#রঙিন_দূত – ০৪,০৫
লাবিবা ওয়াহিদ
০৪
মধ্যাহ্নের দ্বিতীয় লগ্ন। কাঠফাটা রোদের তেজে নিমজ্জিত পরিবেশ৷ মধ্যাহ্নে যেন সূর্যিমামা তার রাজত্ব চালায় এই ধরনীর বুকে। প্রকৃতি তৃষ্ণার্ত হয়ে হাঁসফাঁস করছে। কড়া রোদে পক্ষী’রা ছায়া খুঁজতে ব্যস্ত। ব্যস্ত শহর তখনো থামেনি। কেউ কেউ এই কড়া রোদকে প্রত্যাখান করে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটছে। হৃধির সবেই চোখ লেগে আসছিলো। তখনই বারংবার কলিংবেল বেজে উঠলো। বিরক্তিতে চোখ মেলে তাকালো হৃধি। এই ভরদুপুরে আবার কে উদয় হলো? হৃধি আবার চোখ বুঝলো। ভেবেছিলো রাবেয়া খাতুন খুলবে। পরমুহূর্তে হৃধি আবার উঠে বসলো। রাবেয়া খাতুন তো ঘুমাচ্ছে! গলায় বিরক্তির রেশ ধরে “উফ” বলে আর্তনাদ করলো হৃধি। অতঃপর ওড়না গায়ে জড়িয়ে সদর দরজার দিকে ছুটলো। লক খুলতেই কাজের মেয়ে রিনাকে নজরে এলো। সামনের দাঁত কপাটি সব বের করে রেখেছে সে। হৃধিকে দেখতে দাঁত কেলিয়ে বলে ওঠে,
–“আরে আপাজান! ভিতরে ঢুকতে দিতেন না?”
হৃধি বিরক্তির সাথে সরে চলে আসলো। এই মেয়েটার আসার সঠিক সময় নেই! রিনা শুড়শুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো। হৃধির সদর দরজার দিকে নজর যেতেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
–“আরে, রিনা! দরজা লাগাও না কেন?”
রিনা জিহ্বায় কামড় দিয়ে সেদিকে ছুটলো। দরজা লাগিয়ে রিনা হেসে হেসে বলে,
–“মিস্তেক আপা!”
–“মিস্তেক না, মিস্টেক হবে!”
বলেই এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো। রিনার সামনে থাকলে এই মেয়ে একশো টপিক উঠাবে। সাথে পথে আসার সময় কোথায় কী ঘটেছে সব গড়গড় করে বলবে। আপাতত এসব শোনার ইচ্ছে নেই হৃধির। আজ কোচিং ক্লাস নেই তার। তাই এখন ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে।
———————-
গোধূলি লগ্নে রাবেয়া খাতুন রান্নাঘর থেকে হৃধিকে ডাকছিলো। হৃধি মায়ের নিকট আসতেই রাবেয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–“ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয় তো, সন্ধ্যা হয়ে আসছে!”
হৃধি উত্তরে হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। সোজা বৈঠকঘরে এসে রিনাকে বলে,
–“মা তোমাকে কাপড় আনতে বলেছে রিনা। যাও গিয়ে নিয়ে আসো!”
রিনা সোফার ধুলো ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
–“কান আমার পচে নাই আপা। আমি শুনসি কারে খালাম্মায় কাপড় আনতে কইসে!”
গা পিত্তি জ্বলে উঠলো হৃধির। রিনা এমন ভাব ধরছে যেমন কাজ করে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলছে। হৃধি শেষে উপায় না পেয়ে নিজেই গেলো। ছাদে উঠতেই হিম হাওয়া তাকে ছুঁয়ে যেতে লাগলো। প্রশান্তিতে চোখ বুজে আসলো তার। পরমুহূর্তে রশিতে টাঙানো নিজেদের কাপড়গুলো নিয়ে নেয় হৃধি। তাদের এপার্টমেন্টের পাশেই আরেক এপার্টমেন্ট। এতোটাই কাছে যে সেই ছাদ টপকে তাদের ছাদে আসা যাবে। হৃধি কী মনে করে সেই এপার্টমেন্টের ছাদে দৃষ্টি বুলালো। ছাদের কর্ণারে মাহিনকে ব্যায়াম করতে দেখা গেলো। বর্তমানে পুশ আপ দিচ্ছে সে। মাহিনকে দেখে হৃধির চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো।
মাহিন উঠে দাঁড়াতেই হৃধির ধ্যান ভাঙ্গে। সে দ্রুত পিছে ফিরে চলে যাওয়ার জন্যে কদম বাড়াতেই চিরচেনা পুরুষালি কন্ঠে তার পা’জোড়া থমকে গেলো।
–“পালাচ্ছেন কোথায় হৃধি?”
হৃধি ঘাড় বাঁকিয়ে কোণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মাহিন ফ্লাক্স থেকে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। গলা ভিঁজতেই মুখের উপর কিছুটা পানি ঢেলে দিলো। মাহিনের এরূপ পাগলামি দেখে হৃধি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। ক্লান্তিতে মুখটা কেমন লাল বর্ণ ধারণ করেছে তার। হৃধি সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে, মাহিন তা লক্ষ্য করতেই রেলিঙয়ের কাছে আসলো৷ হাঁক ছেড়ে ডাকলো হৃধিকে।
–“হৃধি?”
নিরুত্তর হৃধি। এক চুলও নড়ে না সে। মাহিন আবার ডাকলো। পূণরায় উত্তর দেয় না হৃধি। এবার মাহিন থমথমে গলায় বলে উঠলো,
–“এখানে আসুন হৃধি। নয়তো ছাদ টপকে আসবো আমি! আমি আসলে কিন্তু আপনার রেহাই নেই!”
এবার যেন টনক নড়ে হৃধির। সে ঘুরে দাঁড়ায়। মাহিনের এই রূপ দেখে তার হৃদপিন্ড’র ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়েই চললো। হাঁটু জোড়া মৃদু কাঁপছে তার। সদ্য ভেঁজা চুল বেয়ে বিন্দু বিন্দু পানি পরছে। টিশার্টটার বক্ষঃস্থল ভিঁজে চুপচুপা! হৃধি পিছে ঘুরে যেতে নিতেই মাহিন আবারও ধমক দিয়ে উঠে,
–“আমি কী বলেছি শুনেননি আপনি?”
শুকনো ঢোক গিলে হৃধি কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। রেলিঙ এর কাছে আসতেই কোণা চোখে তাকিয়ে বলে,
–“ডাকছেন কেন?”
–“প্রেমালাপ করার জন্যে! এছাড়া আর কোনো কারণ দেখছি না!”
চোখ রাঙায় হৃধি। হৃধির মুখে পরা কয়েক গাছা চুল মাহিন হাত বাড়িয়ে কানে গুঁজে দিলো। থমকালো, ভড়কালো হৃধি। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রয় মাহিনের পানে। মাহিন নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসলো। হেসে হেসে বললো,
–“আপনার চোখ রাঙানোটা দারুণ লাগে আমার! যাকে বলে, ভিষণ আদুরে!”
হৃধি দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। প্রসঙ্গে বদলে অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
–“এখানে কী করছেন?”
–“জীম করছিলাম হৃধি!”
ভ্রু কুচকে তাকায় হৃধি। মাহিন স্মিত হেসে রেলিঙ এ কনুই ভর দিয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। অধরে হাসি ঝুলিয়ে-ই বললো,
–“মুভিতে দেখেন না, নায়ক নায়িকাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়! আমারও এমন সখ জেগেছে। যাকে বলে ভয়ানক সখ! তাইতো দিনে দু’বেলা করে জীম করছি। অনার্সে একবার জীমে গিয়েছিলাম, কিন্তু ভিষণ হেয়ালি করতাম। এখন বুঝি এই হেয়ালি করা কতো বড় ভুল ছিলো। তখন যদি জীম করতাম তাহলে এই জীমের জন্যে দেয়া দু’ঘন্টা আপনাকে দিতে পারতাম!”
হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইলো হৃধি৷ কান দু’টো কেমন গরম হয়ে আছে তার। লজ্জায় গাল জোড়াও ভারি ভারি অনুভূত হচ্ছে। সেই নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকাতে সক্ষম হলো না হৃধি। দৃষ্টি নুইয়ে পরে পদতলের নিকট। লাল রাঙা হৃধিকে দেখে বক্ষঃস্থলে প্রশান্তির ঢেঊ খেলে গেলো মাহিনের। চোখে-মুখে মুগ্ধতা নিয়ে পলকহীন দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো হৃধির নিকট। এই লাজুকলতাকে গোধূলির ধূসর আলোতে কী অপরূপ লাগছে।
মাহিন আপনমনেই গেয়ে উঠলো,
–“গোধূলি আকাশ লাজুক, লাজুক
সন্ধ্যা এখনো জেগে!”
দুটো আবেগী লাইন শ্রবণ হয় হৃধির। তড়িৎ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহিনের পানে। ছেলেটার গানের গলা আসলেই মনোমুগ্ধকর! সচরাচর গানের সুর ধরে না মাহিন। মাহিনের দৃষ্টি তখনো হৃধির দিকে নিবদ্ধ। হৃধি এবার মাহিনকে কঠিন কথা শুনানোর প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু গলার স্বর কঠিন হতে নারাজ।
–“কতদিন আমার পিছু নিয়ে বেড়াবেন?”
–“যতোদিন আপনি পালিয়ে বেড়াবেন!” সোজা জবাব মাহিন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে হৃধি।
–“আমি আপনার জন্য নিষিদ্ধ মাহিন। কেন এই ছোট কথাটা বুঝতে চাইছেন না?”
–“আমারও যে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি জোক বেশি, হৃধি। এর কোনো সমাপ্তি নেই!”
–“যদি আপনার হৃদয় অন্যদিকে আপনায় ঘুরিয়ে নেয়? তখন?”
চোয়াল শক্ত হয়ে আসে মাহিনের। চোখে মুখে রক্তিম ভাব স্পষ্ট। মাহিনের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। মাহিন তড়িৎ ছাদ টপকে আসলো। নিজের ভালোবাসার প্রতি এই সন্দেহ জিনিসটা তাকে কঠিন ভাবে রাগিয়ে তুলে। মাহিনকে ছাদ টপকে আসতে দেখে হৃধির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। মাহিনকে এগোতে দেখে শুকনো ঢোক গিলে হৃধি পিছে যেতে থাকে। মাহিন হৃধির হাঁতে পেঁচানো জামাটা টেনে ধরে হৃধিকে থমকে দেয়। মাহিন হাঁসফাঁস করতে করতে খুবই শীতল গলায় বলে উঠলো,
–“আমার অনুভূতির যথেষ্ট দাম আছে হৃধি। আপনার স্পর্ধা নেই আমার এই অনুভূতিকে অপমান করার!”
মাহিনের এই শীতল কন্ঠস্বর হৃধির সর্বাঙ্গ শিথিল করতে সক্ষম। হৃধি ভীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রয় মাহিনের দিকে। হৃধির মুখশ্রীতে একপলক নজর বুলিয়ে মাহিন সরে আসে। এবং দ্রুত ছাদ টপকে চলে গেলো। সবকিছু এতোই দ্রুত ঘটলো যে হৃধি এখন হতবিহ্বল! সব কেমন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। গগণের পশ্চিমাকাশে ধূসর মেঘের আনাগোনা! নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই মাগরিবের ধ্বনি শ্রবণ হয় হৃধির। সাথে আরও একটি পুরুষালি কন্ঠ!
–“বাসায় যান, হৃধি!”
————————–
মধ্যরাত! শব্দহীন, ঘুমন্ত নগরী। নিশাচর পাখিদের কলরব আর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শ্রবণ হচ্ছে। সড়ক দিয়ে বেশ সময় পর পর ভোঁ করে প্রাইভেট কার যাচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাসে নেত্রপল্লব বুজে ফেলে হৃধি৷ হৃদয় তার বড্ড অস্থির, অশান্ত। অস্থিরতায় আজ তন্দ্রা ধরা দিচ্ছে না। বারংবার বক্ষঃস্থল হতে বেরিয়ে আসছে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস! এই সমস্যা তার আজকের নয়৷ এর আগেও এরকম অস্থিরতা বেড়েছিলো তার৷ অস্থিরতা মাহিনকে কেন্দ্র করেই। কিছুতেই ভালো থাকতে পারছে না হৃধি। তার দুশ্চিন্তা মাহিনকে ঘিরে৷ এক অদৃশ্য অনুভূতি তাকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। এই অদৃশ্য অনুভূতিকে হৃধি বুঝতে পারে না, একদমই পারে না। তার হৃদয়ে এখন উথাল-পাতাল অবস্থা।
মেসেজের শব্দে হৃধির ধ্যান ভাঙ্গে। হৃধি তড়িৎ চোখ মেলে তাকায়। ফোন হাতে নিতেই দেখলো মাহিন। এই না বিকালে তার কতো রাগ! এখন আবার মেসেজ দিচ্ছে কেন? হৃধি নিশ্চুপে মেসেজে স্পর্শ করলো।
–“আমার মাঝে আপনার প্রতি রাগটা আসে না হৃধি। আজ আমি রাগের উপরও চরম রেগে! বেহায়া হাত দু’টোর উপরেও!”
আবার মেসেজ আসলো,
–“আপনি কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি হৃধি? কেন পারি না আমার রাগ বহিঃপ্রকাশ করতে? কেন আপনাকে রাগ দেখানোর পূর্বেই সে লেজ গুটিয়ে পালায়? বড়োই বিরক্তিকর পরিস্থিতি!”
তপ্তশ্বাস ফেলে হৃধি৷ মিনমিন করে বলে,
–“আমি আপনার জন্যে নিষিদ্ধ না হলেও আপনি আমার জন্যে নিষিদ্ধ মাহিন! এটা-ই বাস্তব এবং চরম সত্য!”
—————————
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ০৫
লাবিবা ওয়াহিদ
————————-
তাঁরা আপুর থেকে হৃধি শুনেছিলো মাহিন খুব ভালো গান গায়। মাহিনের কোন আত্নীয় আছে, যে কি না রেডিও অফিসে চাকরিরত। তার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে মাহিন গান গেয়ে আসে। এছাড়াও ভার্সিটিতে শুনেছিলো মাহিন অলয়েজ প্রোগ্রামে গান গায়। আজ মাহিন রেডিও তে গান গাইবে। তাঁরা হৃধিকে খুব করে রিকুয়েষ্ট করলো মাহিনের গান যেন শুনে। হৃধি বুঝে না তাঁরা আপু তাকে কেন জোর করছে। হৃধি তাঁরাকে মানাও করতে পারছে না। অবশেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁরার কথা মানলো। তাঁরাও খুশিমনে রেডিও’র ফেসবুক পেজটা দিয়ে দিলো। সেখানেই নাকি প্রোগ্রামটি সরাসরি টেলিকাস্ট হবে। সেদিনের মতো হৃধি বাসায় চলে আসে। কিছুক্ষণ পর আবার কোচিং যেতে হবে৷ হৃধির এটা ভাবতেই অবাক লাগছে, মাহিন তাকে কখনোই বললো না, সে গান করে? অবশ্য বলবে কীভাবে, হৃধি নিজেই তো সেই সুযোগ দেয়নি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হৃধি ওয়াশরুমে চলে গেলো। গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে ডাইনিং এ চলে গেলো। করিম উল্লাহ লাঞ্চ-টাইমে আসেন না। রাবেয়া খাতুন রিমোট হাতে টিভি দেখায় মত্ত। হৃধি এদিক সেদিক তাকিয়ে রাবেয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
–“রিনা আসেনি?”
–“আসলে কী এখানে বসে থাকতে হতো? ওর জন্য-ই অপেক্ষা করছি!”
–“এই মেয়েটাকে ধমক দিতে পারো না? কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করে। তার উপর আসেও লেট করে!”
–“চুপচাপ খাওয়া শেষ করে কোচিং যা। আমার সংসার, আমি বুঝে নিবো!”
ভেংচি কাটলো হৃধি। অতঃপর দীঘল কেশে তাওয়াল বুলাতে বুলাতে খাবারের টেবিলে বসলো। খাওয়া শেষ হতেই আবার রুমে চলে গেলো। ঘড়ির কাঁটা একটা বেজে আটাশ মিনিট! যাক আজ সময় আছে। হৃধি চুল শুকাতে বেলকনি এসে দাঁড়ালো। হিম হাওয়া তাকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হৃধি সেভাবেই দাঁড়িয়ে চোখ বুজে রইলো। অধরে তার এক চিলতে হাসি এঁটে আছে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই হঠাৎ তার ফোনে মেসেজ এলো। মেসেজের টোন শ্রবণ হতেই হৃধি রুমে চলে এলো। টেবিল হতে মুঠোফোনটা নিয়ে আবারও বেলকনিতে দাঁড়ালো! ফোনের পাওয়ার অন করে মেসেজে ঢুকতেই চমকে উঠলো,
–“নির্ঘাত আশেপাশে আমি ব্যতীত অন্য কোনো ছেলে নেই। নয়তো আজ আমার থেকে কঠিন বকা খেতেন!”
হৃধি তড়িৎ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাস্তাতে। এদিক সেদিক তাকিয়ে বার্তার মালিককে খুঁজতে ব্যস্ত হৃধি। তার খোঁজ করার মাঝে আবারও মেসেজ আসলো।
–“এভাবে খুঁজতে হবে না, বোকারাণী৷ আমি আছি তো, আপনার হৃদয়ের কাছাকাছি!”
কান গরম হয়ে গেলো হৃধির। কাঁপা হাতে মেসেজ টাইপ করলো, আবারও কেটে দেয়। বাঁকা চোখের একটা ইমুজি দিলো সে। পরমুহূর্তে মাহিনের তরফ থেকে আসলো লাভ ইমুজি! হৃধি আর বেলকনিতেই দাঁড়ালো না। হৃধি মিনমিন করে বললো,
–“এই ছেলের জন্যে কোথাও শান্তি নেই!”
——————–
আজ বাসে করেই কোচিং গেলো হৃধি। ইদানীং বাসেই চলাচল করছে সে। রিকশা এখন ওদিকটায় খুব একটা যেতে চায় না। আর যেতে চাইলেও দ্বিগুণ ভাড়া চায়। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই বাসে যাতায়াত করতে হয়। হৃধি বাসে বসতেই তার ফোনে কল এলো! হৃধি ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলো। মাহিন ফোন করেছে। মাহিন সচরাচর কল করে না, শুধু মেসেজ করে। তাই হয়তো কলটি অপ্রত্যাশিত ছিলো। হৃধি নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। কল আপনা-আপনি কেটে যায়। আবারও বেজে ওঠে। হৃধি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করলো,
–“কোথায় আপনি হৃধি?”
হৃধি কড়া কথা শোনানোর পূর্বেই এক মধ্যবয়সী পুরুষ এসে তার পাশে বসলো। হৃধি তার দিকে কোণা দৃষ্টি দিয়ে মিনমিন করে বলে,
–“বাসে আছি মাহিন! কোচিং যাচ্ছি!”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। হৃধি কল কেটে বাহিরে মনোযোগ দিলো। বাস তখন চলতে শুরু করেছে। হৃধি প্রায়-ই খেয়াল করছে পাশে বসা লোকটির বিকৃত দৃষ্টি। হৃধি বারংবার তার মাথার ঘোমটা ঠিক করছে। এক গাছা কৃষ্ণকেশ-এ তার দু’গাল ঢেকে আছে। হঠাৎ খুব জোরে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। হৃধি সামনের সিটের সাথে হালকা বারি খেলো। এই ধাক্কায় পাশে বসা লোকটার হাত হৃধির হাঁটুর উপরে চলে আসে। হৃধি তড়িৎ দৃষ্টি ঘুরালো লোকটার দিকে। লোকটার মুখে বিশ্রী হাসি! হৃধি চোখ গরম করে বললো,
–“এই হাফ হিঁজড়া! ঘরে বউ থেকেও নষ্টামি করতে লজ্জা করে না!”
লোকটার আঁখিপল্লবে রাগের আভাস মিললেও অধরে সেই বিশ্রী হাসি। হৃধি রাগে রীতিমতো কাঁপছে। দ্রুত হাতটা সরিয়ে দিলো সে। লোকটা আবার টাচ করতে নিলেই কেউ তড়িৎ গতিতে সেই হাত ধরে ফেললো। লোকটা চোখে-মুখে রাগ এনে পিছে ফিরে চেঁচিয়ে উঠলো,
–“ওই কে রে?”
–“তোর শ্বশুড়, শা’লা!”
মাহিনের এই রূপ দেখে হৃধির পিলে চমকে উঠলো। কী ভয়ংকর লাগছে তাকে! বাস তখন চলছে। মাহিন লোকটার হাত মুচড়ে দিয়ে সিট থেকে উঠিয়ে দূরে ধাক্কা মারে। লোকটা বাসের ঝাকুনি আর মাহিনের ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পরে। বাসের মানুষ তখন বোঝার চেষ্টা করছে বর্তমান ঘটনা। যেন নিরব দর্শক তারা। মাহিন চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–“আমি এ জীবনেও আমার সম্পদকে স্পর্শ করার সাহস পাইনি আর তুই..! তোর হাতটা ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দিলে ভালো লাগবে?”
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলে উঠে,
–“তোর এতো সাহস কচি ছেলে হয়ে আমার গায়ে হাত ওঠাস? তুই জানিস আমি কে?”
মাহিন নাক বরাবর ঘুষি মারলো। লোকটা এবার আরেকজনের উপর গিয়ে পরলো। মাহিনের এমন মারপিট দেখে বাসের এক বাচ্চা মেয়ে হেসে তালি দিয়ে উঠলো। সে যেন ভিষণ মজা পাচ্ছে এই মারামারি দেখতে! মাহিন নিজের পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,
–“কে তুই? আমাদেরও বল! কী করবি তুই আমায়? আমার এক ঘুষিতেই তো আরেকজনের উপর পরেছিস! বল, বল! কে তুই?”
লোকটাকে আরেক পুরুষ ঠেলে ফেলে দিলো নিজের উপর থেকে। লোকটা তখন নাকে হাত বুলাতে ব্যস্ত। কী রকম লাল হয়ে গেছে নাকটা। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মাহিন আবারও বলে উঠলো,
–“লজ্জা করে না? নিজের মেয়ের বয়সী এক মেয়ের দিকে কু’দৃষ্টি দিতে? তাকে বাজে স্পর্শ করতে? তোর থেকে তো রাস্তার কুকুর’রাও ভালো। তোরে তো ইচ্ছা করছে ঘুষি দিয়ে দিয়ে মুখ থেতলে দেই!”
বাসের লোকজন এতক্ষণে বুঝলো আসল ঘটনা কী। কয়েকজন লোক উঠেও আসলো। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে, বিষয়টি উপলব্ধি করতেই হৃধি দ্রুত মাহিনের বাহু চেপে ধরলো। মাহিন তড়িৎ দৃষ্টি ঘুরালো হৃধির দিকে। হৃধির দৃষ্টিতে আকুতি স্পষ্ট।
–“প্লিজ, মাহিন। কোনো সিনক্রিয়েট করবেন না। প্লিজ!”
–“এমন অনুরোধ করবেন না যেটা আমার দ্বারা করা সম্ভব না!”
হৃধি শুনলো না। একপ্রকার জোর করে মাহিনকে পাশের সিটে বসিয়ে দিলো। মাহিন হৃধির দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজেকে সংগত করার প্রচেষ্টা চালালো। এতক্ষণে বাসের কিছু লোকজন ওই বাজে লোককে কয়েক ঘা দিয়ে বাস থেকে বের করে দেয়। এক লোক চেঁচিয়ে উঠলো,
–“শা’লা জা’নো’য়া’র! তোদের জন্যে আমরা আমাদের মা-বোনদের প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি। তোদের জন্য-ই আমাদের দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে! নর্দমার কীট!”
মাহিন সবই শান্ত ভাবে দেখলো। হৃধি বাঁধা না দিলে হয়তো আজ মেরেই ফেলতো ওউ নর্দমার কীটকে। হৃধিও যেন এই আঁচটা করেছিলো, তাইতো তাকে আগেই দমিয়ে রেখেছে। মাহিনের নিস্তব্ধতা হৃধি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। হয়তো হৃধির উপর রেগে আছে। হৃধি কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতেই মাহিন থমথমে গলায় বলে উঠলো,
–“কাধে মাথা রাখবেন হৃধি? রাগ নিয়ন্ত্রণে আসছে না!”
হৃধি বুঝলো না মাহিন আদেশ করলো নাকি অনুরোধ। পরমুহূর্তে কিছুটা সময় নিয়ে বেশ জড়তার সঙ্গে ধীরে ধীরে মাহিনের কাধে মাথা রাখলো। মাহিন সঙ্গে সঙ্গে আবেশে চোখ বুজে ফেললো। অভ্যন্তর হতে দীর্ঘশ্বাস আসছে, প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস। হৃধির কেশ হতে নাম না শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নাকে এসে বিঁধছে।
হৃধি এতক্ষণে খেয়াল করলো মাহিনের পরিহিত পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি পরতে খুব একটা দেখে না হৃধি। বিশেষ কোনো আয়োজন ছাড়া মাহিন পাঞ্জাবি পরে না। তবে হৃধি স্বীকার না করলেও মাহিনকে পাঞ্জাবিতে মারাত্মক সুন্দর লাগে। হৃধি জানে না, মারাত্মক কী শুধু তার দৃষ্টিতেই? নাকি অন্যান্য মেয়েদেরও মাহিনকে ভালো লাগে? এসব উদ্ভট ভাবনা দ্রুত এড়িয়ে গেলো হৃধি। কিসব ভাবছে সে? মাহিনকে নিয়ে সে কেন এসব ভাবছে? কে হয় তার এই মাহিন? তার ভাবনায় ছেদ ঘটালো মাহিন।
–“জানেন আজ অনেকদিন পর গ্যারেজ থেকে আমার প্রাণপ্রিয় বাইকটা নামিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনায় নিয়ে ঘুরবো আমি এই ব্যস্ত শহরের অলিগলি। নিজের ইচ্ছে মিটিয়ে তারপর আপনায় কোচিং দিয়ে আসার প্ল্যান ছিলো। কিন্তু দেখেন, আমার প্রত্যাশার একবিন্দুও আপনি হতে দিলেন না। উল্টো আমায় রাগিয়ে তুললেন আর ওই বদ’মা’ই’শ আপনাকে ছুঁয়েছে। বিশ্বাস করুন হৃধি, আমি অন্তরে শান্তি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আপনি পুণরায় আমার শান্তি ফিরিয়ে দিলেন!”
হৃধি নিশ্চুপ হয়ে শুনলো। কোনো উত্তর দেয় না। অন্তরে তারও যে এক খুঁচখুঁচানির দেখা মিলেছে। হৃধি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
–“আজ হঠাৎ পাঞ্জাবি পরলেন যে?”
–“কেন সুন্দর হয়নি পাঞ্জাবি? কালারটা কী আটঁসে লাগছে?”
–“আমি সেটা বলিনি। আসলে..”
হৃধি জড়তায় পুরো বাক্য শেষ করতে পারলো না। কথার মাঝেই গলার স্বরে মরিচিকা বেঁধে গেলো। মাহিন যেন বুঝলো হৃধির বাকি অর্ধেকের “মানে”। মাহিন স্মিত হেসে শীতল কন্ঠে বলে,
–“আপনাকে কোচিং-এ দিয়ে মামা বাড়িতে যাবো। সেখান থেকে রেডিও অফিসে যাবো আমার ভাইয়ের সাথে। তাই আজ ঘটা করে পাঞ্জাবি পরেছি। এখন আপনি বলুন, কেমন লাগে আমায় পাঞ্জাবিতে!”
হৃধি চমকে মাথা উঠিয়ে বসলো। গালে অস্পষ্ট লাল আভা ফুটে উঠেছে হৃধির। হৃধি দৃষ্টি ঘুরিয়ে আটকে গলায় বললো,
–“আপনি যেমন তেমনই লাগবে!”
–“এর মানে আপনি স্বীকার করছেন, আমি সুদর্শন?”
–“মোটেও না!”
–“আপনার দৃষ্টি যে আমায় তাই বললো হৃধি। আমি আপনার ওই চোখ দু’টোর ভাষা বুঝতে পারি, তা কী আপনি জানেন?”
———————
~চলবে, ইনশাল্লাহ।