দ্বিতীয় বিয়ে পর্ব-আট

0
200

#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-আট
মাহাবুবা বিথী

আমি খুব দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে যাই।মৌমিতা আর মামুন আইসিইউ এর বাইরে বসে আছে।ওদেরকে দেখে আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। আমি আইসিইউর ভিতরে গিয়ে সম্পার খোঁজটা নিয়ে নেই। ডাক্তার অনেকটা ওর ব্যাপারে আশাহত।

ওর মুখটা দেখে আমার মনে হলো,সম্পা যেন জীবন সায়াহ্নের শেষ ট্রেনটা ধরার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে।যে কোন সময়ে ট্রেনটা এসে পড়বে।সবাই আমরা প্রতিমূহুর্তে শেষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি।আমার বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে।বেদনার সুর হৃদয়ের গহীনে বেজে উঠে।সম্পার হাসি ঝলমলে দিন,স্বামী সংসার নিয়ে পরিতৃপ্ত একজন ভাগ্যবান রমনীর মুখটা আমার মনে পড়ছে।

খুব কাছের প্রিয় বন্ধু মানুষ যখন না ফেরার দেশে চলে যায় এর ব্যথা কতটা গভীর হতে পারে,জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে তা হয়তো নিজের কেউ না হারালে উপলব্ধি করা যায় না। আমি আইসিইউ থেকে বের হয়ে সম্পার ছেলেমেয়েদের পাশে এসে দাঁড়ালাম।

পালক খসা পাখির কষ্ট আর কতটা হতে পারে। মা হারানোর বেদনার শোক সামলে উঠা খুব কঠিন।মাহিন মৌমিতা আর মামুনের জীবনের আলোকোজ্জল ঝলমলে দিনগুলি মায়ের মৃত্যুর শোকে অন্ধকারে ঢেকে যেতে চাইছে।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে প্রিয়বন্ধুর প্রিয়মানুষ গুলির পাশে আশ্বাসের হাত ভালবাসার হাত আমার বাড়িয়ে দেওয়া উচিত, যেন কোন অন্ধকার ওদের গ্রাস না করে।

বন্ধুত্ব আর ভালবাসা বহমান জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।একটি বন্ধুত্ব জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারে,দিতে পারে স্বর্গীয় অনুভব।বন্ধুত্ব যেন রঙধনুর সাত রঙ্গে জীবনকে রাঙ্গিয়ে দেয়।আমি সম্পা আর জাহিদের বন্ধুত্বের চারাগাছটা ভালবাসার যত্নে আজ যেন মহীরুহে পরিনত হয়েছে তাই জাহিদ আর সম্পার এই দুঃসময়ে আমার বুকের পাঁজরটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে।
আমি মৌমিতা আর মামুনের জন্য খাবার কিনে আনলাম। ওদেরকে খেতে বললাম,ওরা খেতে রাজী হলো না।আমি ওদেরকে বললাম,
—–প্রিয়জন হারানোর কষ্ট সবার জন্যই বড় বেদনার। বিশেষ করে যে মানুষ গুলো আমাদের জীবনের বড় অংশ দখল করে থাকে। তাদের হারানোর ব্যথা সবাইকে উপলব্ধি করানো যায় না।প্রিয়জন হতে গেলে রক্তের সম্পর্কের প্রয়োজন হয় না। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও কিছু মানুষ পৃথিবীতে অনেক প্রিয় হয়ে যায়। ওনাদের হারানোর ব্যথায় তখন পৃথিবীটা বড় অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই যশ খ্যাতি সবই মুল্যহীন হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে আমরা সবাই দুদিনের মেহমান। আমাদের জন্মই হয়েছে মৃত্যুকে বরন করে নেওয়ার জন্য। তবুও আমাদের বেঁচে থেকে আল্লাহপাকের আদেশকে মেনে নিয়ে ভালকাজ করে যেতে হবে। শেষ বিচারে এইসব দুঃখ কষ্ট বেদনা আর ভাল কাজের জন্য আল্লাহপাক আমাদের পুনরোত্থিত করে পুরুস্কৃত করবেন। ভাল কাজের জন্য ভাল পুরুস্কার মন্দ কাজের জন্য মন্দ পুরুস্কার। তোমরা খেয়ে নাও আল্লাহ পাক খুশী হবেন।

মাহিনকে ফোন দিলাম।
—-হ্যালো,মাহিন জাহিদের শরীর কেমন আছে?ডাক্তার কি বলেছে?
—-আন্টি ডাক্তার বলেছে,আব্বুর ইমিডিয়েট বাইপাস করাতে হবে।হার্টের অবস্থা খুব বেশী ভাল না।আপনি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বললে ভাল হয়।
আমি বললাম,
—–সে না হয় আমি বলবো। তবুও ডাক্তার যেটা ভাল মনে করে আমাদের সেটাই করা উচিত। তুমি জাহিদের কাছে থাকাে। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।
মাহিন বললো,
—-আন্টি আম্মুর শরীর খারাপের সংবাদ আমাদের আত্মীয় স্বজনকে জানিয়েছি। আপনার তো চেম্বার আছে।ওরা চলে আসবে। মৌমিতা আর মামুন তো আছে।আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট করেন।
আমি বললাম,
—-ঠিক আছে। যাওয়ার পথে তোমার বাবাকে দেখে যাবো।
মামুন আর মৌমিতার খাওয়া শেষ হলে ওদের কাছে
বিদায় নিয়ে আমি চেম্বারে যাওয়ার পথে জাহিদকে দেখতে হাসপাতালে যাই।কেবিনে ঢুকে দেখি বাবা ছেলে বিমর্ষ বদনে বসে আছে।আমি জাহিদকে বলি,
—–কেমন আছো জাহিদ?
জাহিদ বললো,
—–ভাল আছি।তোমাকে সময়ে অসময়ে আমি বিরক্ত করছি।তুমি কিছু মনে করো না। (কান্না বিজড়িত গলায়)আসলে তোমার মতো সুহৃদ আমার কেউ নাই।
আমি বললাম,
—–জাহিদ তুমি এভাবে বললে আমি কষ্ট পাবো আর ভাববো,তুমি আমাকে এখনও সত্যিকারের সুহৃদ ভাবতে পারো নাই।আমিও তো তোমাকে আর সম্পাকে সময় অসময়ে কত ডেকেছি।তোমরাও তো সাড়া দিয়ে ছুটে এসেছো।তোমাদের সাথে আমার পনেরো বছরের বন্ধুত্ব।এখনও এই ফর্মালিটিস গুলো আমাদের মাঝে থাকা উচিত না। এখন তুমি শুধু তোমার নিজের সুস্থতা নিয়ে ভাববে। জগতের আর কোনকিছু নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
জাহিদ আবার বলে,
—- সারাহ্ সম্পা বেঁচে ফিরবে তো?
আমি বললাম,
—–বাঁচা মরা আল্লাহপাকের হাতে।আল্লাহ যার যতদিন আয়ু নির্ধারণ করেছেন তার একদিনও বেশী কেউ বাঁচতে পারবে না।তবে আমরা সবাই যেন ঈমান নিয়ে শেষ যাত্রায় রওয়ানা হতে পারি সবসময় আল্লাহপাকের কাছে আমাদের এই মোনাজাত করা উচিত।
জাহিদ বলে,
—-ডাক্তার বলেছে আমার বাইপাস করাতে হবে।আমার বাইপাসের খরচ ওদিকে সম্পার আইসিইউ এর খরচ।মাহিন কিভাবে এতো কিছু সামলাবে বুঝতে পারছি না।আমি তো আজকে কতদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি।
আমি বললাম,
—–জাহিদ এই পৃথিবীতে কারো জন্য কোনকিছু থেমে থাকে না।আল্লাহ পাক সময়মতো সবকিছু ঠিক করে দেন।শুধু মানুষকে ধৈর্য ধরে সময়ের সাথে অপেক্ষা করতে হয়।
আমি মাহিনকে সাথে নিয়ে জাহিদের কেবিন থেকে বের হয়ে আসলাম।মাহিনকে বললাম,
—–তোমাকে শক্ত হতে হবে।তোমার মার শারীরিক কন্ডিশন ভাল না।যে কোন মূহুর্তে যে কারোও জীবনে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।এই জন্য সবার প্রস্তুত থাকা উচিত।পাশাপাশি তোমার বাবার বাইপাসের ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করো।টাকা নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আমি মাহিনের কাছে বিদায় নিয়ে চেম্বারে চলে আসি। আজকে রোগী দেখতে মন চাচ্ছিলো না।রোগী দেখার কোনও মুড নেই। তারপরও দেখতে হবে কারণ এটা যে মানুষের জীবন মরণের ব্যাপার।সবাই ভাবে রোগী দেখলেই তো ডাক্তাররা টাকা পায়।কিন্তু সবসময় ইচ্ছে করে না। আমরাও রক্ত মাংসের মানুষ। তারপরও ভাল না লাগলেও মানবিকতার দাবিতে ভালবেসে আমরাও রোগী দেখি। খুব তাড়াতাড়ি রোগী দেখা শেষ করে সন্ধার পর বাসায় চলে আসি। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সারাদিনের সব ক্লান্তিকে মুছে ফেলি।

এশার নামাজ পড়ে নিলাম।চোখে ঘুম আসছে না। তারপরও বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি।একসময় চোখদুটো ঘুমে জড়িয়ে গেলো। স্বপ্নে দেখলাম আকাশের জ্বলজ্বলে নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে একটি নক্ষত্র পৃথিবীতে ছিটকে পড়লো।এমন সময় আমারো ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ফজরের আযান শুরু হলো। মোবাইলটাও বেজে উঠলো। স্ক্রীনে মাহিনের নামটা ভেসে উঠলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here