#রঙিন_দূত – ৩৩,৩৪
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————
–“যে মানুষটি সফলতার পূর্ব হতে পাশে থাকে, আমি তাকে ঘিরেই আমার সফলতার গান গাইবো।”
এই উক্তিটি হৃধি কতবার পড়েছে গুনে শেষ করা মুশকিল। এই উক্তিটি মাহিন তাকে শুনিয়েছে সাথে তার অফিসিয়াল পেজেও পোস্ট করেছে। সেখানে লাইক, কমেন্টের ছড়াছড়ি। হৃধি উৎসুক হয়ে কমেন্টও পড়েছে। বেশিরভাগ জিজ্ঞেস করেছে “কে সে?”
তবে হৃধির অবচেতন হৃদয় একটু বেশি-ই মাহিনকে স্মরণ করছে৷ অপেক্ষার প্রহরগুলো যেন ভিষণ আলসেমি করছে। এগোতেই চাইছে না। হৃধি তিস্তার সাথে বসে আছে। তিস্তা হৃধির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“তা হৃধি? ছোট ভাইয়া তোমায় কোথায় হানিমুনে নিয়ে যাচ্ছে? বিয়ের সময় তো কম অতিবাহিত হয়নি!”
–“আপু, তুমিও না। কিসব আজেবাজে বলো?”
হৃধির লাজুক গাল জোড়া দেখে তিস্তা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। এতে যেন হৃধির লজ্জার রেশ আরও বেড়ে যায়।
মাহমুদ আলী প্রতিদিনের মতোই রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছেন। এখন ভোর প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজছে। ফজরের নামাজ পড়ে বাহিরে ফুটপাত ধরে হাঁটাটা তার অভ্যাস। তবে আজ ঘন্টাখানেক হাঁটার পর দুর্বলতা অনুভব করলেন। প্রথমে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেলেও এখন একদমই এড়িয়ে চলা যাচ্ছে না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। চক্করও দিয়েছে একবার৷ মাহমুদ আলী না পেরে এক ল্যাম্পপোস্টের হাত রেখে শরীরের ভার সামলালেন। অনবরত ঘামছেন তিনি। নিঃশ্বাসও ঘন হয়ে আসছে। মাহমুদ আলী নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করলেন। আশেপাশে চেনা মানুষদের খুঁজলেন। কিন্তু সে তাদের সেক্টর থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। মাহমুদ আলী পুণরায় ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিটখানেকের মধ্যে তার বাহুরে কারো স্পর্শ করলো। মানুষটি কে তা জানতে তার আধো বোজা চোখগুলো মেলে ঘাড় বাঁকিয়ে দুর্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। হৃধি উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
–“আঙ্কেল, আপনি ঠিক আছেন তো?”
মেয়েটিকে চিনতে তার খুব একটা অসুবিধা হলো না। তবে অসুস্থতার মাঝে সে নিজের কাঠিন্যকে ভুলে গেলো। ধীর কন্ঠে বললো,
–“না, মা। শরীর খারাপ করেছে, ভিষণ!”
হৃধি ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকালো। কিছুটা দূরেই একজন ফার্মেসী খুলছে। হৃধি দেরী করে না। দ্রুত মাহমুদ আলীকে ধরে নিয়ে সেদিকেই ছুটলো। ফার্মেসীতে প্রথমেই প্রেশার চেক করলো। মাহমুদ আলীর প্রেশার লো। এজন্যই তিনি এমন দুর্বল হয়ে গেছিলেন। হৃধি তার ব্যাগে থাকা কিছু টাকা নিয়ে ছুটলো মাহমুদ আলীর খাবারের ব্যবস্থা করতে। মাহমুদ আলী দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে হৃধির ব্যস্ততা দেখলেন। হয়তো তার ভুল বুঝটা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। হয়তো এই ছোট মেয়েটার জন্যে অদ্ভুত মায়া জম্মাচ্ছে। হয়তো তার ছেলের প্রতি করা অন্যায়ের জন্যে অনুতপ্ত হচ্ছে! ছেলেটাকে সেদিন এভাবে না বললে হয়তো ছেলেটা তার থেকে দূরে যেতো না। বছরখানেকের এই বিরহ থাকতো না। গতকাল ছেলের চিন্তা বেশি করেছে সে। চারপাশে ছেলের সাফল্যের সংবাদ। এ জীবনে এর চেয়ে প্রাপ্তির কী আছে? তবে ছেলেটাকেও যে সে দূরে রেখেছেন। ফাতিমা বেগম ছেলেকে ছাড়া কেমন মনমরা থাকেন। ছেলে দু’তিনদিন পর পর মায়ের খোঁজ নিলেও বাবাকে একবারের জন্যেও ফোন দেয় না। ছেলেকে যতই মারুক, কাটুক প্রথম সন্তান তো। প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে প্রথম সন্তান মানেই একটু বেশি চাওয়া, একটু বেশি আকাঙ্খা!
হৃধি ফিরে এলো হাতে কেক আর এক কাপ চা নিয়ে! সেগুলো মাহমুদ আলীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–“আপনার মুখটা বেশ শুকনো লাগছে আঙ্কেল, সকালে নিশ্চয়ই কিছু খাননি। এখন এগুলো দ্রুত শেষ করুন। পানিও আছে, খেতে চাইলে বলবেন। এগুলো শেষ করে একটু বিশ্রাম করবেন। আমি শাফীনকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছি!”
মাহমুদ আলী হৃধির দিকে নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। মেয়েটা কথাবার্তা এবং পোশাক-আশাকে বেশ শালীনতা আছে, মাথাতেও কী সুন্দর হিজাব বেঁধেছে। চেহারা আহামরি ফর্সা না হলেও মোটামুটি উজ্জ্বলতা আছে মুখশ্রীতে। ডাগর আঁখি জোড়ায় যেন মায়ার জোয়ার। মাহমুদ আলী হৃধিকে পর্যবেক্ষণ করে বেশ সময় নিয়ে বললো,
–“হুম!”
হৃধি ব্যস্ত ভঙ্গিতে গেলো শাফীনকে কল দিতে। বাবার অবস্থার কথা শুনে শাফীন দ্রুত বাসা থেকে বের হয়। হৃধি পুণরায় ফিরে আসে মাহমুদ আলীর কাছে। তিনি সবে কেকে কামড় বসিয়েছেন। হৃধিকে দেখে কেমন ইতস্ততা অনুভব করলেন। হৃধি তার ব্যাগ থেকে নিজের পানির বোতলটা মাহমুদ আলীর পাশের সিটে রেখে বললো
–“শাফীন আসছে আঙ্কেল৷ পানিটা দিয়ে গেলাম, খেয়ে নিবেন। আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছি!”
বলেই হৃধি চলে যায়। মাহমুদ আলী নিরবে তাকিয়ে রয় হৃধির যাওয়ার পানে।
———————–
সকাল সকাল হৃধির বাসায় মাহমুদ আলী এবং তার স্ত্রী খাদিজা বেগমকে দেখে চমকে ওঠে হৃধি। করিম উল্লাহ এবং মাহমুদ আলীর মাঝে যেন কথার মেলা বসেছে। করিম উল্লাহ’র মেয়ের দিকে নজর পরতেই তিনি মাহমুদ আলীর উদ্দেশ্যে বললেন,
–“আপনি বসেন ভাইজান, আমি মেয়ের সাথে ক্কথা বলে আসছি!”
বলেই উঠে দাঁড়ালেন এবং মেয়ের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। তিনি কিছুটা গম্ভীর মুখ করে বললো,
–“জরুরি কথা আছে, ভেতরের রুমে চলো মামুণি!”
বলেই তিনি প্রস্থান করলেন। এদিকে হৃধির ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। বাবা হঠাৎ কী বলতে চায় তাকে? আর ওনারাই বা হুট করে কেন আসলেন? কই, মাহিনের সাথে গতকালও তো কথা হলো। তিনি তো কোনো ইঙ্গিত দেয়নি, তার বাবা-মায়ের আসার। আর মাহিন যদি জেনেও থাকে, মাহিন কেন আসলো না?
হৃধি ত্রস্ত পায়ে তার বাবার রুমের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।
–“তোমার জন্যে মাহিনের থেকে প্রস্তাব এসেছে। আমি তোমার মতামত জানতে চাই মামুণি। আমি চাই না পূর্বের ন্যায় একই ভুল করি!”
হৃধি তার ওড়নার এক অংশ মুঠোতে চেপে ধরলো শক্তভাবে। ভিষণ অস্বস্তি লাগছে তার। সময় নিয়ে আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“তুমি যেমন বলবে বাবা। আমার কোনো আপত্তি নেই!”
করিম উল্লাহ’র গম্ভীর মুখশ্রীতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“তাহলে তাদের “হ্যাঁ” করে দিবো?”
হৃধি ইতিবাচক মাথা নাড়ায়।
শাফীন তো মায়ের কাছ থেকে ফোন পেয়ে মাহিনকে কল করলো। দুই-তিনবার রিং হতেই মাহিন রিসিভ করলো। শাফীন উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,
–“কী রে ভাই? কই তুমি? এদিকে তো তোমার বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন শুধু তুমি আসার পালা!”
–“আমি ফিরছি শাফীন, রাস্তাতে আছি। তোর বলার আগেই খবর আমার কানে এসেছে। তবে এটা বুঝলাম না, বাবা হঠাৎ মতামত পাল্টালো কী করে?”
–“তিন দিন আগের ঘটনা বলেছিলাম না? ওটা জন্যই মেবি গলেছে। আর যাই হোক, আমাদের আব্বুজান পা’ষা’ণ হৃদয়ের নয়। তোমার জন্যে তার ভালোবাসা সবসময়-ই বেশি!”
মাহিন হাসলো, প্রতি উত্তরে কিছু বললো না।
—————-
হৃধি ঘুম থেকে উঠে মাথার কাছে মাহিনকে দেখে তড়িৎ উঠে বসলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়ালো। আটকে গলায় আওড়ায়,
–“আ..আপনি? আমার রুমে কী করছেন?”
–“দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে আসলাম, কেন হৃধি ভয় পাচ্ছেন?”
হৃধি পিটপিট করে মাহিনের দিকে তাকালো। আসলেই মাহিন এসেছে, নাকি সে কোনো ভ্রমে আছে? হৃধিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহিন ফিচেল হেসে বলে,
–“কাম অন, হৃধি। স্বপ্নে নই, সত্যি এসেছি আমি!”
এর মানে মাহিন সত্যি তার সম্মুখে বসে? তখনই রাবেয়া খাতুন ভেতরে প্রবেশ করলেন। মাকে দেখে হৃধি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অস্বস্তিতে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। লজ্জাও পাচ্ছে কিছুটা। কে জানে মা কী বুঝলো। হৃধি লজ্জায় মাথা সেভাবেই নুইয়ে রাখলো। রাবেয়া খাতুন একবার মেয়েকে দেখে মাহিনের দিকে ফিরলো। অতঃপর হাসি-মুখে বললো,
–“যাও মাহিন, আমি হৃধিকে তৈরি করে আনছি!”
মাহিন মুচকি হেসে চলে গেলো। রাবেয়া খাতুন এবার নরম স্বরে বললো,
–“হৃধি, ফ্রেশ হয়ে আয়!”
হৃধি বাধ্য মেয়ের মতো ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো রাবেয়া খাতুন হাতে এক জামদানি শাড়ি নিয়ে বসে আছে। হৃধি দেখতেই ফিচেল হাসি দিয়ে বলে,
–“আয়, তোকে শাড়িটা পরিয়ে দেই!”
–“হঠাৎ?”
–“সময় হলেই জানতে পারবি!”
হৃধি মুখে কিছু বললো না। মনের মাঝে তার হাজারো কৌতুহলের বাহার। হঠাৎ মাহিন কেন তাদের বাড়িতে? আর মা-ই বা কেন এই সাত-সকালে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছে। তার অজান্তে কিছু তো একটা কান্ড ঘটছেই। রাবেয়া খাতুন অতি যত্নে শাড়িটি পরিয়ে কিছুটা সাজিয়ে দিলেন। হৃধি পুণরায় প্রশ্ন করতে চাইলে রাবেয়া খাতুন ধমক দিয়ে হৃধিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“কোনো কথা না, আয় আমার সাথে!”
হৃধি অস্বস্তিতে পরলো। আগের বার লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে শাড়ি পরেছিলো। কিন্তু তখন তো তাদের মধ্যে সেরকম সম্পর্ক ছিলো না। গোপনে হোক বা প্রকাশে, আজ তো হৃধি মাহিনের বউ!! লজ্জায়, জড়তায় হৃধির পা চলছে না। যেতে না চাইলেও মায়ের জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। না জানি লিভিংরুমে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে?
–“ভাই, আমি বুঝি আপনার বিষয়টা। কিন্তু আমার ছেলে আপনার মেয়ের জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে। সে আজকেই ওকে বিয়ে করতে চায় এবং তার সাথে নিয়ে যেতে চায়! বুঝেন-ই তো ছেলের জেদের কাছে আমি নিরূপায়!”
করিম উল্লাহ’র কপালে হাত। হৃধি অস্বস্তিতে কাত। এই ছেলে হঠাৎ এত পাগল হয়েছে কেন বিয়ের জন্যে? করিম উল্লাহ বিয়েতে রাজি হয়েছে, এটা কী যথেষ্ট ছিলো না তার জন্যে? হৃধি চোখ রাঙিয়ে মাহিনের দিকে তাকালে মাহিন কোনো পতিক্রিয়া দেখালো না। সে তো একমনে শাড়ি পরিহিত হৃধিকে দেখতে ব্যস্ত। হৃধিকে পুণরায় শাড়ি পরিহিত দেখে মাহিনের মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠেছিলো। অনেক কষ্টে নিজের ইমোশনকে সামলিয়েছে সে। মাহিনের ভাবলেশহীন মুখশ্রী দেখে হৃধির যেন গা জ্বলে ওঠে। হাত দু’টো নিজের হাঁটুর কাছে শক্ত করে মুঠ করে ধরলো সে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে হৃধি।
করিম উল্লাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
–“আমার একমাত্র মেয়ে হৃধি। কী করে কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া আপনাদের হাতে তুলে দেই বলুন তো?”
এবার মাহিনও মুখ খুললো,
–“আঙ্কেল আপনি জানেন, আমি এখানে থাকি না। কাজের সূত্রে অনেক জায়গায় যেতে হয়। আমি কিছুদিনের জন্যে এসেছি এখানে। সামনেই আমার নতুন শুট আছে, তাই আমি চাইছি না দেরী করতে। এছাড়া হৃধি সিমিস্টার ফাইনাল দিক, তারপর নাহয় অনুষ্ঠান ধুমধাম করে করবো। তবে আঙ্কেল, প্লিজ রিকুয়েষ্ট করছি আপনার কাছে। আমি হৃধির বিষয়ে কোনো ডিসিশন নিতে পারছি না। তাকে আমি সর্বোচ্চ সম্মানে আমার বাড়ি তুলবো। বিশ্বাস রাখুন আমার উপর, দেখবেন হৃধি সুখী থাকবে। এই ছেলে আপনাকে কথা দিলো।”
মাহিনের আচরণে করিম উল্লাহ, রাবেয়া খাতুন উভয়ই অবাক হলো। ছেলেটার কথাবার্তায় বেশ বোঝা যাচ্ছে হৃধির জন্যে তার আকুলতা। তবে করিম উল্লাহ কিছুতেই এত দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না। একসময় হতাশ হয়ে করিম উল্লাহ মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ে সব সময়ের মতোই নিরব হয়ে বসে আছে। মাহিনের ব্যাকুলতা প্রমাণ করছে মাহিন কতটা ভালোবাসে হৃধিকে। একসময় করিম উল্লাহ হেরে গেলেন এই ছেলের জেদের কাছে। কিছুক্ষণের মাঝেই কাজি ডাকা হলো। মাহমুদ আলী তার আশেপাশের কিছু আত্নীয়-স্বজনদের ফোন করলেন। যেহেতু হৃধিদের এদিকে কোনো আত্নীয় নেই সেহেতু তারা আর কাউকে কল দিলেন না। শুধু তিস্তা এবং তার স্বামীসহ, তাঁরার আম্মুকে জানানো হলো। তাঁরা ভার্সিটি গেছে বিধায় সে এসবের কিছু সম্পর্কে অবগত নয়।
কাজী আসতে আসতে তারা সিদ্ধান্ত নিলো, আজ হৃধিকে তারা তুলে দিলেও ছ’মাস পর বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে রিসিপশন করা হবে। রিসিপশনের দিন সকালেই নাহয় হলুদে রাঙানো হবে। কাজী আসলো। কাজীর সাথে আসলো মাহিনের বন্ধুরাও! রিনা তো এদিক ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে,
–“ওরে আমার আপার বিয়া, নায়ক ভাইয়ার লগে। আমার আপার বিয়া, ভাঙ্গা থুক্কু নতুন ঢোল দিয়া!”
দ্বিতীয় বারের মতো, পরিবারের সম্মতিতে হৃধি এবং মাহিনের বিয়ে সম্পন্ন হলো। মোনাজাত শেষ হতেই শাফীন এবং সিফাত চললো তাদের নিয়ে আসা মিষ্টির প্যাকেট রাবেয়া খাতুনের হাতে ধরিয়ে দিতে। রাবেয়া খাতুনকে সব প্যাকেট ধরিয়ে তারা এক প্যাকেট নিয়ে গেলো সকলকে মিষ্টি-মুখ করাতে। আজ তারা ভিষণ খুশি, ভিষণ!
———————
হৃধি ফোলা চোখ-মুখ নিয়ে মাহিনের রুমে বসে আছে। রুম ফুলে, ফুলে সজ্জিত। হৃধি নাক টেনে পুরো রুমে নজর বুলালো। ফুলের সুগন্ধী নাকে বাজছে তার। মাথাটা বেশ ধরেছে, হয়তো বেশি কান্না করার ফল। মাহিন এতো অবুঝ কেন? তার কী বোঝার মতো মাথা ছিলো না, যে হৃধি কী করে তার মা-বাবাকে ছাড়া থাকবে? সে তো আগাম কোনো প্রস্তুতি-ই রাখেনি। ছেলেটার হুটহাট কাজকর্ম হৃধিকে বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছে। মাকে ছাড়া, বাবাকে ছাড়া হৃধির বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মাহিনকে এতো করে বললো সে আসবে না। অন্তত আজকের দিনটা যেন তাকে থাকতে দেয় কিন্তু মাহিন তার কোনো কথা শুনলে তো? হৃধি তো আজ ঠিক করেই নিয়েছে, যতই ঝড় তুফান হোক না কেন মাহিনের সাথে সে একবারের জন্যেও কথা বলবে না।
হৃধি হাতের উল্টোপিঠে ভেঁজা গাল মুছে উঠে দাঁড়ায়। তার ভালো লাগছে না এভাবে মূর্তির মতো বসে থাকতে। পরিহিত শাড়িটা ঠিক করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো চোখ-মুখে পানি দিতে। কয়েক ধাপ এগোতেই বেশ শব্দের সাথে দরজা খুলতে শুনে সে। শব্দটা এমন যেন ইচ্ছে করেই অপরপাশের মানুষটা তার উপস্থিতি অনুভব করাতে চাইছে। মুহূর্তে-ই হৃধির ভেতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠলো৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পাঞ্জাবি পরিহিত মাহিন প্রবেশ করলো। হৃধি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাহিনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। চোখে-মুখে ভালো ভাবে পানি দিয়ে বেরিয়ে আসতেই হৃধি থমকালো, ভড়কালো। লোকটা অ’ স’ভ্যের মতো পাঞ্জাবি খুলে সেন্ডো গেঞ্জি পরে আছে। এতো অ’সভ্য কেন লোকটা? হৃধি নিজের অপ্রস্তুত ভঙ্গি বুঝতে না দিয়ে দ্রুত ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে একটা টিস্যু নিয়ে ধীরে-সুস্থে মুখ মুছছে সে। আশেপাশে তোয়ালের অস্তিত্ব সে দেখতে পায়নি। তাই টিস্যু-ই তার শেষ ভরসা। এর মাঝে শোনা যায় মাহিনের গলা ফাটানো চিৎকার!
–“এসব কী হৃধি? আমার কী তোয়ালের কম পরেছে? তোয়াল থাকতে তুমি টিস্যু দিয়ে কেন মুখ মুছছো?”
মাহিনের মুখে “তুমি” সম্বোধন শুনে হৃধির গা শিরশির করে দিলো। হৃদয়ে অদ্ভুত কম্পন অনুভব করলো সে। মাহিনের বুলিতে “তুমি” ডাকটা এতটা কাঁপুনি দিচ্ছে কেন তাকে? হঠাৎ মাহিনের-ই বা কী হলো যে সে হঠাৎ তার পুরানো রোগে ফিরে গেলো? এর মাঝে তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে অতীতে মাহিনের বলা একটি কথা,
–“আমি নিয়্যত করেছি, যেদিন আপনাকে নিজের ঘরে তুলবো সেদিনই আপনাকে “তুমি” করে সম্বোধন করবো!”
এর মানে তো এখন থেকে মাহিন তাকে সবসময় তুমিই বলবে। হৃধির উত্তর না পেয়ে মাহিন উঠে হৃধির একদম পিছে এসে দাঁড়ায়। হৃধির ঘাড়ে এক টোকা মেরে বলে,
–“কী হলো হৃধি? কোথায় হারালেন?”
হৃধি কম্পিত হয়ে আয়নায় মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের দৃষ্টিও হৃধির সেই ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে। সময়টা যেন থমকে গেলো। পলকহীন তাকিয়ে রইলো একে অপরের দিকে। মাহিন মাদকাসক্ত কন্ঠে বললো,
–“আজ আপনাকে ভিষণ বউ বউ লাগছে হৃধি!”
হৃধি পুণরায় চমকে ওঠে, আবারও “আপনি”। হৃধি মনের মাঝে যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নিলো মাহিন “আপনি” “তুমি” যা ইচ্ছা বলুক, হৃধি আর মাথা ঘামাবে না। মাহিন হঠাৎ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। হৃধির যেন দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাহিন নির্বিঘ্নে শাড়ির ভেতরে পেটে হাত রাখলো। হৃধি সঙ্গে সঙ্গে মাহিনের হাত খামচে ধরলো এবং ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। এই পাগল করা স্পর্শ তার একদম সহ্য হচ্ছে না। হৃধি মাহিনের হাতটা সরাতে চাইলে মাহিন তার বাঁধন আরও শক্ত করলো। হৃধি যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো। মাহিন আয়নার হৃধির দিকে তাকিয়ে আধো কন্ঠে বললো,
–“আজ কিন্তু আমাদের বাসর রাত হৃধি। কথা না বললে আপনি পানিশমেন্ট পাবেন, আদুরে পানিশমেন্ট! জাস্ট টাচ-ই তো করেছি, খেয়ে ফেলেনি আপনাকে!”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।