দ্বিতীয় বিয়ে শেষ পর্ব

0
330

#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
শেষ পর্ব
মাহাবুবা বিথী

আমি একটু গম্ভীর হয়ে তানিয়াকে বললাম,
—–আমি আসলে আমার পার্সোনাল বিষয়গুলো কারো সাথে শেয়ার করতে পছন্দ করি না। প্রফেসনাল জায়গায় ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো আনি না এতে আমার পেশাদারিত্বে ডিস্টার্ব ফিল করি।

আমার কথা শুনে তানিয়া নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো,
—-তেমন কিছু না আপু।আমি জানতে চাইছি আপনি কোন মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছেন।
আমি বললাম,
—-কেন তানিয়া আপনি আমার প্রোফাইল চেক করেননি। ওখানে ডিটেইল দেওয়া আছে।
তানিয়া বললো,
—-আমার আসলে দেখা হয়নি।আর একটা বিষয় জানতে চাই, আমি বিয়ের আগে স্কুলে চাকরি করতাম। এখন আবার করতে চাই। প্রেগনেন্সির এই সময়ে বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে নাতো?
আমি বললাম,
—-আপনার কোন সমস্যাই ছিলো না।শারীরিক ভাবে আপনি একদম ফিট।আপনার হাসবেন্ডের সমস্যার কারনে এতোদিন বাচ্চা হয়নি।
আর কিছু বলবেন,আমার পেশেন্টরা বসে আছে।
তানিয়া বললো,
—-না,আপু আর কিছু জানার নাই।আসসালামালাইকুম আপু আসি।
তানিয়া চলে যাবার পর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মাঝে মাঝে ভাবি গল্প উপন্যাসের কাছেও জীবন অনেক তুচ্ছ মনে হয়।রুপকথার চেয়েও জীবন অনেক বেশী অবিশ্বাস্য হয়ে উঠে। জীবনের বাঁকে জন্ম নেয় অনেক অতৃপ্তি না পাওয়ার বেদনা তবুও সময় থেমে থাকে না। কখনও কখনও প্রেম ভালবাসায় জীবনের মূহুর্তগুলো রাঙ্গিয়ে যায়।তখন জীবন অনেক সুন্দর হয়ে উঠে। তাইতো এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মানুষ চলে যেতে চায় না অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায়।এটাই জীবন।

বাকি পেশেন্টগুলো তাড়াতাড়ি দেখা শেষ করলাম।আজকে আকাশটা মেঘ করছে।মনে হয় মুষলধারে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। তাই দ্রুত বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।

এর মাঝে সাত মাস পেরিয়ে গেলো।আজকে আমার একটা গুরুত্বপূর্ন অপারেশন আছে। আমার কাছে মনে হলো,আল্লাহর রহমতে আজ আমার অপমানের জবাব দেওয়ার দিন।জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করার দিন।

আমি ড্রেস পড়ে মুখে মাক্স নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করার সময় এক পলক পলাশের মা ভাই বোন সবাইকে দেখলাম। ওরাও তাকিয়েছিলো। তানিয়াকে এনাসথেসিয়া দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর অশেষ রহমতে সিজার করে তানিয়ার পুত্র সন্তানের জন্ম হলো।
আমি বাচ্চা পলাশের হাতে তুলে দিয়ে পেশেন্টকে পোস্টঅপারেটিভ কেয়ারে রেখে ডিউটি ডাক্তারের কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। কারণ আমার মন বলছে পলাশের বাড়ির লোকেরা আমার সাথে দেখা করতো চাইবে। আমি চাই না।পুরোনো গল্পের মাঝে আর আসত চাই না। এই জীবনে অনেক হয়েছে।আমি নতুন গল্পে ফিরতে চাই।তাই হাসপাতাল থেকে দ্রুত বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম।
হুমায়ুন আহমেদের কথায় বলতে হয়”জীবন সহজ না কঠিন ও না।আমরাই জীবনকে নিজেদের প্রয়োজনে সহজ কিংবা কঠিন করে তুলি”।
ভাঙ্গা গড়া নিয়ে মানুষের জীবন। জীবন চলার পথে অনেক সময় সম্পর্কগুলো রক্ষা করা যায় না। না চাইলেও কোনো কোনো সময় সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে যায়। বিচ্ছেদে হয়ত ক্ষণিক সমাধান হয় কিন্তু হৃদয়ের গভীরে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হয়। এমন সময় মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ চলে আসে।
সারাহ্,
আমি জানি তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই।আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি বলে আল্লাহপাক আমাকে তোমার মুখেমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে তুমি চলে যাবার পর একমূহুর্ত আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি।যার ফলে তানিয়া সুখী হতো পারেনি। আসলে ও তো ঘর পোড়া মানুষ তাই মুখ বুঝে আমার সংসার করে গেছে। ও তোমার আর আমার ব্যাপারটা জানে। ও তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমি আরও অনেক বড় ডাক্তার হও। আমি একজন ডাক্তার হিসেবে তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হয়। নতুন সম্পর্কে জড়ালে পুরোনোকে মনে হয় আরও বেশী মনে পড়ে। তোমাকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম। তুমি রিসিভ করোনি। তাই মেসেঞ্জারে আমার কথাগুলো বলে ফেললাম।কারণ আমি এই কথাগুলো না বলা অবধি একটুও শান্তি পাচ্ছিলাম না। ভালো থেকো।
কেন জানি আমার চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।
ফোনটা বেজে উঠলো।ডিউটি ডাক্তার ফাতিমা ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো ফাতিমা সব ঠিক আছে।
ফাতিমা বললো,
—-হুম সব পেশেন্টরাই ভাল আছে।তবে পেশেন্ট তানিয়ার বাড়ির লোকজন আপনার খোঁজ করেছিলো।আমি বলছি ম্যাডামের শরীর ভালো নেই তাই বাড়ি চলে গিয়েছে।
আমি বললাম,
—-সঠিক কথাই বলেছো।আসলেই শরীরটা ভাল নেই।করোনা হওয়ার পর একটুতেই কাহিল হয়ে পড়ি। ঠিক আছে তুমি পেশেন্টের দিকে খেয়াল রেখো।ফোন রাখছি।

আগামীকাল শুক্রবার। ছুটি আছে। বিশ্রামে থাকা যাবে।ফোনটা আবার বেজে উঠলো।মাহিন ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো আন্টি কেমন আছেন?কাল তো বাসায় আছেন।
আমি বললাম,
—-ভাল আছি। হ্যাঁ বাসাতেই আছি।ছুটির দিনে তেমন কোথাও আজকাল আর যাওয়া হয় না। তোমরা সবাই ভাল আছোতো?
মাহিন বললো,
—-আল্লাহপাকের রহমতে আমরা সবাই ভাল আছি।বাবাও এখন পুরোদমে ওনার ঠিকাদারি কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।আন্টি যে কারনে ফোন দিয়েছি, কাল বিকেলে আমি,মৌমিতা আর মামুন আপনার ওখানে আসবো।
আমি বললাম,
—-ঠিক আছে আসো।আমি বাসাতেই থাকবো।
একটু অবাক হয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।তিনভাই বোন একসাথে আসবে হয়ত ওদের কোন জরুরী কথা আছে।।

পরদিন বিকালে মাহিন মৌমিতা আর মামুন আমার বাসায় আসলো।আসার আগে আমাকে ফোনে বলেছিলো আমি যেন কোনো কিছু রান্না না করি।ওরা বাইরে থেকে খাবার কিনে আনবে। ওরা আসার সময় কাচ্চি, কাবাব, থেকে শুরু করে মিষ্টি, ফল নিয়ে আমার বাসায় চলে আসলো। আমি ওদের বললাম এতো কিছু আনার কি দরকার ছিলো?
মাহিন বললো,
—-মার কাছে আসবো, খালি হাতে আসবো, তা কি করে হয়।
আমার চোখটা জলে ভিজে উঠলো।এমনকরে মা শব্দটা বুকের ভিতর কাঁপন ধরিয়ে দিলাে। তারপর মৌমিতা এসে আমার পাশে বসলো।আর মাহিন আমায় বললো,
—–মা, তোমায় নিতে এসেছি।আম্মু মারা যাবার আগে তার ইচ্ছের কথা আমাদের জানিয়েছে। তোমার মতো মা পেতে গেলে অনেক পূন্য করতে হয়। হয়ত আমাদের এমন কোনো পূন্য আল্লাহপাকের দরবারে জমা আছে তার বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে আমরা তোমার মতো একজন মা গিফট হিসেবে পাচ্ছি।
আবেগে আপ্লুত হয়ে আমার যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে গেলো।নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে বললাম,
—-তোমার মা বাবাও অনেক ভাল মানুষ। টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি হয়ত চেষ্টা করলে মানুষ অর্জন করতে পারে কিন্তু ভাল মানুষ হতে গেলে আল্লাহপাকের রহমত লাগে। উনার হেদায়েত ছাড়া ভাল মানুষ হওয়া যায় না।
তারপর বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা হলো। মৌমিতা আর মামুন টেবিলে খাবার বেড়ে দিলো। ডিনার শেষ করে ওরা চলে গেলো।যাওয়ার সময় মামুন এসে আমায় সালাম দিয়ে বললো,
—-মা আমরা আসি।
ওরা চলে যাবার কিছুক্ষণ পর মা ফোন দিলো।
—-হ্যালো কি ঠিক করলি?
আমি বললাম,
—-মা আমি তো তোমায় বলে আসছি। ওনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
মা বললো,
—তাতো আমি জানি,তুমি নিজে যা সিদ্ধান্ত নিবে তার বাইরে এক পাও হাঁটবে না।পঁচা শামুকে একবার পা কেটেও তোমার শিক্ষা হলো না।
আমি বললাম,
—-তুমি তো আমার মা। দোয়া করো আর কোনো পঁচা শামুকে তোমার মেয়ের পা যেন কেটে না যায়।
মা বললো,
—–আমি রাখছি।
মা বাবা বুঝতে পারছে না এই বয়সে আমার স্বামীর থেকেও একজন বন্ধুর বেশী প্রয়োজন। যে আমাকে মায়ার বন্ধনে বেঁধে রাখবে।

রাতে জাহিদ আমাকে ফোন দিয়ে বললো,
—-সারাহ্ সম্পা তোমাকে অনেক ভালবাসত।আসলে রতন তো রতনকেই চিনে নেয়।তারপর ও বলি তোমার যদি অমত থাকে আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। আমার ছেলেমেয়েরাও তোমাকে অনেক ভালবাসে।আসলে ওদের মাতো তোমাকে ভালবাসতো তাই ওদেরও তোমার প্রতি অনেক টান।
আমি বললাম,
—-জাহিদ আমি আমার মতের বাইরে কিছু করি না।আমি একলা কাঁটা বিছানো পথে চলতে চলতে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।আমার একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন।
জাহিদ আমাকে বললো,
—-আমরা তো বন্ধুই ছিলাম।আসলে এই সমাজে আমরা মনের দিক থেকে যতই পবিত্র থাকি না কেন কিছু দুষ্ট চক্র আমাদের নোংরা কথার বাণে আঘাত করে যাবে।তাই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে একটা সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া।
জাহিদের কথায় মনটা ভরে গেলো।

কলিং বেলের শব্দে অতীত থেকে আমি বর্তমানে ফিরে আসলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা বারোটা বাজে। মনে হয় জাহিদরা এসে পড়েছে।

পাঁচ বছর পর—–
আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে আমি আজ পরিপূর্ণ একজন সুখী মানুষ।আমার একটা ভরভরান্ত সংসার হয়েছে। জীবনটা এতো সুন্দর হবে আগে কখনও ভাবিনি। যে যাই বলুক জাহিদকে বিয়ে করে আমি অনেক সুখী। জাহিদের কাছে স্বামীর থেকেও আমার বন্ধুত্বের দাবী অনেক বেশী। দাম্পত্য জীবনে দুটো মানুষের মনের মিলের বড় প্রয়োজন।মনের মিল না হলে সংসারে সুখী হওয়া যায় না।
মাহিনও বিয়ে করেছে।ওর বউ ও চাকরি করে।একটা ছেলে হয়েছে।মৌমিতা বিয়ে করে ওর স্বামীর সাথে চাঁদপুরে থাকে। ওরা দুজনেই সরকারি ডাক্তার।আর মামুন বুয়েট থেকে পাশ করে ওর এক সহপাঠিকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে। ওখানে একটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে।আর আমার বাবা মা এখন আমার কাছে থাকে। জাহিদের নিজের বাবা মা নেই।ও আমার বাবা মাকে অনেক ভালবাসে। মাঝে মাঝে জাহিদের সাথে আমি দেশের বাইরে ঘুরতে যাই।আল্লাহ পাকের কাছে অনেক শোকরিয়া।আল্লাহপাক মানুষকে পরীক্ষা করেন কিন্তু যখন পুরুস্কৃত করেন তখন একজন মানুষকে পূর্ণতায় ভরে দেন।

শেষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here