কাননবালা,২৭,২৮

0
570

#কাননবালা,২৭,২৮
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৭

পড়ন্ত সন্ধ্যা!একটু পরেই শহরটাকে ঢেকে ফেলবে গাঢ় অন্ধকার!তার আগেই ল্যামপোস্টের লাইট গুলো জ্বলে ওঠে! কোথা থেকে দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠে। নীতু ভয়ে কুঁকড়ে যায়! ফুটপাতের উপর বসে পরে! ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে নীতু!এত বড় শহরে কোথায় খুঁজবে সেতুকে? ভেবে পায় না।
জায়েদ কল করে জানিয়েছে সেতু বাড়িতেও যোগাযোগ করেনি।মা বাবাকে এখনই কিছু বলতে নিষেধ করেছে নীতু। চব্বিশ ঘণ্টা না পেরোলে পুলিশে কমপ্লেইন করেও লাভ নেই!
তাজকে কল দিতে থাকে অনবরত!ফোন বন্ধ বলছে বারবার! নীতু যখন তীর হারা নাবিকের মত হাবুডুবু খাচ্ছে অথৈ জলে তখনই সাথি কল করে।ফোন কলের কথা শুনে নীতু আর একটা মুহুর্ত দেরি করে না।দ্রুত পায়ে সিএনজিতে উঠে পড়ে! বুকের রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করছে অবিরত!

************
ক্লান্ত শরীর আর উদ্বিগ্ন মনে নীতু বাসায় ফিরে দেখে সেতু বসে আছে সোফায় হেলান দিয়ে। পায়ের কাছে একটা ব্যাগ রাখা!চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রাণ! নীতু থমকে দাঁড়িয়ে পরে দরজায়।সেতু নীতুকে দেখে ফ্যাকাশে হাসে।নীতুর বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে! মাত্র এ কয়েকদিনেই কি থেকে কি হয়ে গেছে মেয়েটা।ফর্সা রঙ ছাই বর্ণে পরিনত হয়েছে।চোখের নিচে ইঞ্চি খানেক কালো দাগ।গাল বসে গেছে।শরীর শুকিয়ে গেছে!নীতুর মনে হলো জ্যান্ত লাশ বসে আছে তার সামনে!
সেতু শান্ত, নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে,”আপি ক’টা দিন তোমার কাছে থাকতে দিবে?বেশি দিন থাকবো না।বিশ্বাস করো…. কোথাও থাকার একটা ব্যবস্থা করেই চলে যাবো।”

নীতুর কি হলো কে জানে?ঝড়ের বেগে ছুটে এসে সেতুর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।তাতেও সেতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না।শূন্য দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে!সেতুকে দেখে মনে হচ্ছে, থাপ্পড় খাওয়া আর ডাল ভাত খাওয়া সমান কথা!
নীতু ধপ করে সোফায় বসে পরে।মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদতে শুরু করে!কতটা ভয়ের এই কান্না তা কেবল নীতুই জানে!একটা মুহূর্তে নীতুর মনে হয়েছিল, সেতুকে বুঝি হারিয়েই ফেললো।

সাথি গোল গোল চোখে তাকিয়ে সবটা দেখছে।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।কিছু বুঝতে না পারার কারণে মাথার ভিতর ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে!

নীতুর বিরতিহীন কান্নায় সেতু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আপি, কান্না করো না তো।শুনতে বিরক্ত লাগছে!মাথা ধরে যাচ্ছে! ”
নীতু আকষ্মিক ভাবে দু’হাত বাড়িয়ে সেতুকে কাছে ডাকে।ঠিক ছোট্ট বেলার মত।যখনই সেতুকে মা মারতো, নীতু এভাবেই কাছে ডেকে আদর করতো। সেতু চোখ মুখ শক্ত করেই বোনের কাছে এগিয়ে গেলো।বিড়ার ছানার মত নীতুর কোলে মাথা রাখলো।চোখ থেকে দু’ফোটা জল নিঃশব্দে গড়িয়ে পরলো।নীতু মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সেতু ফুঁপিয়ে উঠে বলে, “আপি, আমাকে একটু তোমার মত শক্ত মনের বানিয়ে দিয়ো তো!সব হারিয়ে কিভাবে হাসতে হয় শিখিয়ে দিও! আমাকে সব দিয়ে দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছো তোমরা,কোন কিছু হারিয়ে ফেলা আমি নিতে পারি না!”

সেই রাতের বেলায় সেতু ডলে ডলে গোসল করলো।নীতু ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিল।পুরো এক প্লেট ভাত খাওয়ার পর সেতু গলগল করে বমি করে ফ্লোর ভাসিয়ে দিলো।ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে অচেতনের মত ঘুমালো।শুধু নীতু ঘুমাতে পারলো না।বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে গোটা রাতটা পার করে দিলো।দু’পাশ থেকে সেতু, সাথি জরিয়ে আছে নীতুকে।নীতুর দমবন্ধ লাগলেও সরিয়ে দিলনা।নীতুর মাথায় পাজলের মত এলোমেলো চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে! ঠিক অনেকদিন পর এসে নীতুর মনে হলো,তার জন্য সুখ যেন অলিক কোন স্বপ্ন!

**************
তাজ ফিরলো রাত দেড়টার সময়। বাসায় ঢুকেই দেখলো ড্রয়িং রুমের লাইট জ্বলছে।এত রাত পর্যন্ত আলো জ্বলতে দেখে তাজের কপাল কুঁচকে গেলো।মা আর বাবাকে সোফায় চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখেও তাজ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না।রাবেয়া বেগম নিজেই বলে উঠলেন,” সেতু চলে গেছে।”
তাজ খানিকটা থমকানো দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো।ফের দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,” ভালো করেছে।গুড জব সেতু,এতদিনে বুদ্ধিমতীর মত কাজ করেছো।”

তাজ কথা বলছে এলোমেলো ভাবে। সেতু কোথায় গিয়েছে, কখন গিয়েছে এসব বিষয়ে কোন আগ্রহই নেই যেন! রাবেয়া বেগম ফের বললেন,”তোর ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।তুই তো এটাই চাইছিলি?”

তাজ কিচ্ছু বললো না।ক্লান্ত পায়ে রুমে চলে যেতে নিলে।বাবা উঠে দাঁড়ালেন।তাজের সামনে এসে প্রচন্ড শক্তিতে একটা থাপ্পড় মারলেন গালে।তাজ নড়ে উঠলো।মাথার ভিতর ভনভন করতে লাগলো।মাথা ঝাঁকি দিয়ে তাজ বিশ্রী ভনভন শব্দটা বন্ধ করার চেষ্টা করছে।ঠিক সেই সময় বাবা বলে উঠলেন,”সন্তান বড় হয়ে গেলে তাদের শাসন করা যায় না।কিন্তু আজ তোমাকে না মেরে আমার শান্তি হচ্ছিল না।তোমার মা যেমন ভুল করেছে তুমিও ঠিক সেই একই রকম ভুল করছো।তোমাদের দুজনের ভুলে দুটো নিষ্পাপ মেয়ে মাঝখান থেকে সাফার করছে।তোমার মা নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেও তুমি কখনোই বুঝতে পারবে না কারণ তোমার ভিতরের কুৎসিত আগুনটা! তুমি একটা স্বার্থপর মানুষ!নীতুকে পাবার সিদ্ধান্তে তুমি দৃঢ়তা দেখাতে পারো নি,লড়াই করতে পারো নি।তখন তোমার কাছে মা প্রাধান্য পেয়েছে।কিন্তু পরে যখন দেখলে তুমি নীতুকে ছাড়া ভালো নেই তখনই তুমি কুৎসিত একটা খেলা খেলতে শুরু করলে।সেই খেলাটার নাম হলো ‘কাউকে ভালো থাকতে না দেয়া’।তোমার মা, নীতু, সেতু, আমি গোটা পরিবারটাকেই তুমি অসুস্থ করে ফেলেছো।”

তাজ বাবার কথায় নিঃশব্দে হাসলো।এই মানুষগুলোই একমাত্র সন্তানের দোহাই দিয়ে তাকে সেতুকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে।আর আজ কেমন সুস্থ ভাষণ ছাড়ছে? তাজ বেপরোয়া কন্ঠে বলে,”আমি ভালো নেই তো কেউ ভালো থাকবে না।সহজ হিসেব! দুই যোগ দুই চার হয় কখনো ছয় হবে না!”……….বলে তাজ হনহনিয়ে চলে গেলো রুমে।
দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করলো। রাবেয়া বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলো। তাজের বাবা জোরে ধমক দিয়ে বললেন,”চুপ করো স্বার্থপর মহিলা।আমার চোখের সামনে একদম কাঁদবে না।এখন এসব ন্যাকামো কান্নার কোন মানে নেই।তুমি আর তোমার ছেলে দুজনেই চরম স্বার্থপর!”

রাবেয়া বেগম থামলেন না।অনবরত কেঁদেই চললেন। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই কান্না বড়ই করুণ হয়ে প্রতিধ্বনিত হলো!

তাজ খাটের উপর বসে আছে। মাথায় এলোমেলো চিন্তারা ঝড় তুলছে।সত্যিই কি সে স্বার্থপর?কি জানি?তাজ অবহেলিত চোখে সারা রুম পর্যবেক্ষণ করলো।বোকা মেয়েটা চলে গিয়েও নিজের ছাপ ফেলে গেছে!রুমের এক কোণে ঘরে পড়ার জুতোটা পরে আছে।বারান্দায় সবুজ রঙের ওড়না উড়ছে।ড্রেসিং টেবিলে চুল সহ চিরুনীটা পরে আছে।টেবিলের উপর চোখ পরতেই একটা ভাজ করা কাগজ দেখে তাজ উঠে গিয়ে কাগজটা মেললো।চোখের সামনে গোটা গোটা অক্ষর গুলো ভেসে উঠলো,

“আমি চলে গিয়েছি শুনে হয়তো আপনি খুশি হয়েছেন।হয়তো বলছি কেন?আপনি খুশিই হয়েছেন তাজ ।এটা বলা উচিত আমার।কতটুকু খুশি হয়েছেন?বলুন তো?খুশিতে কি মুখে হাসি ফুটেছে? আপনার হাসিমুখ দেখার বড় ইচ্ছে ছিলো,একসাথে হাসবো,কাঁদবো!কত কি!কিচ্ছু হলো না।আচ্ছা তাজ এতসবের মাঝে আমার ভুল কোথায়? আপনি কাউকে ভালোবাসলেন কিন্তু বিয়ে করলেন অন্য কাউকে।সেই অন্য কাউকে দিনের পর দিন অবহেলা করলেন।আমি তো খলনায়িকা নই!আমি তো আপনার আর আপনার কৃষ্ণবতীর মাঝে নিজ ইচ্ছায় আসিনি।ভাগ্য বা নিয়তি আমাকে নিয়ে এসেছে!তারপরও আমি অপেক্ষা করেছি।ভালোবাসা হীন একটা সম্পর্ক মেনে নিয়েছিলাম হাসি মুখে!বিশ্বাস করুন আমি অপেক্ষা করেছিলাম,ভালোবেসে না হোক দায়িত্বের কারণে অন্তত আপনি আমাকে মেনে নিবেন।আমাদের ইন্টিমেটের পরও আমি কোন কৈফিয়ত চাইনি।ভালোবেসে ফেলেছিলাম আপনাকে!ভেবেছিলাম এবার হয় অধিকার বা কর্ত্যব্যের খাতিরে আমাকে মেনে নিবেন।কিন্তু আপনি সেটা পারলেন না।আমাকে নাই করে দিয়ে একই ঘরে বসবাস করতে লাগলেন।গত কয়েকদিন আপনি একটা শব্দও আমার সাথে বলেন নি।নীতু আপি বলেছিল, একটা সম্পর্কে ভালোবাসার থেকেও ভালো থাকাটা জরুরী! আপনি না আমায় ভালোবাসলেন না আমায় ভালো থাকতে দিলেন।কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দিলেন!আপনার চোখে নিজেকে কুৎসিত মনে হতো অথচ রুপ থাকলে নাকি ভালো সংসার হয় মেয়েদের।মিথ্যে কথা সব!সুখ আসে ভাগ্যে!আপনি আমাকে ভালো রাখতে না পারলেও আপনাকে ভালো থাকার সুযোগ করে দিলাম।শুনুন একটা না বলা কথা বলছি আপনাকে,আপনার ঘরে আর মনে আমার জায়গা না হলেও আপনি কিন্তু আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন!একদম পাকাপোক্ত ভাবে!”

তাজ চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়লো।বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,”আমাকে ক্ষমা করো সেতু!ভালো থেকো তুমি!”

*************
নীতুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, কোন ঝড় বয়ে গেছে নীতুর উপর থেকে।ঘুমহীন একটা রাত আর দুশ্চিন্তারা ছাপ নীতুর সারা মুখে।জায়েদ কল করে কতক্ষণ চিল্লাপাল্লা করলো।তাজকে পুলিশে দিবে হেনতেন কথা!নীতু তাকে বহু কষ্টে শান্ত করেছে।এটাতো সমাধান নয়!কিন্তু আসল সমাধান টা যে কি নীতু নিজেই ভেবে পেল না।
ঝরঝরা একটা ঘুম দিয়ে সেতু উঠেই বললো,”আপি ক্ষুদা লেগেছে।পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। ”
নীতু নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে খাবার দিলো।সাথি আজ টুকটাক কাজ করছে।মেয়েটা হয়তো বুঝতে পেরেছে।নীতু ঠিক নেই!তিনজনই নাস্তা করলো।রুটি আর আলু ভাজি।নীতু খাওয়ার মাঝে মাঝে সেতুকে পর্যবেক্ষণ করছে।মেয়েটাকে দেখে খুব সুখী মনে হচ্ছে! এমন ভাবে আয়েশ করে খাচ্ছে! নীতু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ইদানীং ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস পরছে!এটা কি কুলক্ষণ না সুলক্ষণ কে জানে?
খাওয়ার পরে সেতু এক মিনিটও পেটে খাবার রাখতে পারলো না!গড়গড় করে বমি করে দিলো।পেটে খাবারের একদানা থাকা পর্যন্ত বমি করতেই থাকলো।নীতু বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রইলো সেতুর দিকে।হাত পা কাঁপতে লাগলো।যে ভাবনা মনে আসছে তাহলে সামনে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে।সাথি লেবুর শরবত বানিয়ে দিলো সেতুকে।শরবত খেয়ে আধমরার মত পরে রইলো সেতু বিছানায়। নীতু ভয় ভয় কন্ঠে বললো, “এত বমি করছিস কেন?”

“কি হয়েছে বুঝতে পারছি না আপি।গলার কাছে শক্ত কিছু দলা পাকিয়ে থাকে এমন একটা অনুভুতি হয় সারাক্ষণ! খাবার খেলেই বমি হচ্ছে! ”

“কতদিন হলো এরমক হচ্ছে? ”

“সাতদিন। “…. সেতুর নিস্তেজ কন্ঠ!

” পিরিয়ড মিস করেছিস?”

সেতু আৎকে উঠে তাকালো।এরপর বিড়বিড় করে বললো,”ওহ মাই গড!গত মাসে পিরিয়ড হয়নি আপি।ভেবেছি এ মাসে হবে।তাও তো মিস হয়েছে পনেরো দিন হলো!”

নীতু শুকানো ঢোক গিললো।চোখ দুটোতে অসহায়ত্ব ভর করলো!মধ্য দুপুরের উতপ্ত রোদের মত বুকটা খাঁ খাঁ করতে লাগলো।
সেতু উঠে বসে আতংকিত চাহনি ফেলে বললো, “আপি আমি কি কনসিভ করেছি?”

নীতু কিছুই বলতে পারলো না।সাথি ঝটপট সমাধান জানার জন্য একটা স্টিক নিয়ে এসে বললো,”আমার কাছে এটা বাড়তি ছিল।অনেকদিন আগের হলেও কাজ হবে আশা করি।”

সেতু ঝড়ের গতিতে ওয়াশরুমে দৌড় দিল দশমিনিট পর বের হলো শান্ত ভঙ্গিতে। নীতু ছো মেরে কাঠি হাতে নিয়ে দেখলো,রেজাল্ট পজেটিভ!
সেতু থম মেরে খাটের এক কোণে বসে পরলো।নীতু আস্তে করে বললো,”অফিসে যাচ্ছি। কোন চিন্তা করিস না”…..কিন্তু নীতুর কন্ঠই চিন্তিত মনে হচ্ছিল। সাথি বুঝতে পারলো না তার কি খুশি হওয়া উচিত নাকি দুঃখিত। অসহায় চোখে কেবল দুবোন কে পরখ করে যাচ্ছিল।

নীতুর মাথা ঘুরাচ্ছে। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ দুটো করে দেখছে।নীতু কোথায় পা ফেলবে বুঝতে পারছে না। হুট করেই নীতু পরে যেতে নিলে অভীক পিছন থেকে ধরে ফেললো।অভীক নিজেও অফিসার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে।নীতুকে শক্ত করে ধরে আছে অভীক।নীতু অভীকের হাতার শার্টটা খামছে ধরেছে।অভীক বললো,”এত অমনোযোগী হয়ে হাঁটছিলেন কেন? এখনই তো পড়ে যাচ্ছিলেন মিস নীতু?কত বড় বিপদ হতো ভেবেছেন?সাবধানে পা ফেলা উচিত!”

নীতু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অভীকের মুখ পানে।মনে মনে বলে উঠলো, “কোথায় পা ফেললে বিপদ হবে না মি.অভীক?আমাকে বলে দিন।আর কত সাবধানে চলবো!চারপাশে এত কষ্ট কেন?”
নীতুর মনের কথা শুনতে না পেলেও নীতুর নিরবতা যেন ছুঁয়ে দিল অভীককে।নীতুকে ধরে সিঁড়ির ধাপে বসালো।পাশে বসে শান্ত কন্ঠে বললো,”আপনি ঠিক আছেন মিস নীতু?কিছু কি হয়েছে?”

নীতু বড় করে দম ফেললো। ঝিম মেরে বসে রইলো মিনিট পাঁচেক। তারপর বললো,”আই’ম ফাইন,টোটালি ফাইন।স্যার আজ যদি আমি লেট করে অফিসে আসি কোন প্রবলেম হবে?”

অভীক বুঝতে পারলো নীতুর কোন সমস্যা হয়েছে।তাই বললো,”খুব আর্জেন্ট হলে অফিসে আসতে হবে না।আপনি বরং রেষ্ট নিন।আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে!”

“না আমি ছুটি নিব না।আসবো তবে একটু লেট হবে।”…. নীতু শক্ত করে বলে উঠে দাঁড়ালো।

অভীক এবার কনফার্ম নীতু কোন সমস্যায় আছে।মেয়েটা চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছে কিছুই হয়নি কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে না!

” কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারেন মিস নীতু!”

“সমস্যা আছে, থাকবে কিন্তু কারো সমস্যা কেউ সমাধান করতে পারে না।আমার সমস্যা কেবল আমারই,তা কখনো আপনার নিজের সমস্যা হতে পারবে না! “…… বলে নীতু বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি মাড়িয়ে নামতে শুরু করলো।
অভীকের ভয় হলো, নীতু আবার পরে না যায়?বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “এত দ্রুত হাঁটতে নেই মেয়ে, এতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে!””

নীতু সে কথা শুনতে পেল না।

*************

নীতু বসে আছে একটা কফিশপে।কফিশপটা বলতে গেলে পুরোটাই ফাঁকা।সকাল বেলা বলেই হয়তো।কোণার এক টেবিলে একজোড়া কাপল বসে আছে।ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে।মেয়েটার চোখে মুখে মুগ্ধতার ছটা!হয়তো ছেলেটা খুবই প্রেমময়ী আলাপ করছে।
নীতু অপেক্ষা করছে তাজের।সকালে কল করে এখানে আসতে বলেছে নীতু।তাজ এখনো আসেনি।না চাইতেও নীতু আবার সেই কোণার টেবিলের দিকে তাকালো।ছেলেটা এখন মেয়েটার কানে কানে কিছু বলছে আর তা শুনে মেয়েটা লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।অথচ মুখ হাসি হাসি!নীতু চোখ সরিয়ে নিল।কারো ব্যক্তিগত সুখ দেখতে নেই!এতে নজর লেগে যায়।
ঠিক তখনই নীতু দেখলো তাজ কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করছে।তাজের মুখ থমথমে! ঘুম থেকে উঠেই হয়তো চলে এসেছে বলে।
তাজ বসলো কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ অস্থিরতা গ্রাস করছে।ওয়েটার এসে দুটো কফি দিয়ে গেলো।নীতু হাসি মুখে বললো,”ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন বলতো?আগে কফি শেষ করি তারপর না হয় বলি কেন ডেকেছি।হা করে না থেকে শুরু করো।”

তাজ এবার আরো কনফিউজড। নীতু তাকে তুমি করে বলছে।তারমানে সমস্যা বড়সড়। সেতুর সাথে বিয়ের পর নীতু কখনো তুমি বলেনি।নীতু আজ বাদামী রঙের একটা শাড়ি পরেছে।চোখে মুখে কেমন যেন অন্যরকম দ্যুতি!ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি! যা পরিস্থিতির সাথে একদমই যায় না।তাজ আর কফি খেতে পারলো না।নীতু শান্ত ভঙ্গিতে কফি শেষ করলো।এরপর বললো,”তুমি তো কফি খেলে না।কি মিসটাই না করলে।এখানের ওরা খুব ভালো কফি বানায়।”

তাজ এবার আর অস্থিরতা চেপে রাখতে পারলো না।অধৈর্য কন্ঠে বললো,”ডেকেছো কেন?”

নীতু হাসলো।একদম অন্যরকম হাসি।তারপর বললো,”তোমার কাছে টাকা আছে তাজ?আমাদের এখন মার্কেটে যেতে হবে।তোমান জন্য ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর আমার জন্য লাল একটা শাড়ি নিতে হবে।এরপর ফুলের দোকান থেকে দুটো মালা কিনতে হবে।তারপর আসল কাজ করতে হবে।”

“কি সব হেয়ালী করছো নীতু?মানে কি?”

“মানে হলো তুমি আর আমি একটু পরই বিয়ে করছি।বুঝতে পেরেছো?তাই একটা সাদা পাঞ্জাবি আর লাল শাড়ি দরকার!”

তাজ বিষম খেলো।বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,”কি?”

নীতু উঠে দাঁড়ালো।তাজের হাত ধরে বললে,”উঠছো না কেন?চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।আজ আমাদের বিয়ে ভাবতেই অন্যরকম ফিল হচ্ছে!তোমার হচ্ছে না? ”
নীতুর চোখে মুখে খুশি ঝরে ঝরে পড়ছো।তাজ তখনও আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীতুর দিকে………

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৮

তাজ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কপাল ও ঘাড় বেয়ে চিকন ঘামের ধারা নামছে!স্নায়ুযুদ্ধ চলছে অবিরত!
নীতু হাসছে কিন্তু চোখ হাসছে না মেয়েটার, আশ্চর্য! চোখের চাহনি কেমন রুঢ়!
নীতু হেসে পুনরায় বললো,”উঠছো না কেন তাজ?চলো এখান থেকে মার্কেটে তারপর সোজা কাজি অফিস!”

তাজ নিজের হাতের দিকে তাকালো। নীতু এখনো ধরে আছে হাতটা!তাজ বড়সড় দম ফেলে বললো,”কেনো হেয়ালী করছো নীতু?”
নীতু হাতটা ছেড়ে দিলো।পুনরায় চেয়ারে বসে সরাসরি তাজের চোখে চোখ রেখে বললো,”হেয়ালী?তাও আমি?”

“হ্যা করছো!এবং হেয়ালীর পাত্র হিসেবে বেছে নিয়েছো আমাকে!”……..তাজ চোখে মুখে অসন্তোষ ফুটিয়ে বললো।

নীতুর মুখ থেকে এবার হাসি মুছে গেলো।চোখের দৃষ্টি কঠিন করে বললো,” আর তুমি করছোটা কি?তুমি হেয়ালী করছো না?নিজের জীবনটাকে তো তছনছ করছোই সাথে সেতুর জীবনটাও শেষ করে দিচ্ছো! ”

তাজ চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো নীতুর মুখ থেকে। একঝাঁক অভিমান নিয়ে কাচের দেয়াল গলে বাহিরে দৃষ্টি ফেললো।
নীতু তাকিয়ে রইলো।পুরুষের অভিমানী রুপ কি ভয়ংকর সুন্দর হয় তা আজ বুঝতে পারলো!
নীতু নরম স্বরে বললো,” আমার দিকে তাকাও তাজ।”
তাজ তাকালো না। নীতু ফের বললো,”তাকাও। মুখ ঘুরিয়ে রাখলে কথা বলবো কি করে?”
তাজ তাকালো। নীতু বললো,”এভাবে চলতে পারে না তাজ।একটা সমাধানে আসা দরকার।জোর করে তো আর কিছু হয় না।তাই সমাধান হিসেবে চলো বিয়ে করে ফেলি।তাহলে অন্তত তুমি আমি ভালো থাকবো।একজন কষ্ট পাবে!”
তাজ নীতুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কথা শুনে।বুঝতে পারলো না,এ কেমন সমাধান? হুট করেই মেঘে ঢাকা সূর্যের মত একটি মুখ মানসপটে খুব আলতো করে উঁকি দিলো।সেতু!তাজ নিজেও কিছুটা চমকালো!এটা হবার কথা নয়,তবুও হয়েছে!

নীতু মৃদু হাসলো।তাজের অস্থির দৃষ্টি দেখে!তারপর বললো,”তুমি ভালো নেই তাজ।নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো, ঠিকঠাক লাইফ লিড করছো না অথচ ভালো থাকার সমাধান হিসেবে তোমাকে বিয়ে করতে চাইলাম,কিন্তু তোমার চোখে আমি বিন্দুমাত্র খুশির ঝলকানি দেখতে পেলাম না! আশ্চর্য না?”
তাজ বিপন্ন বোধ করলো। অস্থির কন্ঠে বললো,”আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি নীতু!খুবই……বিশ্বাস করো!”

“ভালোবাসলে আমাকে এতটা বিপদে ফেলতে না তাজ।তুমি যেটা করছো তাকে ভালোবাসা বলে না!বলে জেদ দেখানো।আচ্ছা নিজ ইচ্ছায় যে এভাবে সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছো, গুছানোর চেষ্টা কি একটুও করেছো?এমন পাগলামো করলেই কি সব সমাধান হয় যাবে?আমি ফিরতে পারবো তোমার কাছে?আচ্ছা ধরো না হয় সব কিছু ফেলে দিয়ে তুমি আমি এক হলাম।তারপর কি?কেউ ভালো থাকবো?মাঝখানে সেতু নামটা কাঁটার মত বিঁধবে না?বিঁধবে!সবাইকে হারিয়ে তোমাকে পেলেও পুরোপুরি কি পাওয়া হবে?হবে না। তবে কেন করছো?”

“তবে কি করবো?মানিয়ে নিবো সবকিছু।হাতের পুতুল হতে বলছো নীতু।”….. …তাজের কন্ঠে আক্ষেপ।

” সমাজের কিছু নিয়ম থাকে যা কখনো অস্বীকার করা যায় না।না চাইতেও সেই শিকল পায়ে পড়তে হয়।মানিয়ে নিতে বলছি না তাজ,তোমাকে ভালো থাকতে বলছি।নিজে ভালো না থাকলে অন্যকে ভালো রাখা যায় না!সত্যটা হলো যত যাই হয়ে যাক আমি কখনোই তোমার কাছে ফিরবো না।কারো বৈধ অধিকারে কখনোই আমি হস্তক্ষেপ করবো না।তুমি যেটাকে মানিয়ে নেয়া বলছো তা হলো বৈধতার সম্পর্ক! নিষিদ্ধ সম্পর্কের অনুভূতি প্রখর হলেও দিনশেষে বৈধতা জিতে যায়!সৃষ্টিকর্তা বৈধতা পছন্দ করে, তাজ!”

তাজ কিছুটা চিৎকার করে বললো,”না আমার তোমাকে চাই, না আমার সেতুকে চাই।আমি কিচ্ছু চাই না!”

নীতুর মেজাজ এবার খারাপ হলো।ঝাঁঝালো স্বরে বললো,” আমার বলতে একটুও দ্বিধা হচ্ছে না যে,তুমি একজন কাপুরষ ধরনের মানুষ! না তুমি ভালো প্রেমিক হতে পেরেছো না তুমি যোগ্য স্বামী হতে পেরেছো।অন্যায় ক্ষমা করা যায় কিন্তু অপমান নয়!সেতুকে বেছে নিয়ে আমাকে তুমি অপমান করেছো তবুও আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি।কেন জানো?মা বাবাকে প্রাধান্য দিয়েছো তাই।
ভালোবাসতে সবাই জানে, দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না!এই জেদটা যদি তুমি আগে দেখাতে তবে আজ আমি তোমার বউ হতাম তাজ, এখন এসব করা অমূলক!তুমি ভালো সন্তানের রোল প্লে করে সেতুকে বিয়ে করলে।বিয়ের পরেই অনুধাবন করলে আমাকে ছাড়া তুমি সত্যিই ভালো নেই তখনই জেদ ধরলে।আমার তোমাকে নিয়ে ভয় হয় তাজ।একসময় যখন তুমি অনুধাবন করতে পারবে সেতুকে তোমার চাই তখনও তোমার এমন দেরি হয়ে না যায়!আফসোস! ”

তাজের বুকে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে নীতুর কথার বাণে! অভিযোগের স্বরে বললো,”তোমরা কেউই আমাকে বুঝলে না!”

নীতু কি করবে ভেবে পেলো না।কি করে এই ছেলেকে বুঝাবে ভালোবাসার বাহিরেও অনেক কিছু থাকে!

নীতু এবার তাজের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো।তাজের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গলার স্বর নরম করে বললো,”তাজ আমরা খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম।আমার একমাত্র বন্ধু তুমি!এরপরে সম্পর্কের মোড় ঘুরলেও আজও আমি তোমার বন্ধু! তাজ তুমি ইচ্ছে করলে জেদ দেখাতে পারো,ছেড়ে চলে আসতে পারো।কিন্তু আমি পারিনা।একটা কালো মেয়ে হয়ে জন্মানোর পর থেকেই আমি কটু কথা শুনে বড় হয়েছি।হাতেগোনা ক’জন ছাড়া কেউ সত্যি ভালোবাসা দেখায়নি আমাকে ।তার মধ্যে তুমি একজন! সেই ভালোবাসা টুকুও যখন আমি হারালাম তখন আমিই কিন্তু সবার থেকে বেশি ভেঙে পড়েছি।কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েছি আবার!সবার আগে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয় তুমি শিখিয়েছো তাজ।তবে আজ কেন ছেলেমানুষী করছো? জানো তো তাজ,জগতে কিছু মানুষ জন্মায় সর্বসুখী হতে আর কিছু মানুষ জন্মায় অন্যকে সুখী করতে!তুমি আমি না হয় দ্বিতীয় কাতারেই পরলাম।সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করো দেখবে সব ঠিক না হলেও তুমি নিজে ভালো থাকবে!”

তাজ এবার নিজেও আর একটা হাত নীতুর হাতের উপর রেখে বললো,”আর তুমি?তোমার কথা মনে হলেই যে আমার ঘুম পালিয়ে যায়,হৃদয়ে ঝড় শুরু হয়!খেতে পারিনা,হাসতে পারি না।মনে হয় সব শেষ করে ফেলি!তার বেলা?”

নীতুর চোখেও এবার পানি এসে গেলো।যতযাই হোক ভালো তো বাসে এই মানুষটাকে!সেতুর নিষ্প্রাণ মুখটা মনে পড়তেই নীতু নিজের আবেগ সামলে নেয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,”ভালোবাসার মানুষটা নিয়তির ফেরে অন্যের হলেও ভালোবাসা নামক অনুভূতিটুকু থেকে যায় দিনশেষে! সে আমার নয় তাই বলে তাকে আমি ভালোবাসি না তা তো নয়!তাকে আমি ভালোবাসি কারণ ভালোবাসাটুকু আমার! এখানে ভালোবাসা টুকুই মুখ্য!দিনশেষে ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকুক এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়?থাকুক না কিছু অনুভূতি অন্তরালে,তাজ তুমি আর সেতু ভালো থাকলেই আমার ভালো থাকা হবে! ”

তাজ কিছুই বললো না।শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নীতুর দিকে।এই মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি তাও ভেবে পেল না।হাসিমুখে বিসর্জনের ক্ষমতা সবার থাকে না,আর যার থাকে তাকে সবাই আগলে রাখতে জানে না!হিরে ভেবে কাচ ক্রয় করা মানুষ আমরা যে!

তাজ উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে থমকে দাঁড়িয়ে বললো,”সেতু কি তোমার ওখানে?”

নীতু মাথা দুলিয়ে হ্যা বললো।তাজ চলে যেতে নিলে নীতু বলে ওঠে,”একটু দাঁড়াও তাজ।”
তাজ দাঁড়িয়ে পরে।নীতু সামনে এসে দাঁড়িয়ে সহজ ভঙ্গিতে বলে,”ভালো সন্তান, ভালো প্রেমিক,ভালো বর হতে না পারো।ভালো পিতা হয়ে দেখিয়ে দিও সবাইকে।আমাকে ভুল প্রমানিত করো না। শুভ কামনা রইলো হবু পিতাকে!”

তাজের দৃষ্টি স্তম্ভিত, বিস্মিত!মুখ হা হয়ে গেছে।নীতু আর কোন কথা না বলে সেখান থেকে চলে গেলেও তাজ নড়তে পারলো না একচুলও।বজ্রহত মানুষের মত দাঁড়িয়ে রইলো!

**************
নীতু অফিসে পৌঁছালো বেলা বারোটার দিকে! উত্তপ্ত রোদের ছোঁয়ায় ক্লান্ত শরীর আর মন আচ্ছন্ন হরেক চিন্তায়! তাজ বুঝবে তো এবার সেতুকে?সেতু ভুল বুঝবে না তো কখনো তাকে?সব ঠিক না হলে অপরাধ বোধে নিজেই যে শেষ হয়ে যাবে।হেনতেন চিন্তায় যখন নীতু অস্থির তখনই খেয়াল করলো, এসেছে একঘন্টা হলো।এরমধ্যে একবারো পলাশ এলো না!একটু দেরিতে এলেই তো আসামাত্র জিজ্ঞেস করে, কেন লেট হলো? তবে আজ কি হলো?

নীতু অফিসে বসে কাজ করছে। একটু বাদেই খেয়াল করলো সবাই তাকে অন্যরকম চোখে দেখছে।কি একটা বিষয় নিয়ে ফিসফিস করছে! ব্যাপার কি? নীতু আগে কাজ মনোযোগ দিল।পরে না হয় জেনে নিবে।
অফিস শেষে সবাই যখন যে যার মত বের হচ্ছে তখন নীতু পলাশের ডেস্কের কাছে গেলো।হাসিমুখে বললো,”কি ব্যাপার পলাশ ভাই?আজকে কি কাজের খুব প্রেসার? ”

পলাশ চেয়েও রাগ লুকাতে পারছে না।তাই রাগ আর বিরক্ত মিশিয়ে মুখটা বাঙলার পাঁচ বানিয়ে বললো,”একটু ব্যস্ত ছিলাম ম্যাম।আপনার কিছু প্রয়োজন ম্যাম?”

নীতু গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো, “আপনার মাথা ঠিক আছে পলাশ ভাই? আমাকে ম্যাম ম্যাম করছেন কেন?”
এবার আর পলাশ নিজের রাগ লুকাতে পারলো না।কিছুটা কটাক্ষের সুরে বললো,”স্যারের হবু স্ত্রীকে কি বলে সম্বোধন করতে হয়?আমার জানা মতে তাকে ম্যামই বলা উচিত নাকি অন্য কিছু?”

নীতুর মেজাজ খারাপ হলো।কপাল কুঁচকে বললো,”কে হবু স্ত্রী? কোন স্যার?”

“ম্যাম আপনাকে অভিনয়ে মানাচ্ছে না।অভীক স্যারের বাগদত্তা নন আপনি?অভীক স্যার তো আর মিথ্যে বলবে না।এছাড়া এটা আজকের অফিসের হট নিউজ।”

নীতুর কাছে সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো।একেতো মন শরীর কোনটাই ভালো ছিল না।তারউপর এই কথায় মেজাজের পারদ সপ্তমে পৌঁছালো। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে অভীকের কেবিনে নক ছাড়াই প্রবেশ করলো।অভীক তখন কোট পরছিল।নীতুকে এভাবে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,”মিস নীতু এটা কোন ধরনের অভদ্রতা? নক না করে এসেছেন কেন?”

নীতু যেন মুহূর্তেই ভুলে গেলো এটা অফিস।কোন বাসা বাড়ি নয়।ক্ষুদার্ত বাঘিনীর মত হুঙ্কার ছেড়ে বললো,”আমিও জানতে চাই এটা কোন ধরনের অভদ্রতা? আমি কবে আপনার বাগদত্তা হলাম?আমি নক না করে আসলে দোষ আর আপনি তো বিনা অনুমতিতে আমার লাইফে এন্ট্রি নিচ্ছেন! এর কারণ কি?”

“কোন কারণ নেই।”…….অভীকের দায়সারা উত্তর।

নীতু কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলো।চোখের দৃষ্টিতে রুক্ষতা। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,”সোজাসুজি বলুন, কোন ডিপ্লোমেটিক এন্সার চাই না।!”

অভীক হাসলো।নীতুর রাগ দেখতে ভালো লাগছে! আজ পলাশের কিছু কর্মাকান্ডে অভীক এই কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।পলাশের কদম বাড়ানোর আগেই থামিয়ে দিয়েছে।
অভীক বেপরোয়া কন্ঠে বলে,”মিথ্যে কি বললাম?আপনি আমার বাগদত্তা। সত্য যা তাই বলেছি।”

নীতু প্রত্যুত্তরে কি বলবে ভেবে পেলো না।খানিক পরে হিসহিসিয়ে বললো,”আমি আপনার বাগদত্তা কবে হলাম,কাইন্ড লি বলবেন?”

অভীক পকেটে দু হাত পুরে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নীতুর মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো,”ঠিক যেদিন আপনার হাতে আমার নামের আংটিটা উঠেছিল সেদিনই আপনি আমার বাগদত্তা হয়ে গিয়েছিলেন মিস নীতু!”

“অযোগ্য বলে সেই আংটি আমাকে খুলে ফেলতে হয়েছিল মি.অভীক!আশাকরি তা আপনার মনে আছে?”

“অফিসিয়ালি এনগেজমেন্ট হলো অথচ আংটি রিটার্ন করা হয়েছে আনঅফিসিয়ালি।তাই কোন কিছুই ব্রেক হয়নি।এখনো আপনি আমার বাগদত্তা! “……
অভীকের বেপরোয়া,জোরালো কথায় নীতুর মনে চাচ্ছে সামনের মানুষটা খুন করতে।তাই বললো,” যা একবার শেষ হয়ে যায় তা আর নতুন করে গড়া যায় না।এখন এসব অফিসে চড়াও করে আমাকে অপমানিত করার মানে কি স্যার?”

অভীক দুর্ভেদ্য ভাবে হাসলো।তারপর বললো,”এখানে অপমানিত করার কি আছে?আপনারও বিয়ের বয়স হয়েছে আর আমারো।তাই শুভ কাজে দেরি করে লাভ কি মিস নীতু?”

নীতু এবার হালকা স্বরে বললো,”মি.অভীক,আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের ভীতটা জোড়ালো করতে আমাকে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে।আশাকরি আপনি নিজের সীমাবদ্ধতা জানেন।আমাকে বাধ্য করবেন না জবটা ছাড়তে!”

অভীক ব্যগ্র কন্ঠে বলে,”আমাকে ভুল বুঝছেন আপনি। মিস নীতু আপনার আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের পথসঙ্গী হতে চাই।আর কিছু নয়!”

“আমার কোন করুণা চাই না।আবারো বলছি আমাকে বাধ্য করবেন না জবটা ছেড়ে দিতে।আসছি।”….. নীতুর কন্ঠে কাঠিন্য!

নীতু দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হলো।অভীক সবকিছু একবার দেখে নিজেও নীতুকে ফলো করে এগোলো।

অভীকের বেপরোয়া মনোভাব, তাজের আকুলতা,সেতুর অসহায়তা সব কিছু যেন মাথার উপর চেপে বসলো নীতুর।নীতু অন্যমনষ্ক হয়ে পা ফেললো চলন্ত রাস্তায়।অভীক যখন অফিস গেটে এসে দাঁড়ালো দেখলো নীতু রোড ক্রসিং করছে।অভীক কয়েক কদম হাঁটতেই বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলো।অভীকের করুণ চিৎকারে চলন্ত রোডের ব্যস্ত যানবাহন সব যেন থমকে গেলো।অভীক ধপ করে বসে পড়লো রাস্তায়।

হুট করেই একটা ট্রলি গাড়ি নীতুকে ধাক্কা দিলো।নীতু ছিটকে কয়েক গাত দূরে গিয়ে পড়লো।টকটকে লাল রক্তের স্রোতে যেন ভেসে যেতে লাগলো সবটা!অভীক কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে বসে পড়লো।অভীক ছলছল চোখে দেখলো, গোধূলির শেষ লগ্নে কনে দেখায় আলোয় কৃষ্ণবতীর লাল রং-এ মিলে মিশে একাকার হয়ে পিঁচঢালা রাস্তাটাকে কৃষ্ণচূড়ার রাঙা আলোয় রুপ দিয়েছে যেন!

****************
রাত তিনটা!হসপিটালের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। সেখান থেকে হন্তদন্ত হযে বের হলো একটি মেয়ে!দ্রুত পায়ে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে পড়লো। কালো জিন্স,সবুজ ফতুয়া পরনে মেয়েটির।ববকাট চুলগুলো রুক্ষ। চোখদুটো টকটকে লাল।হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।মেয়েটি কাঁদছে না অথচ ঠোঁট দুটো বারবার ফুঁপে ফুঁপে উঠছে। কি আশ্চর্য! যার জন্য মেয়েটির চোখে মুখে উদ্যোগের ঢেউ সেই মেয়েটি তখন এই ধরায় নিঃশ্বাস বাঁচিয়ে রাখতে লড়ে যাচ্ছে অবিরাম! তাজের কৃষ্ণবতী, অভীকের কাননবালা ফিরবে তো?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here