এল_এ_ডেইস পর্ব ৬

0
223

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৬
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

সবেমাত্র তীব্র শব্দে সেই ঘন্টা বাজল যা জানান দিচ্ছে জিওগ্রাফি ক্লাস সমাপ্ত। প্রতিটা কক্ষে ছেলেমেয়েরা হইচই শুরু করে দিলো। মনে হলো যেন বন্ধ সাউন্ড বক্সে হঠাৎ করেই কেউ হেভি মেটাল রক মিউজিক উচ্চশব্দে চালু করে দিয়েছে। ক্লাস শেষ হতেই মাহীন ও সাইলোহ লকার ওয়ালা করিডরে এসে পৌঁছেছে। আরোও অনেকেই এখানে এসে ভির করছে। মেটালের চকচকে রুপালী লকারের দরজাগুলো খোলা ও বন্ধ করার ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে। নায়েল কলিমোরও লকারের কাছে এসে ওদের সাথে যোগ দিল। মাহীন নিজের ব্যাগে বইখাতা গুছিয়ে রাখছে এমন সময় নায়েল নিজের লকারের দরজায় চাবি লাগিয়ে বলল,

“কি খবর জেনেট আজকেও সুস্থ হয়নি?”

সাইলোহ বলল, “ধ্যৎ তোমার স্মৃতি শক্তি বোধহয় পুরোই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভুলে গেছ আজকে লিওর নেভাডা ট্রিপ থেকে ফিরে আসার কথা? তাই জেনেট ওকে না নিতে গিয়ে ক্লাসে আসবে এটা হতেই পারে না।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল,”লিও কে?”

নায়েল বলল,”আমাদের খুব ছোট বেলার বন্ধু।”

“তাহলে তোমরা ওকে নিতে গেলে না যে?”

সাইলোহ বলল, “আমাদের শুধু বন্ধু। বন্ধুকে এত কে এরায়পোর্ট থেকে একদম নিতে চলে যায়? আর জেনেট গেছে কারণ লিও ওর বয়ফ্রেন্ড হয়।”

মাহীন এতক্ষণে বুঝতে পারল মূল ঘটনা। বলল,

“তাহলে সেদিন ও ইভেন্ট সম্পর্কে ওর যে স্মরণীয় কাহিনী আছে বলছিল, সেটাই এই কাহিনী? কিন্তু ম্যাক্সিকান কাহিনী বলেছিলা যে?”

সাইলোহ বলল, “মানে লিও হচ্ছে হাফ ম্যাক্সিকান হাফ আমেরিকান। তাই এমন বলেছিলাম।”

মাহীন উপরে নিচে মাথা নাড়ল। তখনই পকেটে মাহীনের সেল ফোনটা ভাইব্রেট হতে লাগল। বের করে হাতে নিতেই দেখে স্ক্রিনে লেখা আছে, ডিস্টার্বার। নামটা দেখেই বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল। নায়েল ওর ফোনে উকি দিয়ে হেসে বলল,

“বাহ কি নাম ডিস্টার্বার কল দিচ্ছে।”

ওরা তিনজন এই কোলাহলের মাঝেই লকারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাইলোহ হেসে বলল,”ডিস্টার্বার নাম কেন দিয়েছ?”

মাহীন বলল, “সর্বদা অসময় ফোন দেয়, অথবা বলতে পারো যখনই কল দিক না কেন আমার ভালো লাগে না ওর সাথে কথা বলতে। আমি খুব ডিস্টার্ব হই, তাই এই নামে সেভ করে রেখেছি।”

তখনই নিঃশব্দে ওদের সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সামনে দাঁড়াল রায়েদ। সাইলোহ ও নায়েল তো যেন ওকে দেখে চমকে উঠল। মাহীন খুব একটা অবাক হলো না। কারণ ও আশা করছিল আর্টিকেলের বিষয়বস্তুর কথা জানা মাত্র রায়েদ ওকে হারিকেন দিয়ে খোঁজা শুরু করবে। চারিদিকে উপস্থিত সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে এদিকেই চেয়ে আছে। রায়েদ কঠোর গলায় বলল,

“লাঞ্চ আওয়ারে দেখা করো। কথা আছে।”

বলেই পেছন ঘুরে কিছুটা ধীর পদক্ষেপে পা টিপে টিপে হেঁটে যেতে লাগল। অনেকে বুঝতে পারল না ও কাকে এই কথাটা বললো। কারণ রায়েদ সরাসরি সাইলোহ, নায়েল ও মাহীনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবং এটাও বলে যায়নি কোথায় দেখা করতে হবে। তবে সবাই জানে কোথায় দেখা করতে হবে। সাইলোহ মাহীনের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আচ্ছা চলো আমি তোমাদের সব ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলছি।”

তারপর ব্যাগ কাধে নিয়ে ধীর গতিতে হাঁটতে লাগল। প্রথমে মাহীন র‌্যবিটকে ভিজিয়ে দেওয়ার কাহিনী টা শোনাল। ফলে দেখা গেল সাইলোহ ও নায়েলের জন্য হাসতে হাসতে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাহীন স্মিত হেসে বলল,

“কিছু হাসি বাঁচিয়ে রাখো। গতকালের ঘটনা এখনো বাকি আছে।” এরপর ও মনিটরের ঘটনাটা খুলে বলল। ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নায়েল ও সাইলোর চোখ ছানাবড়া হয়ে থাকল। ওদের চেহারা দেখে মাহীনের বলতে গিয়ে বারবার হাসি পাচ্ছিল। নায়েল বলল,

“একমিনিট আমি এটা বুঝলাম না, প্রথম দিন এসেই তুমি চিন্তা না জানতেও না এমন একজনের ভিডিও কেন করলা?”

মাহীন শ্রাগ করে বলল, “আমার ওকে দেখেই মনে হয়েছিল ও এক নম্বর ধড়িবাজ। তাই একটা প্রমাণ হাতে রাখলাম কখনো না কখনো কাজে লাগতে পারে ভেবে।”

সাইলোহ খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, “ইশ এখন আর মনিটরের অক্ষরে অক্ষরে আদেশ পালন করতে হবে না। বরং আমরা ওকে আমাদের কথা মতো চালাতে পারব।”

নায়েল বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, এবার তাড়াতাড়ি বলো রায়েদ মাদির ঘটনা টা কি? তুমি ওর সাথে কিভাবে জড়িয়ে গেলা?”

মাহীন বলল, “আসলে ও আমার ইভেন্ট পার্টনার।”

ওদের দুজনের মুখেই বিস্ময় স্থান নিল। সাইলোহ বিস্ময়ান্বিত কন্ঠে বলল, “আর তুমি এখনো ইভেন্টে আছ!”
মাহীন ভাবলেশহীন মুখে বললো,”অবশ্যই।” ওর যেন একই কথা শুনতে শুনতে ইতোমধ্যেই অভ্যেস হয়ে গেছে।

সাইলোহ বলল, “একমিনিট তুমি ঠিকঠাক সব খুলে বলো।”
মাহীন ঘটনাটা বিস্তারিত বলার পর নায়েল ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,
“এই তুমি সাথে সাথে মসলা পাতি নিয়ে ঘোরো কেন বলোতো? আর তোমার সাহস কি, রায়েদের কফিতে লবণ ঢেলেছ। অন্য কাউকে বললে এটা তারা বিশ্বাসই করবে না।”

মাহীন মুখ টিপে হাসল। বলল, “মসলা পাতি তো নিরাপত্তার জন্য নিয়ে ঘুরি। আর ও যখন কফিটা অবশেষে খেয়েছে। আমাকে তেমন ভাবে কিছু বলার আগেই আমি কথা ঘুরিয়ে সেখান থেকে কেটে পরি।”

সাইলোহ এখনো হা করেই চেয়ে আছে।কি বলবে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না।

মাহীন বলল, “আর মিসেস রে এতটা স্নেহের সঙ্গে রায়েদের সাথে কথা বললেন, যে আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”

সাইলোহ এবার মুখ বাঁকা করে বলল,”ধ্যৎ বাজে একটা মহিলা। স্কুলের সবচাইতে খারাপ ছেলে রায়েদ মাদিহ। আর মহিলার দুনিয়ার সকল ছেলে – মেয়েকে মিচকা শয়তান লাগে এবং একলা রায়েদকে ধোঁয়া তুলসি পাতা লাগে। ওর জন্য কি যে দরদ উতলে পরে আহা দেখলে গা জ্বলে।”

মাহীন হাসি এবং কান্নার মাঝামাঝি একটা মুখভঙ্গি করে রাখল কারণ ও বুঝতেই পারছে না এই কথা শুনে হাসা উচিৎ নাকি কাঁদা উচিৎ।

নায়েল বলল, “এই সবগুলোর এই একটাই সমস্যা। ডেক্সটার মনিটর এত ভাব নিয়ে চলে কারণ ওর মা আমাদের টিচার। এবং রায়েদ মাদিহ এমনি এমনি কাউকে জ্বালায় না ঠিকই। কিন্তু ওর এত দেমাক হওয়ার কারণ বলা যায় মিসেস রেকে।”

ওরা দুই তলার খোলা করিডোরের প্রসস্থ কনক্রিটের রেলিঙের ওপর উঠে বসেছে। মাহীন বলল,
“আচ্ছা আগে এটা বলো রায়েদ মাদির সমস্যাটা কেথায়? এমন করে কেন ও?”

সাইলোহ বলল, “কারণ ও এমনই। সমস্যা আবার কি থাকবে।”

মাহীন বলল, “আমি মাত্র একবার কথা বলে যতটুকু বুঝেছি তা হলো, একটা মানুষ মন থেকে খারাপ হলে তার আচরণ অতটাই খারাপ হতো। তবে ও নিজেকে সবার সামনে খারাপ হিসেবেই উপস্থাপন করার জন্য ইচ্ছা করেই এমন আচরণ করে। ” বলে একমুহূর্ত থামল তারপর আবার বলল,”তবে একথা বলতে হবে এই ছেলের অহংকার বড্ড বেশি।”

নায়েল বলল,”তাই বলে টানা বছরের পর বছর ধরে মানুষ শুধু তেমনই অভিনয় করে যাবে যেমনটা সে আসলে নয়? এটা কি সম্ভব? আর প্রতিটা মানুষ চায় ভালো হতে। সকলের সামনে নিজেকে ভালো হিসেবে উপস্থাপন করতে। সেখানে কেন কেউ নিজেকে ইচ্ছে করে খারাপ হিসেবে দেখাতে চাইবে।”

নায়েল থামতেই সাইলোহ বলল, “এবং শুধু মাত্র নিজেকে খারাপ হিসেবে দেখানোর জন্য তো আর কেউ নিজেকেই আঘাত করতে পারে না তাই বলে। তুমি তো নতুন এখানে তাই এখনো দেখোনি। গত বছর এবং তার আগের বছরও ওর বিল এবং ডেনিজের সঙ্গে মারামারি লেগে গিয়েছিল।’ বলে থামল সাইলোহ।

ততক্ষণাৎ নায়েল বলল, “আর অহংকার! সারাদিন বই খাতা নিয়ে বসে থাকে। ফলে সকল টিচারদের চোখের মধ্যমনি। রেজাল্টও ভালো করে। অহংকার থাকবে না।”

ওদের যুক্তি এই মুহূর্তে অকাট্য ঠেকল মাহীনের কাছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,

“তোমরা দুজনই যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছো। এবং আমি এটাও বলিনি যে ও ভালো মানুষ। শুধু এটা বলছিলাম যে ওর এমন হওয়ার পেছনে কি কোনো কারণ আছে?”

সাইলোহ রেলিঙের ওপর থেকে ধপ করে নিচে নেমে বলল, “কারোর খারাপ হতে হলে কারণ লাগে না। বিকৃত মস্তিষ্কই যথেষ্ট।”

তারপর নায়েল বলল,”যাই হোক। একটা কথা না বললেই নয়। মাহীন তোমাকে অনেক কুল লাগসে আমার। স্কুলে আসলা তিন দিনও পুরো হলো না এর মধ্যেই অসভ্য মনিটরটকে হাত করে ফেলসো। অভদ্র রায়েদকে কৌশলের সঙ্গে লবণাক্ত কফি খাইয়েছ। এবং ফাজিল ‌‌র‌্যবিটটাকে শায়েস্তা করেছ।”

সাইলোহ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, “একদম! আমি তো ওকে প্রথম দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম। মাইয়া সেই লেভেলের স্যাভেজ।” মাহীন হেসে উঠল ওদের কথায়।

লাঞ্চ ব্রেক শুরু হয়েছে সবেমাত্র। এবং মাহীন ইতোমধ্যেই লিম জু কে খুঁজে বের করেছে। লিম জু অসহায় কন্ঠে বলছে,
“দেখো আমার সাইকোলজি নিয়ে ধারণাই নেই। এখন মানলাম তোমার কথা যে তুমি গতকাল আমাকে ফোন করেছিলা ব্যপারটা সম্পর্কে মতামত নিতে। কিন্তু তবুও শুধু তুমি হলে একটা কথা ছিলো। রায়েদ মাদির সঙ্গে এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে যেটা নিয়ে আমি কিছুই জানি না। ব্যাপারটা ঠিক গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।”
মাহীন ও লিম জু ক্যাফেটেরিয়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
মাহীন বলল,
“আচ্ছা গতকাল কি তুমি আমার কল রিসিভ করেছিলা?”

লিম জু বলল, “রিসিভ করলে তো তুমি জানতেই পারতে। আমি তখন ফোনের কাছাকাছি ছিলাম না।”

মাহীন বলল, “আচ্ছা চলো আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।”
লিম জু প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো।
মাহীন আবার বলল,
“দেখো আমি তো জানি সাইকোলজি সম্পর্কে এটাই যথেষ্ট। এবং রায়েদ এ সম্পর্কে জানে কি না সে ব্যাপরে আমরা নিশ্চিত নই। তাছাড়া আমরা দুজন এবং ও একা। তাই তো বলছি যে আমি যদি একাই ওর সাথে তাল মিলিয়ে তর্কাতর্কি করতে পারি তাহলে তো তুমি থাকলে আরোও ভালো।”

লিম জু বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইল। মাহীন ওকে কথার কৌশলে ফেলে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ওরা চত্বরে রয়েছে। রোদের তেজ কিছুটা কম। বাতাসে আদ্রতাও কম। মাহীন বলল,

“আর ও তোমাকে কিছু বললে সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এবং হ্যা এরপরের কাজের সময়গুলো কিন্তু আমরা আমাদের সুবিধা অনুযায়ী ঠিক করবো।”

লিম জু ম্লান বলল, “না জানি তোমার পাল্লায় পরে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যাবো।”

মাহীন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “এসব নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকো তুমি। আর হ্যা আরেকটা জিনিস, ওর যেন ঘুনাক্ষরেও এটা না মনে হয় যে, আমরা ওর সাথে এই ইভেন্টে কাজ করার জন্য মরে যাচ্ছি। এমন একটা ভাব থাকবে আমাদের মাঝে যে, ইভেন্টে কাজ করতেই হবে এমন কোনো বালাই নেই আমাদের। ও বেশি গুঁইগাই করলে আমরাও কাজ করবো না।”

লিম জু সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। ওরা লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ে পৌঁছে গিয়েছে। তিনতলায় উঠে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। গতকালের মত আজও কোণার সেই টেবিল জুড়ে বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে রায়েদ মাদিহ। চোখে কালো ফ্রেমের চিকন চশমা। ওদের আসতে দেখে একবার মুখ তুলে চাইল। ওর স্থির দৃষ্টিতে স্পষ্ট গম্ভীরতা। আবার দৃষ্টি বইয়ের দিকে ফেরাল। মাহীন ওর সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরল। লিম জু প্রথমে দ্বিধান্বিত হয়ে একবার মাহীনের দিকে চাইল, একবার রায়েদের দিকে চাইল এবং একবার কাঠের চেয়ারের দিকে চাইল। তারপর মাহীনের পাশের চেয়ারে বসে পরল। রায়েদ সরাসরি মাহীনের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
“তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে ফোন দেওয়ার!”

মাহীন কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। হঠাৎ এমন ভাবে এই প্রশ্ন করবে তা আশার বাইরে ছিল। তবে ধাতস্থ হয়ে নিরুত্তাপ কন্ঠে বললো,
“আমার কোনো শখ ছিল না তোমাকে ফোন দেওয়ার। সেটা তো মিসেস রে এর কড়া নির্দেশ ছিল বিধায় বাধ্য হয়ে করেছিলাম।”

“এবং ভুল করেও আমার নম্বর যদি কাউকে দিয়েছো তাহলে ভালো হবে না। বলে দিলাম।” তীব্র কন্ঠে বলল রায়েদ।

মাহীন ভারি কন্ঠে বলল, “ফোন তো তুমি রিসিভ করোই নি তাহলে এত রেগে যাওয়ার কি আছে। সে যাই হোক একটা কথা বলি, তোমার নম্বর আমাদের স্কুলের সামনে যদি বিলবোর্ডেও সোভা পায় তবুও ভুল করেও কেউ তোমাকে ফোন দিবে না।” শেষের কথাটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল।

রায়েদ ভ্রু কুঞ্চিত করল। তারপর বলল, “দ্বিতীয় বার আর আমাকে কখনো ভুলেও ফোন দিবা না। মনে থাকে যেন।”

মাহীন সুর করে বলল, “ধরো আমি কোনো বিপদে পরেছি। এবং একমাত্র তোমার নম্বরটাই আমার মোবাইলে থাকলেও কখনো ফোন দিবো না। কথা দিলাম।”

লিম জু অপ্রতিভ ভাবে বলল, “আমার মনে হয় আমাদের আর্টিকেল নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল।”

রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “ওহ হ্যা সেটা তো আছেই। তুমি কি হিসেবে বিষয়বস্তু সাইকোলজি ও মেন্টাল হেলথ্ ডিসওর্ডার দিয়ে দিলা?”।

মাহীন বিদ্রুপ করে বলল, “সেটাই তো আমাকে জিজ্ঞেস করা তোমার মুখে সোভা পায় না রায়েদ। এক মিনিটেরও কম সময় পূর্বেই তুমি আমাকে কতগুলো কথা শুনিয়েছ একটা মাত্র ফোন কলের জন্য। এরপর তোমার যেন বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে সে জন্যেই তো কল করেছিলাম।”

রায়েদ বিরক্তি ভরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এবার শান্ত তবে ভারি কন্ঠে বললো,
“এখন তোমার মহামান্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে খুলে বলো।”

“কি খুলে বলবো? সাইকোলজি কিংবা মেন্টাল হেলথ্ নামটা শুনলেই সকলেই বুঝতে পারবে বিষয়টা কি।

” সাইকোলজি কি আমি সেটা জিজ্ঞেস করিনি। এই বিষয়টা নেওয়ার পেছনে যুক্তিটা কি এটাই ভালোয় ভালোয় জিজ্ঞেস করছি।” তিক্ত কন্ঠে বললো রায়েদ।

মাহীন মনে মনে ভাবলো, ‘আসলেই এখন পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কথা বলছে।’ তারপর ধীরস্থির ভাবে বলতে শুরু করল,
“তো শোনো, কারোর শারীরিক কোনো ক্ষতি হলে বা অসুস্থ থাকলে তো সেটা শুধু সে কেন সকলেরই চোখে পরে। তবে কেউ মানসিক ভাবে অসুস্থ থাকলে সেটা কারোও চোখে পরে না। এমনকি কোনো মানসিক ডিসওর্ডার হলে তো ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারে না। এবং ইউএসএ তে মানসিক রোগীর হার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মোতাবেক মানসিক সমস্যার দিক থেকে আমেরিকা বিশ্বের তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। তার কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশগত সমস্যা, জিনগত সমস্যা বা শারীরিক সমস্যা। এখন আমার যুক্তি হলো, আমাদের আশেপাশে টিনএজ ছেলেমেয়েদের ডিপ্রেশন বা মানসিক সমস্যার মূল কারণ পারিবারিক সমস্যা, পিতা-মাতার বিচ্ছেদ এবং ব্রেকআপ, চিট। যা চারিদিকে অহরহ দেখা যায়। আমি জানি আমাদের মধ্যে অনেকেই এসব নিয়ে সোচ্চার। এসব নিয়ে অনেক সংস্থা রয়েছে, অনেক ম্যাগাজিন রয়েছে। তবুও কি খুব একটা খারাপ বিষয় আর্টিকেলের জন্য?” বলে থামল ও। একটা লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিল।

লিম জু ততক্ষণাৎ উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,”বাহ এসব নিয়ে তো চিন্তা করার কথাও আমার মাথায় আসেনি। এখন আমার ইচ্ছে করছে এই বিষয়টা নিয়েই কাজ করতে।”

রায়েদ কাঠখোট্টা ভাবে বলল, “এত লাফালাফি করার কিছু নেই।”

এতেই লিম জুর মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। রায়েদ শান্ত কন্ঠে বললো,
“ঠিক আছে। তবে আজ আর কাজ করার সময় নেই।”

লিম জু বলল,”আগামীকালও ক্লাস রয়েছে।”

মাহীন বলল,”পরশু তো উইকেন্ড। তাহলে পরশুদিন আমরা কাজ শুরু করতে পারি।”

রায়েদ বলল,”বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত।”

মাহীন বলল,”ঠিক আছে। এবং আমি সাথে করে কয়েকটা সাইকোলজি বই নিয়ে যাব।”
রায়েদ উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে পা টিপে টিপে বাম পাশের সেলফগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,

“তোমার পায়ে কি ব্যথা?”

রায়েদ গম্ভীরস্বরে বলল, “হুম।”

মাহীন আর কিছু বলল না। মোট ছয়টা ভারি ভারি বই হাতে নিয়ে ফিরল রায়েদ। বইগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রেখে কঠোরভাবে বলল,

“এর মধ্যে থেকে যেটা নেওয়ার নাও।”

মাহীন মনে মনে ভাবলো, ‘আশ্চর্য এমন ভাবে বলছে যেন লাইব্রেরিটা ওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এখানেই সারাদিন পরে থাকে বলে নিজেকে কি ভাবে আল্লাহই জানে। যেই বই ইচ্ছা সেটাই নিব আমি। ও কে বাঁধা ধরা করে দেওয়ার?’তবে এই মুহূর্তে তার তর্ক করার সময় নেই বিধায় মুখে বললো,

“তো পরশুদিন আমরা বিকেলে কোথায় আলোচনায় বসবো?”

রায়েদ বলল, “কোথায় আবার এখানেই।”

লিম শুকনো কন্ঠে বলল, “ছুটির দিনেও এই স্কুলে আসতে হবে?”

রায়েদ শীতল কন্ঠে বলল,”ক্লাস না হলেও ক্যাম্পাস খোলাই থাকে। প্রতিদিন আসছি তো পরশুদিন আসতে সমস্যা কি?”

মাহীন উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিক আছে।”

লিম জু সায় জানিয়ে বলল,”আমারও সমস্যা নেই।”

প্রায় এক ঘন্টা পর। মাহীন ও নায়েল ল্যাটিন ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। এবং সাইলোহ এই ক্ষেত্রে স্প্যনিস ক্লাসে রয়েছে বলে ওদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে।
আরোও একটা ক্লাস বাকি। তারপর ছুটি হয়ে যাবে। লম্বা খোলা করিডোর ধরে সাইলোহ ছুঁটতে ছুঁটতে এগিয়ে আসছিল ওদের দিকে। এবং ঠিক মাঝের করিডর দিয়ে ‌র‌্যবিট খোলা করিডোরে প্রবেশ করতেই সাইলোর সঙ্গে ঢাক্কা খেল। দুজনেই কোনোক্রমে তাল সামলে নিল। আরেকটা বাদামি চুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে র‌্যবিটের পেছনে। সাইলোহ ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,

“সমস্যা কি তোমার! তোমার জন্য আরেকটু হলে আমি পরে যাচ্ছিলাম।”!

র‌্যবিট তিক্ত কন্ঠে বললো, ” আশ্চর্য ছুটতে ছুটতে আসছিলা তো তুমি। আর এখন দোষ আমার?”

নায়েল বলল, “এক মিনিট। এক্ষেত্রে দোষ কারোরই নয়। কারণ দুজনেই দুজনের আড়ালে ছিল।”

র‌্যবিটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল,”র‌্যবিট তাড়াতাড়ি চলো। ড্রাগ স্টোর পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে।” র‌্যবিট সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

সাইলোহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বলল, “এখনো একটা ক্লাস বাকি আছে। আর তুমি ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার ফন্দি করছ?”

ওরা পাঁচজন জট পাকিয়ে একসাথে করিডোরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ওদের পাশ কাটিয়ে আসা যাওয়া করছে।

র‌্যবিট বলল, “মরার শিক্ষার্থী সব! কারোও কাছে একটা ফার্স্টএইড কিট নাই। কিন্তু আমার লাগবেই লাগবে। তাই তো ক্লাস যেন ফাঁকি দিতে না হয় বলে তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছি।”

মাহীন ততক্ষণাৎ বলল, “আমার কাছে আছে ফার্স্ট এইড কিট।”

র‌্যবিট মাহীনের দিকে চাইল। বলল, “আরেহ তুমিই তো আজকে আমার ওপর অসময়ে বৃষ্টি ঝড়িয়েছ।”

নায়েল বলল,”র‌্যবিট ও অতি দরদ দেখিয়ে তোমাকে ফার্স্ট এইড কিটটা দিতে চাচ্ছে এটাই কি বেশি নয়?”

র‌্যবিট বিরশ কন্ঠে বলল,” আচ্ছা ঠিক আছে দাও।”

মাহীন নিজের ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরল। সাইলোহ টিটকারির সুরে বলল,

“বাহ আজ এই নিয়ে তৃতীয় বার মাহীনের ফার্স্ট এইড কিটটা ব্যবহার হতে যাচ্ছে। তাও আবার তিন বারই র‌্যবিটের সুবাদে।”

মাহীনের নাম ধরে বললেও কথাটা ও র‌্যবিটকে উদ্দেশ্য করে বলল। মাহীন বক্সটা বের করে র‌্যবিটের হাতে দিতেই ও সেটা নিয়ে প্রায় ছুটে চলে গেল। তার সাথে ওর বন্ধুও ছুটলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here