দ্বিতীয় বিয়ে পর্ব-সাত

0
235

#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-সাত
মাহাবুবা বিথী

কিছু কিছু রাত অনেক দীর্ঘ মনে হয়। সম্পার চিন্তায় কোনরকমে রাতটা পার হয়ে যায়।খুব ভোরে আমি মাহিনকে ফোন দিয়ে জানতে পারি সম্পার কেমো দেওয়া শুরু হয়েছে।খুব চিন্তা হচ্ছে,
সম্পা এই ধকল সইতে পারবে তো?
আমার একজন পেশেন্টের সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।ওর বেবি ডেলিভারী আমার হাতে হয়েছে।বাচ্চাটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি।জন্মের পর পর বাচ্চাটা কাঁদেনি।অনেকক্ষণ পরে কেঁদে উঠেছে।ওর বাচ্চার ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।
নাস্তা সেরে খুব সকালে আমি হাসপাতালে পৌছে যাই।আমার ঐ পেশেন্টের নাম মিনারা বেগম।আমি ওকে আমার চেম্বারে ডেকে নেই,
—–আসসালামু আলাই কুম, মিনারা কেমন আছেন।
মিনারা বলে,
—–ওয়া আলাই কুমুস সালাম।আপা আমি ভালো আছি।তবে ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।আপা আমার মনে হয় আর সংসার করা হবে না।কারণ আমার স্বামীর কাছে আমার বাচ্চা নিরাপদ না। ওর নারী ঘটিত সমস্যা থাকা সত্বেও ছেলের কথা চিন্তা করে আমি এতোদিন ওর সাথে সংসার করেছি।কিছুদিন আগে ও আমাকে আর আমার ছেলেটাকে নিয়ে মার্কেটে ঘুরতে যায়।আমার কাছে থেকে ছেলেটাকে নিয়ে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়।এর মধ্যে একবার ছেলেটার ঘুমের সময়ে ওর মুখে বালিশ চাপা দেয়।আমি সবসময় বাচ্চাটাকে চোখে চোখে রাখি।কতক্ষণ এভাবে দেখে রাখা যায়।আমার স্বামী চায় না ও বেঁচে থাকুক।আমি তো মা। আমি পারবো আমার এই সন্তানকে নিয়ে সারাজীবন পার করতে।ওকে ডাক্তার দেখিয়েছি।ডাক্তার বলেছে ও স্পেশাল চাইল্ড।আপনার কাছে এসেছি আমার ছেলের জন্য একজন ভালো ডাক্তারের খোঁজ পাওয়ার জন্য।আমার বাবা মা ভাইবোন সবাই আমার পাশে আছে।

মিনারার কথা শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।এই ডাক্তারী পেশায় থাকার কারনে কত রকম মানুষের সন্ধান পাই।সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনায় ভরা মানুষের জীবনের কাহিনী শুনি।আমি মিনারাকে স্পেশাল চাইল্ডের জন্য একজন ভালো ডাক্তারের ঠিকানা দিয়ে ওকে বিদায় করে দিলাম।

গাইনোকোলজিস্ট হিসাবে আমি আমার ক্যারিয়ার গড়েছি।আসলে এর সাথে আমার একটা উদ্দেশ্য
জড়িত।আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারি একটা নারীর জীবনে সন্তান কতটা পূর্ণতা এনে দেয়।তাই আমার নিঃসন্তান দম্পতি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে হয়।বাংলাদেশে দশ বছরের গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রতি ৮ জনে একজন দম্পতি নিঃসন্তান।এই ক্ষেত্রে অনেক সময় পুরুষরাও দায়ী থাকে।কিন্তু সম্পূর্ণ দায় চাপানো হয় মেয়েদের উপর।আমি এসব নানাবিধ কারনে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের উপর কাজ করতে আগ্রহ পাই।আমাদের দেশে এই বিষয়ের উপরে এখনও কোন কোর্স চালু হয়নি।আমি দেশের বাইরে থেকে ফার্টিলিটির উপরে কোর্স করে আসি।দেশে এসে বেশ কয়েকজন নিঃসন্তান দম্পতির উপর কাজ করে সফলতা পাই।আমার হাসপাতালে ইনফার্টিলিটি সেন্টার খোলা হয়।সেই সেন্টারে ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমি কাজ করছি।

আমার চেম্বারে এক পেশেন্ট আসলো।ওর নাম তানিয়া।ওর হাসবেন্ড ও একজন ডাক্তার।একটা মেডিকেল কলেজে প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত।
—আসসালামু আলাইকুম।
আমি বললাম,
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।আপনার সমস্যার কথা বলুন।
তানিয়া বললো,
—-আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর।সন্তানের মা হতে পারিনি।অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। আমার কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি।তারপরও মা হতে পারলাম না।এটা নিয়ে সংসারে নিত্য অশান্তি চলতে থাকে।প্রতিদিন শুনতে হয় আমি বাঁজা মেয়েলোক।শ্বশুর বাড়ির সবাই আমার কাঁধে দোষ দেয়।কিছুদিনের মধ্যে যদি আমি কনসিভ না করি তাহলে আমার শাশুড়ী ওনার ছেলের আবার বিয়ে দিবেন।আমি আমার বাবা মার একমাত্র সন্তান।আর এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে।আমি আমার সংসারটা ভাঙ্গতে চাই না।অবশ্য আমার হাসবেন্ড এরও দ্বিতীয় স্ত্রী আমি।প্রথম স্ত্রীর বেবি না হওয়ার জন্য ও ডিভোর্স দিয়েছে।আমার সাথে ওর বারো বছরের সংসার জীবন।বাচ্চা না হওয়ার জন্য আমাকে ও এখনও তেমন কিছু বলে না।কিন্তু আমার শাশুড়ী আর অপেক্ষা করতে চায় না।আমার বয়সটা বেড়ে যাচ্ছে।একটা বাচ্চার জন্য আমারও মনের ভিতরে হাহাকার করে।

আমি ওকে বললাম
—এ ক্ষেত্রে আপনার স্বামীকে সাথে আনা উচিত ছিলো।আপনার স্বামী কখনও নিজের পরীক্ষা করেছে।
তানিয়া বললো,
—-আমি ওকে টেস্ট করার কথা বলছিলাম।ও আমাকে বললো, “ও যেহেতু ডাক্তার তাই ওর শরীর সম্পর্কে ও জানে। ওর কোনো সমস্যা নাই”।
আমি বললাম,
—এটাতো মুর্খের মতো কথা হলো।ডাক্তার বলেই তো রিপোর্ট লাগবে। কাগজে কলমে ভেরিফাই করতে হবে। মুখে বললে হবে না।আর প্রথম স্ত্রীকে বেবি না হওয়ার জন্য আপনার স্বামী দুবছরের মধ্যে ডিভোর্স দিলো।আর আপনার সাথে বারো বছর কাটানোর পরও আপনাকে আপনার হাসবেন্ড এখনও কিছু বলেনি।এটা তো সন্দেহজনক।হয়ত ওনার সমস্যা আছে উনি জানে,কিন্তু আপনাকে জানায়নি। ওনাকে আপনার সাথে আনা উচিত ছিলো।কারণ এই বিষয়ে ওনার সাথেও আমার কথা বলতে হবে।
তানিয়া বললো,
—-ও,খুব ব্যস্ত থাকে। তাই আসতে পারেনি।এরপরে ওকে সাথে আনবো।
আমি বললাম(কৌতূহলে)
—-আপনার হাসবেন্ডের নাম কি?
তানিয়া বললো,
—-ডাঃ সারোয়ার আহমেদ পলাশ
(আমার চমকে উঠার পালা)আমি বললাম
—-আপনার হাসবেন্ড জানে,আপনি আমার কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন।
তানিয়া বললো,
—-আমি ডাক্তারের কাছে আসবো, এটা জানে।কিন্তু কোন ডাক্তার দেখাবো সেটা জানে না।
আমি ওকে কিছু টেস্ট করাতে বললাম এবং ওর হাসবেন্ডের কিছু টেস্ট লিখে দিলাম।রিপোর্ট নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে বলে বিদেয় দিলাম।

মানুষ বুঝি এভাবেই তার কর্মের ফল ভোগ করে।আমি আসলেই পলাশকে খুব ভালবেসেছিলাম।প্রথম দেখাতেই ওর প্রতি অদ্ভূত ভাললাগা কাজ করছিলো। যাকে বলা হয়” love at first sight”প্রথম দেখাতেই ভাললাগা শুরু।ওর সাথে স্টুডেন্ট অবস্থায় রাতে যখন কথা বলা শুরু করতাম রাত কখন পার হয়ে যেতো টের পেতাম না। ওকে অনেক ভালবাসতাম তাই বাবা মার নিষেধ অমান্য করেও ওকে বিয়ে করেছিলাম। অথচ ও আমাকে ততটাই আঘাত করলো।নিজ থেকে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো।অথচ আমার কোন দোষ ছিলো না। সন্তান না হওয়াটাকে আমার দোষ হিসাবে ধরে নিলো।আর সাংসারিক জীবনে আমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে নয় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গ্রহন করেছিলো তাই আমি আঘাত পেলে কষ্টের বদলে ও আনন্দ পেতো। কিছু কিছু মানুষের খাছলোত কখনও পরিবর্তন হয় না।কুকুরের লেজ ঘি দিয়ে মর্দন করলেও কখনও সোজা হয় না।পলাশদের বাড়ির অবস্থাটা অনেকট সেরকম।এই বউটার উপরেও মানসিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।

কথায় আছে,”অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেকেও পড়তে হয়”।ভাগ্য আজ পলাশকে নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।ওর স্ত্রীর আগের রিপোর্ট দেখে যতটুকু বুঝেছি ওর ওয়াইফের সেরকম গুরুতর সমস্যা নেই।

মোবাইলটা বেজে উঠলো।ফোনের স্ক্রীনে মাহিনের নাম ভেসে উঠল।
—হ্যালো আন্টি কেমো দেওয়ার পর আম্মুর শরীর হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেলো।পালস রেট অনেক কমে গিয়েছিলো।আম্মুকে আই সিইউতে নেওয়া হয়েছে।আমার খুব টেনশন হচ্ছে।এদিকে আব্বুর বুকে আবারও ব্যথা শুরু হয়েছে।আমার মাথা কোন কাজ করছে না।
আমি বললাম,
—-তুমি এতো টেনশন করো না।জাহিদের শরীর বেশী খারাপ করলে তুমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাও।আমি সম্পার কাছে আসছি।মৌমিতাকে সম্পার কাছে থাকতে বলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here