দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ৩
তামান্না জেনিফার
ছ’ফুট লম্বা ভীষণ সুদর্শন আলিশার সেই স্বামী লোকটির মানসিক বিকারের নাম sexual sadism disorder .. যে মুহূর্তটি আনন্দের হওয়ার কথা ছিলো লোকটি তা আলিশার জন্য চরম ভীতিকর মুহূর্তে পরিনত করেছিলো ৷ আলিশা যখন আমাকে কথাগুলো বলছিলো আমি ভেতর থেকে শিউরে উঠেছি ! লোকটি রাতে ব্লেড নিয়ে শুতে আসতো ৷ শারিরীক মিলনে আলিশাকে বাধ্য করে সেই সময়ে ব্লেড দিয়ে আঁচর দিতো আলিশার গায়ে ৷ আলিশা যত যন্ত্রনায় চিৎকার করতো লোকটা তত বেশি আনন্দ পেতো , অনেকটা ব্রেন অরগাজমের মতো ব্যাপারটা ৷ প্রথমবার যখন আলিশার সাথে দেখা করলাম আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ৷ আমি একটা সুইসাইড ব্যুথ বিক্রি করবো এটা একজন শিক্ষিত বুদ্ধিমতী ডাক্তার মেয়েকে বিশ্বাস করাতে আমার বেগ পেতে হয়েছে ৷ কিন্তু বিশ্বাস না করাতে পারলে আমার সাথে ওর দেখা করাটা সম্ভব হয়ে উঠছিলো না ৷ আর যে কথাগুলো চোখে চোখ মিলিয়ে সহজে বোঝানো যায় তা কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে টাইপ করে তা বোঝানো সম্ভব না ৷ আর সুইসাইড ব্যুথের এই নাটকটা আমি কেন করি সেটাও বলি ৷ ধরেন কাউকে কিছু একটা আমি করতে বারন করবো তাতে কি হবে জানেন ? তাতে তার ঐ জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে ৷ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি দূর্বার আকর্ষন আমাদের সবারই থাকে ৷
আমার ধারনা সুইসাইড যে করতে চায় তাকে যত ভাবেই বোঝানো হোক এটা মহাপাপ , এটা ভালো না , এটা কোন সমাধান নয়…..দিন শেষে এসব কোন কথাই তাদের কানে ঢুকবে না ৷ কষ্টগুলো এতটাই লাগাম ছাড়া হয় যে এসব নীতিকথা , জ্ঞানের কথা সেই কষ্টের কাছে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয় ৷ তাই যখন এমন কাউকে আমি বলি আমি তোমাদের কাছে এমন একটা কিছু বিক্রি করবো যা তোমাদের মৃত্যু সহজ করে দেবে , ঐ হতাশায় ভোগা মানুষগুলো উৎসাহ পায় ৷ দামটাও খুব কম রাখিনি , দশ হাজার খুব ছোট এমাউন্ট নয় ৷ দশ হাজার টাকা জোগারের জন্য বেশিরভাগ মানুষকেই ভাবতে হয় ৷ অনেক বড়লোক যারা তাদের ব্যাপার আলাদা ৷ কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তখন মৃত্যুর চিন্তা একপাশে সরিয়ে টাকার চিন্তা শুরু করে ৷ টাকার জন্য চিন্তা , টাকা জোগারের উপায় মৃত্যুর চিন্তার চেয়েও কঠিন ৷ আমি এই সময়টাকেই কাজে লাগাই ৷ মরতে চাওয়া মানুষটির আদ্যপান্ত খুঁজে বের করি ৷ খুঁজে বের করি মানুষগুলোর আপন জন কারা… ভালোবাসার মানুষ কারা… কে দিতে পারবে একটুখানি মমতার পরশ ৷ একটুখানি মমতার পরশ আর মাথার উপর রাখা ভরসার হাত যে এমন কু চিন্তা মুহূর্তেই উড়িয়ে দিতে পারে , আর কিছুই ব্যথার মলম নয় , জগতের সকল ব্যথার মলম একটুখানি ভালোবাসা …
আলিশা আমার সাথে দেখা করতে এলো ৷ প্রথমেই অবাক হয়ে বললো ” আপনি একজন মেয়ে ! আমি ভেবেছিলাম পুরুষ ! ” আমি হেসেছিলাম কিছু বলিনি ৷ সবাই এমন কেন ভাবে আমি জানি না , তবে বেশিরভাগই প্রথম সাক্ষাতে আমাকে এই কথাটিই বলে ৷ কিছুক্ষন কথা বলার পর ও খানিকটা সহজ হলো ৷ ফুলস্লিভ হাতার জামা পরে এসেছিলো আলিশা ৷ আমাকে জামার হাতা তুলে দেখালো দগদগে নতুন ঘাঁ ৷ আমি ওর ফর্সা হাতে ব্লেডের ক্ষতগুলো দেখে রীতিমতো কেঁপে উঠলাম ৷ আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিলো সে সময় ৷ আমি প্রসঙ্গ বদলে ওর বাবা মায়ের কথা জানতে চাইলে আলিশা নির্বিকার গলায় বললো “তারা আমাকে ত্যাগ করেছে আঁধার , তাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই ” ৷ এই একটা ভুল সন্তানেরা সবসময় করে ৷ তারা জানে না বাবা মা এমন মানুষ , তারা সন্তানের পাহাড়সম অপরাধ এক নিমিষে ক্ষমা করে দিতে পারে …. আলিশা দশহাজার টাকা বের করে আমার কাছে সুইসাইড ব্যুথ চাইলো ৷ আমি আমার পুরোনো ট্রিকসটাই খাটালাম ৷ পুরো ব্যবসায়িকের মতো গলায় বললাম , “শিপমেন্টে আটকে আছে ব্যুথ .. আসলে এটা তো লিগ্যালি আনার উপায় নেই , *** তে তৈরি হয় ৷ ওখান থেকে অনেক ভেজাল করে আনতে হয় ৷ তবে সামনের সপ্তাহেই চলে আসবে ৷ আপনি অর্ধেক এডভান্স করে যান ৷ আমার ডিলারকে দিতে হবে তো , এই মুহূর্তে আমার হাতখালি নাহলে এডভান্স নিতাম না ৷ ”
এই এডভান্সটা আমি নেই মানুষটিকে আরো একটু দ্বিধায় ফেলতে ৷ অপরিচিত একজন মানুষকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নিশ্চয় কেউ নিশ্চিন্তে থাকবে না ৷ তার মাথায় তখন সুইসাইডের চিন্তার পাশাপাশি ঘুরবে আরেকটা চিন্তা …টাকার চিন্তা ….এতগুলো টাকা একজন অপরিচিত মানুষকে দিলো , টাকাটা মার যাবে না তো ! জিনিসটা পাবে তো !
আমি আলিশার হসপিটাল থেকে খুঁজে বের করলাম ওদের আরেকজন কাছের মানুষ ডাঃ রেনু কে ৷ ডাক্তার রেনুর সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করলাম আলিশার বাবা মায়ের ঠিকানা …
আন্টি আঙ্কেলের সামনে গিয়ে আলিশার কথা বলতেই আঙ্কেল দৃঢ় গলায় জানালো “এ বাড়িতে ঐ মেয়ের নাম নেওয়া নিষেধ …তুমি চলে যাও …” আমি আঙ্কেলের হাত ধরে ফেললাম ৷ আঙ্কেলের হাত ধরে বললাম “আঙ্কেল , আপনাদের মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে…ওর স্বামী ওকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে .. আপনাদের মেয়েটা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে ৷ সুইসাইড করবে যেকোন সময় ! ” পাশে দাঁড়িয়ে আন্টিও কাঁদছিলেন ! এবার আঙ্কেলও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন ৷ তারপর তাদের বুঝিয়ে বললাম পুরো ব্যাপারটা … তাদের রাজী করালাম আমার সাথে আলিশার সাথে দেখা করতে ..
আলিশাকে খবর দিলাম সুইসাইড ব্যুথ চলে এসেছে ৷ আলিশা চলে এলো নির্দিষ্ট সময়ে ৷ আমি আর এবার সামনে গেলাম না , আন্টি আঙ্কেলকে পাঠালাম … তাদের দেখে আলিশা প্রথমে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো ৷ তারপর আঙ্কেল যখন জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন এক নিমিষেই যেন বরফ গলে গেলো ৷ তখন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আলিশার ৷ তারপর আলিশার হাতে সেই এডভান্স নেওয়া পাঁচহাজার টাকা দিয়ে বললাম “আলিশা , জীবনটা এতটাও জঘন্য নয় ৷ নিজের জন্য বাঁচো , বাবা মায়ের জন্য বাঁচো …গ্রুপ থেকে লিভ নিও ৷ ঐ গ্রুপ আর তোমার দরকার নেই …এ ব্যাপারে কারো সাথে কোন কথা বলবে না প্লিজ …”
আমি চলে আসছিলাম , এমন সময় আলিশা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো ” আঁধার , ভালো থাকবেন…” আমার তখন মনে হলো আমার সুমা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে , আমার ভীষণ কান্না পেলো ৷ কিন্তু আমি কাঁদলাম না , কাঁদলে শোক কমে যায় ৷ আমি তো এই শোক কখনোই কমাতে চাই না ৷ এই শোক থাকুক , না হলে আমি আঁধারে থাকা সুমাদের আঁধার থেকে বের করার শক্তি কোথায় পাবো !
মারিয়া আফরোজের খোঁজ নিলাম ৷ ভদ্রমহিলার আসলেই কেউ নেই ৷ কোন আপনজন নাই ৷ কেউ নাই আলিশার বাবা মায়ের মতো তার হাত ধরার … আমি এবার চিন্তায় পড়ে গেছি ৷ কি করবো !
অনেক ভেবে দেখলাম , মারিয়া আফরোজের কেউ নাই , কিন্তু তার বাচ্চাটার তো মা আছে ! এই মাকেই এত হবে এতটা শক্তিশালী যেন সন্তানের ভার সেই নিতে পারে ৷ শুধু অন্ন বস্ত্রের জন্য যেন কারো লালসার স্বীকার হতে না হয় ঐ মাসুম বাচ্চাটার …
আচ্ছা দশ হাজার টাকায় কি বিজনেস দাঁড় করানো যায় না ? নিশ্চয় যায় ৷ এটাই বরং খুঁজি ৷ আত্মনির্ভরশীল হতে হবে মারিয়া আফরোজকে ৷ হতেই হবে , হতেই হবে !
**********
রিমশার বাবা আজ বাড়িতে আছে ৷ রিমশার আজ ভালো লাগছে ৷ একবার বাবার ঘরে ঢু দিলো রিমশা ৷ মানুষটার সাথে কথা বললে ভীষণ শান্তি পায় রিমশা ৷ যদিও কথা হয় না বেশি ৷ রিমশার বাবা খুবই সল্পভাষী মানুষ ৷ আজও রিমশা বাবার কাছে গেলো ৷
রিমশার বাবা সম্প্রতি দুটো জাহাজ কিনেছেন ৷ জাহাজদুটোতে তার ইনভেষ্ট করতে হয়ে বেশ মোটা অংকের একটা টাকা ৷ এ দুটো জাহাজের একটা এখন আটকা পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে ৷ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে ৷ রিমশার বাবার প্রেসার বেড়ে গেছে ৷ টাকার টেনশন বড় টেনশন ৷ যত কোটিপতি মানুষই হোক না কেন , টাকার শোক সামলানোর মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না ….
রিমশা এসে বসলো বাবার পাশে ৷ ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হলেন ৷ এই মুহূর্তে আটকে পরা জাহাজের চিন্তা ছাড়া তার মাথায় অন্য কোন চিন্তা নেই .. তার কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না , আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়ের সাথে বলার মতো কোন কথাই খুঁজে পান না .. মেয়েটা বড় হয়ে গেছে ৷ মেয়ের সাথে তার মানসিক দুরত্ব বেড়েছে … এখন হঠাৎ কোন কথা বলতে গেলেই কেন যেন তার মনে হয় কথাটা এলোমেলো হচ্ছে ৷ বেশ গুছিয়ে তিনি অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো কথা বলছেন ৷
রিমশার বাবা তাই খানিকটা বিরক্ত গলায় রিমশাকে বললেন “মামনি , ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড , আমি একটু একলা থাকতে চাই এখন …”
রিমশা কথা না বাড়িয়ে বাবার ঘর থেকে বের হয়ে এলো …. তারপর চলে গেলো ছাদে ৷ ছাদে গিয়ে একদম কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে রিমশার মনে হলো “আচ্ছা , এখান থেকে লাফ দিলে কেমন হবে ? বাবা জানার পর ঠিক কি কি করবে ….”
কল্পনায় রিমশা স্পষ্ট দেখছে , রাস্তায় উপুর হয়ে পরে আছে রিমশার লাশ …রক্তাক্ত…. রিমশার বাবা বিরক্ত মুখে তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে…
চলবে