#রঙিন_দূত – ২৪,২৫
লাবিবা ওয়াহিদ
২৪
————————–
মাহিনদের এলাকার এই পার্কটি খুব বেশি বড়ো না হলেও মোটামুটি ভাবে বড়ো। কিছু জায়গায় কয়েক গাছা গাছ-পালা মাটিতে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেও বেশি আহামরি বড়ো গাছে নেই। গাছের এক দুই পাশে বসার জন্য বেঞ্চি রাখা হয়েছে। পার্কটি মূলত মর্নিং ওয়াক এবং হাঁটাহাঁটির জন্যে-ই ব্যবহৃত হয়। বিকালে এখানে বয়স্ক, জোয়ান বেশি দেখা যায়। কাপলরাও অবশ্য বিচরণ করে। চায়ের ফেরিওয়ালার এক দু’জনকে কখনো কখনো এদিক ওদিক বিচরণ করতে দেখা যায় আবার কখনো কাস্টমারকে চা বানিয়ে দিতেও দেখা যায়। এখন সায়াহ্নের পূর্ব সময়। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে-ই মাগরিবের ধ্বনিতে চারিপাশ মুখোরিত হবে। মানুষজনের সংখ্যা কমে এসেছে। গোধূলি অম্বরে দেখা যাচ্ছে সারাদিনে কিচিরমিচির করা পাখিগণ নিজ নীড়ে হন্য হয়ে ফিরছে। সাথে তাদের কিচিরমিচিরে জানান দিয়ে বলছে যেন,
–“এইযে, আমার গান আজকের মতো সমাপ্ত। আগামীকাল সূর্যদ্বয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তোমাদের জ্বালাতে চলে আসবো! সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে ভুলো না কিন্তু!”
হৃধি একমনে নিশ্চুপ হয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। পার্কের কর্ণারের বেঞ্চিতে নিজের ঠাই হয়েছে তার। করিম উল্লাহ’র ওরকম ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে সে বেরিয়ে এসেছিলো। বলা বাহুল্য, হৃধি সেই সময় থেকে এখনো একই ভাবে বসে আছে। বাসায় ফিরতে সে নারাজ। বড্ড দাগ কেটেছে বাবার বলা কথাগুলো। এই কথাগুলো হৃধির বক্ষঃস্থলে কতটা ক্ষত-বিক্ষত করেছে সেটা হৃধি যদি পারতো দেখাতে। যেই বাবার ভরসা রাখতে কখনো একটা ছেলে বন্ধুও করেনি, মাহিনের মতো ব্যাকুল প্রেমিকের প্রেম নিবেদনে সাড়া দেয়নি সেখানে তার বাবা তাকে ইঙ্গিতে চরিত্রহীন প্রমাণ করলো তাও বাহিরের মানুষের কথায়। হৃধির চাল-চলন, কাজ-কর্ম সবকিছুর সাথেই তো করিম উল্লাহ পরিচিত। তাহলে তার মেয়েকে সে এতটা চিনতে ভুল করলো? বাবার দেয়া চড়ে এখনো গালটা জ্বলছে। কপালের ক্ষত তো আছে-ই। তবে এই বাহিক্য ক্ষতগুলো তাকে খুব একটা পোড়াচ্ছে না, যতটা পোড়াচ্ছে তার বাবার বলা তীর ছুঁড়ার ন্যায় কথাগুলো।
মাহিন একমনে হৃধির কান্না দেখে চলেছে। হৃধির সামনেই সে রুমাল, ব্যান্ডেজ সবকিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন থেকে নয়! বরং হৃধি যখন এসেছে তখন থেকেই। মাহিন হৃধিকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু হৃধি মাহিনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে। একটা কথাও সে বলেনি। মাহিন ব্যান্ডেজ আর রুমাল নিয়ে বারবার মোবাইল চেক করছে। শাফীনের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক বার্তা পাচ্ছে না। মাহিন ফোন পুণরায় পকেটে পুড়লো। হৃধির পাশে গিয়ে বসলো। এতক্ষণে মানুষজন অনেকটা কমে এসেছে। মাহিনের বসাটা লক্ষ্য করতেই হৃধি কান্নারত অবস্থায় সরে বসলো। এতে মাহিন কোনোরূপ অভিযোগ করলো না বরং হৃধিকে বোঝাতে বেশ দৃঢ় গলায় বললো,
–“কার জন্য কাঁদছেন আপনি হৃধি? আপনার বাবা সব রাগের মাথায় বলেছেন। এতে তার কোনো দোষ নেই। দোষ তো ওই নিম্ন-খা’রা’ম লোকটার, যে আপনার বাবার ব্রেইনওয়াশ করেছে! আপনি আপনার বাবাকে বোঝাতে পারতেন? রাখেন সেসব কথা। কান্না থামান হৃধি, প্লিজ। কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছেন! আমি যে সহ্য করতে পারছি না এই মুক্তো দানাগুলোকে। এরা বড্ড দগ্ধ করছে আমায়!”
হৃধি পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ। হৃধির নিস্তব্ধতা এবার মাহিনের সহ্য সীমানা অতিক্রম করতে চাইছে যেন! এতো কাঁদলে হয় নাকি? তবে না কেঁদেও তো উপায় নেই। মাহিন নিজেও শুনেছে হৃধির বাবার বলা প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি বচন। প্রতিটি শব্দে কতটা তিক্ততা মিশে সেটা মাহিনও উপলব্ধি করেছে। সেখানে হৃধির তো সঠিক থাকার কথা নয়। তবে মাহিনও যে এসব সহ্য করতে পারছে না। হৃধিকে সম্মুখে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে। সেখানে মেয়েটা কেঁদে-কেটে পুরোই লাল হয়ে গেছে। চোখ-নাক সম্ভব রকম ফুলে আছে। মাহিনের মস্তিষ্ক চাড়া দিয়ে উঠলে পরমুহূর্তে সে নিজেকে সংগত করছে সপ্তপর্ণে। একসময় হৃধি নাক টানতে টানতে বলে ওঠে,
–“কেন এলেন আপনি আমার জীবনে মাহিন? আপনি না আসা অবধি তো আমি কোনো ছেলের সাথে-ই কথা বলতাম না, বাবাও কখনো এসব বলতো না! কেন আপনি সবটা এলোমেলো করলেন? আমি যদি বলি আমার এলোমেলো জীবনের মূল কারণ আপনি?”
মাহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হৃধির পানে তাকিয়ে রইলো। তার চাহনি ছিলো ভিষণ গভীর। সেই দৃষ্টি হৃধির খেয়ালে এলো না। হৃধি তখন তার ওড়নার এক অংশ দিয়ে নোনাজলে আবৃত গাল মুছছে। এই দৃশ্যটুকুই মাহিনের দৃষ্টিতে অমায়িক লাগলো। মন তাকে যেন হৃধির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো। মাহিন গালে হাত দিয়ে হৃধির দিকে পলকহীন তাকিয়ে বলতে লাগলো,
–“আমি যদি আপনার জীবন এলোমেলো করি তাহলে আপনি হলেন আমার জীবনের সাজানো গোছানো অংশ। আপনি আমার সাদা-কালো জীবনে রঙিন দূত হয়ে এসেছেন। আমি কী করে আমার রঙিন দূতকে হারিয়ে পুণরায় নির্জীব হয়ে যাই? আপনি যেমন আমার প্রিয়জন তেমনই আমার বাঁচতে আপনাকে প্রয়োজন! আপনার জীবন আজ এলোমেলো হয়েছে তাতে কী? গুছিয়ে দেয়ার জন্য আমি মাহিন কী করতে আছি বলুন তো?”
হৃধির কান্না হুট করে থেমে যায়। তড়িৎ দৃষ্টি ঘোরালো মাহিনের দিকে। বাঁকা হেসে তার দিকেই মাহিন তাকিয়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে তাকাতেই পুণরায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়গড় করে জল পরছে। হৃধি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। হৃধি কান্নারত অবস্থাতেই ধরে আসা গলায় বললো,
–“আমায় প্লিজ একা থাকতে দিন! এখান থেকে যান!”
মাহিন গেলো না। উল্টো হৃধির পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
–“ঠিকাছে, আপনার কান্না পর্ব শেষ হলে আমাকে জানাবেন। আমি আবার আপনার ওই মুক্তোদানা দেখে বেসামাল হয়ে পরছি। হৃদয়টাও অশান্ত হয়ে যায়!”
হৃধি বুঝলো না মাহিনের কথার মানে। বুঝতেও চাইলো না। কান্না থামিয়ে সে নির্জীব প্রাণীর ন্যায় সেভাবেই বসে রয় এবং অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
————————
–“ভাবী কী হয়েছে? চেঁচামেঁচির শব্দ আসছে কেন?”
–“হৃধি আপারে নাকি মজিদ কাকায় কোন পোলার সাথে পরশু দেখসে সেটা নিয়াই রাগারাগি!”
রিনা মুখ ফসকে ফাতিমা বেগমকে বলে দিলো সবটা। রাবেয়া খাতুনের ছলছল চোখে হঠাৎ-ই তীব্র ক্রোধ ভেসে উঠলো। কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিনার পানে। রাবেয়া খাতুনের চোখ রাঙানিতে রিনা চুপসে গেলো। করিম উল্লাহ একই ভঙ্গিতে তখনো দাঁড়িয়ে। সে নিশ্চুপ হয়ে ফাতিমা বেগমকে লক্ষ্য করলেন।
ফাতিমা বেগম কী যেন ভাবলেন। বলা বাহুল্য, কিছু মনে করার চেষ্টা করলেন। তৎক্ষনাৎ কিছু একটা মনে পরতেই ফাতিমা বেগম উচ্ছ্বাসের সাথে আওড়ালেন,
–“আরে হ্যাঁ, মনে পরেছে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় হৃধির সাথে দেখা হয়। তারপর আমি এবং হৃধি একসাথেই আসছিলাম তখনই আমার ছোট ছেলেকে দেখতে পাই। আমার কিছু মুদি সদাইয়ের প্রয়োজন ছিলো বিধায় আমার ছোট ছেলেকে সেগুলো বলছিলাম। হৃধি আমার পাশেই ছিলো। আচ্ছা সে-সময়ে এমন হয়নি তো মজিদ ভাই আমাকে উনি খেয়াল করেননি এবং ভেবেছিলেন হৃধি শাফীনের সাথে কথা বলছে? আমার ছেলে শাফীনকে চিনেছেন তো? ইন্টারে পড়ছে!”
করিম উল্লাহকে থমকে যেতে দেখা গেলো। রাবেয়া খাতুন সবটা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললো। কান্না থামিয়ে নাক টানতে টানতে করিম উল্লাহ’র উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“আচ্ছা এমন নয়তো মজিদ ভাই ভুল তথ্য দিয়েছে আপনাকে? আপনি কেন মেয়ের কাছে সবটা না জেনে এরকম ব্যবহার করলেন? আপনার কী সমস্যা বলুন তো? মেয়েটা আপনার চোখের সামনে বড়ো হয়েছে! কী করে আপনি ঘরের মেয়েকে রেখে বাহিরের লোকের কথা শুনতে গেলেন? সেই লোকের কথায় আপনি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন, চরিত্র নিয়েও…”
পুরো বাক্য শেষ না হতেই রাবেয়া খাতুন মুখে আঁচল গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। স্বামীর এই রূপ যে তার বড্ড অচেনা। কী করে সইবে একমাত্র মেয়ের প্রতি এমন অবিচার। ফাতিমা তড়িৎ রাবেয়া খাতুনের কাছে গিয়ে তাকে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালালেন। করিম উল্লাহ’র মাথাটা যেন চক্কর দিয়ে ওঠে। সে দ্রুত সোফার উপরিভাগ ধরে নিজেকে সামলে দেয়। বুকের বা পাশটা তীব্র জ্বালাতন করছে৷ এ সে রাগের বশে কী করে ফেললো?
—————–
মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে প্রায় অনেকক্ষণ। ধীরে ধীরে আঁধার গ্রাস করছে আলোকে। চারপাশে কৃত্রিম আলোয় পার্ক ঝলমলে। মাহিন গুণগুণিয়ে গান গাইছে আর মশার কামড় খাচ্ছে। হাতে এক চড় মেরে বিরক্তির সুরে বললো,
–“শা** বি/য়া/দ/ব মশার দল! আমাকে কী তোদের শ্বশুরবারির রক্ত পাইছিস? এক শ্বশুরের মেয়েরে সামলাত পারি না আর এরা আরও আগুনে ঘি ঢালতে আসছে।”
হৃধি চোখ পাকিয়ে আলতো ঘাড় বাঁকালো। মহারাজা এমন ভাব ধরছে যেন মশা তাকেই কামড়াচ্ছে, হৃধি তো লোহা! তাকে তো কামড়ানোর প্রশ্নই আসে না! হৃধি প্রচন্ড বিরক্ত প্রকাশ করলো মাহিনের এসব কথাবার্তায়। এমনেই মনের অবস্থা ভালো নেই আর এই ছেলের বাঁ/দ/রা/মী কমার বদলে যেন আরও তিড়তিড় করে বাড়েই। হৃধি সেভাবেই মুখ ঘুচে বসে আছে। এর মাঝে মাহিনের ফোনে কল আসে। মাহিন ফোন পকেট থেকে বের করে দেখলো রাফিদের কল৷ মাহিন বিনা-বাক্যে কল রিসিভ করলো৷ প্রথমেই শ্রবণ হয় রাফিদের উত্তেজিত কন্ঠস্বর,
–“জলদি ভাগ! তোর শ্বশুর পার্কের ভেতরে ঢুকছে। তোরে ভাবীর সাথে দেখলে নিশ্চিত হয়ে থাক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবেই!”
–“রাখ ফোন!”
ধমকের সাথে কথাটা বলে মাহিন কল কেটে দেয়। মাহিনের হঠাৎ ধমকানিতে হৃধি কিছুটা চমকে যায় এবং পিছে ফিরে তাকায়। মাহিন অদূরে গেটের দিকে নজর যেতেই দেখলো আসলেই করিম উল্লাহ আসছে। মাহিন হৃধির দিকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বেশ নম্র স্বরে বলে,
–“আপনার বাবা আসছে হৃধি। উনি আসলে বাসায় চলে যাবেন। একদম অভিমান করে কোনো রকম জেদ করবেন না। আঙ্কেল হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেই আপনাকে নিতে এসেছে? আসি, হুম?”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#রঙিন_দূত – ২৫
লাবিবা ওয়াহিদ
————————————–
করিম উল্লাহ মেয়েকে দেখতেই এগিয়ে আসেন। হৃধি বাবাকে দূর থেকে দেখে আর তাকায়নি৷ বাবার উপস্থিতিতে তার কান্না আবারও শুরু হলো। ফোঁপাচ্ছে এবং নাক টানছে। মেয়ের এই করুণ অবস্থা দেখে করিম উল্লাহ’র মুখশ্রী যেন আঁধার গ্রাস করলো৷ অতি সন্তর্পণে মেয়ের পাশে বসলেন। হৃধি তখনো নিশ্চুপ। একটুও নড়েনি সে। করিম উল্লাহ হাতের মলমের ট্যাপ খুলতে খুলতে বেশ থমথমে স্বরে বললো,
–“দেখি?”
হৃধি নিশ্চুপ হয়ে বাবার দিকে ফিরলো। দৃষ্টি তার তখনো নত। করিম উল্লাহ এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালের চুল সরিয়ে অতি স্নেহে কপালের ক্ষততে মলম লাগানো শুরু করেছে। হৃধি বাঁধা দেয়নি তাকে। তার ভিষণ ভালো লাগছে বাবার এই যত্ন-আত্তি! মলম লাগানোর মাঝে দিয়ে দিয়ে হৃধি অস্ফুট আর্তনাদ-ও করেছে। এতে করিম উল্লাহ ভিষণ ব্যথিত এবং অনুতপ্ত। হৃধির নিস্তব্ধতা তাকে আরও অপরাধী করে তুলছে!
–“বাবার সাথে কথা বলবি না? বাবা কী এতোই ক্ষমার অযোগ্য?”
করিম উল্লাহ-র কাতর কন্ঠস্বর। হৃধি দৃষ্টি তুলে তাকালো। ততক্ষণে তুলো চেপে এক ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে কপালে। মেয়ের টকটকে লাল চোখ-মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বললো,
–“বাবা হিসেবে তোমাকে চিনতে আমি ব্যর্থ মামুনি! আমার উচিত ছিলো তোমার কথা শোনা। মজিদ ভাইয়ের কথাগুলো এমনই দাগ কেটেছিলো যে আমি আমার বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম, তার সামনে আমি যেন আমার সম্মান খুইয়েছি, এমন ভাবনা হয়েছে। কিন্তু আমার মামুনিকে তো আমি চিনতাম! সে তো তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। সে কখনো-ই তার বাবাকে দুঃখ দিবে না তাই না? তাও দেখো, এত বড়ো অন্যায় করে ফেললাম আমার মামুনির সাথে!”
শেষোক্ত বাক্যগুলো হৃধির থুতনি ধরে বলে করিম উল্লাহ। এবার যেন হৃধির কান্নার বেগ হুঁ হুঁ করে বেড়ে যায়। বাবার বুকে মাথা রেখে চোখের পানি বিসর্জন দিতে লাগলো। কঠিন হলেও সত্য, করিম উল্লাহ’র চোখের কোণে জলের আভাস মিলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার চিকচিক করছে। পরম যত্নে মেয়েকে আগলে নেন নিজ বক্ষঃস্থলে! অনেকক্ষণ বাবা-মেয়ে সেভাবেই কাটালো। সবশেষে করিম উল্লাহ মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“এই ব্যর্থ পিতাকে ক্ষমা করবে না মামুনি?”
—————————–
শাফীন সেদিন মাহিনের বলা প্ল্যান মতো তার মা ফাতিমাকে ধরেছিলো। ফাতিমা বেগম ছেলের চিন্তিত মুখ দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়। অতঃপর ছেলের কপাল ছুঁয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে আওড়ায়,
–“কী হয়েছে শাফীন? এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?”
–“না আম্মু। তোমাকে কিছু বলার ছিলো।”
–“হ্যাঁ নিশ্চয়ই! বলো আব্বু!”
–“হৃধি ভা.. সরি আপুকে তো চিনো?”
–“হ্যাঁ! কেন কী হয়েছে?”
–“আসলে গত পরশু আপুকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে তাঁরা আপুর কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। কিন্তু ওই মজিদ কা’উ’য়া এসব দেখে বিচার-বিবেচনা না করে হৃধি আপুর নামে তার বাবার কাছে উল্টো পাল্টা লাগিয়েছে। তুমি তো জানোই এই মজিদ কাকা কতো নিচ মানসিকতার একজন লোক! এখন আঙ্কেল হৃধি আপুর সাথে বেশ ঝামেলা করছে!”
–“আয়হায়! কী বলছো আব্বু? মেয়েটার সাথে তো তাহলে অনেক বড়ো অন্যায় হচ্ছে!”
–“মা তুমি প্লিজ তাদের বুঝিয়ে বলো না। হৃধি আপু আমার জন্য তার বাবার বকা শুনছে। শুনেছি চড়ও দিয়েছে!”
এ কথা শ্রবণ হতেই ফাতিমা বেগম উঠে পরে লাগে করিম উল্লাহ কে সত্যিটা জানানোর জন্য। সামান্য কারণে এতো বড়ো অন্যায় তিনি মানতে পারবে না। শাফীন মাকে ঠান্ডা করে বলে,
–“শান্ত হও আম্মু! আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে। তুমি পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের বলবা, তাহলে দেখবে সব মুহূর্তে-ই ঠিক হয়ে যাবে!”
–“কী পরিকল্পনা আব্বু? দ্রুত বলো.. দেরী হলে তো সমস্যা!”
শাফীনের থেকে সব ব্যাখ্যা শুনে মাহিন শাফীনকে বাহবা দিয়ে কাঁধে চাপড়ালো।
–“এই না হলে আমার ভাই! বল কী চাই তোর? যা চাইবি তোকে আজ তাই দিবো!”
–“আজকের কাজে কোনো ইনাম নিবো না আমি। আমি আমার ভাবীর জন্যে করেছি বুঝলি? ভাবীর বিপদে কোনো কাজে যে এসেছি এটাই অনেক! তবে কিছু প্রশ্ন আছে তোমার কাছে!”
–“বল!”
–“ভাবীকে তো দেখলাম দু’দিন তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা ভাবী কী বুঝছে না তোমার ভালোবাসা? তুমি তো কম ঘুরছো না! ভাবীকে মাঝে-মধ্যে বড্ড পা/ষা/ণ লাগে!”
–“ঠা’টি’য়ে এক চ’ড় মারবো, ওকে পা/ষা/ণ বললে। কতটুকু জানিস ওর ব্যাপারে?”
–“ভাবীর তো তোমার প্রতি কোনো অনুভূতি নেই!”
মাহিন দূর আকাশে কিছুক্ষণ নজর বুলিয়ে নিলো। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বলে,
–“ওর মনে অনুভূতি আছে। একটু-আধটু নয়, অনেকটা। আমার বোকারাণীটা ভীষণ ভীতু বুঝলি?প্রকাশ করতে জানে না, এটাই ওর দোষ! আমি যদি ওর সমস্যা ধরতে না পারি তাহলে কেমন ভালোবাসলাম ওকে বল তো?”
মাহিনের এই অন্যমনস্ক কথাগুলো শাফীনের মনে দাগ কাটলো। তার গম্ভীর, কথা কম বলা ভাইটা যে পুরোপুরি প্রেমিক পুরুষে পরিণত হয়েছে সেটা তার বুঝতে বাকি নেই!
–“ভাবী তোমাকে এভয়েড করলে খারাপ লাগে না?”
–“পরিস্থিতি যখন শোচনীয় হয় তাহলে কোনো মেয়ে চাইলেও কারো সাথে মিশতে পারে না। হৃধি যতোই আমাকে এড়িয়ে চলুক, বিরক্তি দেখাক সেটা ওর বাহিক্য রূপ। অন্তরের ভাবনা অনায়াসেই ওর সেই স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে আমি দেখতে পাই। সেখানে যেন আমার-ই বসবাস!”
–“তুমি এতটা নিশ্চিত হয়ে বললে কী করে?”
–“হৃদয় কখনো ভুল কথা বলে না, শাফীন!”
———————
বৃষ্টিস্নাত মধ্যাহ্ন। হুট করে এমন বৃষ্টি নামবে কেউ-ই ধারণা করতে পারেনি। হৃধি নিজেও নয়। এমনিতেই শীত নামতে শুরু করেছে তার উপর এই বৃষ্টি মানে কনকনে শীত নামবে শীঘ্রই। হৃধি ছুটে পাশের দোকানের ছাউনিতে এসে দাঁড়ালো। গা থেকে ঝেড়ে ঝেড়ে বৃষ্টির পানি ফেললো। এই বৃষ্টি মাথায় পরলে বিছানায় পরতে হবে নিশ্চিত। জ্বর-ঠান্ডা হৃধির নিকট বরাবরই বিরক্তিকর। মাথায় ভালো ভাবে ওড়না টেনে
বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলো। দমকা হাওয়ায় হৃধিকে কাঁপিয়ে তুলছে কিয়ৎক্ষণ পরপর। হৃধি নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় আসমানের পানে। আজ অম্বর অবিরত কাঁদছে। তার কাঁদতে বারণ নেই। সে কাঁদবে, স্নান করাবে এই প্রকৃতিকে, সতেজ করবে ধুলো-মাখা শহরকে। মাঝে-মধ্যে ঝড়ের তান্ডবও লাগাবে বড়ো-সড়ো।
হৃধি তার ভাবনার মাঝে কাঁধে কারো বাহুর সংঘর্ষ উপলব্ধি করলো। হৃধি তড়িৎ পাশে তাকালো। মাহিন হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। হৃধি চমকে দু’এক কদম দূরে চলে গেলো। আমতা আমতা করে আওড়ালো,
–“আ..আপনি এখানে?”
–“নিকাব পরেননি কেন?” মাহিনের পাল্টা প্রশ্ন। দৃষ্টি তার বৃষ্টিস্নাত পথে। হৃধি মাহিনের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
–“প্রয়োজনবোধ করিনি!”
–“আবার কেউ দেখলে তো আপনার বাসায় ঝড় তুলবে!”
–“আপনি আমার পাশে না থাকলে কেউ-ই ঝড় তুলবে না! তাই ভালো হয় আপনি দূরে থাকুন আমার থেকে!”
–“মানুষ কখনো তার ছায়াকে ছাড়া চলতে পারে না। তেমনই আমি আপনার ছায়া। যেখানে আপনি সেখানেই ছায়া হিসেবে আমি মাহিন থাকবোই!”
হৃধি আড়চোখে মাহিনকে দেখলো শুধু। কিছু বললো না। ইদানীং মাহিনের প্রতি সে বিরক্তি উপলব্ধি করে না। বলা চলে, বিরক্তি আসে-ই না! তাইতো হৃধি ভবঘুরে, নিশ্চুপ, নির্বিকার থাকে প্রতিবার। হয়তো মাহিনকে বলার মতো শব্দ খুঁজে পায় না। শব্দ না পেলে পুরো একটি বাক্য পূরণ হবে-ই বা কী করে?
শেষমেশ হৃধি না পেরে বৃষ্টি মাঝেই বেরিয়ে আসলো। সে পারবে না মাহিনের কাছাকাছি থাকতে। মাহিন এমন এক চৌম্বক যা হৃধিকে প্রতিনিয়ত লোহার মতো টানতে চায়। সেই চৌম্বক শক্তি এতটাই প্রখর যে হৃধি নিজেকে সামলাতে পারে না। প্রতিবার তার বেহায়া দৃষ্টি মাহিনের দিকে চলে যায়। মাহিন নিজেও ছাতা নিয়ে হৃধির পিছে ছুটলো। মাহিন নিজের মুখে এক মাস্ক পরে হৃধির পিছে ছুটতে ছুটতে আওড়ায়,
–“হৃধি! দাঁড়ান! ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”
–“লাগুক ঠান্ডা, জ্বর। আপনার কিছু না!”
এবার মাহিন কিছু না শুনে হৃধির কাছে এসে মাথায় ছাতা ধরলো। হৃধি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই মাহিন পকেট থেকে নিকাবটা নিয়ে একপ্রকার জোর করে হৃধির মুখে সেটা পরিয়ে দেয়। হৃধি হিজাব পরিহিত ছিলো বিধায় সুবিধা-ই হলো। হৃধি অস্ফুট স্বরে বললো,
–“আরে মাহিন করছেন কী?”
–“ইশ! কতটা পারফেক্ট লাগছে। এবার আমাদের কেউ চিনবে না! নিশ্চিন্তে পাশাপাশি হাঁটুন। চা খাবেন? এই বৃষ্টিস্নাত ওয়েদারে প্রিয় মানুষটির সাথে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না!”
~চলবে, ইনশাল্লাহ