়ে পৌছালো।
অভীককে ঠেলে সোজা করতেই নীতু হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।অভীকের মাথার কাছটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। শরীরে শত আঘাতের চিহ্ন। ডান পাজরের কাছটা থেঁতলে গেছে। নীতু উন্মাদের মত কাঁদছে,আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছে।কোথাও কেউ নেই! নীতু বিড়বিড় করে বলছে,”রক্ষা করো আল্লাহ! অনীক ভাইয়া আপনি কই? কোথায় সবাই?”
নিজের ব্যথা ভুলে প্রিয় মানুষটার আঘাতে কাঁদছে মেয়েটা। নীতুর সাজ সজ্জা এলোমেলো। পাগলের মত অভীকের মুখে হাত বুলিয়ে ডাকছে। অভীকের কোন সাড়া নেই। নীতু চিৎকার করে উঠলো।বললো,”আল্লাহর দোহাই লাগে অভীক উঠুন।আমার কষ্ট হচ্ছে অভীক।ইয়া আল্লাহ এতটা নির্দয় হয়ে না তুমি!”
অভীকের নিথর দেহ ধরে নীতু পাগলের মত কাঁদছে। বোকা মেয়েটা নিজের যন্ত্রণা যেন বেমালুম ভুলে গেছে।নীতুর শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।অভীকের বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছে সে।ফিসফিস করে বলছে,”কেউ কি নেই?কোথায় তোমরা?আমাদের কষ্ট হচ্ছে।”
অভীকের বুকের সাথে লেপ্টে থেকে নীতু মাথা উচিয়ে তাকালো। শুভ্র মুখটিতে কেমন অজস্র ক্ষত।নীতু ফুঁপিয়ে উঠলো। নীতুর পদ্মদিঘি চোখ জলে টইটম্বুর।পরক্ষণেই নীতু নিজের সাদা ওড়না খুলে অভীকের মাথা পেঁচিয়ে দিলো।পুরুষ্ট মুখটাতে হাত বুলিয়ে নিস্তেজ স্বরে বললো, “এমন কেন হলো অভীক?এমন কেন হলো?কেন এভাবেই সব ভেঙে চূড়ে যেতে হলো?কেন আপনাকে ভালোবাসার সময় দিলো না আল্লাহ ?আপনার ভালোবাসার ঋণ নিয়ে মরতে হচ্ছে অভীক!এই পাপ আমি কি দিয়ে ঘুচাবো অভীক? আমাদের ঘরটা সাজানো হলো না!আপনাকে ভালোবাসা হলো না! কিচ্ছু হলো না!….উঠুন অভীক।আমার কষ্ট হচ্ছে অভীক!”
অভীক নড়ে উঠলো। হালকা চোখ মেলে চাইলো।যখন বুঝতে পারলো সব শেষ হতে চলছে তখন আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো।নীতু ফুঁপিয়ে উঠে অভীকের রক্তাক্ত ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললো,”চোখ বন্ধ করবেন না অভীক।তাকান।”
অভীক তাকালো।নিভু নিভু চোখে।নীতু খুশিতে কেঁদে ফেললো।অভীকের ঠোঁটে ফের চুমু দিলো। অভীকের ঠোঁটটা প্রসারিত হলো।নিভু কন্ঠে বললো,”তোমার প্রথম চুমুর স্বাদ এত রক্তাক্ত কেন কাননবউ?”
নীতু কাঁদছে।কাঁদছে অভীকও।তবে নিরবে।চোখের কার্নিশ বেয়ে নিরবে জল পড়ছে। অভীক নড়তে পারছে না। কেবল তাকিয়ে রইলো।চোখে ভাসছে মায়ের মুখ,সাজানো গুছানো রুম খানি!
একসময় নীতু অভীকের বুকের পাশেই লেপ্টে রইলো।অভীক ভাঙা ভাঙা স্বরে বললো,”আমাকে ক্ষমা করে দিও নীতু।তোমাকে সুখী করতে পারলাম না।মরে যেতে হচ্ছে! বড় আফসোস হচ্ছে কাননবউ। তোমাকে গভীর আলিঙ্গনে ছুঁয়ে দেয়ার স্বাদ এ জন্মে আমার অপূরণীয় হয়েই রইলো!”
নীতুর চোখে ঘুম নেমে আসছে।দু’জনেই বুঝতে পারছে।আর কিছু মুহূর্ত! তারপর সব শেষ। নীতু ঘুমিয়ে যাওয়ার পূর্বে ফিসফিস করে বললো,”ভালোবাসি অভী! খু…ব! একমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি অভী!”
অভীকের চোখে প্রশান্তি।মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আর কোন দ্বিধা রইলো না।উত্তর ফিসফিস করে সেও বললো,” ভালোবাসি কাননবউ…. তোমার থেকে একটুখানি বেশি! ঠিক এক চিমটি বেশি!”
প্রকৃতির এই অবাস্তব খেলায় দুটো মানুষের ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির ইচ্ছে অন্যরকম।ভালো না বেসেও কেউ থেকে যায় আ-জনম।ভালো বেসেও কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে আ-জনম।
সন্ধ্যা তারা যখন মিটিমিটি করে জ্বলছে। প্রকৃতিতে মৃদুমন্দ সমীরণ। ঠিক তখন তীব্র ভালোবেসে যাওয়া দুটো মানুষের দেহ রক্তের নহরে ভাসছে!বিয়ের পোশাক জড়িয়ে দুটো মানুষ দু’জন তে লেপ্টে পড়ে রয়েছে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তার উপর!কি নিস্তব্ধ চারপাশ! আজ যেন ভালোবাসা টুকুও নিস্তব্ধ!ঘোর অমানিশায় আসক্ত!
চলবে,