দ্বিতীয় বিয়ে পর্ব-এক

0
715

#ধারাবাহিক গল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-এক
মাহাবুবা বিথী

ভোরের দুধ সাদা আলোয় চারিদিক আলোকিত।পাখপাখালির শব্দে পৃথিবীটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।আজ ছুটির দিন।শহরটা একটু নিরিবিলি।

আজ আমার বিয়ে।দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসছি কিছুটা মনের তাগিদে আর কিছুটা মানুষের নোংরা মানসিকতার জবাব দিতে।জীবনের চল্লিশটা বছর পার করেছি।বিয়েটা খুব ঘরোয়া ভাবে করছি।আত্মীয় স্বজন কাউকেই ডাকিনি। ডাকবোই বা কাকে। দেখা হলে কেন ডিভোর্স হলাে, সংসার করতে পারলাম না কেন, ওদের ধারণা সংসার না করে আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। মাসছয়েক আগে আমার ছোটো ভাইয়ের ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাবার বাসায় গিয়েছিলাম। ওর শাশুড়ীর সাথে দেখা হলো।ওর শাশুড়ী বললো,
——জীবনের একটা গতি করো।এটা একটা জীবন হলো।
আমি বললাম,
—-আন্টি আমার জীবনের বেগতিক কি দেখলেন।নাম যশ খ্যাতি সবই তো আমার আছে।তারপরও বলছেন এটা জীবন না।
—-শোন সারাহ্,বিয়ে করে সংসারী হও।এইযে এতো টাকা পয়সা কামাচ্ছো তুমি মরে গেলে বারোভূতে খাবে।কেউ একটা মিলাদও পড়াবে না।
আমি ওখান থেকে উঠে চলে আসলাম।নির্বোধের সাথে কথা বললে ও আপনাকে নির্বোধের পর্যায়ে নিয়ে যাবে।তারপর আর বাপের বাড়িমুখো হয়নি।
আমি দুটো এতিম খানায় খরচ চালাই।অনেক চ্যারিটিতে অংশ নেই।এগুলিতো কাউকে বলি না।বললে তো দানের মর্যাদা থাকে না।দান নাকি এমনভাবে করতে হয় ডান হাত দিয়ে দান করলে বাঁ হাত যেন টের না পায়।

জানি ওনারা আসবে না তাও বাবা মাকে আসতে বলেছিলাম।বাবা বললো
—–তুমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছো বিয়ে করবে তাহলে বিয়েটা করেই ফেলো।আমার আর তোমার মার দোয়া রইলো।সময় করে এসে আমাদের সাথে দেখা করে যেও।
আমার কথা বাবা আমাকে ফিরিয়ে দিলো।

বাবা মার আমার উপরে এখনও অভিমান জমিয়ে রেখেছে।জাহিদকে বাবা মার অভিমানের কথা জানিয়েছিলাম।জাহিদ বললো,
—–আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক।ওনাদের সাথে যখন দেখা করতে যাব ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবো।ও নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করোনা।
জাহিদের মানুষকে আপন করার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা আছে।ওর আছে স্ট্রং পারসোনালিটি।যেটা পলাশের একদম ছিলো না। পলাশ আমার সাথে ওর পরিবারের ব্যালেন্স কখনও করতে পারেনি।

জাহিদ ডিগ্রী পাশ করে আর লেখাপড়া করেনি।ঠিকাদারী করে।বরিশাল থাকতে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।ও আমার আর পলাশের বন্ধু ছিলো। আমাদের ডিভোর্সের বিষয়টা ও জানে। বরিশাল থেকে চলে আসার পর ফেসবুকে
মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো।আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হবে।একদিন আমার হাসপাতালে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়।ওর ছেলে মাহিন আমার সাথে দেখা করে ওর অবস্থা জানায়।এই হাসপাতালে কার্ডিও তে আমার একজন পরিচিত ডাক্তার আছেন।ওনার নাম জাবেদ।আমি মাহিনকে নিয়ে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।জাহিদও ডাক্তারের পারফরমেন্সে খুব খুশী।ওর বউয়ের সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক।জাহিদের দুটো ব্লক আছে।রিং পরানো হয়েছে। জাহিদের টাকার সমস্যা ছিলো।ঠিকাদারের বিল সব আটকে ছিলো।আমি টাকা দিয়ে হেল্প করেছিলাম।পরে অবশ্য টাকা ফেরত দিয়েছিলো।আমি নেইনি।
ডাক্তারী পেশায় থাকাতে করোনার শুরুতেই আমার করোনা হয়েছিলো।জাহিদ আর ওর বউ মিলে আমার সেবা করেছে।যেখানে আপনজনেরাই কাছে আসে না।জাহিদের যেহেতু হার্টে রিং পরানো ছিলো ও আসতো না।তবে ওর বউকে পাঠিয়ে দিতো।এক মাস আমাকে সম্পা (মানে জাহিদের বউ) রান্না করে খাইয়েছে।সহমর্মিতা আর সহানুভূতি থেকে আমাদের সম্পর্কটা আজকের পর্যায়ে এসেছে।

আমি পেশায় সাকসেসফুল একজন গাইনি ডাক্তার।যশ খ্যাতি অর্থ সব এখন আমার হাতের মুঠোয়।এতো সফলতা সত্বেও কিছু মানুষ আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চায় আমার যেহেতু সংসার নেই তাই আমি ব্যর্থ।কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অপরিচিত কেউ এসে জিজ্ঞাসা করে,
—-আপা ভাই বাচ্চাদের নিয়ে আসেননি।
—-আমি হয়তো বলি আমার বাচ্চা নেই
—–তখন জ্ঞান দিতে গিয়ে বলবে, আপনি তো গাইনি ডাক্তার।চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা উন্নত হয়েছে সেটাতো জানেন।
ওদের কথার মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলি,
—-আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে
তখন আবার বলা শুরু করে
—-ভাবী আজকাল ডিভোর্সটা পান্তা ভাত হয়ে গেছে।আপনার মতো সুন্দরী ডাক্তার মেয়েকেও ডিভোর্স দিতে মানুষের বাঁধে না।
কেউ আবার আগ বাড়িয়ে বলে
—-শিক্ষিত হলে তো হবে না।সংসার টিকিয়ে রাখতে যোগ্যতা লাগে।
তখন যদি আমি বলি,
—–আমাকে কেউ ডিভোর্স দেয়নি।আমি ডিভোর্স দিয়ে চলে এসেছি।
নোংরামির ছুড়িতে আমার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করতে তখন সবাই মিলে উঠে পড়ে লাগে।

আমি আর পলাশ বরিশাল মেডিকেল কলেজে একসাথে পড়াশোনা করেছি।ফাইনাল প্রফ দেওয়ার সাথে সাথে পলাশ বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে।আমি চেয়েছিলাম বিসিএস দিয়ে বিয়ে করবো।কারন বিয়ের পরে সাংসারিক ব্যস্ততায় অনেক সময় বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করা যায় না।বাবা মাও চাইছিলেন একটু সেটেলড হয়ে বিয়ে করি।
অগত্যা পলাশের চাপাচাপিতে বিয়েটা করে ফেলি।বাবা মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।বাবা বলেছিলো
—-সারাহ্ তুমি কাজটা ঠিক করোনি
আমি বলেছিলাম,
—–বাবা জীবনটা আমার সিদ্ধান্ত আমার। ভালো মন্দ যাই হোক এই দায়িত্ব আমার।
বাবা আহত হলেন।সেই থেকে বাবা মা আমার ব্যাপারে উদাসীন।
আমি সবার বড়।আমার ছোটো একবোন।তার ছোটো ভাই।আমার এই আচরণের কারণে ছাত্রী অবস্থায় ইলোরার বিয়ে হয়ে যায়।রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও চাকরিটা আর করা হয়নি।তবে একটা ভরভরান্ত সংসার হয়েছে।ছেলে দুটো মানুষের মতো মানুষ হয়েছে।একটা ছেলে ডাক্তারী পড়ছে আর একটা ছেলে মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ছে।পাশাপাশি ইলোরা বাবা মার দেখাশোনাও করেছে।আমার ছোটো ভাই সরকারী ইন্জিনিয়ার।এখন পোস্টিং কুমিল্লায়।
পলাশের সাথে বিয়ের পর থেকেই মতের অমিল হতে শুরু করে।আমরা দুজনেই তখন একটা ক্লিনিকে জব করি।দুজন মিলে মাসে তিরিশ হাজার টাকা রোজগার করি। পলাশ ওর বেতনের সব টাকা আমার শাশুড়ীর হাতে তুলে দেয়।আমাকেও কিছু টাকা দিতে বলে।আমি যেখানে আমার বাবা মাকে কোনদিন কোনো টাকা পয়সা দেইনি সেখানে শাশুড়ী মার হাতে টাকা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।আমি পলাশকে বললাম,
—-সংসারের কোনখাতে আমাকে খরচ করতে হবে সেটা বলে দাও।আমি করে দিবো।কিন্তু কারো হাতে টাকা দিতে পারবো না।গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন জীবনে কোনো কাজে আসে না।আর উচ্চতর ডিগ্রীগুলোতে অনেক টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়।তখনি বা আমি টাকা কোথায় পাবো?

এতে পলাশ আর আমার শাশুড়ী মা দুজনেই আমার উপরে নাখোশ হয়।সকালে ক্লিনিকে যাবার সময় সবার জন্য রুটি সবজি বানিয়ে যেতে হয়।পলাশরা দুই ভাই একবোন।শ্বশুর রিটায়ার করেছেন।

আমার শ্বশুরবাড়ি মোহাম্মদপুরের ইকবালরোডে।পেনশনের টাকা দিয়ে আমার শ্বশুর বারোশো স্কয়ার ফিটের এই ফ্লাট কিনেছেন।
পলাশের ছোটো ভাই আকাশ ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে।খাবার টেবিলে সবজির সাথে সবার জন্য ডিম বরাদ্দ থাকলেও আমার জন্য থাকে না।শাশুড়ি মা বলেন ডিমের যে দাম প্রতিদিন সবার জন্য ডিম কেনা যাবে না।আমি যে বাবার বাড়িতে খাই নাই তা না।আমি সচ্ছল পরিবারের মেয়ে।শুধু আমার অপমানে লাগে।তাই বেশীর ভাগ সময়ই টেবিলে নাস্তা দিয়ে আমি না খেয়ে বের হয়ে যাই।
আমার ননদ মিরা কলেজে পড়ে।যে কোন প্রোগ্রামে ও আমার শাড়ি গয়না পড়ে।তাতে কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু ওকে যে শাড়িটা দিবো সেটা নিঁখুত অবস্থায় আমি ফিরে পাবো না।
কয়েকটা শাড়ি নষ্ট হওয়ার পর আমি ওকে আমার শাড়ি পরতে দেই না।
আমি নিজ থেকেই সংসারের কিছু খরচের দায়িত্ব নিলাম।কাজের হেলপারের বেতন আমি দিয়ে দেই।আর সকালের নাস্তার খরচ আমি করি।এভাবেই আমার সংসার জীবনের দিনগুলি পার হতে লাগলো।যে পলাশ বিয়ের আগে আমার জন্য কত কেয়ারিং ছিলো সে এখন আমার কোনো খোঁজ রাখে না।বিয়ের আগে আমার পছন্দ অপছন্দের কত গুরুত্ব ছিলো এখন ওর কাছে আমার ই কোনো গুরুত্ব নাই।আমার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব তো দুরের কথা।

বেশ কিছুদিন থেকে পিরিয়ডের সময় ব্লিডিং বেশী হয়।পলাশকে বললাম ম্যাডামের কাছে যাবো।তুমি কি আমায় একটু সময় দিতে পারবে?
পলাশ বললো,
—-তুমি নিজেই তো হাসপাতালে ম্যামকে দেখাতে পারো।ন্যাকামো করে আমার যাওয়ার দরকার নাই।
আমি খুব আহত হয়ে বললাম,
—অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকাকে তোমার ন্যাকামো মনে হয়।
পলাশ বললো,
—-দেখ সারাদিন পরিশ্রমের পর আদিখ্যেতা করতে ভালো লাগে না।
আমি পলাশের সাথে কোনো কথা না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।বুকের গহীনে বিন্দু বিন্দু দীর্ঘশ্বাস জমা হয়ে কখন যে দীর্ঘশ্বাসের মহা সিন্ধু তৈরী হয়েছে আমি নিজেই বুঝতে পারেনি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here