এল_এ_ডেইস পর্ব-৭

0
221

#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৭
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য চারিদিকে প্রবলভাবে উত্তাপ ও আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে গরমে কাহিল দশা মোটামুটি সবারই। কদাচিৎ এক দমকা হাওয়ার ঝাপটা অসংখ্য তাল গাছগুলো কে মৃদু দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছাপালা দুলে উঠছে। তবে এক দন্ড শীতলতার ছোঁয়া রপ্ত করার পূর্বেই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে বাতাস। তাই তো গরম থেকে নিস্তার নেই। অনেকে আশঙ্কা করছে, অতিরিক্ত গরমের প্রভাবে ক্যালিফোর্নিয়ার সবুজ পর্বত সমূহ ও বনাঞ্চলগুলোতে দাবানল শুরু হতে পারে। মাহীন কিছুক্ষণ পূর্বে স্কুলে পৌঁছেছে। সাইকেল পার্কিং-এ রেখে প্রথমে ব্যাগ থেকে অন্যান্য বইখাতা গুলো লকারে রেখে এসেছে।এখন সবেমাত্র সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্লান্ত ভঙ্গিতে উপরে উঠছে। দুইতলায় পৌঁছতে হবে ওকে। দুইতলায় উঠে খোলা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতেই দেখল পাশের কনক্রিটের প্রসস্থ রেলিঙের ওপর নায়েল বসে আছে সাথে আরেকটা ছেলে। ছেলেটার সোনালি ঝাঁকড়া চুল, নীল ছোট চোখ। তার শরীরে বোধহয় মেলানিয়াম একটু বেশিই কম, ফলে চোখের পাপড়ি ও ভুরুর রঙ্গ কিছুটা সোনালির পর্যায়ে। ছেলে মেয়েরা একে অপরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। নায়েল মাহীন কে দেখা মাত্র রেলিঙ থেকে লাফ দিয়ে নামল। সঙ্গের ছেলেটিকেও সাথে করে টেনে এনে মাহীনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,
“এই হচ্ছে আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু লিওনার্দো হায়েস।”

লিও স্মিত হেসে বলল,
“আর তুমি ম্যহীন ফারুকী। নতুন করে চেনার কিছুই নেই। গতকাল থেকে সাইলোহ এবং নায়েল তোমাকে নিয়ে এত ঘটনা শুনিয়েছে যেন তুমি যুগ যুগ ধরে এখানেই পড়ছ।”

মাহীন মুচকি হেসে বলল,”তিন দিনেই অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।”

লিও বলল,”মাত্র সাত দিনের নেভাডা ট্রিপে না গেলেই সব সচক্ষে দেখতে পেতাম।”

নায়েল বলল,”ধ্যৎ আমরাও কিছু দেখিনি। সব ওর মুখেই শুনেছি।”

লিও বলল,”আচ্ছা চলো ক্লাসে গিয়ে বসো। তুমি তো বোধহয় অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো।”

মাহীন ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,”তা তো হয়েছিই।”

ক্লাসে প্রবেশ করতে করতে লিও নায়েলকে উদ্দেশ্য করে বলল,”বাইশ তারিখ শওন ম্যান্ডেসের এলএ তে কনসার্ট আছে। তবে টিকেটের দাম ২১৫ ডলার। চিন্তা করতে পারো?’

নায়েল বলল,”এটাই তো আমাদের বেরোজগার ছাত্রদের সমস্যা। একটা টিকেট কিনতেই হিমশিম খাই। ভাবছি এখন থেকে কোনো পার্ট টাইম জব করব।’

মাহীন জানালার পাশের নিজের চেয়ারে বসল। বলল,”কেন তোমরা কখনো কারোও কনসার্টে যাওনি?”

নায়েল আফসোস ভরা কন্ঠে বলল,”নাহ আমার সেই ভাগ্য নেই।”

লিও বলল,”আমি একবার গিয়েছিলাম। জেনেট ধরে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল আরকি কারণ ওটা ডেমি লোভাটোর কনসার্ট ছিল।” মুখটা বেজার করে বলল ও।

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “ডেমি লোভাটোকে দেখতে পারো না মনে হচ্ছে।” লিও সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

নায়েল বলল, “তোমার প্রিয় গায়ক কে?”

মাহীন বলল,”টেইলর সুইফট।”

তখনই সাইলোহ ও জেনেট ক্লাসে প্রবেশ করল। ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সোজা মাহীনের পাশের টেবিলের

ওপর উঠে বসল। জেনেট উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো, “ওহ মাহীন তুমি সেই রকম কুল। র‌্যবিটের কাক ভেজা অবস্থাটা আমি শুধু কল্পনা করতে পারি।”

সাইলোহ বলল, “তোমাদের দেখি ইতোমধ্যেই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে।”

লিও হেসে বলল, ‘অনেকটা সেরকমই।’

জেনেট উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, “আচ্ছা কেমন হয় যদি আমরা মাহীন কে নিয়ে ভে…”

সাইলোহ মাঝখান দিয়ে বলল, “দয়া করে ভেনিস বিচের কথা বলো না।”

জেনেট বিরশ কন্ঠে বলল,”আমি তো সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম।”

লিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”ওফ জেনেট, বারবার একই জায়গায় যেতে আর ভালো লাগে না। ওখানে এতবার যাওয়া হয়েছে যে একেকটা বালুকণা কেও চিনি আমি।”

নায়েল বলল, “এখানকার বাসিন্দারা তো ভেনিস বিচের বালুতে গড়াগড়ি খেতে খেতে আর সাগরে ভাসতে ভাসতেই বড় হয়ে যায়। সেখানে আবার ঘুরতে যাওয়ার কি আছে?”

জেনেট ভারি বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, “ধ্যৎ আমি জানতাম তোমরা এমনই করবে। কিন্তু এবার কথা হচ্ছে মাহীনকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে। সুতরাং মাহীন বলবে আমরা যাবো কি যাবো না। তাই না মাহীন?”

মাহীন দ্বিধান্বিত হয়ে একে একে চারজনের দিকেই চাইল। ওরা উৎসুক দৃষ্টিতে মাহীনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহীন ইতস্তত করে বলল,

“আমাকে যেখানেই নিয়ে যাও না কেন সব জায়গায়ই আমার জন্যে নতুন।”

জেনেট সঙ্গে সঙ্গে তুরি বাজিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“এইতো আমরা তাহলে ভেনিস বিচেই যাচ্ছি।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কবে?”

“কবে আবার আজকে।”

সাইলোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেনেট কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ঠিক আছে কিন্তু মনে রেখো আমরা মাহীনের জন্য যাচ্ছি। তোমার জন্যে নয়।”

লিও বলল, “আচ্ছা চলো আজকের বিকেলেই যাই।”

মাহীন চোখ বড় বড় করে বলল, “এই এক মিনিট। আমার মায়ের অনুমতি নিতে হবে প্রথমে।”

নায়েল বলল, “কি? কিন্তু কেন? আমাদের সাথে বাইরে গেলে কোনো সমস্যা?”

মাহীন ততক্ষণাৎ বলল, “না,না বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। আসলে আমার মা আমাদের জন্য খুব বেশিই চিন্তা করেন। এমনকি সাইকেল কেনার আগ পর্যন্ত আমাদের বাসার বাইরে একা বের হতেই দেননি।”

জেনেট বলল, “সত্যিই অবাক করা বিষয়।”

সাইলোহ বলল, “মাহীন তোমার…”

মাহীন মাঝখান দিয়ে বলল, “না, না এবার আর মাকে ফোন দিও না।”

সাইলোহ হেসে বলল,”নাহ এবার আর মোবাইল নয়। এবার তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও।”

মাহীন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মার্কিনীদের সংকোচবোধটা বোধহয় একটু কমই আছে। আজকের প্ল্যান আজই করে। চেনা পরিচিত হলো কী হলো না তার ঠিক নেই কিন্তু বাড়ি গিয়ে হাজির ঠিকই হতে পারবে। মাহীন ইতস্তত করে বলল,

“টুয়েন্টি ফোর নাম্বার স্ট্রিট, হাউজ নাম্বার সেভেন, মন্টানা এভ।”

নায়েল মুচকি হেসে বলল, “বিষয়টা অদ্ভুত যে, তুমি যতসব ডেয়ারিং কাজকারবার করে বেরাও। আর বাইরে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের কথা মনে পরেই কপালে ভাজ পরে।”

মাহীন বিচলিত ভাবে বলল, “তোমরা বুঝবানা ব্যাপারটা।”

বিকেল হওয়ার সাথে সাথেই সূর্যের আলোয় নিস্তেজতা নেমে আসছে। উত্তপ্ত রোদের বদলে সুপ্ত মিষ্টি কিরণ ছড়াচ্ছে সূর্য। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। পাড়ার ছেলে মেয়েরা বাইরে বেরিয়েছে, কেউ সাইকেল নিয়ে, কেউ স্কেট বোর্ড নিয়ে আবার কেউ পায়ে হাঁটছে। পার্কগুলো ছেলেমেয়েদের কলরবমূখর হয়ে উঠেছে। মাহীন নিজের কামরায় আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। ছোট কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলোয় কোনো জট না থাকা সত্ত্বেও বারবার চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে। চুল আঁচড়ানো শেষে বাদামি কুর্তির ওপর একটা কালো রঙ্গের স্রাগ পরে নিয়ে, এক কানে একটা পাথরের টপ পরল। ওর হ্যামস্টার সোনালি খাঁচার ভেতর থেকে কুই কুই করে ডাকল। মাহীন সেদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,

“নাহ তোকে সাথে নিব না। তুই লাফ দিয়ে পানিতে পরে যাস তখন তোকে কে বাঁচাবে?’

“চি চি”

‘আরেহ পানিতে সিহর্স দেখাতো পরের কথা। আগে তোকে বাঁচার কথা ভাবতে হবে।’
তারপর কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিচে নেমে গেল। মিসেস নাসরিন বেড রুমে নিজের বিছানায় বসে বই পরছেন। নাইম ও মি.মোর্শেদ কেউই বাসায় নেই। মাহীনের বাসায় একা একা ভালো লাগছে না বলে ড্রইংরুমের স্লাইডিং ডোরটা খুলে প্যাটিওতে এসে দাঁড়াল। সামনের বাগানে একটা স্যাকামোর ট্রি রয়েছে। এখানে রয়েছে একটি ক্র্যাবএপোল গাছ। সাদা সাদা ডেইজি,বর্ণিল পেতুনিয়া, হালকা গোলাপি, বেগুনি, কমলা গোলাপ এবং জুঁই ফুলের সুবাস মিলেমিশে একাকার অবস্থা। একপাশে একটা ছোট হাইড্রেন্জিয়ার ঝাড়ও রয়েছে। এবং বাগানের ভেতরেও একটা তাল গাছ না থাকলেই নয়। বিকেলের সোনাবরণ রোদের খানিকটা ছুঁয়েছে মাহীনের চুল ও গাল।

“কিরে তুই বাগানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস যে?”

হঠাৎ মিসেস নাসরিনের কন্ঠে চমকে উঠে মাহীন। পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে মিসেস নাসরিন ড্রইংরুমে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাহীন ভেতরে এসে বলল,

“ভালো লাগছিল না তাই বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।”

তারপর একটু থেমে বলল, “আচ্ছা কেমন হয় যদি আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসি?”

মিসেস নাসরিন বললে, “এইসময় আবার বাইরে একা যাবি? তুই তো রাস্তাঘাট কিছুই চিনিস না। কোথায় যাবি?”

“যদি আমার বন্ধুদের সাথে যাই?”

মিসেস নাসরিন সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন,”ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “দুজন ছেলে, দুজন মেয়ে।”

“এত তাড়াতাড়ি তুই এদের কোথা থেকে জোগাড় করলি?”

“স্কুল থেকে। আমি জানি না কিভাবে যেন আমার বন্ধু হয়ে গেছে ওরা।”

“এখন তুই ওদের ফোন দিবি, তারপর কে কি করছে না করছে সেসব ছেড়ে তোর সাথে ঘুরতে যাবে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না।”

তখনই কলিং বেজ বেজে উঠল। মাহীন মুচকি হেসে বলল,

“ওরা এসেছে গেছে।”

বলেই দরজার দিকে ছুটে গেল। দরজা খুলতেই দেখল নাইম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহীনকে হাসি মুখে দরজা খুলতে দেখে নাইম অবাক হয়ে বলল,

“কিরে তুই দেখি আমাকে হাসি মুখে বরণ করছিস। কি কুমতলব পাক্কাচ্ছিস তুই?”

মাহীন ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, “তোর রুমে আজ না গেলেই তোর জন্য এবং আমার জন্য দুইজনের জন্যেই ভালো।”

নাইম বাসার ভেতর প্রবেশ করে বলল, “এই তুই আমার রুমের কোনো সর্বনাশ করিস নি তো!”

বলেই জুতা খুলতে ব্যস্ত হলো। এরপর হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মাহীন দরজার বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দেখল, সাইলোহ, জেনেট, নায়েল ও লিও বড় গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। ওদের দেখে ও বাইরে বেরিয়ে গেল। গেটের বাইরে একটা কালো রঙের টেসলা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ওরা সামন-সামনি আসতেই নায়েল হাসি মুখে বললো,

“বাহ তুমি দেখি তৈরি হয়ে দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে আছ।”

মাহীন বলল, “না, তা নয়। আমার ভাই মাত্র বাড়ি ফিরল তাই।”

জেনেট বলল, “তোমার এক কানের টপ বোধহয় পরে গিয়েছে।”

মাহীন বলল, “না, আমি এক কানেই টপ পরেছি। আচ্ছা চলো ভেতরে গিয়ে একবার আমার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।”

লিও বলল, “হ্যা। চলো,চলো।”

ওরা পাঁচজন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। মিসেস নাসরিন এখনো সোফায়ই বসে আছেন।

ওরা সকলে সমস্বরে বলল, “হ্যালো আন্টি।”

হঠাৎ এতগুলো ছেলেমেয়ের আগমনে একটু চমকে উঠলেন তিনি। প্রস্তরীভূত হয়ে চেয়ে রইলেন।

সাইলোহ বলল, “আমরা মাহীনকে নিতে এসেছি।”

মিসেস নাসরিন হঠাৎ ওদের কে এখানে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছেন। দ্বিধান্বিত হয়ে চেয়ে আছেন।

নায়েল বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা ওকে দেখে রাখব।”

হঠাৎ করেই মাহীনকে বিরক্তি পেয়ে বসল। কিছুটা রাগও হলো নিজের ওপর। এ পর্যায় মনে হচ্ছে যেন, ও কোনো বাচ্চা মেয়ে। এবং একদল আত্মনির্ভরশীল বড় মানুষ দায়িত্ব নিয়ে ওকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বড়ই বিরক্তিকর লাগল। তাছাড়া ওরাও কি ভাবছে তা নিয়েও ওর মনে প্রশ্ন জাগল। ছিঃ কী অস্বস্তি! কী লজ্জা!

মিসেস নাসরিন ইংলিশে বললেন, “আচ্ছা সমস্যা নেই। কিন্তু তোমরা যাচ্ছ কোথায়?”

লিও বলল, “ভেনিস বিচে। এখান থেকে বেশি দূর নয়।”

মাহীনের এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। তাড়াতাড়ি বলল,

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা গেলাম।”

বলেই পিছনে ঘুরে দাঁড়াল। এবং মিসেস নাসরিনকে বিদায় জানিয়ে বাকিরাও বাইরে বেরিয়ে আসল। মিসেস নাসরিন সেল ফোনটা হাতে নিয়ে গুগলে ভেনিস বিচ লিখে সার্চ দিলেন। এবং একটু ঘাটাঘাটির পর ভাবলেন,

“জায়গাটা তো এখান থেকে বাইশ মিনিটের দূরত্বে। এত দূরে যাচ্ছে এরা। আর সাইলোহ মেয়েটাই তো সেদিন আমাকে ফোন করেছিল। আশা করি ওর ওপর ভরসা করা যায়।’

” মাহীন কোথায় তুই!”
নাইমের কন্ঠে চমকে উঠলেন তিনি। নাইম বলল,

“এই মাহীন গেল কোথায়? আমার রুমে কি করেছে ও?”

মিসেস নাসরিন বললেন, “মাহীন বাসায় নেই। ওর বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে গেছে”

” কী আজব দুই মিনিটের মধ্যে কোথা থেকেই বা আসল ফ্রেন্ড আর কোথাই বা গেল ওরা। মশকরা হচ্ছে নাকি!”

‘কিন্তু কী হয়েছেটা কী?’

“ওফ না জানি আমার কামরার সাথে কি করেছে। রুমে ঢুকতেই ভয় করছে।”
মিসেস নাসরিন মুচকি হাসলেন।
.
.
.
স্যান্টা মনিকার রাস্তা ধরে একটা কালো টেসলা ছুটে চলেছে লস এঞ্জেলসের দিকে। খালি রাস্তাগুলোয় বাতাস কেটে যাচ্ছে শা শা করে। লম্বা তাল গাছগুলো এক পায় দাঁড়িয়ে মৃদু ভাবে মাথা দোলাচ্ছে। রাস্তায় বিকেলের সময় প্রচুর মানুষ হাঁটতে বের হয়। আবার প্রচুর দর্শনার্থীরাও এসে ভির জমায় এসব রাস্তায়। রাস্তার দুপাশে শুধু সারি সারি বিভিন্ন ব্র্যন্ডের সপ। লুই-ভিটন,ডিওর, নাইকি,ভার্সাচি, শেনেল থেকে শুরু করে কি নেই এখানে। রাস্তার দুপাশের সাইডওয়াকে সারি সারি তাল গাছ। গাড়ির ভেতর বাকিদের গল্পে তেমন একটা মন নেই মাহীনের।
গাড়ির রেডিওতে ‘দ্যা ঈগলের’ হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া গানটা চলছে। মাহীন গানের কথায় আবিষ্ট হয়ে ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাস্তায় হালকা জাম থাকার কারণে মোট পঁচিশ মিনিট পর ওরা ভেনিস বিচ পিয়ারে এসে পৌঁছল। এটা শুধু একটা বিচ নয়, এটা ভেনিস বিচ নেইবারহুড। এলাকার নামই ভেনিস বিচ। মাঝে ওরা স্টার বাকস থেকে অল্প কিছু খাবার কিনে নিয়েছিল। ওরা পাঁচজনই গাড়ি থেকে নামলো। টেসলাটা জেনেটের। সোনালি রোদের পরশে মোরা চারিদিক। তবে এ মিষ্টি রোদ গায়ে মাখলে আরাম লাগে। সামনে সাদা বালু বিছানো প্রান্তর পেরিয়ে দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের গাড়ো নীল জলরাশি চোখে পরে। ছোট ছোট ঢেউ ফেনার মতো ছুটে এসে সাদা বালুগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে ছড়িয়ে আছে এক সুমিষ্টঘ্রাণ।
বালুর মধ্যে সারি সারি অসংখ্য রঙবেরঙের ছাতা লাগান। এ এক সাদা বালুর বিস্তৃত সৈকত। পরিষ্কার পেলব সাদা মেঘে ভরতি গাড় নীল আকাশের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের পানি মিশেছে দূর দিগন্তে। মানুষের ভীরে গিজগিজ করছে জায়গাটা। বেশির ভাগ শেতাঙ্গীনিরা বিকিনি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেনেট উৎফুল্ল কন্ঠে মাহীনের এক কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

“দেখেছ কি অসম্ভব সুন্দর জায়গাটা। এখানে আসলেই মনটা ভালো হয় যায়। আর এদের এই জায়গাটা পছন্দই না।” শেষের কথাটা মুখ বাঁকা করে বলল।

সাইলোহ বলল, “কে বলেছে পছন্দ না? শুধু বারবার আসতে ভাল্লাগে না।”

ওরা চওড়া প্রসস্থ ব্রডওয়াক ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে। রাস্তার একদিকে সারি সারি রঙিন দোকান। বর্ণিল মুরাল দোকানের গায়ে গায়ে। আশেপাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি ভলিবল ক্লাব, টেনিস কোর্ট, ড্যান্সিং প্লাজা ইত্যাদি। দোকান গুলোবেশির ভাগ সার্ফিং বোর্ড, সুইমিং গগলস,টিউব ও সমুদ্রের ধারে বসে থাকার জন্য যেসব প্রয়োজন সেসবের দোকান। রয়েছে সুস্বাদু খাবারের জমজমাট রেস্টুরেন্ট। লস এঞ্জেলসের একটি বিখ্যাত আকর্ষণ হলো এই ভেনিস বিচ। রাস্তার অপর পাশের বেড়ার মত সারি সারি তাল গাছ। বেশ দূরে সৈকত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ভেনিস বিচ ফিশিং পিয়ার রয়েছে। তাল গাছের সারিগুলোর ওপাশে বিচ। রাস্তা ধরে প্রচুর মানুষ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ স্কেটিং করছে। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা ওয়ার্ক আউট স্যুট পরে হাঁটছে বা দৌড়ে যাচ্ছে। চলার পথে অনেকেই গুড আফটারনুন বলে আন্তরিক ভাবে গ্রিট করছে। এখানে সাইকেল ভাড়া নেওয়ারও অনেকগুলো দোকান দেখা গেল। একটা আইসক্রিম পার্লার থেকে আইসক্রিম কিনে নিল।

লিও বলল, “আচ্ছা ম্যাহীন তোমার কয় ভাই বোন?”

মাহীন বলল,”আমরা দুই ভাই বোন। আমার বড় ভাই আছে।”

জেনেট বলল, “তোমার ভাই তোমাকে জ্বালায় না?”

মাহীন মুচকি হেসে বলল,”অনেক। তোমরা কয় ভাই বোন?”

জেনেট বলল,”আমরাও এক ভাই এক বোন। আমার ভাইকে নিয়ে আমি খুবই বিরক্ত। সবসময় আমার মেক-আপের জিনিসপত্রগুলোর সর্বনাশ করে।”

নায়েল বলল,”আমরা তিন ভাই বোন। আমার দুজন বড় বোন আছে।”

লিও আফসোস ভরা কন্ঠে বলল,” এবং আমি একা। আমার কেউ নেই।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “আর সাইলোহ তোমার?”

সাইলোহ ম্লান কন্ঠে বললো,”আমার একজন ভাই আছে।”

জেনেট উৎফুল্ল গলায় বলল,”চলো না আমরা পানির কাছে যাই। আমি পা ভিজাবো।”

লিও উচ্চস্বরে বলল,”ওউ! ওউ একদম না।খুব ভালো করে মনে আছে গতবার তুমি আমাদের কিভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলা।”

জেনেট বলল,”ওফ ওটা কি আমার দোষ ছিলো নাকি?”

মাহীন বলল,”এক মিনিট কি হয়েছিল টা কি?”

নায়েল বলল,”আরেহ ওইবার সাইলোহ সাথে ছিল না। শুধু আমরা তিনজন এসেছিলাম। তো আমি আর লিও সার্ফ করতে নেমেছি। এখন জেনেটও জেদ ধরেছে ও সার্ফ করবে। শেষে সার্ফ করতে গিয়ে পানিতে ভেসে গিয়েছিল ও।”

মাহীন ও সাইলোহ হেসে উঠল। সাইলোহ হাসি থামিয়ে বলল,”যতবার শুনি ততবারই হাসি লাগে।”

জেনেট মুখ ফুলিয়ে বলল,”ওফ ওটা তো সার্ফ করতে গিয়েছিলাম। আর আজ তো শুধু পানিতে পা ভেজাতে চাচ্ছি। এবং ওইদিন সমুদ্রে অনেক ঢেউ ছিল।”

নায়েল বলল, “আচ্ছা চলো একবার সমুদ্রের দিক থেকে ঘুরেই আসি।”

বাকিরাও সম্মতি জানালে ওরা রাস্তা থেকে নেমে সাদা বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। বিচের তুলনায় রাস্তায়ই বেশি মানুষের ভিড়। ওরা একদম পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর পর ফেনাময় ঢেউ এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাহীন স্নিকার্স পরে এসেছিল, তাই সেটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের পানি সর্বদাই শীতল। এই গরমের মধ্যে শীতল পানির পরশে কেঁপে উঠছে মাহীন। তিরতির করে এগিয়ে আসা সাদা ফেনার ঢেউ হৃদয় ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশের ক্যানভাসে হঠাৎ বুঝি কোনো শিল্পী এক মুঠো হলুদ ও কমলা রঙের মিশ্রণ ছুঁড়ে দিয়েছে। তিরতির করে গোটা আকাশের রঙ পাল্টে যাচ্ছে। দূর দিগন্তে এখনো চকচকে থালার মতো সোনালি গোলক টা আকাশে ঝুলে রয়েছে। তার সমুদ্রের বুকে ডুবে যেতে এখনো অনেক দেরি। সাইলোহ সতর্ক কন্ঠে বলল,

“এই সাবধানে!”

দেখা গেল রাস্তা থেকে নেমে তিনজন ছেলে সাইকেল নিয়ে বালু মারিয়ে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এবং ওরা পাঁচজন দ্রুত পেছনে পানির দিকে সরে গেল। সেই ছেলেগুলো মাথায় হেলমেট পরে আছে বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকের পরনেই জ্যাকেট। তারা দ্রুত গতিতে ঠিক লিওর একদম পাশ দিয়ে চলে গেল। বাকিরা আরও পিছনে ছিল। লিও পেছনে সরতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে বালুর মধ্যে পরে গেল। এবং হালকা গুঙ্গিয়ে উঠল। জেনেট ছুটে এসে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। বাকি তিনজনও ওকে ঘিরে দাঁড়াল। নায়েল চিন্তিত স্বরে বলল,

“তোমার কি পায়ে খুব লেগেছে?”

লিও চোখ মুখ কুঁচকে বলল,”বাম পায়ের গোড়ালিতে অনেক ব্যথা হচ্ছে। বোধহয় মচকে গেছে।”

সাইলোহ বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলল,”ওফ জেনেট দেখেছ। যখনই এই বিচে এসেছি, কিছু না কিছু একটা ঝামেলা হয়ই প্রতিবার।”

জেনেট ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,”তো ওরা সাইকেল দিয়ে ওকে ঢাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে গেছে এটা আমার দোষ!”

মাহীন শান্ত কন্ঠে, “আপাতত লিও কে এখান থেকে নিয়ে চলো। ওর পায়ের এই অবস্থা নিয়ে তো এখানে বসে থাকা যাবে না।”

নায়েল বলল, “হ্যা আমি লিও কে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছি।”

জেনেট বলল,”আমিও সাহায্য করছি।”

ওদের দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেও, লিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজেই কোনো রকম হাঁটতে পারল। গাড়ির কাছে পৌঁছেই প্রথমে লিওকে ভেতরে বসিয়ে দিল। জেনেট ওর পাশের সিটেই উঠে বসল। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাকি তিনজন গাড়িতে প্রবেশ করতে যাবে তখনই দেখল সেই সাইকেলার তিনজন ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন মাথার হেলমেট টা খুলে হাতে ধরে আছে। ওরা এগিয়ে আসল ওদের ধীকে। সবার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে টিটকারির সুরে বলল,

“কি ব্যাপার সামোহিরা লাস্ট ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর তো আর ওদের এদিকে দেখাই যায় না। হঠাৎ তোমরা এদিকে কি করতে এসেছ?”

কেউ কিছু বলার আগে নায়েল কঠিন স্বরে বলল,”আমাদের বন্ধুকে আহত করার জন্য তোমাদের আমরা ছেড়ে দেব ভাবছো! কি হয় দেখোই না।”

ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনা সাকনা ছেলেটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল,

“কি করবা? তোমরা মাত্র কয়েকজন মিলে আমাদের বালটাও ফেলতে পারবা না।”

সাইলোহ কঠিন স্বরে বলল
“ভুলে যেও না তোমরা আমাদের এলাকায় দাঁড়িয়ে আছ। এখানে তোমাদের কোনোও ক্ষমতা নেই সে আমরা কয়েকজনই হই না কেন।”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তিক্ত কন্ঠে বলল,”শুধু এখানে থাকো বলেই জায়গাটাকে নিজের জায়গা বানিয়ে ফেলতে পারো না। সারা দুনিয়া থেকে মানুষ এখানে আসছে তাহলে আমাদের এখানে আসা না আসাতে তোমাদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই।”

মাহীন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নায়েল ও সাইলোহ। ছেলেগুলো কে চেনে না বলেই ও মুখ খুলছে না।

নায়েল বলল, “তো? সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আসে ঠিকই কিন্তু তারা কি এখানেই বসবাস করে? নাহ। একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো আমরা এখানে অন্য কোনো স্টেট থেকে আসিনি। আমরা এখানকার স্থানীয়।”

জেনেট জানালা খুলে বাইরে উকি দিল। মাহীন পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল বলে সেটা খেয়াল করে, অপেক্ষা করতে ইশারা করল। সাইলোহ আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“এবং এখানে মারামারি করার কথা তো ভুল করেও ভেবো না। তাহলে আর নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছনোর মত অবস্থা থাকবে না তোমাদের। একবার আশে পাশে চোখ বুলাও। আমাদের অনেক সিনিওর আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবার শুধু আমরা ইশারা দিলেই এক মুহূর্তে সকলে এখানে এসে জড়ো হবে।”

ছেলেটাও ফুঁসে ওঠে বলল,”এরপরের ম্যাচে এর শোধ তুলবো আমরা।”

বলেই ওরা সাইকেল নিয়ে উল্টো পথে এগিয়ে যেতে লাগল। মাহীন, নায়েল ও সাইলোহ গাড়িতে উঠে বসল। জেনেট বলল,
“ওহ আমি তো ভেবেছিলাম তোমাদের মধ্যে বুঝি মারামারি শুরু হয়ে যাবে।”

লিও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে।

মাহীন বলল, “এরা কারা? সমস্যা কি ওদের?”

নায়েল বলল,”ওরা প্যাসাডেনা হাই স্কুলের ছাত্র। ওদের সাথে সাধারণত বাস্কেটবল খেলার সময় দেখা হয়।”

সাইলোহ বলল, “এখানে না আসতে চাওয়ার আরেকটা কারণ, এই বদগুলো সারা সপ্তাহই এই এলাকায় ঘুর ঘুর করে। এবং আমরা বা আমাদের স্কুলের ছেলে মেয়েদেরকে বিরক্ত করে।”

টেসলা চলতে শুরু করেছে ধীর গতিতে কারণ রাস্তায় প্রচুর মানুষ। জেনেট বলল,

“মাহীন তোমার দেরি হলে যেহেতু আন্টি চিন্তা করবেন তাই আগে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, আমরা হাসপাতাল যাবো। একবার ওকে ডাক্তার না দেখালেই নয়।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here