#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-ছয়
মাহাবুবা বিথী
বছর খানিক পর সম্পার শরীর আবার খারাপ হতে থাকে।ওর বড় ছেলে মাহিন সেদিন আমার চেম্বারে এসেছিলো।ওকে খুব চিন্তিত ও বিমর্ষ মনে হলো।ও আমাকে বললো,
—-আন্টি, ডাক্তার আমায় বলেছিলো ক্যান্সার কোনদিন পুরোপুরি নির্মুল হয় না। আবার ফিরে আসার চান্স থাকে। আমার মায়ের ক্ষেত্রেও এই সম্ভাবনা রয়েছে।সেদিন মাকে ডাক্তার দেখালাম।ডাক্তার এরকমটাই সন্দেহ করছে।কিছু টেস্ট দিয়েছে।রিপোর্ট দেখে এরপর কেমো দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে।
আমি ওকে বললাম,
—-তোমার মা জানে?
মাহিন বললো,
—-মাকে বলিনি।কারণ যদি মার মনোবল ভেঙ্গে যায়।অসুখের সাথে লড়াই করতে গেলে মনোবল দরকার।
মাহিন চলে যাবার পর আমার মনে হলো,সম্পা মনে হয় ওর শরীর সম্পর্কে ডাক্তারের তথ্য গুলো যে ভাবেই হোক জেনে গেছে।সেই কারনে হয়ত আমাকে জাহিদকে বিয়ে করতে বলেছে।মেয়েরা সব পারে নিজের স্বামীর ভাগ স্বেচ্ছায় কাউকে দিতেপারে না।ওর শারীরিক কন্ডিশনে অসহায় হয়ে আমার হাতে ওর সংসার তুলে দিয়ে হয়ত ভারমুক্ত হতে চাইছে।
সেদিন রাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি রাত চারটা বাজে।মাহিন ফোন দিয়েছে।
—-একটু থমথমে গলায় মাহিন বললো,আন্টি মার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ করেছে। ইউরিনের সাথে অনেক রক্ত গিয়েছে।নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়েছে। আমি আর আব্বু মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি।আপনি সকালে এসে মাকে একটু দেখে যাবেন।
আমি বললাম,
—মাহিন টেনশন করো না। আমি যাবো।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
একটু পরে ফজরের আযান হলো।আমি নামাজ পড়ে ওটস দুধ আর কলা দিয়ে নাস্তা করে নিলাম।ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বললাম।
ড্রাইভার চলে আসার পর সম্পাকে দেখতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।মিরপুর স্পেশালাইজড হাসপাতালে সম্পাকে ভর্তি করা হয়েছে।সকালে রাস্তাটা বেশ ফাঁকাই ছিলো।ধানমন্ডি থেকে কল্যানপুর খুব দ্রুত পৌঁছে গেলাম।
সম্পাকে কেবিনে রাখা হয়েছে।ওর শরীরে রক্ত কম।ওকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। মৌমিতা আর মামুনও ওদের মায়ের পাশে বসে আছে। আমাকে দেখে সম্পা খুব খুশী হলো।তারপর বিমর্ষ মুখে বললো,
—-জানো সারাহ্ মারণ রোগটা আমার সংসারে অশরীরির মত ছায়া ফেলেছে।মাঝে মাঝে ও আমার শরীরে ঘুণ পোকার মতো রুপ ধারণ করে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অশরীরির নখের আঁচড়ে আমার আত্মাটা ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে।আত্মাটা এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়।কিন্তু সারাহ্ আমার এতো যত্নে গড়া সাজানো সংসার ফেলে যেতে ইচ্ছে হয় না।আর আমার এই রোগটার কারনে সংসার থেকে সুখটা হারিয়ে যাচ্ছে।নিজের থেকে নিজেই যেন আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছি।এই মরণব্যাধি আমার শরীরের সমস্ত কোষ দখল করে নিচ্ছে।অনেকে বলে ক্যান্সার রোগী নিজেও মরে আর তার পরিবারকেও ধনে মেরে যায়।আমি যেন মৃত্যুর অন্তহীন গন্তব্যর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
ও আরো বলে,
আমার আপনজনেরা কান্না লুকিয়ে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।তাই বলে হৃদয়ের কান্না কি লুকানো যায়।মৃত্যুর ছায়া আমাকে প্রতিমূহুর্তে বিবর্ণ করে দিচ্ছে।
জানো সারাহ্ এখন কিভাবে দিন আসে রাত পার হয়ে যায় আবার ভোর হয়, সকালের সোনালি আলোয় পুরো পৃথিবী হেসে উঠে।এই অনুভূতিগুলো আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে।সারাহ্ তুমি তো ডাক্তার, বলনা কেন এভাবে ভালবাসাগুলো এই মরণ ব্যাধির কাছে হার মেনে যায়।মৌমিতা আর মামুনও কেঁদে ফেলে।
জাহিদ চোখের জল লুকাতে কেবিনের বাইরে চলে গেল।আমার চোখ দুটিও নোনা জলে ভরে উঠলো।
ক্যান্সার শুধু রোগীর কোষকেই হানা দেয় না।রোগীর পরিবারের সদস্যদের জীবনেও নির্মমভাবে হানা দেয়। চোখের সামনে আপনজনকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে দেখার মতো নৃশংস ভয়াবহতা আর কিছু নেই।ক্যান্সার রোগীদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষেত্রে গভীর ক্ষত তৈরী হয়।তাই ওদের লড়াইয়ে শারীরিক ও মানসিক এর সাথে আরোও কিছু দরকার হয়। একজন ডাক্তার হিসাবে জানি রোগী ও রোগীর পরিবার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কতটা মর্মঘাতী লড়াই চালিয়ে যায়।ক্যান্সারকে জয় করার সৌভাগ্য সবার হয় না।
আমার আসলে সম্পাকে সান্তনা দেওয়ার কোন ভাষা নেই।তবুও ডাক্তার হিসাবে ওকে বলি,
—-ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মৌমিতাকে বললাম,
—–ইন্টার্ণি শেষ করে আমার চেম্বারে জয়েন করতে পারো যদি তোমার ইচ্ছে হয়।
মৌমিতা বললো,
—-আন্টি ভাবছি বিসিএস দিব।
আমি বললাম,
—-খুব ভাল সিদ্ধান্ত। জীবনের যে কোন পরিস্থিতি সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।এটাই বেঁচে থাকার নিয়তি।
এরপর মামুনকে বললাম,
—-তুমি বুয়েট থেকে কবে বের হবে?
ও বললো,
—–আন্টি, করোনার কারনে আমাদের সেশনজট হয়েছে।তাই একটু সময় লাগবে।
ঠিক আছে তোমরা ভাল থাক।মায়ের যত্ন নাও।
আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে দেখি জাহিদ চোখের জল লুকিয়ে ফেলছে।আমি জাহিদের কাছে আসতেই জাহিদ নিজেকে সামলাতে পারলো না।ডুঁকরে কেঁদে উঠে আমাকে বললো,
—সারাহ্ ও মনে হয় আর বাঁচবে না।
আমি জাহিদকে বললাম,
—-তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়োনা।তাহলে তোমার বাচ্চাদের কে সামলাবে।হায়াত মউতের মালিক আল্লাহ। কে কতদিন বাঁচবে তা একমাত্র আল্লাহপাক নির্ধারণ করেন।
জাহিদ বলে
—-সারাহ্ সম্পা আজ একটা স্বপ্নের কথা বলেছে।সেটা শোনার পর আমার মনোবলটা হারিয়ে যাচ্ছে।ও স্বপ্নে একটা কবর দেখেছে।ও কাছে গিয়ে দেখে ঐ কবরটায় ও শুয়ে আছে।
আমি জাহিদকে বলি,
—আল্লাহকে ডাকো।আল্লাহপাক শ্রেষ্ট ফয়সালা করে দেন।
আমি ওদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি।আমারও মনটা খুব খারাপ। যদিও ডাক্তার হিসাবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই তারপরও সম্পা আমার বন্ধু।আমার সুহৃদ।আমার আত্মার আত্মীয়।অনেক স্মৃতি ওর সাথে জড়িয়ে আছে। যখনি কোনো বিপদে পড়েছি ও আর জাহিদ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
হাসপাতাল থেকে আমি দ্রুত বাসায় চলে আসি।লাঞ্চ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি।অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠার কারনে মাথাটা ধরে আছে।
ঘুম তেমন হলো না।আসরের নামাজ পড়ে হাসপাতালে ফোন দিয়ে সম্পার খোঁজ নেই।মাহিনের সাথে কথা হলো। ওকে দ্রুত কেমো দেওয়া শুরু করবে।কারণ ক্যান্সার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।কিন্তু সম্পা এই ধাক্কাটা সামলাতে পারবে কিনা এটা নিয়ে ডাক্তারের সংশয় রয়েছে।
আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।বাস্তবতার সামনে আবেগ বড়ই বেমানান।এই যান্ত্রিক জীবনে কেউ কারো পাশে থাকতে পারে না।কিন্তু আমার এই পরীক্ষিত বন্ধু পরিবার আমাকে এ অবধি বুক দিয়ে আগলে রেখেছে।
বন্ধুত্ব শুধু একটা সম্পর্ক নয়।সুখে দুঃখে পাশে থাকার নিরব প্রতিশ্রুতি।বন্ধুত্বের সম্পর্ক যতই পুরোনো হয় এই বন্ধন ততই মজবুত হয়।তাই সম্পার এই অসুস্থতা ওর পরিবারের অসহায়ত্ব আমাকেও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।বুকের গভীরে একরাশ শুন্যতা গ্রাস করছে।
নিশ্চিত মৃত্যুর পৃথিবীতে কিছু কিছু মৃত্যু হৃদয়ের মাঝে গভীর দাগ ফেলে যায়।সারাজীবন এই যন্ত্রণার দাগ বয়ে বেড়াতে হয়।
চলবে