#রঙিন_দূত_০১
#লাবিবা ওয়াহিদ
আজকের কেনা কামিজটা ট্রাই করছিলো হৃধি হঠাৎ বেলকনির সজোরে দরজা লাগানোর শব্দে ভড়কে উঠলো। পিছে ফিরে রাগাম্বিত মাহিনকে দেখে তার মাথায় যেন বাজ পরলো। রাত আনুমানিক বারোটা! এই মাঝরাতে মাহিন তার রুমে কী করে আসলো? হৃধি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তাকে চেপে ধরলো মাহিন তার ক্রোধমিশ্রিত ধমক দ্বারা।
–“কী সমস্যা, হ্যাঁ? এক্সেটলি তোমার সমস্যাটা কোথায়? এতোগুলা মেসেজ দিলাম, একটার রিপ্লাইও করোনি! আমাকে কী ভালো থাকতে দিবে না তুমি নাকি তোমার আমার ভালো দেখতে ইচ্ছা করে না! এতো কেন পোড়াও আমাকে? আমায় কী তোমার মানুষ বলে মনে হয় না? একটা রিপ্লাই করলে কী সমস্যা হতো? তুমি জানো আমি কতোটা টেনশনে ছিলাম? তা জানবে কী করে তুমি, তোমার সো কল্ড..”
অবশিষ্ট কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় মাহিন। হৃধির দৃষ্টি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে মাহিনের দিকে তাকিয়ে। মাহিনের হঠাৎ রুমে আসা, তাকে এতো এতো ধমক দেয়া সবটাই তার মস্তিষ্কে ভালো রকম জ্যাম বাধিয়েছে, যার ফলে তার বুঝতে কিঞ্চিৎ সময় লাগলো। হৃধি তার হতভম্বতা কাটিয়ে দ্রুত সরে আসলো মাহিনের পাশ থেকে। অতঃপর গলায় কিছুটা কাঠিন্য এনে বললো,
–“এটা কোন ধরণের অসভ্যতা মাহিন? আপনি এই মাঝরাতে আমার রুমে ঢুকেছেন কোন সাহসে? কী ছিলো আপনার মেসেজে? যাই থাকুক! আপনার মেসেজের রিপ্লাই করতে বাধ্য নই আমি! আপনি কিন্তু রীতিমতো হ্যারেজ করছেন আমায়!”
মাহিন দু’কদম এগিয়ে গেলো হৃধির নিকট। নেত্রযুগল এবং অধরে তাচ্ছিল্যতা স্পষ্ট। হৃধি কিছুটা ভড়কালো। শুকনো ঢোক গিলে নিজের অজান্তেই তার পা’জোড়া দু’কদম পিছে চলে গেলো! মাহিন তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,
–“আমি কী আপনার ওড়না ধরে টেনেছি নাকি বাজে কথা বলেছি? কিছু না করেই হ্যারেজ করলাম? যদি সত্যি সত্যি হ্যারেজ করি, নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো?”
হতবিহ্বল, বিমূঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হৃধি। বক্ষঃস্থলে কেমন মুচড়ে উঠলো হৃধির। আঁখিযুগল কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম! ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্বও মিলে। কী অসভ্য এই ছেলে! মুখে কোনো কথাই আটকায় না। ইচ্ছে তো করে কষে কয়েকটা চড় মেরে সোজা করে দিতে। কিন্তু সেদিন এবং কিয়ৎক্ষণ পূর্বে যেই রূপ দেখলো, সাহস হলো না নিজ ইচ্ছাকে বহিঃপ্রকাশ করতে। হৃধি প্রসঙ্গ বদলে কম্পনরত গলায় আওড়ালো!
–“কী এমন জরুরি ছিলো মেসেজে? দ্রুত বলুন এবং প্রস্থান করুন। মাঝরাতে অবিবাহিত মেয়ের কক্ষে পরপুরুষকে শোভা পায় না!”
–“ছেলেটা কে ছিলো? আর কেন তার সাথে তুমি বাসায় ফিরেছো?”
–“ছেলে মানে?” কিছুটা বিষ্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলো।
–“কেন চিনো না? কোচিং থেকে ফিরেছো কার সাথে?”
–“ভাইয়ার সাথে।” মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে আসলো হৃধির। হৃধির মামা’রা পাশের শহরেই থাকে। মামাতো ভাই রক্তিমের সাথে আজ হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। কথা বলতে বলতে রক্তিমের সাথেই বাসায় ফিরেছিলো সে। নির্ঘাত মাহিন দেখেছে তাইতো তার এই অস্বাভাবিক ব্যবহার।
হৃধির যখন হতবুদ্ধি আসলো রাগে সঙ্গে সঙ্গে নিজ গালে চড় মারতে ইচ্ছে হলো। কেন বলতে গেলো “ভাইয়া”? একটা বানোয়াট কাহিনী শোনালেই তো এই রাস্কেলটা তার পিছু ছাড়তো। উফ, হৃধি তোকে বোকার তালিকার শীর্ষে রাখা উচিত। মা কী সাধে তোকে বোকার জননী বলে?
অভ্যন্তরে নিজেকে একমনে বকে গেলো হৃধি। মাহিন যেন গললো “ভাইয়া” ডাক শুনে। অতঃপর শান্ত স্বরে বললো,
–“নেক্সট টাইম হতে আমার মেসেজের রিপ্লাই করতে ভুলবেন না। তখন দেখা যাবে আমি প্রেশারে নই আপনি আছেন! রাত জাগবেন না, ঘুমিয়ে পরুন। আসছি!”
বলেই মাহিন বেলকনিতে যেতে অগ্রসর হয়। হৃধি তখনো সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে। কী বললো মাহিন? মাহিন কী তাকে ইনডাইরেক্টলি হুমকি দিয়ে গেলো, তাও নিজ কক্ষে দাঁড়িয়ে? হৃধি ক্রোধে ফুঁসতে লাগলো। পরমুহূর্তে কী মনে করে বেলকনিতে ছুটলো। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই, নিচে মাহিনের সাঙ্গ-পাঙ্গ মই ধরে দাঁড়িয়ে। আর মাহিন শুড়শুড় করে নেমে যাচ্ছে। হৃধি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“দোয়া করি, মই থেকে পা পিছলে পরে যান এবং আমি নামক সকল স্মৃতি আপনার মস্তিষ্ক থেকে মুছে যাক!”
কিন্তু হৃধির দোয়া এবার কবুল হলো না। অভিজ্ঞ পায়ে খুব সুন্দরভাবে-ই নেমে যায় মাহিন। হৃধি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। দ্রুত বেলকনির দরজা আটকে ভেতরে চলে আসে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রুমের লাইট অফ করে দেয়। আবছা আলোয় বিছানায় ছড়ানো সদ্য কেনা কামিজ সেট গুছিয়ে ভাঁজ করে নেয়।
অতঃপর সেটি যত্ন সহিত তুলে রাখে আলমারিতে। ঈদ ছাড়া জামা খুব একটা পায় না। দুই ইদ মিলিয়ে আট-নয় জোড়া কামিজ সেট হয়ে যায়। আর বছরে মাঝেমধ্যে এক দুইটা।
আজ হঠাৎ-ই বাবা করিম উল্লাহ তার জন্য কামিজ সেট নিয়ে আসে। হৃধির খুশি দেখে কে? নতুন পোশাক দেখতে কার না ভালো লাগে? তাইতো বিছানায় মেলে রেখেছিলো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখে তৃপ্তি মেটানোর জন্য৷ ঠিক এই অসময়েই মাহিনের আবির্ভাব ঘটে।
এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে ফ্যান বাড়িয়ে নেয়। এই গরমের উত্তাপ যেন পিছু ছাড়ে না। এবার চেয়ার টেনে গিয়ে বসলো পড়ার টেবিলে। কাল টেস্ট আছে, সেটারই প্রস্তুতি নিচ্ছে হৃধি। হঠাৎ বইয়ের পাশে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। উজ্জ্বল ফোনটায় চোখ বুলালো হৃধি। মাহিনের মেসেজ!
প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরমুহূর্তে স্মরণে এলো কিয়ৎক্ষণ পূর্বের ঘটনা। ভড়কালো হৃধি। কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিলো। এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেসেজে টাচ করলো। সাথে সাথে-ই ভেসে ওঠে মাহিনের অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তাটি!
–“মাঝরাতে এতো কষ্টে বোকারাণীর বেলকনিতে উঠলাম কিন্তু আমার বোকারাণী পটে না। তাকে পটানোর কিছু টিপস দিন তো!”
কিছুটা ক্ষিপ্ত হয় হৃধি। “বোকারাণী” মানে? তাকে কোন দিক দিয়ে বোকা মনে হয়? সে নিজেই তো একটা পাগল, খবিশ! হৃধি তার ক্রোধ দমিয়ে টাইপ করে,
–“টিপস নিজে খুঁজে নিন, আমায় খামোখা বিরক্ত করছেন কেন?”
–“এর মানে স্বীকার করছো তো, তুমি আমার দ্বারাই পটবে?” এমন মেসেজ দেখে হৃধির আঁখিযুগল বড়ো হয়ে যায়।
–“আশ্চর্য! মোটেও না!”
মন যেন বললো, অপরপাশের ব্যক্তিটি হাসছে। হয়তো তার স্বভাব সম্পর্কে অবগত হৃধি! আর কোনো রিপ্লাই আসলো না। হৃধি ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে পড়ায় মনোযোগ দেয়ার প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছে না। আপনমনেই বলে ওঠলো,
–“একবার “তুমি” তো আরেকবার “আপনি” বলে। হাহ্! ঢং তার গা বেয়ে বেয়ে পরে। স্টুপিড!”
———–
মাহিন নামক ব্যক্তিটি হৃধির জীবনে আসে চার মাস পূর্বে। চার মাস হৃধির নিকট অতি সংক্ষিপ্ত লাগলেও মাহিনের অনুভূতি সাত মাসের কোঠায়৷ হৃধি যেই ভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্রী, মাহিন সেই ভার্সিটির মাস্টার্সের ছাত্র। খুব অদ্ভুতভাবে তাদের পরিচয় হয়েছিলো। সময়টা আষাঢ়ের কোনো এক সুমিষ্ট সকাল। গগন তখন ঘন কালো মেঘে আবৃত। দূর-দূরান্ত হতে বজ্রপাতের বিকট শব্দ শ্রবণ হচ্ছে। দিনের বেলাতেও কেমন আঁধার লাগছিলো চারপাশ। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই হয়তো নামবে এক পশলা বৃষ্টি। প্রচন্ড ঝড়ে হৃধির বেলকনির রশিতে টাঙ্গানো ওড়নাটি গ্রিলবিহীন রেলিং দিয়ে বাহিরে চলে যায়।
হৃধি তা দর্শন করতেই দ্রুত রেলিঙয়ের দিকে ছুটে যায়। ওড়না রাস্তার দিকেই যাচ্ছে। অনিলে ওড়া চুলগুলো কানে গুঁজে হৃধি দ্রুত ছুট লাগায় সদর দরজার দিকে। এই সবুজ ওড়নাটি হারালে তার কামিজ সেট বৃথা যাবে। যতো দ্রুত সম্ভব সে নিচে চলে যায়। কিন্তু নিচে গিয়ে কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। এক যুবকের মাথাতে ওড়নাটা পরেছে আর যুবক সেই ওড়না সবেই মাথা থেকে সরিয়ে বিরক্ত সহিত ওড়নাটির দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই বাসার নিচে দিয়ে নিজ গন্তব্যে যাওয়ার পথে যুবকের মাথায় ওড়না আটকিয়েছে?
যুবকের অধর জোড়া মৃদু কম্পনরত, বোঝা যাচ্ছে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। কিন্তু কী বলছে তা হৃধির শ্রবণ হলো না। তাও সে দ্রুত যুবকের দিকে ছুটে যায় এবং কিছুটা বেসামাল ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–“সরি, সরি! একচুয়ালি এই ঝড়ে আমার ওড়নাটা বারান্দা দিয়ে পরে গেছে। সেটা ভুলবশত আপনার নিকট-ই এসেছে। এগেইন, সরি!”
হঠাৎ মেঘ প্রবল শব্দ গর্জন দিয়ে উঠলো। অদূর আকাশে দৃশ্যমান হয় শুভ্র বিজলি! কিছুটা ভড়কালো হৃধি। হৃধির কাচুমাচু মুখটার দিকে নিনির্মিশেষ তাকিয়ে রয় যুবক। এই দৃষ্টির ভাঁজের রহস্যটা হৃধির নিকট ধোঁয়াশা। হৃধি এবার কিছুটা ইতঃতস্ত হলো। আমতা আমতা করে বলে,
–“ওড়নাটা কী পেতে পারি?”
ধ্যান ভাঙ্গে যুবকের। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে ওড়নাটির দিকে লক্ষ্য করলো। অতঃপর ওড়না দেখিয়ে নরম স্বরে বলে,
–“তোমার ওড়না?”
ইতিবাচক মাথা নাড়ায় হৃধি। ওড়নাটা বাড়িয়ে দেয় যুবক। ওড়নাটি নিয়ে ছোট্ট করে “ধন্যবাদ” জানিয়ে হৃধি এপার্টমেন্টের ভেতরে চলে গেলো। যুবক তখনো ঠাই দাঁড়িয়ে। হৃধি বাসায় ঢুকতেই প্রবল বেগে নামে মুষলধারে বৃষ্টি। হৃধি তখন নিশ্চিন্তে টিভিতে চ্যানেল পাল্টালেও কেউ একজন তখন বাড়ির বাহিরে বৃষ্টিতে ভিঁজতে মগ্ন!
বৃষ্টির কারণে সেদিন আর ভার্সিটি যেতে পারে না হৃধি। মধ্যাহ্নের দ্বিতীয় লগ্নে এই বর্ষণের সমাপ্তি ঘটে। এতক্ষণ বৃষ্টি হলেও সূর্য এখন তার প্রখর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কে বলবে, কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই প্রকৃতি বর্ষণে স্নান করছিলো? এতক্ষণ বৃষ্টি থাকায় ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোর চোখ অবশ হয়ে আসছিলো তন্দ্রায়। কিন্তু সূর্যের তীক্ষ্ণ কিরণ মুহূর্তে-ই ঘুম কেড়ে নিয়ে সকলকে ঘর্মাক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। হৃধি তৈরি হচ্ছে কোচিং এর জন্য৷ কোচিং চারটা হতে শুরু হয়, এখন বাজে দু’টো পয়তালিশ! রাস্তা আধঘন্টার হলেও ঢাকা শহরের জ্যাম এক ঘন্টার কোঠায় নিয়ে যাবে। তাইতো আগে আগে তৈরি হওয়ার আয়োজন।
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পরে হৃধি। বের হওয়ার পূর্বে অবশ্যই রাবেয়া খাতুন অর্থাৎ হৃধির মায়ের হতে ভাড়া নিতে ভুলেনি। রাস্তায় নামতেই উপলব্ধি করলো ভেঁজা মাটির গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করছে। হৃধি রিকশার জন্যে না দাঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে রাস্তার মোড়ের দিকে অগ্রসর হলো। ওখান হতে রিকশা নিলে কিছুটা কম ভাড়ায় যাওয়া যায়। আবার আজ হয়েছে বৃষ্টি, অনেক রিকশাচালক হয় ঘাপটি মেরে বসে থাকবে নয়তো কড়া দাম চাইবে।
নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার সম্মুখে হাজির হয় সকালের ছেলেটি। হৃধি চমকালো, ভড়কালো। আতঙ্কে তার চলমান পা’জোড়া থেমে যায়। হৃধি তার বক্ষে থুঁ থুঁ মেরে সম্মুখে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে তার প্রবল বিষ্ময়। যুবক পরিস্থিতি আরও বিষ্ময়কর করে বললো,
–“তোমার নাম কী?”
———————-
~চলবে, ইনশাল্লাহ।