দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ২

0
278

দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ২
তামান্না জেনিফার

— হ্যালো , আঁধার ! আমি সুইসাইড ব্যুথটি কিনতে আগ্রহী ৷

—আপনার নাম ?

—প্রফাইলে যেটা দেওয়া আছে , মারিয়া আফরোজ ৷

—প্রফাইলে তো সবার সঠিক নাম দেওয়া থাকে না ৷ যেমন আমার নিজেরও নেই ৷ যাই হোক , আপনি এনাউন্সমেন্ট পোস্টটি পড়েছেন মন দিয়ে ?

—জি পড়েছি ৷

—তাহলে তো আপনি সবই জানেন ৷ বলুন , কি কারনে সুইসাইড করতে চান ?

—কারনটা কি বলতেই হবে ? দেখুন আমার কাছে যেটা যৌক্তিক কারন , আপনার কাছে নাও হতে পারে ৷ আর কারন বললেই যে আমি জিনিসটা পাবো তার গ্যারান্টি কি ?

—কোন গ্যারান্টি নাই ৷ কারনটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হতে হবে ৷ দেখুন , এটা আমার বিজনেস ৷ সবার বিজনেসেরই কিছু রুলস থাকে ৷ আমার রুলস এটাই ৷ আপনি বলতে না চাইলে সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার , তবে কারন না বললে আমি আপনার সাথে লেনদেন এ যাবো না ৷

—হুম , বুঝতে পারছি ৷

—জি তাহলে কি ঠিক করলেন ? বলতে চান নাকি চান না ..

—আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর আগে ৷ আমার একটা মেয়ে আছে দশ বছর বয়সের ৷

—জি তারপর

—থাক , আর বলবো না ৷ আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি ৷

—সরির কিছু নাই আপু ৷ ঠিক আছে বলতে না চাইলে বলতে হবে না ৷

—আচ্ছা সুইসাইড ব্যুথে কি একসাথে দুজন ঢোকা যাবে ? না মানে স্পেস কতটা ?

—জি যাবে ৷

—আমার মেয়েটাকে ওর নিজের চাচা এবিউজ করছে …দিনের পর দিন … বাচ্চাটা আমার কেঁদে কেঁদে বলে “মামনি আমার ব্যথা লাগে , আমার খুব কষ্ট হয় ..”

—আপনি এই সত্য জানার পরও চুপ করে আছেন ? ব্যাপারটা বুঝলাম না !

—আমি বিধবা ৷ আমার বাবা মা নেই ৷ এক ভাই আছে , সে আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আমাদের দায়ভার সে নিতে পারবে না ৷ আমাকে এ বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে ৷ আমি কি পরিমান নিঃস্ব আপনাকে বোঝাতে পারবো না ৷ এই ব্যুথ কেনার টাকা কোথায় পাবো আমি তাও জানি না , তবে জোগার করে ফেলবো ৷ এই কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে মা মেয়ে মিলে মরে যাবো এটাই সহজ ৷ আমি একা হলে এই ঝামেলায় আসতাম না … আমার মেয়েটা অলরেডি অনেক কষ্ট পেয়েছে , মৃত্যু অন্তত সহজ হোক ওর জন্য !

—কিছু মনে না করলে আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি পড়ালেখা কতদূর করেছেন ?

—অনার্স পাশ করেছি , রেজাল্ট ভালো ছিলো না ৷ থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম ৷

—রেজাল্ট মূখ্য বিষয় না আপু ৷ আচ্ছা বাদ দেন , আপনি টাকাটা কিভাবে জোগার করবেন বলেন ৷ আমি কিন্তু দাম কমাবো না ৷ ফিক্সড প্রাইস ৷

—এখনও জানি না ৷ দেখি কিছু না হয় স্বামীর শেষ চিহ্ন একটা চেইন আছে স্বর্নের , ওটাই বিক্রি করে দিবো ৷

—ঠিক আছে ৷ আপনি টাকা জোগার করে আমাকে নক দিবেন ৷

—আমি কি তাহলে সুইসাইড ব্যুথটা পাচ্ছি ?

—এখনি বলতে পারবো না ৷ ভেরিফিকেশন করতে হবে ৷

—ঠিক আছে ৷ আমি টাকা জোগার করেই আবার নক দেবো ৷

মারিয়া আফরোজ ! আমার নতুন সুমা ৷ এটাও কি সম্ভব ! দশ বছরের বাচ্চাকে শারিরীকভাবে নোংরা করছে তার আপন চাচা ! আর কত হৃদয়ভাঙা গল্প শুনতে হবে আমাকে… আমার যে ভীষণ কষ্ট হয় , বারবার মনে হয় আমার সুমার বোধহয় এরকমই কষ্ট ছিলো যা আমার জানা হয়ে উঠেনি ৷

আমার হাতে সময় বেশি নেই ৷ আমি জানি মারিয়া আফরোজ খুব দ্রুতই টাকার ব্যবস্থা করে ফেলবে ৷ মরার জন্য টাকার জোগার করতে দেরি হবার কথা নয় ৷ অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে ৷ যদিও দশ হাজার টাকা খুব ছোট এমাউন্ট নয় , তবুও মন বলছে দুদিন লাগবে বড়জোর ! এর মধ্যেই আমাকে আমার কাজ করতে হবে ৷

**********

রিমশার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যেবেলা ৷ আকাশটাতে লালচে রঙ ধরতে শুরু করেছে ৷ ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দাড়াতেই রিমশা দেখলো মর্জিনা দাড়িয়ে আছে চায়ের ট্রে হাতে ৷ এই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনে হয় রিমশার ৷ রিমশার ঘুম ভাঙার পর কখনোই অপেক্ষা করতে হয় না ৷ মেয়েটা গরম গরম চা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ৷

চা খেতে খেতে রিমশা ফোন অন করে ৷ একগাদা নোটিফিকেশন এসেছে ৷ একটা নোটিফিকেশনে চোখ আঁটকে গেলো রিমশার ৷ আলিশা পোস্টেড ইন দি গ্রুপ “দি সুইসাইড ব্যুথ” .. এই আলিশা কে রিমশা জানে না ৷ তবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে ৷ এই মেয়েটিই তাকে ঐ গ্রুপে ইনভাইট দিয়েছিলো ৷ ওখানে বলা ছিলো যাদের দেখে মনে হয় যে সুইসাইড করতে চায় তাদেরই ইনভাইট করতে ৷ কিন্তু রিমশা অবাক হয় এই ভেবে যে তার সোশ্যাল লাইফ দেখে তো এটা বোঝার উপায় নেই সে সুইসাইড করতে চায় , এমনকি এটেম্পও নিয়েছিলো ! ফেসবুকে তো রিমশা ভয়ানক সুখী ৷ রিমশা আলিশার পোস্ট চেক করে ৷ তিন লাইনে আলিশা লিখেছে —

“আঁধার , আপনাকে চিনেছি বলেই আলোকে চিনতে পারলাম ৷ আপনাকে ধন্যবাদ বলে আসলে আমার মনের কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে পারবো না , তাই সে চেষ্টা করলাম না ৷ নিয়মানুসারে গ্রুপ থেকে চলে যাচ্ছি , ভালো থাকবেন ৷”

রিমশা এবার একটু ঝটকা খেলো ৷ আঁধার নামের ছেলে বা মেয়েটি আসলে কি করেছে আলিশার জন্য যে আলিশা এতটাই বেশি কৃতজ্ঞ ! রিমশা নিজে থেকে কখনো কাউকে নক দেয় না ইনবক্সে ৷ এতে তার সেলিব্রেটি ইমেজটা একটু কেমন কেমন দেখায় ! তবে আজ সে নিজে থেকেই নক দিলো আলিশাকে ..আলিশা যেন জানতো রিমশা নক দিবে , সাথে সাথেই রিপ্লাই পেলো রিমশা ওপার থেকে ৷

—হ্যালো , ভালো আছেন আলিশা ?

—জি আপু , ভীষণ ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ ৷

—আপনি আমাকে একটা গ্রুপে ইনভাইট করেছেন ৷ দি সুইসাইড ব্যুথ ৷

—জি , আপু আমি জানি আপনার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে ৷ আপনি বোধহয় আমার কথা ভুলে গেছেন ৷ আপনার সাথে কিন্তু আমার অনেক কথা হয়েছিলো ৷

—আসলে কিছু মনে করবেন না , আমি মনে করতে পারছি না ! আর প্রফাইলেও ছবি নেই , ছবি থাকলে হয়তো চিনতাম ৷

—কিছুদিন আগে আপনি **** খেয়েছিলেন , তখন আপনাকে যে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিলো আমি সেখানকার ডাক্তার ৷ হসপিটালে সাত দিন আমিই আপনার সেবা করেছি ৷ মনে পড়েছে ?

—আচ্ছা আচ্ছা মনে পড়েছে ৷ সরি আমি ভুলে গিয়েছিলাম ৷ আচ্ছা আমাকে বলো তো গ্রুপটার ব্যাপার কি !

—আপু গ্রুপের ব্যাপারে আলোচনা করা একদম নিষেধ ৷ বিশেষ করে যারা গ্রুপ থেকে চলে আসবে তাদের জন্য একেবারেই নিষেধ ৷

—আরে সমস্যা নাই বলো ৷ আমি কি কাউকে বলতে যাবো নাকি !

—আপু , আপনি বরং আঁধার আইডিতে ম্যাসেজ দিয়েন !

—ওসব পাগল ছাগলের সাথে কি আর কথা বলবো ! থাক বাদ দাও , এই ইস্যু নিয়ে যথেস্ট ভেবে ফেলেছি ৷ তুমি বলতে না চাইলে ইটস ওকে ৷

—আপু , আপনাকে আমার ভীষণ পছন্দ ৷ যদি কখনো আবার এমন হয় যে তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বড্ড অর্থহীন তাহলে প্লিজ আঁধারকে নক দিও ৷ এটা রিকোয়েস্ট ৷

—তুমিও সুইসাইড করতে চেয়েছিলে নাকি ?

—এসব বলা বারণ আছে আপু ৷

—ঠিক আছে ৷ ভালো থেকো আলিশা ৷ করুনাময় তার মঙ্গলময় হাত তোমার দিকে বাঁড়িয়ে দিক ..

—তুমিও ভালো থেকো আপু ..

রিমশার আবার বিরক্তি লাগা শুরু হয় ৷ অযথাই মেয়েটাকে নক দিয়েছে সে !

**********

মারিয়া আফরোজের খোঁজ খবর বের করা খুব কঠিন হলো না ৷ আমি বরং এর চেয়েও ঝামেলা করে এর আগে খোঁজ বের করেছি ৷ যেমন আমার লাস্ট কেস আলিশা , কম হয়রানি হয়নি ওর ডিটেইল বের করতে ৷ আলিশাকে যে শেষ পর্যন্ত ফিরাতে পারবো এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না ! এর চাইতে মারিয়া আফরোজের কেস সহজ হবার কথা !

আলিশার কথা মনে হলে আমার গাঁয়ে কাটা দেয় ৷ মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলো তাকে ভালোবাসি বলা মানুষটিই ৷ বাবা ছেড়ে যার ধরে ঘর ছেড়েছিলো সেই মানুষটি পেশায় একজন ডাক্তার আলিশার মতই ৷ একই হসপিটালে কর্মরত ছিলো দুজনই ৷ আলিশার সেই ডাক্তার স্বামীটি এর আগেও বিবাহীত ছিলো ৷ তালাক হয়ে গিয়েছিলো দুজনের ৷ এরপরই আলিশা আসে তার জীবনে ৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আলিশা ৷ তার ডাক্তার হবার পথটা মসৃন ছিলো না , শুধুমাত্র বাবা মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ আর নিজের অসম্ভবরকম মেধা আলিশাকে ডাক্তার আলিশা বানিয়েছিলো ৷ সেই আলিশা বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো সেই আরেক ডাক্তারের সাথে ৷ ঘর ছাড়বার আগে আলিশার মা শুধু একটা কথাই আলিশাকে বলেছিলো “যার বউ ছেড়ে গেছে , কোন না কোন কারনেই গেছে ! ভালোমতো খোঁজ না নিয়ে তুমি তার জন্য পাগল হইও না …”

আলিশার তখন পাগল হবার সময়ই ছিলো ৷ আমি আধাঁর হয়ে যখন শুনেছি আলিশার গোপনগাঁথা শিউরে উঠেছি ভিতরে ভিতরে … কী নিদারুণ ! কি ভয়ানক ! আবার নতুন করে বুঝেছি বাবা মা যা বলে ভালোর জন্যই বলে , পৃথিবীতে বাবা মার চেয়ে আপন কেউ নয় ৷

আলিশার স্বামীটি ছিলো একজন অসুস্থ মানষিকতার মানসিক রোগী ! ডাক্তারের সাদা এপ্রনের তলায় তার ছিলো একটা কুৎসিত কালো কলুষিত মন… মাথায় ছিলো বিকার ! ভয়ানক ! ভয়ানক সেই বিকার …

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here