আধারে_তুমি,১৬,১৭

0
216

#আধারে_তুমি,১৬,১৭
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ১৬

সোহা আবারও সেই গভীর ভাবনায় ডুবে যাওয়ার আগেই তার ফোন বেজে উঠে। সোহা হাতে নিয়ে দেখলো ইতির ফোন। ফোন রিসিভ করতেই ইতির জড়ানো গলা শোনা গেলো
” সোহা কেমন আছিস তুই ?” সোহা আলত হাসলো ইতির প্রশ্ন শুনে। মেয়েটা এই পর্যন্ত অনেকবার ফোন করে ফেলেছে কিন্তু বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করে। সোহা গলায় বিরক্তির আভাস নিয়ে আসলো এবং বললো
” আর কতোবার একই কথা জিজ্ঞেস করবি বলতো ! আমি এখন ঠিক আছিরে। তুই আসবি কখন সেটা বল !” ইতি নাক টেনে বললো
” এই যে হসপিটালে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছিলাম তখন খবর পেলাম তুই বাড়িতে চলে গিয়েছিস তাই সেখানেই আসছি।” সোহা বুঝতে পারলো কে খবর দিয়েছে তাও জিজ্ঞেস করলো
” ওমা তোকে খবর দিলো কে ? বাবা আর মা দুইজনই মাত্র বাড়িতে এসে আমাকে নিয়ে। দুজনের মধ্যে কেউ খবর দেয়নি এটা নিশ্চিত তো খবর কোথায় পেলি তুই ?” ইতি ইতস্তবোধ করতে করতে বললো
” আমি গাড়িতে উঠছি এসে কথা বলবো ঠিকাছে ?” ইতি কোনোরকম করে ফোন কেটে দিলো। ইতির কাজ দেখে সোহা হেসে উঠে। কিন্তু হাসতে গিয়েও পড়লো আরেক বিপত্তি। পেটের ব্যাথায় টান পরতেই ব্যাথা পায়। সোহা ব্যাথায় কুকরে যায়। সোহা চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। টমিকে এখনও পর্যন্ত কাছে না পাওয়ায় একদমই ভালো লাগছে না সোহার। নাইসাকেও মিস করছে। সোহা এসব ভাবতে ভাবতে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

এদিকে শাহানাজ বেগম বাড়ি ফেরার পর থেকে সালমা তার পেছনে ঘুরঘুর করছে। শাহানাজ বেগম পাত্তা দিচ্ছে না আরো সালমাকে একশটা কাজ গজিয়ে দিচ্ছে। সে ভালো করেই জানে সালমা কোনো বিষয় নিয়ে মারাত্মক ভাবে গবেষণা করেছে। এখন তার কাছে সেটা নিয়েই কথা বলবে তবে আজ শাহানাজ বেগম একদমই এসব শুনতে চান না। তার মন আজ খুবই খারাপ। সোহাটা এতোবড় আঘাত পেলো ! কিছুতেই মন মানছে না। তার মতে সোহা অসাধারণ একটা মেয়ে। সোহা নিজের মতো আনন্দে থাকে আর সবাইকে আপন করে নিতে চায়। এই বাড়ির কেউ না হলেও বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের চোখের মনি সোহা। অবশ্য তার দুই বউ মা ও কি কম নাকি ? তিনি তো তিনজনকেই মেয়ের চোখে দেখে। সোহার কথা ভাবতে ভাবতেই দেখলো শান ঢুকছে বাড়িতে। শাহানাজ বেগম দ্রুত পায়ে শানের কাছে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। শানও ভদ্র ছেলের মতো মায়ের সামনেই দাঁড়িয়ে যায়। শাহানাজ বেগম চিন্তিত হয়ে বলে
” সোহাকে ঠিক মতো বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিস ?” শান মাথা নেড়ে বলে
” হ্যা মা। সোহা রেস্ট করছে এখন।” শাহানাজ বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো
” কি থেকে যে কি হয়ে গেলো ! শান যা রেস্ট কর গিয়ে। কালকে থেকে তো অনেক ছুটেছিস।” শাহানাজ বেগম ছেলেকে নিচু করে কপালে চুমু দিয়ে আদর করে দিলো। শান মলিন হাসি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। সালমা খুটে খুটে শানকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। শানের মুখে মলিন হাসিটা তার চোখে পরছে বারবার। শান চোখ খুলতেই সালমার বিজ্ঞানী বিশেষ চোখের তাকানো দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো। মাকে ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললো
” তোর কি হয়েছে ? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো ? মনে হচ্ছে আমি কিছু চুরি করে এসেছি !” সালমা আমতা আমতা করে বললো
” না না ভাই আপনি কেনো চুড়ি করবেন ! আপনি তো চোর না পুলিশ।” শান আবারও গম্ভীরতার সাথে বলে
” তো এভাবে কি দেখছিস ? কি চাই ?”
শাহানাজ বেগম বললো
” ছাড় তো বাবা ওর কথা। পিছু পিছু ঘুরছে কি বলবে বলে। তুই রেস্ট কর গিয়ে আমি কফি পাঠাচ্ছি।” শান নাকচ করে দিলো, বললো
” নাহ আমি এখন ঘুমাবো একটু তারপর একটু থানায় যেতে হবে কাজ আছে।” শান চলে যেতেই শাহানাজ বেগম সালমাকে কড়া গলায় বললো
” যা কাজ কর গিয়ে তুই ! দেখছিস বাড়ির কারো মন ভালো নেই অথচ তুই আমার পেছনেই পরে গিয়েছিস ! যা আজ কিছু শুনবো না গিয়ে কাজ কর আর নিলাকে ডেকে আন গিয়ে।”
শাহানাজ বেগম রান্নাঘরের গিয়ে ছুটলো। সালমা হতাশা ভরা কণ্ঠে বললো
” কবে যে বলবো ! কতোদিন ধরে কথাটা বলার জন্য ঘুরছি কিন্তু আজও বলতে পারলাম না।” সালমা নিশ্বাস ফেলে নিলাকে ডেকে আনতে চলে গেলো।

ঘুমের মাঝে কারোর কথাবলার ফিসফিসানীর জন্য সোহার ঘুম হালকা হয়ে আসে। নড়ে চড়ে চোখ খুলতেই তার সামনে চোখ গেলো। সিমি আর ইতিকে দেখতে পেলো। দুজন গল্প করছে বসে বসে যদিও ধীরেধীরেই গল্প করছে কিন্তু সেই ফিসফিসানীতেই সোহার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সোহা কিছুটা সোজা হয়ে বসতেই পাশে টমির গায়ে হাত লাগে। সোহা টমিকে পেয়ে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে আর সোহার চেঁচানো শুনে সিমি আর ইতি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ায়। সোহা টমিকে কোলে তুলে আদর করতে থাকে। সিমি বুকে হাত রেখে চোখ বড়বড় করে বলে
” উফফ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাদর পেয়ে এভাবে কেউ চিৎকার করে ?” সোহা উত্তর না দিয়ে টমিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। সিমি আলতো হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। ইতি সোহার পাশে বসে অভিমানী গলায় বললো
” বাহ খুব ভালো। টমিকে একদিন না দেখিসনি তাতেই এতো আদর। আর আমাদের যে কতোদিন হলো দেখা হয়নি সেটা মনে আছে তোর ?” সোহা দাঁত কেলিয়ে বলে
” তোকে কি কোলে নিয়ে আদর করা যাবে ? তোকে তো তোর জামাই এভাবে আদর করবে। আর রোগী মানুষকে দেখতে এসেছিস ভালো কথা কিন্তু কি এনেছিস আমার জন্য?”
ইতি মাথা চুলকে বলে
” আমি তো কিছুই আনিনি তোর জন্য। তবে তোর জন্য কিছু ফ্রুটস এনেছি যেগুলো তোর ভাষ্যমতে গরু, ছাগলের খাবার।” সোহা রেগে পাশ থেকে কুশন নিয়ে ইতির উপর ছুড়ে মারে। ইতি কুশন জায়গায় রেখে বলে
” চিল বেবি চিল ! এই সময় বেশি হাইপার হলে ব্যাথা পাবি। চল ফ্রেশ হয়ে নে তোর জন্য খাবার আনতে গিয়েছে আপু।” ইতি সোহাকে ওয়াসরুমে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে সোহা এসে বিছানায় বসতেই সিমি খাবার নিয়ে হাজির হয়।
সিমি সোহাকে খাইয়ে দিতে থাকে। সোহা আর ইতি বসে বসে গল্প করতে থাকে। সোহা ওই বাড়িতে কি কি করেছে সবই বলছে। ইতি কথা বলতে বলতে সিমিকে জিজ্ঞেস করলো
” আপু ভাইয়া কবে আসবে ?” সিমি উত্তরে বললো
” জানি না গো কথা হয়নি উনার সাথে। একটু পর কথা বলে জানতে পারবো কবে আসবে।” সোহা এক গাল হেসে বলে
” আমি জানি ভাইয়া তো আজকেই আসবে। ভাইয়া এখনও আমাকে দেখেনি তাই একেবারে রাতেই এখানে চলে আসবে।” সিমি হেসে বলে
” বাব্বাহ আমার থেকে তো তুই দেখছি ভালো জানিস।” সোহা ভাব নিয়ে বলে
” দেখতে হবে না শালিটা কার !” ইতি মিটমিট হেসে বললো
” হুতুমপেচার।” ইতির কথায় তিনজন হেসে উঠে।
সোহার কথা সত্যি হলো রাতে সামির আসলো এই বাড়িতে। সোহার জন্য সোহার পছন্দের হরেক রকম জিনিস নিয়ে আসলো। সোহা তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে গিয়েছে।
দুইদিন কেটে গেলো এভাবেই। ইতি এখন সোহার সাথে থাকে। এদিকে ভার্সিটির এডমিশন টেস্টও এগিয়ে আসছে। তা নিয়ে দুজন খুবই চিন্তিত।

এতোদিন ধরে ঘুরে ঘুরে সালমা আজ সুযোগ পেয়েছে শাহানাজ বেগমকে সব বলার জন্য। শাহানাজ বেগমই তাকে ডেকে এনেছে। মেয়েটা যখন এতোদিন ধরে ঘুরছে তখন একটা সুযোগ দেওয়া উচিত কথা বলার জন্য। শাহানাজ বেগমই শুরু করে
” বল কি বলবি বলে এতোদিন ধরে ঘুরছিস !”
সালমা আগে থেকেই তার কথা গুছিয়ে রেখেছে। শাহানাজ বেগমের অনুমতি পেয়েই বলা শুরু করে
” খালাম্মা আমার কি মনে হয় জানেন ! ছোট ভাই সোহা আপাকে ভালোবাসে।” সালমার কথায় শাহানাজ বেগম চরম লেভের চমকে গেলো। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে সালমার দিকে। সালমা মাথা নেড়ে আবারও হ্যা বলে। শাহানাজ বেগম অবাক হয়ে বলে
” তুই কি করে জানলি এসব ? আমার ছেলে তোকে বলেছে এসব?” সালমা জিভ কেটে বলে
” না না খালাম্মা এটা তো আমার কথা। মানে আমি দেখছি। সেইদিন যে জ্বর হইছিলো আপার ! আপনারা তো বাসায় আছিলেন না। তখন আমি দেখছি ভাইকে। ভাই এতো অস্থির অস্থির হয়ে ছিলো! অনেক যত্ন করছে আপার। সারারাত জেগে বসে ছিলো। আপার কি দরকার, না দরকার সব দেখছে। থানায় যাওয়ার আগে আমারে বারবার বলতো খেয়াল রাখতে আপার। ভাইরে দেখে মনে হইছিলো আপা অসুস্থ হওয়ায় ভাইয়ের অনেক কষ্ট লাগছিলো। তারপর একদিন তো আপা যখন বেশি অসুস্থ হয়ে গেছে তখন কোলে করে উপরে নিয়ে গেছে। তারপর তো আবার সেইদিন ! সোহা আপার যে এক্সিডেন্ট হইছিলো আপনি ভাইরে দেখছেন ! আপার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ভাইয়ের চোখ মুখ শুকাইয়া ছিলো। হসপিটালেও তো সারারাত জেগে বসে ছিলো। দুইদিন তো ভালো করে খাওয়া দাওয়া করলো না। আমার তো মনে হয় সোহা আপার চিন্তাতেই। তারপর সোহা আপার সব কাজেই তো আগে আগে করে দেওয়ার চেষ্টা করতো। আর সোহা আপার পেটে যেই লোকটা ছুরি ঢুকিয়ে দিছিলো তারে তো কত্তো খুঁজতেছে ছোট ভাই আর ইমন ভাই।” সালমা তার কথা শেষ করে বড়সড় একটা নিশ্বাস ফেললো। এতোদিনের জমিয়ে রাখা কথা গুলো বলতে পেরে মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করতে পেরেছে।
শাহানাজ বেগম ভাবনায় পরে গেলো। তার ছেলে সোহাকে ভালোবাসে অথচ তিনি একবারও খেয়াল করে দেখলো না ! কথাটা শুনে যতোটা না খুশি হয়েছে ততোটাই চিন্তিত কারণ সালমার সব ধারণা যদি ভুল প্রমাণিত হয় ? শাহানাজ বেগম ভাবতে ভাবতে শানের রুমে যেতে থাকে

চলবে……….

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ১৭

শাহানাজ বেগম ভাবতে ভাবতে শানের রুমে যেতে থাকে। শানের রুমের সামনে এসেই থেমে গেলো। ভাবলো এখন জিজ্ঞেস করবে কিনা ! নাকি একটু পরীক্ষা করে দেখবে !
দরজায় নক করতেই দরজা আপনা আপনিই খুলে গেলো। শাহানাজ বেগম সব কিছু ভাবা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকলো।
শান থানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। শাহানাজ বেগম ছেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো
” ব্রেকফাস্ট করে যাবে না !” শান চুল ঠিক করছিলো শাহানাজ বেগমের কথা শুনে না চলা থামিয়ে থমথমে মুখে মায়ের দিকে তাকালো। উত্তরে বললো
” আমি তো একটু আগেই ব্রেকফাস্ট করলাম সবার সাথে। আবার কেনো করবো ?” শাহানাজ বেগম মনে মনে নিজেকে বকা দিলো। শান চিন্তিত হয়ে বলে
” মা কি হয়েছে তোমার ? তুমি কি অসুস্থ ?” শাহানাজ বেগম মাথা নেড়ে বলে
” না না আমি ঠিক আছি। আমি বলতে এসেছি যে থানায় আজকে আর যেতে হবে না। তুমি তো থানার সিনিয়র অফিসার একদিন না গেলে কিছু হবে না।” শান শব্দহীন ভাবে হাসলো। হাসতে হাসতে বলে
” কি যে বলো মা ! আমি সিনিয়র অফিসার দেখেই তো আমাকে সব সময় যেতে হবে। পুরো থানার দায়িত্ব আমার কাধেই। একদিন ইমন সামলে নেবে ঠিকই কিন্তু সবাই তো সিনিয়রকেই ফলো করবে। যারা আমার আন্ডারে কাজ করছে তারা আমাকেই অনুসরণ করবে।”
শাহানাজ বেগম দুঃখি দুঃখি স্বরে বলে
” হ্যা বুঝেছি। আমি আরো ভেবেছিলাম সোহাটাকে গিয়ে দেখে আসবো। কেমন আছে মেয়েটা। কিন্তু তোর যখন এতো কাজ আমি একাই নাহয় চলে যাবো নাহলে নিলা তো আছেই।” শান আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিনমিন স্বরে বললো
” নাহ একা যাবে কেনো ? তুমি যখন এতো আশা নিয়ে এসেছো তখন আমিই নিয়ে যাবো তোমাকে। তুমি রেডি হও গিয়ে। আমি চেঞ্জ করে আসছি।”
শাহানাহ বেগম শানকে আটকে বলে
” না না থাক। যখন ইউনিফর্ম পরেই ফেলেছিস তখন আজ থানায় চলে যা। আগামীকাল নাহয় যাবো।” শান বোকার মতো তাকিয়ে বললো
” এই তো এখনই বললে এখন যাবে তাই থানায় না যেতে আর এখন বলছো কালকে যাবে ?” শাহানাজ বেগম হেসে বলে
” আসলে তোকে তৈরি হতে দেখে ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলেছি। আচ্ছা সাবধানে যাস থানায়।”
শাহানাজ বেগম শানের রুম থেকে একপ্রকার দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো।
শান শাহানাজ বেগমের মতিগতি কিছুই বুঝলো না তবে মুচকি একটা হাসি দিলো। সোহার জন্য দুইদিন ধরে মনটা বেকুল হয়ে ছিলো। বলেছিলো সোহার খোঁজ নেবে কিন্তু সেই রেস্টুরেন্ট এর লোকটাকে হন্ন করে খুঁজছে শান। মনে মনে পন করেছিলো লোকটাকে খুঁজে বের করে আগে শাস্তি দেবে তারপর সোহার খোঁজ খবর নেবে কিন্তু শাহানাজ বেগম যখন যাচ্ছে তখন আর সোহাকে দেখার লোভটা সামলাতে পারলো না। দুদিন পর আজ শানের মনটাও কিছুটা ভালো হয়ে গেলো। তৈরি হয়ে থানায় উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।

সোহা যতোটুকু পারছে তার ভার্সিটির এডমিশন টেস্ট এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। ইতিও হেল্প করছে তাকে। সোহা আজ বায়না ধরেছে বাড়ির ছাঁদে যাবে। ঘরে বসে বসে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে সোহা। যেই মেয়ে একটু শান্ত হয়ে বসতে চায় না সে যে এই দুদিন, তিনদিন ধরে ঘরে বসে কাটাচ্ছে এটাই অনেক কিছু সবার কাছে। ইতির সাহায্যে ধীরে ধীরে ছাদে এসে পৌঁছায়। ছাঁদে পা রেখেই মুচকি হেসে বড় একটা নিশ্বাস ফেললো। কতোদিন পর তার প্রাণ প্রিয় ছাঁদে এসেছে। সোহা ধীরেধীরে ছাদ জুড়ে হাটতে থাকে আর তার প্রিয় ফুল গাছ গুলো ছুঁয়ে দিতে থাকে। ইতি বিরক্তের সঙ্গে বলে
” তোকে না সিরি থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। অসভ্য বাদর একটা। এতো ঘুরাঘুরির কি আছে ? এখন যদি পেটের সেলাই এ টান পরে ব্যাথা পাস তাহলে দেখবি তোকে কি করি।”
সোহা মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলে
” ইমন ভাইয়া কি ফোন ধরছে না নাকি ? তার রাগ আমার উপর ঝাড়ছিস কেনো তুই ? ভাইয়া পুলিশ অফিসার। তার তো কাজ আছে নাকি ? এখনই এতো রেগে থাকলে বিয়ের পর তো তোদের সংসার নিয়ে টানাটানি চলবে দেখছি।”
ইতি মুখ কালো বলে
” ছাড় তোর সংসার ! এখনও বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো না বাড়িতে আবার সংসার ! কয়েকমাসের মধ্যে যদি বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে না যায় না ! তাহলে দেখবি আমি নিজেই অন্যকাউকে ধরে বিয়ে করে ফেলবো।”
সোহা ফিকফিক করে হেসে বলে
” আর ভাইয়া তোকে তোর বাসর থেকে তুলে এনে নিজেই বাসর করে ফেলবে তাই না !”
ইতি সোহার পিঠে ঠাসঠাস করে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো কিন্তু সোহা থামলো না। সোহা ইতি আর ইমনকে নিয়ে মজা করতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে আসতেই সোহাকে নিয়ে নিচে এসে পরলো। ড্রইংরুমে গিয়ে বসে। সোহাকে দেখেই রিয়ানা রহমান চলে গেলো রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পর সিমি ফোলা ফোলা চোখ মুখ নিয়ে এসে হাজির হলো। সোহা সিমিকে রাগানোর জন্য বলে
” কিরে আপু আমার ভাইয়া কি তোর সাথে ব্রেকাপ করেছে নাকি ? কেঁদে কেটে দেখছি চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিস !” সিমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সোহার দিকে। মনে মনে একটাই কথা ঘুরতে থাকে সোহাকে নিয়ে। এতো কথা বলে কিভাবে মেয়েটা ! একটু চুপ থাকতে পারে না ? সোহার আবোল তাবোল কথায় কান দিলো না আজ। অনেক শান্তির ঘুম দিয়ে এসেছে। ঝগড়া করে মেজাজ বিগড়ানোর কোনো ইচ্ছে হলো না সিমির। রিয়ানা বেগম শষীকে দিয়ে সিমি আর ইতির জন্য চা আর সোহার জন্য গরম গরম চা পাঠালো। সেসব দেখেই সিমি আর ইতির মুখে বিশ্ব জয়ের শয়তানি হাসি আর সোহা মুখ কালো করে রাখে। তাকে এখন এই দুধ খেতে হবে। মনে মনে মারাত্মক রকমের কান্না পেলো কিন্তু কাদঁলো না সোহা। দিন খারাপ গেলে আরো অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয় এটা তো কিছুই না ! এসব ভেবে নিজের মনকে শান্ত করে নিলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দুজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে মজা করে দুধটা খেয়ে নিলো। ইতি আর সিমি মুখ টিপে হাসলো সোহাকে দেখে। দুজনও সোহাকে দেখিয়ে দেখিয়ে শব্দ করে চা করে খেতে লাগলো। সোহা রেগে ধুপধাপ পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ইতি ব্যস্ত হয়ে বলে
” আরে আস্তে যা !” সোহা কি শোনে কারো কথা ! নিজের মতো করে চলে আসে রুমে। এসেই পেটের ডান সাইড ধরে বসে থাকে মুখ ফুলিয়ে। রাগ দেখিয়ে আসতে গিয়ে এখন ব্যাথা করছে তার।

আজ শাহানাজ বেগমের সাথে শান সোহাদের বাড়িতে এসেছে। সাথে নিলা, নাইসা, তামিম, সালমাও এসেছে। বলতে গেলে আজ তাদের বাড়ির সবাই আসছে সোহাকে দেখতে। বাকিরা দুপুরের পর আসবে। সিমি, শষী, রিয়ানা রহমান তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত।
শান অধীর আগ্রহে বসে আছে সোহাকে একপলক দেখার জন্য। আসার পর থেকে তার মনটা ছটফট করছে। কিন্তু নিজেকে শান্ত দেখানোর চেষ্টা করছে। শাহানাজ বেগম সিমিকে বললো সোহার রুমে নিয়ে যেতে। সিমি সবাইকে সোহার রুমে নিয়ে যায়। সোহার রুমে আসতেই সবার চোখ কপালে উঠে গেলো। সোহা এক বক্স টিস্যু নিয়ে বসেছে। কাঁদছে আর টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে রুমে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে। ইতি সোহাকে বকেই যাচ্ছে। টিস্যু দিয়েই পুরো রুমের বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। সিমি গিয়ে সোহাকে এক ধমক দিলো। সোহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কেউ কিছু বুঝছে না কেনো কাঁদছে বেচারী।
এদিকে মনে মনে শানের অবস্থা বেহাল। সোহাকে কাঁদতে দেখে তার একদমই ভালো লাগছে না। কেউ না থাকলে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে পারতো কিন্তু সবার সামনে করতে পারবে না। শান মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলো। সিমি ভ্রু কুঁচকে বলল
” তুই কাঁদছিস কেনো বলবি তো নাকি? কেঁদে কেঁদে টিস্যু নষ্ট করছিস কেনো তুই ?” শাহানাজ বেগম এগিয়ে এসে সোহাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সোহা আরো আহ্লাদী হয়ে কাঁদতে থাকে। শাহানাজ বেগম সিমিকে বললো
” আরে বউমা বকছো কেনো ? আমি দেখছি ওকে তুমি বসো গিয়ে।” ইতি সবাইকে বসতে বলে।
শাহানাজ বেগম সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে
” কেমন আছিস মা ! কাঁদছিস কেনো ?” সোহা নাক টেনে টেনে বলে
” ভালো নেই একদম। তোমার কত্তো মিস করেছি জানো?” নাইসা দৌঁড়ে সোহার কাছে এসে বসলো। সোহা নাইসাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। নাইসা মন খারাপ করে বললো
” আমাদের বাড়িতে যাওনি কেনো মিষ্টিপাখি ?”
সোহা ঠোঁট উল্টে বললো
” আমি তো অসুস্থ তাই। তবে তুমি আজকে থেকে আমার সাথে থাকবে। ঠিকাছে ?” নাইসা খুশি হয়ে হ্যা বলে। এরমাঝে টমি এসে উপস্থিত হয়। শান টমিকে দেখেই মুখ কুঁচকে নিলো। নাইসা টমিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। নিলা এগিয়ে এসে সোহার পাশে বসে বললো
” কাঁদছিলে কেনো গো সোহা ?” সোহা মুখ ফুলিয়ে বলে
” তোমরা আসবে আর আমাকে কেউ জানায়নি। একটু আগে মাত্র জানিয়ে গেলো। আগে জানলে আমি একটু সেজেগুজে তৈরি হয়ে থাকতাম।” সোহার কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। শানের ইচ্ছে করলো ঠাস করে গিয়ে সোহার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। এতো ছোট একটা বিষয় নিয়ে এতো কান্নাকাটি ? শানের মাথাই গরম হয়ে গেলো।
তামিম এগিয়ে এসে বলে
” তুমি তো এমনই অনেক সুন্দর আর সাজগোজের কি প্রয়োজন ?” সোহা তামিমকে এনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। ইতি তামিমকে দেখে ভাবতে ভাবতে বলে
” আচ্ছা তোমাকে তো আমি দেখছিলাম আপুর বিয়েতে। শুনলাম তুমিই নাকি সোহার উপর ক্রাশ খেয়েছো ?” তামিম ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো ইতির কথায়। এভাবে সবার সামনে না বললেও পারতো। এখন সবাই যদি তাকে নিয়ে মজা করে ! শাহানাজ বেগম, নিলা শব্দ করে হেসে দিলো। শান গম্ভীর হয়ে বসে থাকে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here