দ্বিতীয় বিয়ে পর্ব-নয়

0
218

#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-নয়
মাহাবুবা বিথী

বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠে ফোনটা রিসিভ করলাম।
—–হ্যালো (কান্না জড়িত গলায়)আন্টি,আম্মু আর নেই।
আমি বললাম,
—-মাহিন,তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না,বাবা।তোমাকে তো ছোটো দু,ভাই বোন তোমার অসুস্থ বাবাকে সামলাতে হবে।আমি এখুনি আসছি।
ফোনটা রেখে ফজরের নামাজ পড়ে হালকা নাস্তা সেরে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম।

আল্লাহপাকের আদেশে মানুষ পৃথিবীতে আসে আবার উনার নির্দেশেই মানুষ ছেড়ে যায় এই সুন্দর পৃথিবী।তবুও মানবজীবনে আফসোসের কোন সীমা পরিসীমা থাকে না।প্রিয়জনকে চিরতরে হারানোর কষ্ট, শোক মানুষ একসময় ঠিক সামলে নেয়।তারপরও কিছু কিছু বেদনার ক্ষত মানুষ সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।এর যন্ত্রণা এতটাই গভীর তা একমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা অকালে তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে। জাহিদ, মাহিন,মৌমিতা, মামুনের বেদনা ভারাক্রান্ত মুখটা খুব মনে পড়ছে।আমার বুকের ভিতরটাও ব্যথায় চিন চিন করছে।দীর্ঘদিনের বন্ধুকে হারিয়ে আমিও শোকে মুহ্যমান।চোখের পাতা নোনা জলে ভিজে গেলো।জাহিদ অসুস্থ শরীরে এই শোক কিভাবে সামলে নিবে সেটা ভেবে আমার খুব অস্থির লাগছে।

আজ শুক্রবার।তাই একটু তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম।ছুটির দিন বিধায় চেম্বার ও বন্ধ।অনেকটা সময় এই শোকাগ্রস্ত পরিবারের সাথে থাকতে পারবো।আমাকে দেখে মাহিন মৌমিতা আর মামুন দৌড়ে আসলো।ওদেরকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার মনে হলো সদ্য মাতৃহারা সন্তানরা আমার বুকে আশ্রয় খুঁজছে। আমি মাহিনকে জিজ্ঞাসা করলাম
—–তোমার বাবাকে খবর দিয়েছো।
মাহিন বললো,
—–বাবাকে কিভাবে খবরটা দিবো বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম,
——তুমি তোমার বাবাকে বলবে,মার শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ করেছে।তোমাকে মা দেখতে চাচ্ছে।তারপর এখানে আসার পর আত্মীয় স্বজন সবার মাঝখানে নিজেকে সামলে নিতে পারবে।
মাহিনকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি ডেথ সার্টিফিকেট সহ আনুষঙ্গিক সব ফর্মালিটিস শেষ করার জন্য বিল কাউন্টারে চলে গেলাম।
আত্মীয় স্বজন সবাই হাসপাতালের করিডোরে ভীড় করেছে।আইসিইউ এর বিল দেখে আত্মীয় নামধারী এক স্বজন বলে উঠলো নিজে তো মরলো জাহিদটাকে ধনে মেরে দিয়ে গেলো।আমি খুব অবাক হলাম। এই কথাগুলো মনের ভিতরে রাখা যেতো। আমাদের কমনসেন্স এতো কমে গেছে কোন জায়গায় কি কথা বলতে হয় আমরা তাও জানি না।আমি মামুনকে সাথে নিয়ে সব কিছু গুছিয়ে লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে মিরপুরে জাহিদের বাসায় রওয়ানা হলাম।
মাহিনকে ফোন দিয়ে বললাম,
—-হ্যালো,আমি লাশ নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি।তুমি জাহিদকে নিয়ে বাসায় চলে আসো।
মৌমিতা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে কষ্টগুলো ঝরিয়ে ফেলতে পারছে।মামুন সেটা পারছে না। বোবা কান্নায় ও নির্বাক হয়ে আছে। যার ছাঁয়াতলে ওরা বড় হয়েছে তাকে হারানোর বেদনার সান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নাই। দুনিয়ার এমন কোন শব্দ নেই যে শব্দের বিনিময়ে মাতৃবিয়োগে সান্তনা দেওয়া যায়।

ছুটির দিন হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি আমরা মিরপুরে পৌছে গেলাম। লাশের গোসলের ব্যবস্থা করা হলো।মৃতের বাড়িতে সবাই শোকাতুর।তাই বাইরে থেকে বাড়ির সবার জন্য খাবার কিনে আনা হলো।আত্মীয় স্বজনের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো।এর মধ্যে জাহিদও চলে আসলো।ও যখন হাসপাতাল না গিয়ে বাড়ির দিকে আসলো তখনই বুঝে গেছে ওর জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।ও বাড়িতে এসে
সম্পার কফিনের সামনে বসে বললো,
—–তোমার এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবার তাগিদ হলো আমার যে তোমার সাথে সংসার করে সাধ মিটলো না।
আমি বললাম,
—-এভাবে চোখের পানি ফেলো না।ওর কষ্ট হবে।ওর তো রোগ যন্ত্রণায় অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। আল্লাহ পাক ওকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে।দোয়া করো আল্লাহপাক ওকে জান্নাতবাসী করুণ।

আমি লক্ষ্য করলাম,ইতিমধ্যে আমার সাথে জাহিদের সম্পর্ক নিয়ে আত্মীয় স্বজনের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। আমরা কারো উপকার করতে পারি বা না পারি মন্দ সমালোচনা করতে পারদর্শী। আমার বিপদে যেমন আমার কোন আত্মীয় স্বজন আমার পাশে দাঁড়ায়নি তেমনি জাহিদের বিপদেও কোনো আত্মীয়কে এগিয়ে আসতে দেখিনি।

বরই পাতা দিয়ে পানি ফুটিয়ে আলতো হাতে লাশ গোসল করানো হলো।কাফনের কাপড় দিয়ে সাজিয়ে আতর গোলাপ পানি মাখিয়ে দিয়ে জানাযার জন্য প্রস্তুত করা হলো।সবার কাছে বিদায় নিয়ে খাটিয়া করে লাশ নিয়ে গেলো মসজিদে। জুম্মার নামাজ পড়ে লাশ দাফন করা হলো। সাথে সাথে আকাশ জুড়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।প্রকৃতি যেন এই শোক সামলাতে পারলো না তাই অঝোর ধারায় কেঁদে ফেললো।

জাহিদ এমনিতেই অনেক অসুস্থ।তারপর এই শোকের ঝড় ওকে পুরোদমে বিদ্ধস্ত করে দিয়েছে। সেই ঝড় যেন আমাকেও ছুয়ে যাচ্ছে।আসলে বন্ধুত্বের বন্ধন বন্ধুর প্রতি টান কোনকিছু দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।আমার মনের অবস্থা যে কি তা কাউকে বুঝানো সম্ভব না।তবে আমার থেকে সহস্রগুন কষ্টের ঝড় জাহিদ আর ওর ছেলেমেয়ের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।আমি শুধু ওদের পাশে থেকে কষ্ট অনুভব করতে পারি আর কিছু করার সামর্থ্য আমার নাই।প্রবাদ আছে”যার যায় শুধু সেই বোঝে’।সুতরাং আমি বুঝতে পারছি ওরা কি কঠিন সময় পার করছে। এই মনোকষ্টগুলো ওদের একান্ত।দাফন শেষ হওয়ার পর জাহিদ আর মাহিন হালকা খেয়ে হাসপাতালে রওয়ানা হলো। আত্মীয় স্বজন যাওয়ার আগে সুনিপুনভাবে খোঁচা দিয়ে গেলো।জাহিদের এক বউ মরতে না মরতে আর এক মালদার বউ যোগাড় করে ফেলেছে।এসব নোংরা কথার প্রতিবাদ জাহিদের ছেলেমেয়েরা করতে গেলে আমি ওদের বারণ করি।

কারণ জাহিদের কানে এই কথাগুলো গেলে ওর কষ্টের মাত্রা আরোও বেড়ে যাবে।ও এখন শংকাজনক অবস্থায় আছে।আমি মাহিনকে বললাম,
—-এই পৃথিবীতে যারা নোংরা কথা বলে মানুষকে আঘাত করে তাদের সাথে কথা বলা উচিত নয়।তারা তোমাকে পঁচা নর্দমায় ফেলে দিবে।তার থেকে ইগনোর করা ভাল।
মাহিন বললো,
—-সরি আন্ট, আমি ওদের হয়ে আপনার কাছে মাফ চাইছি।
মৌমিতা আর মামুনও কষ্ট আর অপমানে আমার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
আমি বললাম,
—-আমি বহু কন্টক পথ মাড়িয়ে এসেছি।এগুলো আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। তুমি বরং জাহিদের বাইপাসের ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে কথা বলো।যত তাড়াতাড়ি বাইপাস হবে ততই মঙ্গল। আজকের রাতটা আমি মামুন আর মৌমিতার সঙ্গে কাটিয়ে দিচ্ছি।তুমি ওদের নিয়ে ভেবো না।

আমার ঘুম আসছিলো না।মৌমিতা আর মামুনকে জোর করে ঘুমাতে বললাম।এই কয়দিন ওদের উপর অনেক ঝড় বয়ে গেছে।ওদের ঘুমানো দরকার।অজানা অচেনা বিছানায় আমার ঘুম আসতে চায় না।অন্ধকারে বারান্দায় বসে আছি।মাঝে মাঝে আমি অন্ধকারকে অনুভব করে কবরকে অনুভব করি।এখনও বৃষ্টি ঝড়ছে।তার সাথে শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বইছে।আমি যেন সেই বাতাসের স্পর্শে সম্পাকে অনুভব করছি। মনে হচ্ছে সম্পা যেন আমার আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো।তাকিয়ে দেখি মা ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো,আম্মা কেমন আছেন।
আম্মা বললেন,
—-আমি ভাল আছি।তোর বাবার শরীরটা একটু খারাপ।কাল একবার এসে তোর বাবাকে দেখে যাস।
আমি বললাম,
—-আচ্ছা আসবো।
আম্মা বললেন,
—-শোন মা, এভাবে আর কতদিন থাকবি। বিয়ে তো করা উচিত। ইলোরা তোর জন্য একটা ভাল প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।পাত্রের ছেলে মেয়েরা সবাই বিদেশে স্থায়ী বসবাস করছে।বউটাও মারা গেছে।বেচারা একা থাকে।তোর সাথে ভালই মানাবে।বয়স পঞ্চাশের একটু উপরে।ঢাকায় তিনটা ফ্লাট আছে।গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে।ওদের নিজেদের একটা ক্লিনিকও আছে।
আমি বললাম,
—-মা আমার ধনী পাত্রের দরকার নেই।আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে অর্থ যশ খ্যাতি সবই আমার আছে।আমার একজন ভালো মনের মানুষের দরকার।যে আমার জীবনের রোদ বৃষ্টির খেলায় ছাতা হয়ে থাকবে।
মা একটু রেগে গিয়ে বললেন,
—-তোর নজর তো সবসময় নিচের দিকে।এটাই তো আমার ভয়।
আমি বললাম,
—–অযথা আমাকে নিয়ে ভয় পেয়ো না। আমি সারা জীবন যা করেছি নিজের বুদ্ধিতে করেছি। ভুল হোক আর ঠিক হোক।তোমাদেরকে তো আমার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছি।আর মানুষের ভবিতব্যে যা লেখা থাকে তা কখনও খন্ডানো যায় না।
ফোনটা আবার বেজে উঠলো।এবার আমি চমকে উঠলাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here