রঙিন_দূত,০২,০৩

0
420

#রঙিন_দূত,০২,০৩
লাবিবা ওয়াহিদ
০২

এরূপ প্রশ্ন শ্রবণ হতেই চোখ-মুখ ঘুচে এলো হৃধির, বিষ্ময়ে। এই সামান্য প্রশ্নের জন্য বুঝি এভাবে পথ আটকে দাঁড়াবে? তবে হৃধি ঘাবড়ালো না, নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। ধীর কন্ঠে আওড়ালো,
–“নাম জেনে কী করবেন আপনি? আমাদের কথা তো সকালেই মিটমাট হয়ে গেছিলো!”
সামান্য হাসে মাহিন। অতঃপর নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলে,
–“মিটমাট হয়নি কারণ তুমি হতে দাওনি!”
–“মানে?”
–“মিটমাটের পথ যে দীর্ঘ, সেই পথে আমি তুমি চলবো অবিশ্রান্ত!”

একপ্রকার মাথার উপর দিয়ে গেলো মাহিনের কথাগুলো। অভ্যন্তরে মাহিনকে গালমন্দও করে হৃধি। কী অসভ্য এই ছেলে, এক সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা মেয়েকে কি না “তুমি” সম্বোধন করছে? এ বিষয়টা বড়-ই মস্তিষ্কে দাগ কাটার মতোন। অন্যদের জন্যে না হলেও হৃধির জন্যে এটা বিশাল অপরাধ। হৃধি মুখ ঘুচে নম্র স্বরে বললো,
–“পথে-ঘাটে একটা মেয়েকে আটকিয়েছেন, আবার এমন তুমি, তুমি করছেন যেন আমি আপনার শত দিনের পরিচিত। ভদ্রতা শিখেননি?”

হৃধি ভেবেছিলো যুবক সরে দাঁড়াবে, তার করা এই অপমানে। কিন্তু না, যুবক রাগ নয় বরং উল্টো ফিক করে হেসে দিলো। হৃধির কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে গেলো। আশ্চর্য, সে কৌতুক বলেছে নাকি?
–“আই লাইক ইওর এটিটিউড! এনিওয়ে, বলা লাগবে না নাম! হৃ~ধি, রাইট?”

থমকে গেলো হৃধি। চোয়াল বেয়ে বিশাল ‘হা’ এর অস্তিত্ব মিললো। এই ছেলে কোথা থেকে জানলো তার নাম? হৃধি কম্পিত গলায় আওড়ালো,
–“আমার নাম জানলেন কী করে?”
–“সেটা তো সিক্রেট, হৃধি রাণী! আমার ইন্ট্রোডাকশন দেই? আমি মাহিন, মাহিন ইরফান। তোমার ভার্সিটির-ই ছাত্র, বাট সিনিয়র!”

আশ্চর্য, চরম আশ্চর্য! এই ছেলে তো দেখছি হৃধি আগা গোড়া সব ডিটেইল’স নিয়ে রেখেছে। ভয়ানক ছেলে তো। প্রথম বাক্যটিতে হৃধির থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যায়, ক্রোধে। কী অসভ্য এই ছেলে, রাস্তাঘাটে তাকে উল্টোপাল্টা নাম দিয়ে ডাকছে। হৃধি চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“অসভ্য লোক।”
–“লোক নই, আমি যুবক! যৌবন চলছে আমার!”

হৃধির ইচ্ছা হলো না এই আধ পাগল ছেলের সঙ্গে কথা বলার। প্রথমদিন হিসেবে হৃধির জন্যে ভালোই এক্সপারিয়েন্স হয়েছিলো। প্রায়-ই জ্বালাতন করতো, একসময় ফোন নাম্বারও পেয়ে গেছিলো। দিন যতো গড়াচ্ছিলো এই ছেলেকে হৃধির ততোই খাতারনাক লাগতে শুরু করেছিলো। তাই খুব একটা কথা বলতো না, বেশ এড়িয়ে চলতো। এর মাঝে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিলো। হৃধির বেশ সমস্যা ছিলো এই “তুমি” সম্বোধন নিয়ে। প্রায় সময় কথাও শুনাতো। ঠিক তখন থেকেই মাহিন মূলত তাকে “আপনি” ডাকা শুরু করেছে। যখনই বন্ধুদের সামনে থাকতো আর হৃধি মাহিনদের অতিক্রম করতো ঠিক তখনই মাহিন উচ্চস্বরে তাকে প্রশ্ন করে উঠতো। যেমন,
–“কোথায় যাচ্ছেন?”
-“গতকাল বের হননি কেন?”
–“কোচিং কী আজকে যাবেন?” এরকম ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন।
তখন মাহিনের বন্ধুরা টিপ্পনী কেটে বলতো,
–“আমাদের বন্ধু এতোই প্রেমে দেওয়ানা যে নব্বই দশকের মেয়েদের মতোন আমাদের ভাবীকে “আপনি” আপনি করে ডাকেন!”

এরকম কথাবার্তায় ভীষণ লজ্জা পেত হৃধি। মাহিন ততক্ষণে তার বন্ধুদের দু’এক ঘা লাগিয়ে দেয়। পরমুহূর্তে ওরাই আবার সরি সরি বলে ক্ষমা চায় হৃধির নিকট। ক্ষমা তো এমনি এমনি চায় না, মাহিন বাধ্য করে তাদের। এসবে হৃধি বক্ষ ফুলিয়ে আনন্দের দীর্ঘশ্বাস ফেললেও পরমুহূর্তে ভাবে,
–“এসব আর কতদিন চলবে?”

একসময় মাহিনের প্রতি অতীষ্ঠ হয়ে হৃধি যখন সিদ্ধান্ত নেয় তার বাবার নিকট সকল ঘটনা খুলে বলবে এবং মাহিনের ব্যবস্থা করবে তখনই উপরের ফ্ল্যাটের তাঁরা আপুর থেকে জানতে পারে কঠিন সত্য। এই মাহিন মাহমুদ আলীর বড় ছেলে। “আলী কমপ্লেক্স প্লাজা”-র মালিকের ছেলে। সেই হিসেবে মাহমুদ আলী বেশ সম্মানিত মানুষ তাদের এই সেক্টরের। মাহিন তার ছেলে এ-কথা জানতেই হৃধির হৃদপিন্ডের পানি শুকিয়ে যায়। এই বড়লোক বাবার ছেলেকে নিয়ে তার বাবাকে বিচার দিবে? অসম্ভব ব্যাপার! দিলেও বা কী? তারা মধ্যবিত্ত! মধ্যবিত্ত’রা কখনো বিত্তশালীর সাথে পারে না। এটা-ই হয়ে এসেছে বহু প্রজম্ম। তাই এটাই যে বাস্তব সত্যি। সেদিনের পর অবহেলায় ফেলা মাহিনকে প্রায়শই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে হৃধি।

কেমন সাদাসিধে তার আচরণ। সবসময় হাসি যেন মুখে লেগেই থাকে। খুব চঞ্চল স্বভাবের মাহিন। চেহারার গড়ণ, গায়ের রঙ সহ সবদিক দিয়েই সে সুদর্শন। আহামরি ফর্সা না হলেও তাকে দেখে মানুষ বলবে সে ফর্সাও না আবার উজ্জ্বল শ্যামও না। অদ্ভুত এক অজানা রঙের ভাঁজে আটকে আছে তার গায়ের রঙ। ক্লিন সেভ, বেশিরভাগ সময় তাকে টিশার্ট পরতেই দেখা যায়। চুলগুলো জেল ছাড়া কোনরকমে আঁচড়ানো যা অনিলে অবাধ্যের মতো উড়ে বেড়ায়। এরকম এক মাস্টার্সে অধ্যায়নরত, বড়লোক বাবার ছেলে হৃধির মতো সাধারণ মেয়ের প্রেমে দেওয়ানা, বিষয়টা ঠিক হজম হয় না হৃধির। মাহিন যতোই পাগলামি করুক, তার মনগহ্বরে কী চলছে, সেটা যে তার বুঝার উপায় নেই। তাই হৃধি মাহিনকে যথেষ্ট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।

বড়লোক ঘরের ছেলে সে। এই বড়লোক ছেলেদের খারাপ কিছু অভ্যাসের ধারণা আছে হৃধির। তার চেয়েও বড় কথা হৃধি তার বাবার বাধ্য মেয়ে। সে কখনোই বাবার অনুমতি ব্যতীত কোনো ছেলেকে ভালোবাসা তো দূর, বন্ধুও করতে পারবে না।

এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ-ই কোচিং এর এক ছেলে হৃধিকে প্রপোজ করে বসে। ছেলেটা হৃধির সমবয়সী তবে অন্য ভার্সিটির। হৃধি সেদিন ভিষণ হতভম্ব হয়েছিলো। ছেলেটাকে রিজেক্ট করার আগমুহূর্তে-ই ছেলেটার গালে সজোরে এক চড় পরেছিলো। এতো-ই জোরে ছিলো চড়টা যে ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পরে। পাশে ফিরতেই হৃধির চমকালো, ভড়কে উঠলো। মাহিনকে এই অসময়ে মোটেই প্রত্যাশা করেনি হৃধি। মাহিনের চোখ-মুখ দেখে হৃধির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো! মাহিনের এই সূক্ষ্ম চাহনি দ্বারাই যেন ছেলেটাকে খুন করে দিচ্ছে সে। আতঙ্কে কয়েকবার শুকনো ঢোঁক গিলে ফেললো হৃধি। অতঃপর আমতা আমতা করে বললো,
–“আ..আপনি এখানে?”

মাহিনের তরফ হতে কোনো উত্তর আসে না। ছেলেটার দিকে তেড়ে গিয়ে নিজ ইচ্ছামতো ছেলেটাকে চড় মারতে শুরু করে দিলো। একেকটা চড় দিচ্ছে আর মাহিন বলছে,
–“এখুনই ৫০০ বার করে লিখবি,
হৃধি আমার ভাবী হয়!
হৃধি আমার আন্টি হয়!
হৃধি আমার আম্মা হয়!
হৃধি আমার ভাগনি হয়!”

এমন উক্তি শুনে চোখ-মুখ অস্বাভাবিক হয়ে যায় হৃধির। কী বলছে কী এই আধ-পাগল? ৫০০ করে চারটা বাক্য লিখলে দুই হাজার বার! ছেলেটা তো আজ আধমরা হয়ে যাবে! ছেলেটা একেকটা চড়ের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বলে,
–‘আমি আজ খাতা আনিনি বড়ো ভাই!”

সাথে সাথে আরেক চড় পরে ডান গালে। মাহিন গাল চেপে রাগাম্বিত হয়ে বলে,
–“কোনো বাহানা আমি শুনবো না! সাব্বির, রাফিদ! ওরে দিয়া লেখা! যেই পর্যন্ত দুই হাজার বার না লিখবে ওরে ছাড়বি না!”

মাহিনের বাকি দুই বন্ধু মুখ টিপে হেসে সম্মতি জানায়! এসব শ্রবণ হতেই হৃধির চোখ কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
–“পাগল হয়ে গেছেন নাকি? এতো বাড়া..”

বাকিটুকু বলার পূর্বেই মাহিন হৃধির মুখ চেপে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। টানার স্টাইলটা অবশ্য ভিন্ন। মাহিন পেছন হতে হৃধির মুখ চেপে ধরে সামনে হাঁটছে আর হৃধি “উমম, উমম” করতে করতে পেছনের দিকে কদম চালিয়ে উল্টো হয়ে হাঁটছে। হৃধিকে লাফাতে দেখে মাহিন বিরক্তির সাথে বলে,
–“বিরক্ত করবা না একদম! ছেলেটা যখন প্রপোজ করতে আসছিলো এক চড় মেরে দিতে পারোনি? কেমন মেয়ে মানুষ তুমি? আমার দশটা থাপ্পড়েও এতো আনন্দ নেই যতটা তোমার একটা থাপ্পড়ে আছে! ইডিয়েট!”

আবার আপনি থেকে তুমিতে আসছে! গা পিত্তি জ্বলে উঠলো হৃধির। আবহাওয়াও এতো দ্রুত বদলায় না, যতোটা না মাহিনের অঙ্গি-ভঙ্গি বদলায়। হৃধি বিরক্ত করছে নাকি মাহিন? মুখ থেকে মাহিনের হাত সরিয়ে সেদিন প্রথমবারের মতোন হুমকি দিয়েছিলো হৃধি,
–“সে চড়টার যোগ্য ওই ছেলেটি নয় আপনি! সর্বপ্রথম চোর দিয়ে-ই আপনাকে ঠান্ডা করার উচিত ছিলো আমার! এতো বেশি বাড়াবাড়িও মানায় না মাহিন!”

হৃধির কথাগুলো যেন কৌতুকের ন্যায় ছুঁয়ে যাচ্ছিলো মাহিনকে। মাহিন অধর বাঁকিয়ে নিজের গাল এগিয়ে বলে,
–“শুভ কাজে দেরী কিসের? দিন দেখি চড়! চড় খেলে আমিও বুঝতে পারবো আপনার ওই মসৃণ তুলতুলে হাতের ভালোবাসা!”

হৃধি চড় মারবে কী সেদিনের মতো সে সেখানেই থমকে গিয়েছিলো। মাহিন তার গাল আরও এগিয়ে দিলে হৃধির বিরক্তির সাথে আওড়ালো,
–“ধ্যাত্তেরি কি!”

বলেই মাহিনকে পাশ কাটিয়ে এক রিকশা উঠে দ্রুত বাসায় চলে আসে। মাহিন সেখানে দাঁড়িয়েই হাসছিলো।

———————-
~চলবে, ইনশাল্লাহ।

#রঙিন_দূত [০৩]
~ লাবিবা ওয়াহিদ

ধরণীতে সূর্যের দেখা মিলেছে ঘন্টাখানেক পূর্বেই। ঘড়ির কাঁটা এখন আট’টায় এসে ঠেকেছে। সাথে রয়েছে ঘড়ির ঠকঠক শব্দ। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, উম্মুক্ত জানালা দিয়ে হিম বাতাস ক্ষণিক পরপর এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। রাস্তার অপরদিকের কারেন্টের তারে কয়েকটি শালিক এসে বসেছে। কিছুক্ষণ পরপর-ই কিচিরমিচির শব্দে ডেকে উঠছে। হৃধির তন্দ্রা কাটে দরজায় কড়াঘাতের বিকট শব্দে। ললাটে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। গত রাতে পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পরেছিলো সে। টেবিলে ঠেকানো মাথা উঠাতেই ঘাড়ে অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হলো। সাথে দু-বাহু এবং কোমড়েও একই ব্যথা অনুভূতি হয়। হৃধির সাথে এমনই হয়। সে জড়োসড়ো হয়ে একভাবে ঘুমাতে পারে না। এরকম বেঠিক হয়ে ঘুমালে ঘাড়, কোমড় অবশ হয়ে থাকে নয়তো অসহনীয় ব্যথা সহ্য করতে হয়। কম করে হলেও আধ বেলা এই ব্যথা তাকে জোঁকের মতো পেচিয়ে থাকবে। এজন্য সচরাচর বেঠিক হয়ে ঘুমোয় না। কিন্তু গতকাল কখন যে চোখ লেগে গেলো বুঝতেই পারেনি!

আবারও কড়াঘাতের শব্দ শ্রবণ হলো, সাথে রাবেয়া খাতুনের হাঁকও!
–“হৃধি, উঠেছিস? আটটা তো বেজে গেলো!”

হৃধি হাত দু’টো টান টান করে চোখ কচলে নেয়। অতঃপর ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে দরজা খুলে দেয়। সম্মুখে রাবেয়া খাতুনকে দেখে ওষ্ঠজোড়ায় হাসির রেখা টেনে বলে, “গুড মর্নিং!”

–“দ্রুত ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নে। কারেন্ট গেছে অনেকক্ষণ। না জানি কলের পানি কখন ফুরিয়ে যায়। আমি নাস্তা বানাতে গেলাম!”

হৃধি ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে দরজা ভিজিয়ে রাখে। রাবেয়া খাতুন হৃধির উত্তরের অপেক্ষা না করে পূর্বেই প্রস্থান করে। হৃধি হাই তুলে বিছানার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখলো গতকালের মতোই ফোনটা পরে আছে। একে একে গত রাতের সকল ঘটনা মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো। হৃধি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। অতঃপর ফোন রেখে ওয়াশরুম চলে যায় গোসল নিতে। একে তো ইলেক্ট্রিসিটি নেই, তার উপর এই প্রভাতও কেমন উত্তাপময় লাগছে।

গোসল সেরে একদম রেডি হয়েই বের হয় হৃধি। হৃধি আজ গোলাপী এবং সাদার কম্বিনেশনের কামিজ সেট পরেছে। চুল ভেঁজা থাকায় পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছে। মাথায় বরাবরের মতোই ওড়নায় আবৃত। করিম উল্লাহ অবশ্য উশৃঙ্খল পছন্দ করেন না। তাই শত গরমের মধ্যেও এই ওড়না মাথায় দিয়ে চলাফেরা করতে হয়। করিম উল্লাহ গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। চলাফেরার ক্ষেত্রেও করিম উল্লাহ’র যথেষ্ট আদেশ নিষেধ আছে। একপ্রকার কড়া শাসনের মাঝেই বড় হয়েছে হৃধি। বাবা মানুষটাকে যেমন ভালোও বাসে তেমন ভয়ও করে। ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন করিম উল্লাহ। মেয়ের উপস্থিতি টের পেতেই মাথা উঁচু করে মেয়ের দিকে তাকায়। অধরে হাসির রেখা টেনে করিম উল্লাহ বলে ওঠে,
–“শুভ সকাল আমার মামুনি!”
“মামুনি” ডাকটা শুনলেই হৃধির হৃদয়ে শান্তির ঢেউ খেলে যায়। প্রশান্তিতে অধরে দেখা দেয় মিষ্টি হাসি। সেও নরম স্বরে বলে,
–“গুড মর্নিং বাবা!”

চেয়ার টেনে বসে হৃধি। রাবেয়া খাতুন ব্রেকফাস্ট সাঁজাতে ব্যস্ত। কাজের মেয়েটা আসে বেলা বারোটায়। তাই সকালের সময়টাতে একাই সবকিছু সামাল দিতে হয়। আগের মতোন খুব একটা কাজ করতে পারেন না রাবেয়া খাতুন, কোমড়ের ব্যথাটা যেন দিনদিন বাড়ছেই। মেয়েটাও সারাদিন পড়াশোনার খাতিরে বাহিরে কাটায়, সাহায্য করবেই বা কখন? তাইতো করিম উল্লাহ উপায়ন্তর না পেয়ে কাজের মেয়ে ঠিক করলেন।

খাবার খাওয়ার সময়কালীন রাবেয়া খাতুন বেশ করে লক্ষ্য করলেন তার মেয়ে বারংবার ঘাড়ে হাত বুলাচ্ছে। হয়তো কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। মুহূর্তে-ই মেয়েকে ধমকে উঠলেন তিনি!

–“আবার পড়ার টেবিলে ঘুমিয়েছিস? তোকে কতবার বলবো নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখ, তা না করে নিষিদ্ধ কাজ-ই অবিরাম করে বেড়াস!”

হৃধির বিরক্তিতে ললাটে ভাঁজ পরলো। মায়ের ঘ্যানঘ্যান যেন থামতেই চায় না। এজন্যই কোনদিন নিজের অসুস্থতা বলতে চায় না হৃধি। বকা শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত। আচ্ছা মায়েদের মুখটা ক্লান্ত হয় না? প্রতিদিন নিয়ম করে এতো বকা কী করে দেয়? হৃধি মুখে কিছুই বলে না, চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। রাবেয়া খাতুন তখনো হৃধিকে বকতে ব্যস্ত। একসময় করিম উল্লাহ বিরক্তি প্রকাশ করলেন। অস্ফুট স্বরে রাবেয়া খাতুনকে থামালেন। রাবেয়া থামলেও তার বিড়বিড়ানি থামেনি। হৃধি সেদিকে ধ্যান না দিয়ে কাধে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

বাহিরে বের হলেও হৃধির আরেক চিন্তা। যদি কোনোভাবে মাহিনের সঙ্গে দেখা হয়? ছেলেটা কখন কীভাবে তার সামনে এসে দাঁড়াবে তার নির্দিষ্ট সময়-জ্ঞান নেই। এটাও কী বুঝে না এই ছেলে, এলাকা জুড়ে করিম উল্লাহ’র পরিচিত’রা রয়েছে। তারা হৃধিকে মাহিনের সাথে দেখে ফেললে যে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। মুখে ওড়না দিয়ে চারপাশ চেক করতে করতে হাঁটতে লাগলো হৃধি। কোনো এক সময় খালি রিকশা খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতো হৃধি, আর এখন রিকশাকে ভুলে মাহিনকে খুঁজা যেন নিয়মিত রুটিনে যোগ হয়েছে৷ এই রুটিনটি মাহিনকে দেখার জন্যে নয়, মাহিনকে এড়িয়ে চলার জন্য। যেদিন মাহিনকে দেখবে না সেদিন সে মনগগণে ডানা ঝাপটে উড়বে আর যেদিন মাহিনের মুখোমুখি হবে সেদিন মুখটা পেঁচার মতো বানিয়ে রাখবে। তবে আজ যেন হৃধির ডানা ঝাপটে উড়ার দিন।

অতিব আনন্দে হৃধি এক রিকশা নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে গেলো। অদূরে টঙে দাঁড়িয়ে হৃধির বাচ্চামো দেখছিলো মাহিন। হাতে তার ঠান্ডা পানির বোতল, গায়ে টিশার্ট এবং টাউজার। জিম থেকেই সবে ফিরেছে। সারা সত্ত্বা ঘেমে চুপচুপে তার। বেশ হাঁপাচ্ছেও সে। টঙের সামনে আসতেই পিপাসাটা বেড়ে গেছিলো। তাই টঙের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে পানির একটা বোতল কিনে মুখ খুলবে তখন-ই অদূরের চঞ্চল হৃধিকে নজরে পরে। আজ আর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়নি, সামনে গেলেই মেয়েটা কেমন চুপ মেরে থাকে। সোজা কথা এতদিন পর চঞ্চল হৃধিকে দেখে তার দিকে এক ধাপ এগোনোরও ইচ্ছা জাগেনি। হৃধি দৃষ্টির বাহিরে যেতেই মুচকি হেসে পানির টেপটা খুলে ঢকঢক করে পুরোটা পানি শেষ করলো। শান্তি লাগছে, ভীষণ শান্তি। গলার তৃষ্ণাও মিটলো, সাথে দৃষ্টিরও!

————————

–“কীরে এতো দেরী করলি কেন আসতে?”
ত্বোহার পাশে হৃধি বসতেই প্রশ্ন করে উঠলো।
–“জ্যাম ছিলো। সময়মতো আসতে পেরেছি এ-ই অনেক!”

ত্বোহা আর হৃধির দিকে ধ্যান দেয় না, বইয়ের মধ্যে নিজের সকল মনোযোগ ঢেলে দেয়। প্রথম ক্লাসেই টেস্ট, গতকাল রাত এক পাতাও পড়েনি ত্বোহা। তাইতো সকাল সকাল এসেই পড়া শুরু করে দিয়েছে সে।

পরীক্ষা দুজনেরই ভালো হয়েছে। ত্বোহা না পারলে হৃধির থেকে হেল্প নিয়েছিলো। পরপর বাকি ক্লাসও দু’জনে সেরে নেয়। এখন চলছে ব্রেক টাইম। ত্বোহা হৃধিকে ভার্সিটির পেছন দিকে যেতে বলে বললো,

–“তুই যা, আমি আসছি। পরীক্ষার কারণে নাস্তাও করে আসিনি! পেটটা কেমন গুটগুট করছে খুদায়। আমি ক্যান্টিন থেকে কিছু নিয়ে আসি!”

প্রচন্ড গরম পরেছে আজ। ক্যান্টিন পর্যন্ত গিয়ে আবার ভার্সিটির পেছনে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই হৃধি ঘর্মাক্ত ললাটে ওড়নার বিচরণ চালিয়ে বলে, “আচ্ছা, যা!”

কয়েক কদম এগোতেই ত্বোহা দাঁড়িয়ে গেলো। অতঃপর পিছে ফিরে হৃধির উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোর জন্য কিছু আনবো?”
–“একটা ঠান্ডা ফ্রুটিকা আনিস!”

ত্বোহা চলে যেতেই হৃধি ভার্সিটির পেছনে চলে গেলো। বিস্তৃত নরম সবুজ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলো। আজ হিমেল হাওয়ার স্পর্শ পাচ্ছে না হৃধি। সূর্য তার তীক্ষ্ণ কিরণে একাধারে উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সময়টা অগ্রহায়ণ, সূর্যের এতো তীক্ষ্ণতা মানায় না। পিঠ ঘামে ভিঁজে একাকার। হৃধি তার উম্মুক্ত চুলে হাত রাখলো৷ চুল শুকিয়েছে অনেক আগেই। হৃধি এবার আশেপাশে চোখ বুলালো। নাহ, কেউ নেই। হৃধি মাথার ওড়না সরিয়ে উম্মুক্ত কেশকে খোপায় বদ্ধ করে রাখলো। অতঃপর আবারও মাথায় ওড়না টানলো। এবার কিছুটা হলেও শান্তি লাগছে৷ ঘামে পিঠে জামা লেপ্টে আছে, যা খুবই বিরক্তিকর এবং অস্বস্তিকর। হৃধির হঠাৎ সামনে নজর যেতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। মা..মা..মাহিন! সে অদূরে গাছের সাথে হেলান দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে। অধরে তার বাঁকা হাসি।

বিষ্ময়ে চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেলো হৃধির। এর মানে পুরোটা সময় মাহিন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো? আগে কেন খেয়াল করেনি সে? মাহিন বিস্তৃত হেসে এদিকেই পা বাড়ালো। ধীরে ধীরে মুখমন্ডল মলিন করে ফেললো হৃধি। মাহিনকে সে একদম প্রত্যাশা করেনি। মাহিন হৃধির গা ঘেষে বসতেই হৃধি সরে বসলো। দৃষ্টি অন্যদিকে। মাহিন হাসলো। এই হাসিতে কোনো বাহিক্য শব্দ নেই। শব্দহীন হাসি ঠিকই টের পেলো পাশে বসা নারীটি। মুখে থমথমে ভাব এনে হৃধি বললো,
–“ক্লাস নেই?”
–“আছে।”
–“তাহলে এখানে কী করছেন?”
–“আপনায় দেখছি!”

তড়িৎ দৃষ্টি ঘুরালো হৃধি। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন ছুড়লো,
–“ক্লাসের চেয়েও বেশি জরুরি আমায় দেখা? আগে কোনদিন দেখেননি?”
–“আপনাকে দেখা আমার একান্ত ব্যক্তিগত জরুরি!”
–“এতো দেখে কাজ কী? আমি আহামরি কেউ না।”
–“অবশ্যই আহামরি! আমার লাক দেখেছেন? সময়মতো না আসলে অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য মিস করে যেতাম!”
গলা গুলিয়ে আসলো হৃধির। নেত্রপল্লব ছোট ছোট করে মাহিনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
–“মানে?”
–“এক অপরূপা তার দীঘলকৃষ্ণ কেশকে খোপা করছিলো। জানেন এই দৃশ্যটি কতটা মারাত্মক সুন্দর? আজকাল টিকিট কেটেও এতো সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় না!”

————————
~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here